বাঙালি মায়েরা তার শিশু সন্তানকে কবিতা আবৃত্তি করে ঘুম পাড়ায়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে আমাদের ছোটো তিন ভাই-বোনকে ঘুম পাড়াতেন আমার মেজ আপা মারিয়াম বেগম। সে সময় যে কবিতাগুলো শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম, সেগুলোর কিছু আংশিক এবং দু’একটির পুরোটাই মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল, যা আজও মনে আছে। সেগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ছিল “বিদায় হজ্জ”। শুনে মুখস্ত! তাই এটি কোন্ কবির লেখা, তা জানা ছিল না। সাহিত্যপ্রেমিক বা কবিতাপ্রেমিক অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি, সদুত্তর পাইনি। তবে সকলেই কবিতাটির দু’টি লাইন জানেন। তা হলো-
“নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশের পরিচয়,
সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়।”
উপরের চরণ দু’টি সম্ভবত হাই স্কুল লেভেলের ভাব-সম্প্রসারণ হিসেবে পড়েছিলাম। যা হোক কবিতাটি খোঁজার জন্য গুগোলক্রমেও সার্চ করেছি, পাইনি। খুঁজতে খুঁজতে যখন পেরেশান, তখন আমার পঞ্চম বোন হোসনেআরা বললো, আব্বার হাতে লেখা এ কবিতাটি আমার সংরক্ষণে আছে। আমার বাবা শেখ আব্দুল বাকী (রহিমাহুল্লাহ) সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর বেশ পারোদর্শিতা ছিল। আব্বার সংগ্রহকৃত কিছু দুর্লভ গ্রন্থ আজও আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে। ইসলামী বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। আশির দশকে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় আহলে হাদীস জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং জেনারেল শিক্ষিত হয়েও অবৈতনিক খতীবের দায়িত্ব গ্রহণ করে দীনের বিভিন্ন বিষয়ে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ’র আলোকে নাসিহা প্রদান করতেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন -আমীন। তিনি ২০০৫ সালে ১৩ এপ্রিল মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন -আল্লাহুম্মাগ ফিরলাহু ওয়ার হামহু।
যা হোক গুগোলক্রমে কবিতাটি না পেলেও কবির নাম ও সংক্ষিপ্ত জীবনী পেলাম। তাই আরাফাত পাঠকগণের খিদমতে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ দুর্লভ কবিতাটি পেশ করলাম। আমার বিশ্বাস এ কবিতাটি থেকে জাতি উপকৃত হবেন ইন্শা-আল্লাহ।
কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে এ মহান কবি সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য কিছু পেলাম না। তবে প্রতিভাবার্তা, ডিসেম্বর ১৬, ২০০৯-এ যা পেয়েছি তা-ই হুবহু পাঠকগণের খিদমতে পেশ করলাম: কবি আবুল হাশেম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এদেশের সুধী সমাজ তাকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে। কবি আবুল হাশেমের জন্ম ১৮৯৮ সালের ২০ নভেম্বর। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার খাগরবাড়ীয়া নামক নিভৃত পল্লীর এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিল এই কবি। বিত্ত-বৈভবের প্রতি নির্মোহ, প্রচার-বিমুখ এই ক্ষণজন্মা মানুষটির প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গৃহে পিতা-মাতার কাছে। স্থানীয় জমিদার কর্তৃক ১৯১২ সালে বনওয়ারীনগর সি বি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তিনি ছিলেন সেই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের একজন। ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা ও পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজ থেকে যথাক্রমে ১৯১৯ ও ১৯২১ সালে কৃতিত্বের সাথে আই.এ এবং বি.এ পাশ করেন। তিনি ছিলেন ফরিদপুর থানার প্রথম গ্রাজুয়েট। শুনা যায় তার সাফল্যের খবরে দূর-দূরান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। জ্ঞান-পিপাসু এই মানুষটি আইন পড়ার জন্য ১৯২৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং প্রথম ভাগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হন। কিন্তু অর্থের অভাবে দ্বিতীয় ভাগ সমাপ্ত করা সম্ভব হয় না। এরপর ১৯২৯ সালে ঢাকা টিটি কলেজে ভর্তি হন। চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে বিশ টাকা মাসিক বৃত্তিই ছিল তাঁর আর্থিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। ১৯৩০ সালে তিনি টি টি পাশ করেন। কি জ্ঞানার্জন কি সাহিত্য সেবা উভয় ক্ষেত্রেই তিনি অসামান্য মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। স্কুলে ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম কবিতা ‘রুদ্ধ করোনা দ্বার’ কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম পত্রিকায়’ ছাপা হয় ১৯১৬ সালে। ২০ দশকের গোড়ার দিকে সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হন। রাজশাহী কলেজ থেকে বি এ পাশ করার পর কবি অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁর সংস্পর্শে আসেন। এই সময় তাঁর প্রখ্যাত কবিতা ‘বিদায় হজ’ স্বার্থক কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীকালে তাঁর লেখা ‘বিদায় হজ’ ও ‘তারেক’ নামক কবিতা দু’টি উচ্চ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়ে কবির খ্যাতি প্রসারিত করে। কবি আবুল হাশেম-এর বিখ্যাত কবিতা “খেজুর গাছ” এর জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক অর্জন করেন। তাঁর রচিত ‘হাতিম তায়ী’ কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্র কবি ফররুখ আহমেদ রচনা করেছিলেন তাঁর অনবদ্য কাব্য নাটিকা ‘নওফেল ও হাতিম’। ১৯৩৮ সালে কোলকাতা ইতিকথা বুকডিপো থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কথিকা” কিছু দিন পরেই প্রকাশিত হয় তাঁর অনবদ্য নাটক ‘মাস্টার সাহেব’। ১৯৫৭ সালে শিক্ষা বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর আর থেমে থাকা নয়, তাঁর সুনিপুণ কলম একেরপর এক রচনা করে চলেছে অসংখ্য বিখ্যাত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রবন্ধ। যার অল্প সংখ্যকই প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশই পাণ্ডুলিপি আকারে এখনও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে, বেশ কিছু হারিয়েও গেছে।
ইসলামী ভাবের উপজীব্যকে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের সাথে তিনি রবীন্দ্র ধারার সুললিত ছন্দে সমৃদ্ধ করে তোলেন এবং তৎকালীন সুধী সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। বাংলা সাহিত্যের সুশোভিত সুবিশাল অঙ্গনে তিনি যে সকল বরেণ্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তারা হলেন মহাকবি কায়কোবাদ, কবি জসিম উদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি আবুল ফজল, কবি বন্দে আলী মিঞা প্রমুখ। তিনি ছিলেন এমনই একজন মানুষ, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা যাকে কখনই স্পর্শ করেনি। তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল “তোমার যা দেবার আছে উজাড় করে দাও, প্রতিদানে কি পেলে সে ভাবনা তোমার নয়’। ‘আর জীবনের পথ পরিক্রমায় চোখ দু’টি খোলা রেখে চলো, তোমার কখনই স্খলন ঘটবে না।”
১৯৮৫ সালের ২৪ জুন কৃতবিদ্য এই বরেণ্য পুরুষ ইহজগৎ হতে চিরবিদায় নেন। ঢাকা-বনানী গোরস্থানে তিনি চির নিদ্রায় শায়ীত।
[সূত্র: protivabarta.wordpress.com]
আপনার মন্তব্য