ইংরেজি নববর্ষ ও আমাদের ভাবনা
সংস্কৃতি একটি জাতির দর্পণ। সংস্কৃতির মাধ্যমে জাতির আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি ও সভ্যতার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। দেশ, জাতীয়তা ও ধর্মভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও এর মূল উৎস যে ধর্ম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীগণ নিজ নিজ ধর্মের বিধান মতেই মৌলিক সংস্কৃতি চর্চা করে থাকে। পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত সংস্কৃতি মানব মননের সুকোমল অভিব্যক্তি, যা কখনো কখনো ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে ইনসাফভিত্তিক ঐক্য ও বিবেকের জাগরণ ঘটায়। কিন্তু যে সব উৎসব ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাসের পরিপন্থী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা সময় ও অর্থের অপচয় বা বাহুল্যতা থাকে, তা একজন মুসলিমের জন্য কখনোই শোভনীয় নয়।
আমরা জানি যে, মহামানব মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্বের যুগ ছিল আইয়্যামে জাহিলিয়াহ্ বা মূর্খতার যুগ। সেই জাহিলি যুগের আরবরাও সমরবিদ্যা, অতিথি সেবা, আন্তঃদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে খ্যাতি লাভ করেছিল। শিল্প-সাহিত্যের চর্চায়ও তারা ছিল অগ্রগামী। সে সময়ের ইতিহাস বিখ্যাত ‘উকাজের মেলা’র কথা আমাদের জানা আছে। কবিতা উৎসবের সর্বশ্রেষ্ঠ সাতটি কবিতা স্থান পেয়েছিল পবিত্র কাবার দেওয়ালে, যাকে বলা হয় ‘সাবউল মুয়াল্লাকাত’। ছিল নববর্ষ পালন ও ঘৌড়দৌড় উপলক্ষ্যে প্রচলিত ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরগান’ নামের দু’টি উৎসব। কিন্তু ইসলামের সর্বশেষ বার্তাবাহক মুহাম্মদ (সা.) আরবের মরুর বুকে আবিভূর্ত হয়ে জাহিলি আরবের সেসব সংস্কৃতি ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করলেন। কেননা, তাতে ছিল না মানবতা ও নৈতিকতার ছেঁায়া; বরং ইবলিসকে খুশি করার উপকরণ-অনুষ্টুপ নাচ-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার বেসাতি।
আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে জাহেল আরব জাতিকে সতর্ক করে বলেন, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, কেননা শয়তান তো নির্লজ্জ ও মন্দ কাজেরই আদেশ করে। সাথে সাথে নবী মুহাম্মদ (সা.)-ও সতর্ক করলেন, যে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ বা সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন সে তাদেরই দলভুক্ত হবে।
ক’দিন পরে আমাদের দেশের কিছু তরুণ-যুবক এবং একশ্রেণির মাঝ বয়সী অর্বাচীন থার্টি ফাস্ট নাইট বা ইংরেজি বর্ষবরণ উৎসবে মেতে উঠবে। অথচ এদেশের সচেতন অর্ধশিক্ষিত এমন কি অশিক্ষিতরাও জানেন যে, থার্টি ফাস্ট নাইটের সাথে ইসলামী সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই, আর না আছে আমাদের দেশীয় কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির কোনো সাদৃশ্য বা সামঞ্জস্য। বাঙালি-বাংলাদেশি মুসলিম জাতিকে সতর্ক করতে এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বহু সতর্কবাণী সম্বলিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে; নতুন করে বলার কিছুই নেই। যারা সচেতন তারা উপদেশ গ্রহণ করেছে, আর যারা অন্ধ তাদের পথ দেখাবে কে?
আমরা যারা মুসলিম তারা থার্টি ফাস্ট নাইটের অপসংস্কৃতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। তবে যা কিছু ভালো তার সাথে আমরা আছি। ভালোকে ভালো বলা এবং মন্দকে মন্দ জানা ও তাত্থেকে সতর্ক থাকা আমাদের স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। ডিসেম্বর মাস শেষ হওয়া মানে একটি বছর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া এবং দরজায় নতুন বছরের কড়াঘাত। কী করেছি এ বছর (?) যা দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের ভালো ফলাফল আশা করতে পারি। আর কীভাবেইবা স্বাগত জানাবো নতুন বৎসরকে? আছে কোন সুন্দর পরকল্পনা, যা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাতে পারবো? নিশ্চয়ই এর কোন সঠিক উত্তর হয়তো অনেকের কাছে নেই। সন্তানকে নামী—দামী মাদ্্রাসাহ, স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যলয়ে ভর্তি করানোর প্রতিযোগিতা বেশিরভাগ অভিভাবকের আছে; কিন্তু নৈতিক গুণ সম্পন্ন আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছবিচারে সে চেতনা গৌন হয়ে যায়। আমাদের সন্তানদের নতুন ক্লাস, নতুন বই হতে তোলে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু কী দিচ্ছি আর কী পড়াচ্ছি, তা নিয়ে আমারে বিবেক কতখানি জাগ্রত। পড়ালেতো হবেনা, সন্তানকে মানুষ করতে হবে। প্রকৃত মানবতার জ্ঞান দিতে হবে। পিতা—মাতা ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি স্নেহশীলতার দীক্ষা দিতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে চেনা এবং আল্লাহ প্রদত্ত দীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দেওয়া। দেশ ও জাতির প্রতি স্বভাবপ্রসূত ভালোবাসায় সিক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করা-এসবের কী কোন বালাই আছে? ঐদি স্বপন সঠিক হয়, লক্ষ্য স্থির থাকে এবং যথোপযোক্ত পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়, তাহলে সন্তানদের নিয়ে আমাদের ভাবনা কাজে দেবে; নতুবা স্বপ্নঘোর বা দিবাস্বপ্নে পরিণত হবে।
অতএব আসুন, আমরা আত্মসমালোচনা করি। সৎকর্মে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। সর্বপ্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতাকে বর্জন করি। আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখি। মহান আল্লাহ আমাদের সুবুদ্ধির ঊদয় ঘটিয়ে নি এবং আমাদেরকে সুপথে পরিচালনা করুন! আমীন!!
আপনার মন্তব্য