সাময়িক প্রসঙ্গ
পারস্পরিক সদ্ভাব স্থাপনে মর্যাদা বাড়ে
প্রফেসর এ. কে. এম শামসুল আলম

মুসলিম উম্মাহর এবারের হাজ্জ এমন এক সময় সুসম্পন্ন হলো, যখন মুসলিম বিশ্ব এবং আরব জাহানের বহু দেশেই অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এক নজরে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান সংকটের সংক্ষিপ্ত চিত্র মোটামুটি নি¤œরূপ :

১। মুসলিম উম্মাহর বহু দেশ ও অঞ্চলে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, কোথাও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ চলছে, আবার কোথাও বুদ্ধিভিত্তিক ও মিডিয়াভিত্তিক এবং রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে, যা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেরই ইন্ধন বলে বিবেচিত।

২। বর্তমান অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে ইসলামের সঠিক চিত্র বিকৃত করে প্রচারে ইসলামের দুশমনরা আদাজল খেয়ে লেগেছে।

৩। মুসলিম মিল্লাতের অধিকাংশ দেশে নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়েছে।

৪। মুসলিম মিল্লাতের প্রায় সব দেশেই সৃষ্ট সংকটের দরুণ স্বাভাবিক জীবন যাত্রার মান কমেছে এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

৫। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বা সঠিক দিকদর্শনের জন্য যোগ্য পথ প্রদর্শকের অভাব তীব্র হচ্ছে।

৬। সাহসী ও নিষ্ঠাবান ‘আলেম উলামার সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। রাজনীতির অঙ্গনে চিন্তাশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে, মিডিয়া কর্মীদের অনেকেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই মিথ্যে ও বানোয়াট খবর ছাপিয়ে নির্দোষ ব্যক্তিকেও দোষী বানিয়ে ফেলছে, বহু সম্মানী ব্যক্তির মানহানি ঘটিয়ে সমাজে বিশৃংখল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

মুসলিম উম্মাহর জন্য এই সংকট উত্তরণের পথ যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র অভিজ্ঞ বুদ্ধিজীবী, ‘আলেম, সুশীল সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরাই মিল্লাতকে সংকটমুক্ত করতে পারেন। সততা, নিষ্ঠা ও সাহসের অধিকারী নেতৃবৃন্দই জাতিকে সংকট মুক্ত করতে সক্ষম। কেননা নীতিকথায় বলা হয়Ñ কোন মানুষ লজ্জিত হয় না অথবা কোন জাতিও লজ্জায় পড়ে না যদি তাদের মধ্যে বিজ্ঞ, জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিবর্গ নেতৃত্ব দান করেন।

আজ মুসলিম বিশ্বের বহু দেশে ও অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, নৈতিক অবক্ষয় আর পাপাচারের সয়লাব দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা সভ্যতার নগ্ন থাবা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও আকাশ সংস্কৃতির উলঙ্গপনা মুসলিম তরুণদের পথভ্রষ্ট করছে, মাদকাসক্তের মরণ ছোবলের শিকার মুসলিম মিল্লাতের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী আর কিশোররা। সংকটের বেড়াজালে আবদ্ধ মুসলিম সমাজে জাহিলিয়াতের নতুন সংস্করণ বিকশিত হচ্ছে। চারিদিকে আজ তমাশাচ্ছন্ন। যে সমাজে সাহসী বুদ্ধিজীবীর সংকট, সেখানেই এসব হয়ে থাকে। তাই পথভ্রষ্ট জাতিকে অধঃপতনের গভীরে নিয়ে যায় অপশক্তিÑ তথা আবেগপ্রবণতা, স্বেচ্ছাচারিতা, চরমপন্থা আর মেধাহীন নির্বোধ লোকের নেতৃত্ব।

এই আত্মঘাতী সংকট দূর করার লক্ষ্যে মুসলিম নেতৃবৃন্দের উচিৎ তরুণ তরুণীদের নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করা। জাতিকে মেধাসম্পন্ন করতে হলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই কর্মসূচী হাতে নিতে হবে, তবেই মুসলিম মিল্লাত বর্তমান সংকট উত্তরণে সক্ষম হবে।

বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করে তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। দীনীয়াতের দু’পাতা পড়েই এক শ্রেণীর লোকের ফাতাওয়া দেয়ার ফলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়, যার ফলে মুসলিম সমাজে পারস্পরিক বৈরী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের মধ্যে সহনশীলতার অভাব তীব্র হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুপ্তহত্যা, গুমসহ অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা অহরহ ঘটছে এটা কোন একটি দেশ বা রাষ্ট্রের চিত্র নয় বরং এ অবস্থা বিরাজ করছে গোটা মুসলিম সমাজে। অবশ্য এ কাজে ইহুদী চক্র সহ ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমনরা মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তারা নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন :

﴿فَاتَّقُوْا اللهَ وَأَصْلِحُوْا ذَاتَ بِيْنِكُمْ وَأَطِيْعُوْا اللهَ وَرَسُوْلَهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِيْنَ﴾

“আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আনুগত্য করো যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।” 

তাই আমাদের উচিৎ প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার করে অশালীন উক্তি বর্জন করা, উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলার লক্ষ্যে কুরুচীপূর্ণ আচরণ বর্জন করে সবাইকে মিত্রে পরিণত করার কৌশল রপ্ত করা। মুসলিমরা কখনই বিতর্ক করবেন না, ‘এক মু’মিন অপর মু’মিনের সহোদর’ এই নীতির বাস্তবায়ন ঘটিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যেমন সদ্য সমাপ্ত এ বারের হাজ্জ শাব্দিক ও প্রয়োগিক অর্থেই আমাদের শিখিয়েছেÑ ঝগড়া-বিবাদ, বাক-বিত-া, ফিৎনা-ফাসাদ বর্জন করে নিজেদের ও পরিবার-পরিজন, দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির জন্য আমরা কেবল মহান আল্লাহর সাহায্য চাইব। একে অপরের সহায়ক হব, সহানুভূতি আর সহমর্মিতার  গুণে গুণান্বিত হয়ে নিজেকে অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত রাখার দৃঢ় সংকল্প করব।

শত্রুতা সৃষ্টির প্রয়াস সমাজে অশান্তির বীজ বপন করে। ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়, তা সবারই জানা।

হাজ্জের অনুপম শিক্ষা সমাজে বাস্তবায়ন করলে অবশ্যই সমাজের চিত্র পাল্টে যাবে। মুসলিম মিল্লাত আজ সামান্য মতপার্থক্যের দরুণ শতধা বিভক্ত। অমুসলিমরা মুসলিমদের দল উপদলে বিভক্ত হওয়াকে অদ্ভুত ও হাস্যকর মনে করে থাকে।

যে জাতির মধ্যে মৌলিক বিষয়ে কোন মতভেদ নেই, যারা এক মহান আল্লাহর ‘ইবাদতে ব্যস্ত, একই রাসূলের (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুসরণ করে, একই আসমানী কিতাবের নির্দেশ মেনে চলে, এক কিবলার অনুসরণ করে তাদের মধ্যে তফাৎ থাকার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।

মুসলমানরা আজ দুশমনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেদের দীনকে বিকৃত করে মনগড়া রসম-রেওয়াজকে দীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভেবে সর্বনাশের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। ছোট ছোট বিষয় যেমন মুবাহ, মাকরুহ ও মুস্তাহাব নিয়ে তারা আজ এমন সীমায় পৌঁছেছে যে, انما المؤمنون اخوة পবিত্র কুরআনের এই সার্বজনীন শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে পরস্পর একে অপরকে শত্রু মনে করছে। বিভক্তি-ই মুসলিম মিল্লাতের পতনের অন্যতম কারণ। তাই সব কিছু ভুলে এক মহান আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে হাতে দাঁতে কামড়ে ধরতে হবে। তবেই অশান্তির পাহাড় চুরমার হয়ে পবিত্র শান্তির ফোয়ারা বইতে শুরু করবে Ñইন্শা-আল্লাহ।

হাজ্জ পালনে আগত মুসলমানরা মহান আল্লাহর তাওহীদ, তা‘যীম এবং তামজীদে ঐকমত্য হয়েই মক্কার মিনা, মুযদালিফা ও আরাফার আকাশ বাতাস কাপিয়ে পুনঃপুনঃ ঘোষণা করেছিল :

لَبَّيْكَ اَللّٰهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيْكَ لٰكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لٰكَ وَالمُلْكَ، لَا شَرِيْكَ لٰكَ.

“হে আল্লাহ! তোমার দরবারে আমরা হাজির হয়েছি। হে আল্লাহ! আমরা হাজির, তোমার কোন শরীক নেই। সব নি‘আমত তোমার, রাজত্ব ও কর্তৃত্ব তোমারই, তাই তোমার দরবারে আমরা হাজির।”

এমনকি কোন হাজী ছিলেন যিনি এই শ্লোগান উচ্চারণ করেননি? লাব্বায়কা ধ্বনি শুনে মনে হত সমবেত কন্ঠের এই ধ্বনি প্রায় চল্লিশ লক্ষ হাজী সাহেবানের সম্মিলিত শ্লোগান। হাজ্জের মতো ‘ইবাদতে যদি আমরা এক হতে পারি, তবে বাকী ‘ইবাদতসমূহেও কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারব না? এ প্রশ্ন উত্থাপন আজ সময়ের দাবি।

মুসলিম ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার আদেশসম্বলিত দু’টি আয়াতই মক্কা মুকাররমায় অবর্তীণ হয়Ñ

﴿إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْنِ- إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتقوْنِ﴾

প্রথমটি সূরা আল মু’মিনূন-এর ৫২ এবং দ্বিতীয় আয়তটি সূরা আল আম্বিয়া’র ৯২ নম্বর। প্রথম, আয়াতের শেষে فَاعْبُدُوْنِ এবং দ্বিতীয় আয়াতটির শেষ শব্দ فَاتقوْنِ। উভয় আয়াতের অর্থ বা বক্তব্য প্রায়ই এক।

এ-ই যে তোমাদের জাতিÑ এতো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক, অতএব আমার ‘ইবাদত করো। 

এবং তোমাদের এ-ই যে জাতি এ তো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক, অতএব আমাকে ভয় করো। 

হাজী সাহেবান হাজ্জের মানাসিক আদায় করেন সম্মিলিতভাবে, পবিত্র স্থানসমূহের আদব রক্ষার্থে তারা ঐ সকল স্থানে বিনীত চিত্তে চলাফেরা করে থাকেন, আর মহান আল্লাহর কুদরতের প্রতীকসমূহ বা নিদর্শনাবলীকে সম্মান ও সমীহ করে থাকেন।

বিদায় হাজ্জে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরাফা ময়দানের ঐতিহাসিক জাবাল রহমতের উপরে দাঁড়িয়ে সমবেত হাজীদের উদ্দেশ্যে মহামূল্যবান ভাষণ দেন, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি এতে বলেছিলেন :

لَا تَرْجِعُوْا بَعْدِيْ كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ، فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِيْ شَهْرِكُمْ هَذَا، فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا.....

“সাবধান! তোমরা আমার পরে পুনরায় কাফির হয়ো না, যারা একে অপরের ঘাড়ে আক্রমণ করে, নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও সম্মান রক্ষা পবিত্র আমানত যেমন পবিত্র আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহর।”

সৌদি বাদশাহ খাদেমুল হারামাইন মুসলিম বিশ্বের হাজ্জ ডেলিগেশন ও রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন :

اننا فى أشد الحاجة الى تضامن حقيقى يحفظ وحدة الأمة ويحميها من التجزئة والانقسام ويصون الدماء التى حرمها الله.....

“আমরা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি তীব্রভাবে অনুভব করছি, যে ঐক্য উম্মাহকে দলে উপদলে বিভক্ত করণ থেকে রক্ষা করবে, রক্ত প্রবাহ চিরতরে বন্ধ করবে যা আল্লাহ তা‘আলা হারাম করেছেন, আমি মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের প্রতি আবেদন জানাই তারা যেনো নিজ নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও জাতির মধ্যে বিভক্তি রোধে মহান আল্লাহকে ভয় করেন এবং নিষ্ঠা ও ইখলাসের সাথে কাজ করেন, তাদের কাঁধে যে গুরুভার অর্পিত হয়েছে, তারা যেনো তা বুঝতে সচেষ্ট হন। আমাদের সবাইকে এ জন্য মহান আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে, আমরা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য কতটুকু আন্তরিক এ ব্যাপারে আমাদের জিজ্ঞাসিত হতে হবে। দেশের সমৃদ্ধি ও জনগণের সুখশান্তি ছাড়া কোন জাগরণ ও উন্নতিকে প্রকৃত উন্নতি বলা যায় না। আমরা তীব্রভাবে অনুভব করছি যে বিবাদমান জাতি গোষ্ঠির মধ্যে আলোচনা ও সংলাপই সংকট নিরসনের একমাত্র উপায়। এর কোন বিকল্প নেই। এই সংলাপের মাধ্যমেই অনৈক্য, অজ্ঞতা, চরমপন্থা ও নিপীড়নের অবসান সম্ভব হবে। কেননা ঐ সবই মুসলিম মিল্লাতের আশা-আকাংখা  ও স্বপ্নপূরণে বাধা।

যে জাতির বিবেক লোপ পেয়েছে, তাদের কর্মকা- মাতাল ও পাগলের কর্মকা- ছাড়া আর কি হতে পারে? তাদের ব্যর্থতা আর দুর্দশা লেগেই থাকবে। মহান আল্লাহর ঘোষণা হলোÑ

﴿مَنْ يَعْمَلْ سُوْءًا يُجْزَ بِهِ﴾

“কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে পাবে।” 

মন্দের মন্দ হলো বিবেক হারিয়ে ফেলা, আর কা-জ্ঞানহীন আচরণ করা। বিবেক হারা জাতি বিদ্যুৎ পৃষ্ট মানুষের মত অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে, পল কেনেডী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি’-তে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

বাদশাহ ‘আব্দুল্লাহ’র সময়োচিত এই আহ্বান বিবেকহীনদের জাগিয়ে তুলবে বলেই আমরা আশাবাদী।

আজ মুসলিম উম্মাহর জীবনে আমাবশ্যার ঘনকালো অন্ধকার বিরাজ করছে। তারা আজ চিন্তার ক্ষেত্রে তন্দ্রামগ্ন, বিবেকের ক্ষেত্রে শক্ত পাথর সদৃশ হয়ে পড়েছে।

২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কুয়েত শীর্ষ সম্মেলনেও সৌদি বাদশাহর আহবান ছিল মুসলিম উম্মাহর বিবেক ফিরিয়ে আনার জন্য সময়োচিত ও যুগোপযুগী। ঐ ভাষণে আরব শীর্ষ নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য করে বাদশাহ ‘আব্দুল্লাহ বলেছিলেন :

يجب ان أكون صريحا صادقا مع نفسى ومعكم فأقول : ان خلافاتنا السياسية ادت الى فرقتنا و انتقساماتنا وشتات أمرنا وما زالت هذه الخلافات عونا للعدو الإسرائيلى الغادر.....

“আমি সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই আমাকে ও আপনাদের সবাইকে সংকট নিরসনে আন্তরিক হতে হবে। তাই বলছি যে, আমাদের মাঝের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বই আমাদেরকে দলে উপদলে বিভক্ত করছে, আমাদেরকে বিভিন্ন শিবিরের শ্রেণীভুক্ত করছে, আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে আমরা বিভক্ত ও বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে থাকলে শত্রু ইসরাঈল লাভবান হবে, বিশ্বাসঘাতক ইসরাঈলের হাত শক্ত হতে থাকবে। যারা আরবদের মাঝে অনৈক্য চায় তারাও লাভবান হবে। আমাদের মাঝে বৈরী আচরণ শত্রুদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। আমাদের ঐক্য ও আত্মসম্মানের বিনিময়ে শত্রুরা এ অঞ্চলে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির বাস্তবায়ন ঘটাবে। আরব নেতৃবৃন্দ! বর্তমানে আরব জাহানে নৈরাজ্য চলছে এজন্য আমরাই শতভাগ দায়ী। আমাদের মধ্যে এমন দুর্বলতা বিরাজ করছে যা আমাদের ঐক্য ও সংহতির ভিতকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আমি কথাগুলো বললাম তবে আমরা কেউই এর ব্যতিক্রম নই।”

বাদশাহ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্দুল ‘আযীযের দু’টি ভাষণ থেকেই উদ্ধৃতি পেশ করা হলো, পূর্বের বা পরের দু’টো ভাষণই আজ মুসলিম উম্মাহর জন্য উপযোগী, কারণ মুসলিম মিল্লাতের এই দুর্দ্দিনে তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার মহাপরিকল্পনা এখন সময়ের দাবী।

পাগলের কাছে লুকমান হাকীম কিংবা সক্রেটীসের জ্ঞানের কোন কদর আশা করা যায় না। যারা দায়িত্ব জ্ঞানহীন তাদের দায়িত্ববোধ জাগানো কঠিন কাজ, অন্তরহীন নিষ্ঠুর পাষাণ বিবেকবানের কথায় সাড়া দেয় না। তাই দলে উপদলে শতধা বিভক্ত জাতির সামনে ঐক্যের আহ্বান কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, মহান আল্লাহই ভাল জানেন।

পাগল যখন প্রাসাদে আগুন লাগিয়ে মজা পায়, তখন দমকল বাহিনীর লোকেরা আগুন নিভাতে তৎপর হয়, পাগল কিন্তু দমকল বাহিনীর লোকদেরকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় না, দমকল বাহিনীর লোকেরা কৌশল খাটিয়ে আন্তরিকভাবে প্রাণপন চেষ্টা করে সার্বিক কল্যাণের পথ প্রশস্ত করেন। দমকল বাহিনীর উদাসীনতা ও অলসতা হলে একটি ঘরের আগুনে পুরো জনপদ ধ্বংস হয়ে ভস্মীভূত হতে পারে।

সমাজে নৈতিক অবক্ষয় আগুন লাগার চেয়েও মারাত্মক, তাই আমাদের সকলকে দমকল বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় নেমে এ আগুন নিভাতে তৎপর হতে হবে। সমাজ দেহের অজ্ঞতা, বোকামি, হঠকারিতা, চরমপন্থা, ফিৎনা-ফাসাদ, বিপর্যয় আর বিশৃংখলার আগুন থেকে সমাজকে হিফাযতের দায়িত্ব ‘আলেম সমাজ ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের।

আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যত গুরুত্বপূর্ণই হোক আমাদের তা বহন করতে হবে। তাই সৌদি বাদশাহ যথার্থই বলেছেন :

সৌদি আরব মুসলমানদের মাঝে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব ও মত পার্থক্য দূরীকরণে তৎপর। কেননা নিজেদের মাঝে আপোষ করা আর সদ্ভাব স্থাপনই মুসলিম উম্মাহর মুক্তির একমাত্র পথ। আমাদের সম্মান ও শুভ পরিণাম এ কাজেই নিহিত।

যে কোন মূল্যে আমাদের মাঝে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেই হবে। হারামাইন শরীফাইনে হাজ্জ ও ‘উমরার উদ্দেশ্যে আগত লোকেরা কোনরূপ বিবাদ কলহের সুযোগ পান না। যার যার মতো ‘আমল করেও তারা মুসলিম ঐক্য ও সংহতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে থাকেন।

মুসলিম মিল্লাতের মহাসম্মেলন হাজ্জে প্রায় চল্লিশ লাখ লোকের থাকা খাওয়া এবং যাতায়াতে নানা রকম অসুবিধে উপেক্ষা করে হাজী সাহেবান যে সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে থাকেন তা বর্তমান বিশ্বে নজীর বিহীন ঘটনা। সাত মহাদেশের প্রায় ১৯০টি দেশের নাগরিক যাদের ভাষা, গোত্র বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম ভ্রাতৃত্ব অর্জনে কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আরাফার পবিত্র অঙ্গনে সবার শ্লোগান ছিল এক, পোষাক পরিচ্ছদও এক, সবার মুখে দু‘আ-মুনাজাত আর গুনাহ মাফের আবেদন, বিন¤্রচিত্তে ও অনুশোচনার মাধ্যমে তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার। এ দৃশ্য তো বর্ণনার ভাষা নেই, প্রত্যক্ষদর্শী অথবা যারা বিনীত ও বিশুদ্ধ মন নিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করেন, কেবল তারাই হাজ্জের শিক্ষা থেকে দরস গ্রহণে সক্ষম, ভাগ্যবান ব্যক্তি।

হে আল্লাহ! মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে দাও। তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার হোক Ñআমীন, ইয়া রব্বাল আ‘লামীন। ###



m~iv Avj Avbdvj : 01|

m~iv Avj Avw¤^qv- : 92|


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত