‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক’-এ কোন্ নিনাদ
আমি যথাযথভাবে তোমার দরবারে হাজির হে আল্লাহ! আমি হাজির, আমি হাজির! তোমার কোনো শরীক নেই। আমি হাজির, নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, সর্বপ্রকার নিয়ামত এবং রাজত্ব কেবল তোমারই। তোমার কোনো শরীক নেই। মহান আল্লাহর ঘর কা‘বা যিয়ারতকারীগণ নির্ধারিত স্থান হতে এভাবে তাওহীদের নিনাদ ঘোষণা করেন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এ স্থানগুলোকে মীকাত বলা হয়। ‘উমরাহ্ ও হজ্জকারীগণ নিজ নিজ মীকাত হতে নিয়ত করে ‘উমরাহ্ ও হজ্জে প্রবেশের ঘোষণা দেন। নির্ধারিত মীকাত হতে নিয়ত করা, মহান আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সা‘ঈ ও মাথা মুণ্ডন কিংবা চুল ছাঁটার মাধ্যমে যে ‘ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া হয়, তাকে ‘উমরাহ্ বলে। এটি বছরের যে কোনো সময় করা যায়। এর জন্য কোনো নির্ধারিত সময় নেই। তবে রমাযান মাসে ‘উমরাহ্ করলে একটি হজ্জের নেকী পাওয়া যায়। আর হজ্জের মাস ও দিন-তারিখ নির্ধারিত। রমাযানের পরেই আসে শাওয়াল মাস। আর তখন থেকেই শুরু হয় হজ্জের গণনা ক্ষণ। শাওয়াল, যুলক্বা‘দাহ ও যুলহিজ্জাহ হচ্ছে হজ্জের মাস। আর মূল আনুষ্ঠানিকতা বা হজ্জের আসল পর্ব শুরু হয় ৮ যিলহাজ্জ তারিখে এবং শেষ হয় ১৩ যিলহাজ্জ তথা আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন। ইহরাম তথা হজ্জের নিয়ত, তাওয়াফ, সা‘ঈ, মীনায় রাত্রি যাপন, আরাফায় অবস্থান, মুযদালিফায় রাত্রি যাপন, যামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ ও বিদায়ী তাওয়াফ-এর মাধ্যমে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
একজন মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। তাওহীদের বাক্য হচ্ছে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ বা মা‘বূদ নেই। আর রিসালাতের বাক্য “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” অর্থাৎ-মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। উভয়বিধ বাক্যের মর্মার্থ হচ্ছে সর্বপ্রকার ‘ইবাদত কেবল মহান আল্লাহর জন্য নিবেদন করা এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ত্বরীকায় এসব ‘ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা জিন্ ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ‘ইবাদতের জন্য। আর ‘ইবাদতের মূল হলো মহান আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদ নিশ্চিত করা। ইসলামে প্রবেশ করে যখন মানুষ সালাত, যাকাত ও সিয়াম আদায় করে, তখন সে পরতে পরতে মহান আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেয়। এভাবে যখন একজন মানুষ তাওহীদ বুঝতে সক্ষম হয় এবং মহান আল্লাহর ঘর কা‘বায় পোঁছার সামর্থ্য পায়, তখনই তার উপর ইসলামের পঞ্চম রুকন হজ্জ ফর্য হয়। আর হজ্জের প্রতিটি কাজ-কর্ম তথা আনুষ্ঠানিকতার মূল হচ্ছে মহান আল্লাহর যিক্র। সেজন্য হজ্জের মূল প্রতিপাদ্য বাক্য হচ্ছে “লাব্বায়িকা, আল্লা-হুম্মা লাব্বায়িকা, লা-শরীকা লাকা, লাব্বয়িকা, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুল্কা, লা-শরীকা লাকা।” বান্দা মহান আল্লাহর কাছে নিজের বিনয়-নম্রতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পূর্ণ বিনয়াবনত হয়ে মহান আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদের ঘোষণা দেয়।
হজ্জের মহামিলনে মিলিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে তাওহীদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুসলিম নর-নারী। তাঁরা সমাজের সচেতন ও বিত্তবান নাগরিক। প্রবেশ করে মহান আল্লাহর ঘর কা‘বায় তাওহীদের ঘোষণা দিয়ে এবং হজ্জের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন শেষে আবার বাইতুল্লাহ চূড়ান্ত অঙ্গীকার করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। এক দেশের মুসলিম অপর দেশের মুসলিম সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে। ফলে তাদের মধ্যকার তাওহীদী বন্ধন মজবুত হয়। বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে ঐক্যের মহাসম্মিলন সাধিত হয়। আর এ ঐক্য কোনো ভাষা, বর্ণ বা সংস্কৃতির নয়; বরং তা নিখাদ তাওহীদের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত ঐক্য। এ ঐক্যই মানুষকে নৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ করে। এটিই মুসলিমের প্রকৃত ঐক্য। এটাকে বলে ‘আক্বীদাহ্’ ও ‘মানহায’—এর ঐক্য। যেখানে এ মর্মে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানেই তাওহীদী চেতনার উন্মেষ ঘটবে। আর এটাই মহান আল্লাহর একান্ত চাওয়া। অপরদিকে হজ্জ শেষে স্বদেশে ফিরে সমাজ সচেতন এসব সৎ, নিষ্ঠাবান ও আল্লাহভীরু মানুষেরাই সমাজ পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা রাখলে সমাজ থেকে শির্ক ও বিদআতের মূলোৎপাটিত হবে ইন্শা-আল্লাহ। তাওদীদের ভিত্তিমূলে গড়ে উঠবে আদর্শ ইসলামী সমাজ। আর এটাই হোক হজ্জের সফলতার বিশেষ ফলক!
আপনার মন্তব্য