সাময়িক প্রসঙ্গ
তাভীল পরিচিতি ও তাফসীরের সাথে পার্থক্য : একটি পর্যালোচনা
প্রফেসর ড. আ. ব. ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী
[শেষ পর্ব]
তাফসীর ও তাভীলের পার্থক্য(الفرق بين التفسير والتأويل) : তাফসীর হলো কুরআনের কোনো আয়াত বা শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যকে ঠিক রেখে মানুষের সাধ্যমত চেষ্টা করা।
আর তাভীল হলো শব্দের প্রকাশ্য অর্থ থেকে তার সম্ভাবনাময় অর্থের দিকে প্রত্যাবর্তন করানো। تفسير এবং تأويل (তাভীল)-এর পার্থক্যের ব্যাপারে মুফাস্সীরদের ৪টি অভিমত রয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে মতামত তুলে ধরা হলো-
১. ইমাম আবুল মানসূর মাতুরীদির মতে অকাট্যভাবে মহান আল্ল­াহর উদ্দেশ্য জানার নাম তাফসীর। আর সম্ভাব্য কোন একটি অর্থকে প্রাধান্য দেয়ার নামই তাভীল।
২. অনেকের মতে রিওয়ায়াতযুক্ত বিষয়কে তাফসীর আর দেরায়েতের دراية-এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়ই তাভীল।
৩. তাফসীর বর্ণনাভিত্তিক আর তাভীল বুদ্ধিভিত্তিক।
৪. অকাট্য বা নিশ্চিতভাবে কোনো বিষয়ের অর্থ প্রকাশ করার নাম তাফসীর। আর অনিশ্চিতভাবে কোনো বিষয়ের অর্থ প্রকাশ করার নাম তাভীল।
৫. ইমাম আবূ ‘উবায়দার মতে- তাফসীর ও তাভীল   সমার্থবোধক।
৬. তাফসীর শব্দটি ফাসরুন (فسر) সাফরুন (سفر) ও তাফসিরাহ (تفسرة) শব্দত্রয় হতে উৎপন্ন হয়। পক্ষান্তরে তাভীল শব্দটি আউল (أول) ওইয়ালাহ (إيالة) শব্দ হতে নির্গত হয়।
৭. ইমাম সুয়ূতীর মতে কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের বর্ণনা হলো তাফসীর। আর বিজ্ঞ ‘আলেমদের উদ্ভাবিত আয়াতের গোপন ও সূক্ষ্ম রহস্য হলো তাভীল।
৮. ইমাম মাতুরীদী (রাহিমাহুল্লা-হ)-এর মতে তাফসীর হলো অকাট্য। আর তাভীল হলো সম্ভাব্য বিভিন্ন অর্থ হতে একটিকে প্রাধান্য দেয়া।[১]
৯. তাফসীর হচ্ছে স্পষ্টবাক্য থেকে গৃহীত অর্থের বর্ণনা, আর তাভীল হচ্ছে ইশারা ইঙ্গিতের ভিত্তিতে গ্রহণীয় অর্থ।[২]
১০. ইমাম রাগেব এর পার্থক্য দু’ভাগে বর্ণনা করেন।
ক. শাব্দিক ব্যাখ্যাকে তাফসীর (تفسير) বলে। আর ভাব ও শাব্দিক ধরনের ব্যাখ্যাকে তাভীল (تأويل) বলে।
খ. কেবল আল্ল­াহপ্রদত্ত গ্রন্থের ব্যাখ্যাকেই বলা হয় তাফসীর। পক্ষান্তরে আল্ল­াহপ্রদত্ত ও মানব রচিত উভয়গ্রন্থের ব্যাখ্যাকে বলে তাভীল।
১১. তাফসীর (تفسير) শব্দটি (تأويل)-এর সমার্থে ব্যবহৃত শব্দ। আভিধানিকভাবে তাফসীর এর অর্থ স্পষ্টকরা, বর্ণনা করা, প্রকাশ করা, রহস্য উদঘাটন করা ও ব্যাখ্যা করা, পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা। পক্ষান্তরে তাভীল শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, পরিচালনা করা, প্রাধান্য দেয়া, সাম্ভাব্য একটি অর্থ স্থির করা, স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা, প্রত্যাবর্তন স্থল ও শেষ পরিণতি ইত্যাদি।
১২. আবূ ‘উবাইদার মতে, তাফসীর ও তাভীল সমার্থবোধক। এখানে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দু‘আ اَللهم فقهه في الدين وعلمه التأويل. “হে আল্লাহ! তুমি ইবনু ‘আব্বাসকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও তাভীল শিক্ষা দাও” উল্লেখ করা যেতে পারে। অত্র হাদীসে তাভীল দ্বারা তাফসীরকে বুঝানো হয়।[৩]
১৩. অনেকেই এ দু’টিকে সমার্থক হিসেবে দেখেছেন। কেননা ইবনু জারীর আত্ তাবারী তাঁর তাফসীরের নামকরণ করেন, জামিউল বায়ান আন্ তাবীলি আইইল কুরআন (جامع البيان عن تأويل أي القرآن)।[৪]
১৪. কেউ কেউ উভয়ের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক নির্ণয় করেন। যেমন- ইমাম আবুল মানসূর মাতুরীদির বলেন, অকাট্যভাবে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য যার মাধ্যমে জানা যায়, তা তাফসীর (تفسير)।
আর সম্ভাব্য কোন একটি অর্থকে প্রাধান্য দেয়ার নামই তাভীল।[৫] অর্থাৎ- কুরআন সম্পর্কে সাহাবীগণ থেকে যা বর্ণিত হয় তা হলো তাফসীর (تفسير) আর ফকীহগণ কর্তৃক ব্যাখ্যা ও মতামত হলো তাভীল।[৬]
১৫. আল্লামা সাবূনী বলেন, তাফসীর (تفسير) হলো আল কুরআনের আয়াতের স্পষ্ট অর্থ যা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যের সাথে স্পষ্টনির্দেশিত। আর তাভীল হলো আয়াতের নিগূঢ় ও গোপনীয় অর্থ, যা উদঘাটন করতে চিন্তা-গবেষণার প্রয়োজন হয়।[৭]
১৬. ইমাম রাগিব ইস্পাহানী দু’ভাগে এর পার্থক্য বর্ণনা করেন।
ক. শাব্দিক ব্যাখ্যাকে (تفسير) আর ভাব ও শাব্দিক ধরনের ব্যাখ্যাকে তাভীল (تأويل) বলে। শব্দের জন্য ব্যবহৃত হয় তাফসীর (تفسير) আর অর্থের জন্য হয় তাভীল (تأويل)।
খ. আল্লাহ প্রদত্ত ও মানব রচিত উভয় গ্রন্থের ব্যাখ্যাকে তাফসীর (تفسير) বলে। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) কেবল আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থের ব্যাখ্যাকেই বলা হয়। অর্থাৎ- তাফসীর (تفسير) শব্দটি তাভীল (تأويل) থেকে আম বা ব্যাপক। এটি অন্যান্য শব্দাবলী বা অর্থের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। আর তাভীল শব্দটি নিছক অর্থ, বাক্য এবং আসমানী গ্রন্থের বেলায় ব্যবহৃত হয়।[৮]
১৭. আবূ ত্বালিব আস্ সালাবী এর মতে,
التفسير بيان وضع اللفظ إما حقيقة أو مجازًا، كتفسير "الصراط" بالطريق، و"الصَيِّب" بالمطر والتأويل تفسير باطن اللفظ، مأخوذ من الأول، وهو الرجوع لعاقبة الأمر.
“কুরআনের আয়াতে বর্ণিত কোন শব্দের প্রকৃত এবং রূপক অর্থ বর্ণনা করাকে তাফসীর (تفسير) বলে। যেমন- الصراط-কে الطريق দ্বারা এবং الصَيِّب-কে المطر দ্বারা ব্যাখ্যা করা। আর কোনো শব্দের অন্তর্নিহিত ভাব বর্ণনা করাকে তাভীল (تأويل) বলে।”[৯]
১৮. আবুল ইয়াকযান ‘আত্বিয়্যাহ্ আল যাব্বুরীসহ অনেকের মতে,
التفسير ما يتعلق بالرواية، والتأويل ما يتعلق بالدراية.
“তাফসীর রিওয়ায়াত (رواية)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তাভীল (تأويل) দেরায়েত (دراية)-এর সাথে সম্পর্কীত।”[১০]
১৯. আল্লামা সুয়ূতী বলেন,
التفسير بيان لفظ لا يحتمل إلا وجها واحدا والتأويل توجيه لفظ من الأدلة متوجه إلى معان مختلفة إلى واحد منها بما ظهر.
“একটিমাত্র অর্থের সম্ভাবনা থাকলে তাকে তাফসীর আর অনেক অর্থের একটি প্রকাশ করলে তাকে তাভীল (تأويل) বলে।”[১১]
২০. ইমাম বাগভী বলেন, তারীখ, নুযূল, সুন্নাহ, আসার ও শান ইত্যাদির আলোকে কৃত কুরআনের ব্যাখ্যাকে তাফসীর আর ইজতিহাদের আলোকে সম্ভাব্য অর্থের দিকে আয়াতের ব্যাখ্যা করাকে তাভীল (تأويل) বলে। [১২]
২১. ইবনুল আন্বারীর মতে, ইজতিহাদের আলোকে কুরআনের মুতাশাবিহাত আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাভীল (تأويل) বলে।[১৩] আধুনিক ‘আলেমগণ এ বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত হননি। তাঁরা তাফসীর এবং তাবীলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেন, যা অধিক যুক্তিযুক্ত।
التفسير هو بيان المعانى التى تُستفاد من وضع العبارة، والتأويل هو بيان المعانى التى تُستفاد بطريق الإشارة. فالنسبة بينهما التباين، وهذا هو المشهور عند المتأخرين.
“কুরআনের বোধগম্য অর্থ হলো তাফসীর আর ইশারা দ্বারা বোধগম্য অর্থ হলে তাকে তাভীল বলে।”[১৪]
আভিধানিক ও পারিভাষিক পার্থক্য :
১. ক. তাফসীরের আভিধানিক অর্থ স্পষ্ট করা, পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা।
খ. তাভীল (تأويل) অর্থ প্রাধান্য দেয়া, সাম্ভাব্য একটি অর্থ স্থির করা।
২. ক. পারিভাষিক অর্থে- তাফসীর হচ্ছে কুরআনের কোনো আয়াত বা শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যকে ঠিক রেখে মানুষের সাধ্যমত চেষ্টা করা।
খ. আর তাভীল (تأويل) হলো শব্দের প্রকাশ্য অর্থ থেকে তার সম্ভাবনাময় অর্থের দিকে প্রত্যাবর্তন করানো।
সাধারণ পার্থক্য :
১. ক. ইমাম বাগভীর মতে তারীখ, নুযূল, সুন্নাহ, আসার ও শান ইত্যাদির আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করাকে তাফসীর (تفسير) বলে।
খ. ইজতিহাদের আলোকে আয়াতের সাম্ভাব্য অর্থের ব্যাখ্যা করাকে তাভীল (تأويل) বলে।
২. ক. আল্ল­ামা রাগেবের মতে তাফসীর (تفسير) শব্দটি তাভীল থেকে আম বা ব্যাপক। এটি অন্যান্য শব্দ বা অর্থের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।
খ. আর তাভীল (تأويل) শব্দটি শুধু অর্থ, বাক্য এবং ঐশ্বরিক গ্রন্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
৩. ক. আবূ তালে সালাবীর মতে শব্দের হাকীকী বা মাজাযী অর্থ বর্ণনা করাকে তাফসীর (تفسير) বলে।
খ. আর শব্দের গুঢ় রহস্য বর্ণনা করাকে তাভীল (تأويل) বলে।
৪. ক. মুতাআখখিরীনের মতে কুরআনের ইবারত দ্বারা বোধগম্য অর্থ হলো তাফসীর (تفسير)।
খ. আর ইশারার দ্বারা বোধগম্য অর্থ হলো তাভীল (تأويل)।
বিধানগত পার্থক্য : উপরোক্ত পার্থক্য ছাড়াও বিধানগত পার্থক্য হচ্ছে-
১. ক. তাফসীর (تفسير) অকাট্য। ফলে তা ‘আমল ও ‘ইল্মকে ওয়াজিব করে।
খ. তাভীল (تأويل) অকাট্য নয়। ফলে তা শুধু ‘আমলকে ওয়াজিব করে।
২. তাফসীর (تفسير) বর্ণনাভিত্তিক আর তাভীল (تأويل) বুদ্ধিভিত্তিক।
৩. তাফসীর (تفسير) শব্দের অর্থ অকাট্য আর তাভীল শব্দের অর্থ সম্ভাবনাময়।
৪. ক. তাফসীর (تفسير)-এর মধ্যে নিজস্ব সিদ্ধান্তের কোনো সুযোগ নেই।
খ. তাভীল (تأويل)-এর মধ্যে নিজস্ব সিদ্ধান্তের সুযোগ আছে।
৫. ক. তাফসীর (تفسير)-এর ক্ষেত্রে ভুল হলে গুনাহ হবে।
খ. কিন্তু তাভীল (تأويل) ক্ষেত্রে ভুল হলে গুনাহ হবে না।
৬. ক. ইমাম মাতুরিদী বলেন তাফসীর (تفسير) হলো অকাট্য যে এটাই হবে শব্দের উদ্দেশ্য।
খ. তাভীল (تأويل) অনিশ্চিত ও অকাট্যহীনভাবে বিভিন্ন সম্ভাবনা থেকে একটিকে প্রাধান্য দেয়া। সুতরাং তা শরী‘আতের গ্রহণযোগ্য অকাট্য দলীল নয়।
৭. ক. আল্ল­ামা বায়যাভী বলেন, তাফসীর রিওয়ায়াত অর্থাৎ- কুরআন ও হাদীস বর্ণনার সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং এটা সন্দেহহীন।
খ. তাভীল (تأويل) দেরায়াত বা ঘটনা, বর্ণনা ও বিশ্লেষণের সাথে সম্পৃক্ত।
৮. অকাট্য বা নিশ্চিত কোনো বিষয়ের অর্থ প্রকাশ করার নাম তাফসীর। আর অনিশ্চিতভাবে কোনো বিষয়ের অর্থ প্রকাশ করার নাম তাভীল (تأويل)।[১৫]
৯. ইমাম সুয়ূতীর মতে তাফসীর (تفسير) হলো কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের বর্ণনা। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) হলো বিজ্ঞ ‘আলেমদের উদ্ভাবিত আয়াতের গোপন ও সূক্ষ্ম রহস্য।
১০. কারও কারও মতে তাভীল বিশেষ (خاص) অর্থে এবং তাফসীর (تفسير) ব্যাপক (عام) অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই তাভীল শব্দটি আসমানী কিতাব আর তাফসীর (تفسير) আসমানী কিতাব ছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।[১৬]
১১. তাফসীর (تفسير) মুতাওয়াতির বর্ণনাকে বলে। পক্ষান্তরে তাভীল সুস্থ বিবেকের গবেষণা ও উদ্ভাবনকে বলা হয়।
১২. ইমাম মাতুরীদীর মতে তাফসীর (تفسير) হলো অকাট্য। আর তাভীল (تأويل) হলো সম্ভাব্য বিভিন্ন অর্থ হতে একটিকে প্রাধান্য দেওয়া।[১৭]
১৩. তাফসীর (تفسير) হচ্ছে স্পষ্টবাক্য থেকে গৃহীত অর্থের বর্ণনা, আর তাভীল হচ্ছে ইশারা-ইঙ্গিতের ভিত্তিতে গ্রহণীয় অর্থ।[১৮]
১৪. আল্লামা জুরজানী বলেন, তাফসীর (تفسير) হলো ডিম থেকে পাখী বের করা। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) হলো কাফির থেকে মু’মিন অথবা মূর্খ থেকে জ্ঞানী বের করা।[১৯]
১৫. আল্লামা সাবূনীর মতে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যের সাথে স্পষ্টনির্দেশিত আয়াতের অর্থ হলো তাফসীর। আর আয়াতের নিগূঢ় ও গোপনীয় অর্থ, যা উদঘাটনে চিন্তা ও গবেষণার প্রয়োজন হয় তা হলো তাভীল।[২০]
১৬. আল্লামা যুরকানী বলেন, তাফসীর (تفسير) এমন এক বিজ্ঞান যা আয়াতে বর্ণিত মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য নির্ণয়ে মানুষের সামর্থানুযায়ী কুরআনের বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে।
১৭. সালাবী বলেন, তাফসীর (تفسير) শব্দের গঠন বর্ণনা করে। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) শব্দের গুঢ় অর্থ বর্ণনা করে।[২১]
১৮. তাফসীর (تفسير) কুরআনের একক শব্দের অর্থের জন্য প্রযোজ্য হয়। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) পূরো বাক্যের অর্থ প্রকাশ করে।
১৯. তাফসীর (تفسير) হলো আয়াতের অর্থের বর্ণনা। কারণ শব্দ তার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) হলো প্রকৃত অর্থের বর্ণনা।
২০. তাফসীর (تفسير) কুরআন এবং কুরআনের বিভিন্ন বিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে তাভীল (تأويل) কুরআনসহ আরবী পরিভাষার যাবতীয় বিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
২১. ইবনু হাবীব নিসাপুরীর মতে তাফসীর (تفسير) ও তাবীলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় একটি দুরূহ কাজ। তিনি বলেন,
نبغ في زماننا مفسرون لو سئلوا عن الفرق بين التفسير والتأويل ما اهتدوا إليه.
“আমাদের যুগে এমন কিছু মুফাস্সিরের উদ্ভব হয়, যাঁদেরকে তাফসীর ও তাবীলের পার্থক্য জিজ্ঞেস করলে তাঁরা তা বলতে পারবেন না।”[২২]
২২. প্রফেসর আমীন খাওলী বলেন, আমার মতে তাফসীর (تفسير) ও তাভীল (تأويل)-এর মত পার্থক্যের ৩টি কারণ রয়েছে।
প্রথমতঃ আলকুরআনে তাভীল শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়।
দ্বিতীয়তঃ উসূলবিদগণ এটিকে বিশেষ পরিভাষার রূপ দিয়েছেন।
তৃতীয়তঃ বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধের লেখক এবং বিভিন্ন মতের অনুসারী মুতাকাল্লিমদের মুখে মুখে এটি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ব্যাখ্যাই তাফসীর। তাফসীর (تفسير) ও তাভীল (تأويل) শব্দ দু’টো আল কুরআন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও তাফসীর (تفسير) অভিজ্ঞানটি সাধারণত আল কুরআনের ব্যাখ্যার জন্য প্রযোজ্য হয়ে থাকে। আর তাভীল (تأويل) শব্দটি আল কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। [সমাপ্ত]

[১] মুহাম্মদ আব্দুল আযীম আয্ যারকানী, মানাহিলুল ইরফান ফী উলূমিল কুরআন, বৈরুত : দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৮৮), প্রাগুক্ত।
[২] আল জুরজানী, পৃঃ ৭২।
[৩] মান্না আল কাত্তান, মাবাহিস ফী  উলূমিল কুরআন (কায়রো : মাকতাবা ওয়াহাবা, তাবি), পৃঃ ৩১৯।
[৪] মানাহিলুল ইরফান, ২ খণ্ড, পৃঃ ৫।
[৫] শামসুল হক দৌলতপুরী, তাফসীর শাস্ত্র পরিচিতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭, তৃতীয় সংস্করণ : মার্চ ২০০৪, পৃঃ ১০।
[৬] আবূ মানসূর মুহাম্মদ ইব্ন মুহাম্মদ আল মাতুরীদী, তাবীলাতু আহলিস সুন্নাহ, সম্পাদনা : ড মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান (ইরাক : ওযারাতুল আওকাফ ওযাশ শুউনি দীনিয়্যাহ, ১৪০৪ হি), পৃঃ ৫; ড. এ. কে. এম. আইয়ূব আলী, ‘আক্বিদাতুল ইসলাম ওয়াল ইমাম মাতুরীদী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৩ খ্রি), পৃঃ ২৬৫।
[৭] আত্ তিবইয়ান ফী উলূমিল কুরআন, পৃঃ ৬০।
[৮] রাগিব ইস্পাহানী, আল মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন (করাচী : নূর মুহাম্মদ কুতুবখানা, তাবি), পৃঃ ৩১; আত্ তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ খণ্ড, পৃঃ ২২।
[৯] আত্ তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ খণ্ড, পৃঃ ২০।
[১০] আত্ তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ খণ্ড, পৃঃ ১৮; আবুল ইয়াকযান ‘আত্বিয়্যাহ্ আল-জাব্বুরী দিরাসাতুন ফীত তাফসীর ওয়া রিজালিহী (বৈরুত : দারুন নাদওয়াহ আল জাদীদাহ, ১৯৮৬ খ্রি) পৃঃ ২১; মান্না আল কাত্তান, পৃঃ ৩৩৮।
[১১] জালালুদ্দীন আস্ সুয়ূতী, আল-ইতকান, ১ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২১; তাফসীরে জালালাইন, জালালুদ্দীন আস্ সুয়ূতী, তাফসীরে জালালাইন, ইসলামিয়া সম্পাদনা পর্ষদ কর্তৃক সম্পাদিত, প্রকাশনায় : ইসলামিয়া কুতুবখানা, ৩০/৩২, বাংলা বাজার, ঢাকা, পৃঃ ৩৩।
[১২] আত্ তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ খণ্ড, পৃঃ ২০; আবূ আবদিল্লাহ বদরুদ্দীন ইবনু বাহাদুর আল যারকাশী, আল বুরহান ফী উলূমিল কুরআন (কায়রা : মাকতাবাতুল খানিজী, তাবি), ২ খণ্ড, পৃঃ ১৬৬।
[১৩] লিসানুল আরব, ৫ম খণ্ড, ৫৫-৫৬।
[১৪] আত্ তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ খণ্ড, পৃঃ ২০; মাবাহিস ফী উলূমিল কুরআন, পৃঃ ৩২৭।
[১৫] তাফসীর শাস্ত্র পরিচিতি, পৃঃ ১০-১১।
[১৬] ড. আহমদ শারবাসী, কিস্সাতুত তাফসীর (বৈরূত : দারুল জায়ল, তাবি), পৃঃ ১০; মানাহিলুল ইরফান, খণ্ড ২, পৃঃ ১৪।
[১৭] মানাহিলুল ইরফান, ২ খণ্ড, পৃঃ ৪।
[১৮] আল জুরজানী, পৃঃ ৭২।
[১৯] রাগিব আল ইস্পাহানী, তানযীহুল কুরআন আনিল মাতাইন, মুকাদ্দামা, পৃঃ ৪০২।
[২০] আত্ তিবইয়ান ফী উলূমিল কুরআন, পৃঃ ৬০।
[২১] প্রাগুক্ত, ২ খণ্ড, পৃঃ ২২২।
[২২] আল বুরহান ফী ঊলূমিল কুরআন, সং ১, ২ খণ্ড, পৃঃ ১৫২; আল ইতকান, ৬ খণ্ড, পৃঃ ২২৬১।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত