মানুষ সামাজিক জীব। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে আমরা সমাজের উপর নির্ভরশীল। ইসলাম মানবতার ধর্ম। কল্যাণের ধর্ম। ইসলাম প্রতিনিয়তই সমাজের সৌহার্দ্য সম্প্রতি শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে বদ্ধপরিকর। আমাদের জীবনে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও সামাজিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে। ঊষর মরুভূমির রৌদ্রতাপে যেন আমাদের জীবন সর্বদা খাঁ খাঁ করে বেড়াচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা সৌহার্দ্য সম্প্রিতিপূর্ণ সমাজ গঠনে ইসলামের বিধান থেকে অনেক দূরে বাস করছি।
পিতা-মাতার ও সন্তানের পারস্পরিক হক্ব আদায়ের জোর তাগিদ-সামাজিক জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে পরিবার। আর পারিবারিক জীবনের ভিত্তিই হচ্ছ পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি।
ইসলাম সুস্পষ্টভাবে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের এবং সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব-কর্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে। সন্তান লালন-পালনে একজন মা-বাবাকে অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এজন্য পবিত্র হাদীস শরীফে মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশ্ত হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পিতা-মাতার সাথে উফ্ শব্দ উচ্চারণকে পবিত্র কুরআনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيْمًا
“আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ‘ইবাদত করবে না এবং পিতা—মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো।” ৪৪
এমনকি পিতা-মাতার বৃদ্ধ বয়সে তাদের খেদমতের মাধ্যমে যে সন্তান জান্নাত লাভ করতে পারবে না তাকে দুর্ভাগা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন : “সে ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, তারপর ধূলিমলিন হোক, তারপর ধূলিমলিন হোক”, সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে কে? রাসূল বললেন : “যে পিতা-মাতার একজন বা উভয়কে তাদের বৃদ্ধাবস্থায় পেল তারপর জান্নাতে যেতে পারল না।” ৪৫ পৃথিবীর অনেক উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বৃদ্ধাশ্রম সংস্কৃতি থাকলেও আমাদের মুসলিম সংস্কৃতিতে বৃদ্ধাশ্রমের কোনো সুযোগ নেই।
সালামের প্রচার প্রসার : সালাম আরবি শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে শান্তি, প্রশান্তি, কল্যাণ, দু‘আ, শুভকামনা। সালাম প্রদানের মাধ্যমে অপরিচিত অজানা ব্যক্তির প্রতিও মুহূর্তের ব্যবধানেই হৃদ্যতা তৈরি হয়।
সালামের মাধ্যমে প্রথম সাক্ষাতেই পারস্পরিক শান্তি, সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ভালোবাসার বীজ রোপিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম যে প্রথমে সালাম প্রদান করে।’ ৪৬
আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ : ইসলামী সমাজব্যবস্থায় আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার বিষয় জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সৌহার্দ্য সম্প্রীতিপূর্ণ একটি সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সোপান হচ্ছে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে একদিকে অফুরন্ত সাওয়াব লাভের পাশাপাশি আমাদের হায়াত ও রিজিকে বরকত হবে। অন্যদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অনেক বড় গুনাহ থেকে মুক্তি পাবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন : ‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ ৪৭
প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আমাদের সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে প্রতিবেশীরাই সবার আগে এগিয়ে আসেন। প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন ব্যতীত একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর কাছে সেই সঙ্গী উত্তম যে নিজ সঙ্গীদের কাছে উত্তম। মহান আল্লাহর কাছে সেই প্রতিবেশী উত্তম যে নিজ প্রতিবেশীদের কাছে উত্তম।’ ৪৮
ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠন : পবিত্র কুরআন প্রতিটি মুসলিমের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একজন মুসলমানের বিপদে উম্মাহের প্রতিটি মু’মিনের হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ
“নিশ্চয়ই মু’মিনগণ পরস্পর ভাই, অতএব তোমরা তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করো এবং আল্লাহকে ভয় করো; যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ লাভ করতে পার।” ৪৯
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পুরা করে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রয়োজন পুরা করেন। ৫০
গীবত, চোগলখোরি, গোপন দোষ অনুসন্ধান ও মানুষকে মন্দ নামে ডাকা নিষিদ্ধকরণ : মানুষের সামাজিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি শৃঙ্খলা যেন বিনষ্ট না হয় সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা এগুলো নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَحِيْمٌ
“তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয়ের সন্ধান করো না এবং একে অপরের পেছনে নিন্দা (গিবত) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে চাইবে?” ৫১
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ : পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে একজন অমুসলিম নাগরিকের অধিকারও রক্ষা করেছে। হাদীসে এসেছে-
‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ ৫২
প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র অমুসলিমদের পূর্ণ স্বাধীনভাবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতা দিবে। কোনো অমুসলিমকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
لَا إِكْرَاهَ فِيْ الدِّيْنِ
“দ্বীন-ধর্ম সম্পর্কে জোর জবরদস্তি নেই।” ৫৩
রাসূল (ﷺ) ছিলেন উম্মতদের জন্য সামাজিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক। সবার প্রতি বিদ্বেষমুক্ত অন্তরে দিন-রাতযাপন রাসূল (ﷺ)-এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। মক্কা বিজয়ের দিন কাফেরদের সর্দার আবূ সুফিয়ানকেও রাসূল (ﷺ) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা সামান্য মনোমালিন্যতেই মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন যোগাযোগ বন্ধ করে দেই।
পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর অনুসৃত পথে আমাদের জীবনকে পরিচালনা করতে হবে। তবেই আমাদের জীবনে সামাজিক সম্প্রীতির সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হবে।
*লেখক; ইসলামবিষয়ক গবেষক। গ্রাম : দত্তপাড়া, হাসানলেন, পোস্ট অফিস : এরশাদ নগর, টংগী, গাজীপুর।
৪৪.সূরা বানী ইসরাঈল : ২৩।
৪৫.সহীহ মুসলিম- হা. ২৫৫১।
৪৬.মিশকা-তুল মাসা-বীহ- হা. ৪৬৪৬, সহীহ।
৪৭.সহীহুল বুখারী- হা. ৬৬৮৫।
৪৮.জামে‘ আত্ তিরমিযী; আদাবুল মুফরাদ; সুনান আবূ দাঊদ।
৪৯.সূরা আল হুজুরা—ত : ১০।
৫০.সহীহুল বুখারী-হা. ২৪৪২।
৫১.সূরা আল হুজুরা-ত : ১২।
৫২.সহীহুল বুখারী-হা. ৩১৬৬।
৫৩.সূরা আল বাক্বারাহ্ : ২৫৬।
আপনার মন্তব্য