ভূমিকা : আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
﴿وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِيْ الْأَرْضِ وَلَا طَائِرٍ يَطِيْرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِيْ الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُوْنَ﴾
অর্থ : “পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণী নেই, এমন কোনো উড়ন্ত জীব নেই যারা তোমাদের মতো গোত্র (Community) রচনা করেনি। আমরা এ গ্রন্থে কোন কিছু অবহেলা করিনি অবশেষে তারা সকলেই একত্রিত হবে তাদের প্রভূর সমীপে।[১]
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অত্র আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, প্রাণী জগতের প্রত্যেক গোত্র গঠিত হয় তাদের নিজস্ব প্রজাতীর আলোকে। এ প্রজাতিভুক্ত প্রাণীরা পৃথিবীর বুকে কেউ হামগুড়ি দিয়ে চলে, কেউ পায়ে হেটে ভ্রমন করে, কেউবা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। পৃথিবীতে প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতি নিবিড়। বিজ্ঞান আবিষ্কারের পূর্বে এ সম্পর্ক তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না; বরং বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির দরুন মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে। আল কুরআনে মানুষ ব্যতীত অন্যান্য যেসব কীটপতঙ্গ ও জীব-জন্তুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তা খুবই প্রনিধানযোগ্য।
যেমন- মৌমাছির চাল-চলন, মাকড়সার জাল বুনন, মরুভূমির উট, ভারবাহী পশু, শূকর, মৃত পশু পাখি এসবের উপস্থাপনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।[২]
আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনে ৩০টি প্রাণীর উল্লেখ করেছেন। সকল জীবন্তু ও প্রাণীকুলকে অর্থ করতে انعام، دابة، بهيمة، (আন‘আম, দাব্বাত, বাহিমাত) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় বিশেষ প্রাণীর নাম উল্লেখপূর্বক নির্দেশিত হয়েছে। আল কুরআনে বর্ণিত প্রাণীদের বর্ণনা, হিকমত, উপকারিতা অপকারিতা এবং এদের প্রাপ্তিস্থান বৈজ্ঞানিক পরিচিতিসহ বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ প্রবন্ধে কুরআনে বর্ণিত সৃষ্টিসেরা প্রাণী মানুষের পরিচিতি, অবস্থা, প্রকৃতি আলোচনা করা হলো।
মানুষ : মানুষ শব্দের আরবি প্রতি শব্দ কুরআনেإِنْسَانُ انسان - بشر- ناسশব্দটি পবিত্র কুরআনে নিম্নোক্ত ৩৯টি সূরায় ৫৮টি আয়াতে মোট ৫৮ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
انسان শব্দটি ال ছাড়া ১ বার (সূরা ইসরা- ১৩)।
الإنسان তথা ال -সহ ৫৬ বার।
الناس তথাال -সহ ১৭২ বার।
আর তন্মধ্যে ৩৩টি মাক্কী সূরা আর বাকী ৬টি যথা সূরা আন্ নিসা, আল হাজ্জ, আল আহ্যা-ব, আর্ রহমান, আল ইনসান, আয্ যিলযাল মাদানী। انسان শব্দটি পবিত্র কুরআনের ৫৬টি সূরায় ৫৮ বার পুণঃআবৃতি করা হয়েছে। সূরাগুলো হলো নিম্নরূপ সূরা বাণী ইসরা-ঈলে ৫ বার, আল ক্বিয়া-মায় ৬ বার, আল ‘আলাকে ৩ বার আর সূরা মারইয়াম, আয্ যুমার, ফুস্সিলাত, আশ্ শূরা-, র্আ রহমান, আল ইনসান, আল আবাসা ও আল ফজরে ২ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
ذكر الإنسان في القران الكريم (৬৩) مرة.
ذكر بني أدم في القران الكريم (৬) مرات.
ذكرت كلمة الناس في القران الكريم (২৪০) مرة.
ذكر جبريل في القران الكريم (৩) مرات.
ذكر الحجاب في القران الكريم (৭) مرات.
মহান আল্লাহর সকল সৃষ্টির সেরা প্রাণী হলো মানুষ। আল্লাহ তা‘আলার বাণী-
﴿لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِيْ أَحْسَنِ تَقْوِيْمٍ﴾
অর্থ : “আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।”[৩]
এ মহাগ্রন্থ নাযিলের একমাত্র উদ্দেশ্য মানবজাতির হিদায়াত। মানবাজাতির এ হিদায়াতের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার উপর কোথাও সংক্ষিপ্ত আবার কোথাও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
হিদায়াতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে স্রষ্টার সন্ধান লাভ।[৪] আর স্রষ্টার জ্ঞান যেহেতু অসীম, সসীম জ্ঞান দিয়ে কোনো সৃষ্টির পক্ষেই স্রষ্টাকে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। সুতরাং সৃষ্টি তার স্রষ্টা সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করে মাত্র। বিচিত্র এ জগত, তার চেয়েও বিচিত্র এ জগতের মানুষ ও প্রাণীকূল। মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি মানুষ। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম এবং গোত্রের মানুষ ও প্রাণী দ্বারা এ জগত পরিপূর্ণ। মানুষ প্রধানত প্রাণী। প্রাণী হিসেবে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। প্রাণীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাণত্ত্ব বা প্রাণ বৃত্তি। মানুষেরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাণবৃত্তি।
তবে মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত এক স্বতন্ত্র গুণ রয়েছে যা তাকে অন্যান্য জীব ও প্রাণীকুল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে। এই অতিরিক্ত স্বতন্ত্র গুণ হচ্ছে তার ‘বুদ্ধি’। এ বুদ্ধির কারণেই মানুষ শুধু প্রাণী নয়, সে মানুষ এবং মানুষ নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। এখানেই অন্যান্য প্রাণী থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। আর এ শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই পৃথিবীর তাবৎ সৃষ্টি তার কর্তৃত্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণে। বস্তুতঃ মানুষ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি। আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ‘ইবাদত করার জন্য, আর মানুষের প্রয়োজনে, কল্যাণে ও উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন বিভিন্ন প্রকার প্রাণী।
মানুষের সাধারণ পরিচিতি : মানুষের আরবী শব্দ ‘আল ইনসান’। বৈজ্ঞানিক নাম : Homo Sapiens।
মানুষের গঠন : দেহ এবং আত্মা, এই দুইয়ের সমন্ময়ে মানুষ গঠিত।
মানুষের প্রধান অন্ত্রসমূহ- ১. ত্বক তন্ত্র, ২. কংকালতন্ত্র ৩. পেশীতন্ত্র, ৪. পরিপাকতন্ত্র, ৫. সংবহনতন্ত্র, ৬. শ্বসনতন্ত্র, ৭. রেচনতন্ত্র, ৮. স্নায়ুতন্ত্র, ৯. অন্তঃরেখা গ্রন্থিতন্ত্র, ১০. প্রজননতন্ত্র।
মানুষের আদি উৎস (The origin of man) : পৃথিবীতে মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। এগুলোর মধ্যে অগ্রহণযোগ্য ও ভুল মতবাদ হচ্ছে চার্লস ডারউইন এর ‘মানব বিবর্তনবাদ’ তত্ত্বটি।
এতে ডারউইন বলেছে, প্রতিটি জীব বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বলে বর্তমান আধুনিক মানব প্রজাতি বিবর্তনের আওতাভূক্ত এবং আদি Primate (chordata) (Legs)-এর একটি শাখার উন্নত সংস্করণই বর্তমান সুন্দর মানব।
বহু কোষী কার্ডাটা (chordata) পর্বের মেরুদণ্ডী ও স্তন্যপায়ী চার পা বিশিষ্ট বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ প্রাইমেটের অন্তর্ভূক্ত। আদি প্রাইমেট এর বিবর্তনের বিভিন্ন শাখায় কেউ হয়েছে বানর, কেউ হয়েছে গরিলা, কেউ শিম্পাঞ্জি এবং সর্বাধিক বিবর্তনের সহায়ক প্রজাতির একটি শাখা মানুষে পরিণত হয়েছে।[৫]
উনবিংশ শতাব্দির বিজ্ঞানীরা ডারউইনের উক্ত মতবাদটি সঠিক নয় বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেবল কিছু সংখ্যক নাস্তিক বুদ্ধিজীবী এখনও এ তত্ত্বকে সঠিক বলে থাকে। বাস্তববাদী বিজ্ঞানীরা ডারউইনের উক্ত মতবাদটি অবাস্তব বলে যুক্তি দিয়েছেন যে, ‘যদি বানর কিংবা শিম্পাঞ্জির বিবর্তনের ফলে মানুষ সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে মানুষের বিচার ক্ষমতা, প্রজ্ঞা, বিবেক, বুদ্ধিমত্তা, আত্মশক্তি, উদ্ভানীশক্তি, চিন্তাশক্তি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যও কি বিবর্তনের ফল? যা বানর কিংবা শিম্পাঞ্জির মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। প্রাণী জগতের মধ্যে একমাত্র মানুষই কথা বলতে পারে।
স্বর যন্ত্রের সাহায্যে শব্দ তৈরী করে কথা বলার জন্য মানুষের মস্তিস্কে একটা অঞ্চল রয়েছে যার নাম ‘ব্রোকার জোন’। বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি কিংবা অন্য যে কোনো প্রাণীর মস্তিস্কে ‘ব্রোকার জোনের’ সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই অন্যান্য প্রাণীরা কথা বলতে পারে না। এসব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও ৬টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মানুষের আছে যা বানর, কিংবা শিম্পাঞ্জির মধ্যে নেই।[৬] যেমন-
১. চলন : শুধু মানুষই দু’পায়ে হাটতে সক্ষম।
২. মুষ্ঠিবদ্ধতা : মুষ্টিবদ্ধ করার ক্ষমতা কেবল মানুষের রয়েছে। লিখা, ইচ্ছামত নাড়াচারা করা, অস্ত্র চালানোর কাজ ও অন্যান্য কাজ করতে পারে মানুুষ।
৩. মস্তিষ্কের বিকাশ : মানুষের মস্তিষ্ক এতো বেশী উন্নত যার ফলে পৃথিবী ভ্রমন, মহাকাশে অভিযান চালাতে পারে।
৪. শৈশব ও প্রাক বয়ঃসন্ধিকাল : মানুষের শৈশব ও প্রাক বয়ঃসন্ধিকাল দীর্ঘ হওয়ায় মা ও শিশুর সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়েছে এবং মায়ের কাছ থেকে শিশু শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছে।
৫. সামাজিক জীবন : উন্নত সামাজিক জীবন মানুষের অন্যতম সাফল্য এবং পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তারের অন্যতম মূল শক্তি।
৬. নৈতিক বিকাশ : নীতিগতভাবে মানুষ সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভলো-মন্দ, আলো-আঁধার ইত্যাদি পার্থক্য করতে পারে।
মলিকুউল ভিত্তিক কার্বন ব্যবহারের ফলে যে সব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেসব বিক্রিয়ার ধারাবাহিকতার মধ্যে সৃষ্ট যে প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞনীরা জীবন (Life) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ প্রক্রিয়ার দ্বারা জীবন একটি সিস্টেমে পরিণত হয়েছে এবং জীবনের এ সিস্টেম বৃদ্ধি ও প্রজনন কাজে সাহায্য করেছে। যেসব কোষ দ্বারা মানুষ সৃষ্টি হয় সে সব কোষকে প্রধানতঃ চার ধরনের জৈব পদার্থ (organic substance) পার্থক্য দেখাতে পারে। এসব জৈব পদার্থ হলো কার্বোহাইড্রেট, ফেটস, নিউক্লিক এসিড এবং প্রোটিন।
এ চার উপাদানের সাথে অজৈব বস্তু (inorganic substance) জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে যে আধুনিক চিন্তা-ভাবনা তা হলো কিভাবে জৈববস্তু অস্তিত্ত্ব লাভ করেছে। প্রাণীদেহ তৈরী হয় একটার পর একটা কোষ সাজিয়ে। কোষের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস রয়েছে তার মধ্যে আছে DNA (Dioxiribo Nucleic Acid)। জীবনের শুরু অবশ্যই DNA থেকে। DNA-এর গঠন পদ্ধতি এতই জটিল যে, এটিকে দেখতে কিছুটা মোচড়ানো (twisted) মইয়ের মতো মনে হয়। বিজ্ঞনীরা একে বলে- Double Helix (স্ক্রুর ন্যায় পেঁচানো)। এ মইয়ের ধাপগুলো চার ধরণের মলিকুউলের বহুবিধ জোড়ার সংযোগে তৈরী হয়ে থাকে। এরা হলো আ্যডানিন (adenin), থাইমিন (thyamine), গুয়ানিন (guanine) ও সাইটোসিন (cytosine)।
মানুষ যে দেখতে ঠিক মানুষের মতো, বানর কিংবা শিম্পাঞ্জির মত নয়। তার কারণ মানুষের ডিএনএ (DNA) ওদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্বের প্রতিটি প্রাণীরই রয়েছে আলাদা আলাদা DNA। DNA বিষয়ে প্রথম অধ্যায়ে আল কুরআন ও বিজ্ঞান পরিচ্ছেদে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।[৭]
কুরআনের আলোকে মানব সৃষ্টি : মানুষের সৃষ্টি প্রসঙ্গে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে যে, এই মানুষের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
﴿أَلَمْ يَكُ نُطْفَةً مِنْ مَنِيٍّ يُمْنَى﴾
অর্থ : “মানুষ কি সেই সামান্যতম শূক্র ছিল না যা সজোরে নির্গত হয়েছিল?”[৮]
পক্ষান্তরে মানব দেহে এই শুক্র এলো কোথা থেকে। পৃথিবীতে আমরা যা কিছু দেখি এসবের মূল উপাদান হলো মাটি। মাটি থেকেই সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়েছে।
মানুষ মাটি থেকে উৎপন্ন খাদ্য আহার করে। দেহ এবং দেহের অভ্যন্তরে যা কিছু আছে, তা গঠিত হয় গ্রহণকৃত খাদ্যের সার নির্যাস থেকে। মানুষের দেহ থেকেই শুক্র নির্গত হয়। অতএব শুক্রের মূল উপাদান হলো মাটি। এ জন্যই বলা হয় মানুষ সৃষ্টি হয়েছে মাটি থেকে। অসংখ্য কোষ (Cell) দিয়ে মানব দেহ গঠিত। এই অসংখ্য কোষ সর্বপ্রথম বিস্তৃতি লাভ করেছে একটি মাত্র কোষ থেকে, একটি পুরুষ প্রজনন কোষ যাকে বলা হয় শুক্রানু (Sperm) এবং আরেকটি স্ত্রী প্রজনন কোষ যাকে বলা হয় ডিম্বানু (Ovum)। এ দু’টি কোষের কোষ মিলিত হয়ে অন্য একটি কোষ উৎপন্ন হয় যাকে বলে জাইগোট (Zygote)। বিভাজনের মাধ্যমে এই জাইগোট মহান আল্লাহর নির্দেশে ক্রমশ মাতৃগর্ভে বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। মাতৃগর্ভের জরায়ূ (Uterus) থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ভ্রুণ তৈরি হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوْا اللهَ الَّذِي تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا﴾
অর্থ : “হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের রব কে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি তার থেকে সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট অধিকার দাবি করে থাকো এবং আত্মীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন আছেন।”[৯]
মাতৃগর্ভে মহান আল্লাহর ব্যবস্থাপনায় ভ্রমণ বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। এভাবে প্রায় ৪০ সপ্তাহ পর অপূর্ব সুন্দর মানব শিশু পৃথিবীতে আগমন করে।
মহান রাবুল আলামীন বলেন-
﴿خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيْمٌ مُبِيْنٌ﴾
অর্থ : “তিনি মানুষকে এক ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন।”[১০]
নুৎফা শব্দ দ্বারা শুক্রানু ও ডিম্বানু কে বুঝানো হয়েছে। এসব পদার্থকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যার একটি সাইটোপ্লাজম এবং অপরটি নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থান করেছে DNA (Dioxiribo Nucleic Acid) মূল এ জিনিসটিই হচ্ছে প্রাণীজগতের বংশগতির ধারক বাহক। প্রতিটি প্রাণীর DNA ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। ফলে এক প্রাণীর গর্ভ থেকে ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী জন্ম গ্রহণ করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿وَقَدْ خَلَقَكُمْ أَطْوَارًا﴾
অর্থ : “তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্টি করেছেন।”[১১]
মানুষ মাতৃগর্ভে কিভাবে অবস্থান করে এবং কয়টি পর্যায় অতিক্রম করে এই পৃথিবীতে আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ الْأَنْعَامِ ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ يَخْلُقُكُمْ فِيْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِيْ ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ ذٰلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُصْرَفُوْنَ﴾
অর্থ : “তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে। অতঃপর তা থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের জন্য আট প্রকার চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মাতৃগর্ভে তিন তিনটি অন্ধকারময় আবরণের মধ্যে তোমাদেরকে একের পর এক সজ্জিত করেছেন। তিনি আল্লাহ যিনি তোমাদের রব। প্রভুত্ব সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই, তিনি ব্যতীত দাসত্ব লাভের অধিকারী কেউ নেই।”[১২]
আল্লাহ তা‘আলা আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-কে সৃষ্টি করার পর তাঁকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন এবং তাঁর আত্মা থেকে একজন সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন। যার নাম হাওয়া (‘আলাইহিস্ সালাম)। তিনি সমগ্র মানব জাতির আদি মাতা। আদম ও হাওয়া (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর শুভ বিবাহ হওয়ার পর থেকে সন্তানের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সরাসরি মানুষ সৃষ্টির আর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوْا اللهَ الَّذِيْ تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًاوَآتُوْا الْيَتَامَى أَمْوَالَهُمْ وَلَا تَتَبَدَّلُوْا الْخَبِيْثَ بِالطَّيِّبِ وَلَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَهُمْ إِلَى أَمْوَالِكُمْ إِنَّهُ كَانَ حُوْبًا كَبِيْرًا﴾
অর্থ : “হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রভূকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দু’জন থেকে বিস্তার করেছেন অগণিত নারী পুরুষ। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট অধিকার দাবি করে থাকো এবং আত্মীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপরে সতর্কতা অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।[১৩]
বর্তমান মেডিকেল সাইন্স এই তিনটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণকে বলেছে, (chromosome) বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুসারে প্রতিটি মানুষের দেহে যে কোষ রয়েছে তার ভেতরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম (chromosome) রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২২ জোড়া উভয় লিঙ্গে একই রকম এবং সেগুলোকে অটোসোম (autosome) বলে। কিন্তু ২৩তম জোড়ার ক্রোমোজোম নারী ও পুরুষ সদস্যের ভিন্নতর এবং এগুলোকে হেটারোজোম (heterosome) বা সেক্স ক্রোমোজোম (sex chromosome) বলে। মানব দেহে দু’ধরনের সেক্স ক্রোমোজম রয়েছে যা (x) ও (y) ক্রোমোজোম নামে পরিচিত। যার দেহে ২৩তম ক্রোমোজোম জোড় দু’টি x ক্রোমোজোমে (x x) গঠিত সে ব্যক্তি, নারী অন্যদিকে যার দেহে ২৩ ক্রোমোজোম জোড়ের একটি x ও অন্যটি (y) ক্রোমোজোম (x y) সে ব্যক্তি পুরুষ। স্ত্রী গ্যামিট (ডিম্বানু) যদি (y) ক্রোমোজোম বাহী পুরুষ গ্যামিট দিয়ে নিষিক্ত হয় তাহলে সন্তান হবে পুত্র (x y), আর যদি (x) ক্রোমোজোমবাহী গ্যামিট দিয়ে নিষিক্ত হয় তাহলে সন্তান হবে কন্যা (x x)। অর্থাৎ- পিতার গ্যামিটই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য দায়ী; এ ক্ষেত্রে মায়ের কোন ভূমিকা নেই।[১৪] আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿وَاللهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْوَاجًا وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَى وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِهِ وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلَا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلَّا فِيْ كِتَابٍ إِنَّ ذٰلِكَ عَلٰى اللهِ يَسِيْرٌ﴾
অর্থ : “আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর শুক্রকীট থেকে, এরপর তোমাদেরকে জোড়ায় পরিণত করা হয়েছে। কোন নারী গর্ভবতীও সন্তান প্রসব করে না। এসব কিছু রয়েছে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।”[১৫]
তিনি আরো বলেন-
﴿ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِيْ قَرَارٍ مَكِيْنٍ ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ﴾
অর্থ : “আমি মানুষকে মাটির সার নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তাকে একটি সংরক্ষিত স্থানে টপকে পড়া ফোঁটায় পরিবর্তিত করেছি। এ এরপর সেই ফোঁটাকে জমাট রক্তপিণ্ডে পরিণত করেছি। তারপর সেই রক্তপিণ্ডকে মাংস পিণ্ডে পরিণত করেছি। এরপর মাংসপিণ্ডে অস্থি পিঞ্জর স্থাপন করেছি। তারপর অস্থি পিঞ্জরকে মাংস দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। তারপর তাকে দাঁড় করেছি স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি হিসাবে। সুতরাং বরকতময় আল্লাহ যিনি সমস্ত শিল্পীর চেয়ে সর্বোত্তম শিল্পী।”[১৬]
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। মহান আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের দু’টি পরিচয় আছে। এক মহান আল্লাহর দাস এবং অপরটি মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। একদিক থেকে মানুষ জন্মগতভাবেই মহান আল্লাহর প্রতিনিধি অপরটি দাস। তাতে সে যে ধর্মেরই হোক না কেনো, প্রতিনিধি হিসেবে মহাবিশ্বে বা জান্নাতে তার গন্তব্যস্থল এলাকা নির্ধারিত হয়ে আছে। দাস হিসেবে তাকে যাবতীয় বিধান মেনে চলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।[১৭]
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلٰى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُوْمًا جَهُوْلًا لِيُعَذِّبَ اللهُ الْمُنَافِقِيْنَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِيْنَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوْبَ اللهُ عَلٰى الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَكَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَحِيْمًا﴾
অর্থ : “তিনি তোমাদের ‘আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে। আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহণ করতে অস্বীকার করল। নিশ্চয়ই সে যালীম- অজ্ঞ। যাতে আল্লাহ মুনাফিক্ব পুরুষ, মুনাফিক্ব নারী, মুশরিক পুরুষ, মুশরিক নারীদেরকে শস্তি দেন এবং মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীদেরকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[১৮]
মানুষ জীবজগতের সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতি। উচ্চ শ্রেণীর মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব। নিজ বুদ্ধি বলে মানুষ পৃথিবীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে। সৃষ্টির আদি থেকে তথা আদম ও হাওয়া (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর পর নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানবজাতি আজ এই স্তরে উপনীত হয়েছে।
[১] সূরা আল আন‘আম : ৩৮।
[২] আবূ তালেব, Al Quran is all science, চতুর্থ সংস্করণ, আরজু পাবলিকেশন্স, পৃঃ ২৩৫।
[৩] সূরা আত্ তীন : ৪।
[৪] মুহাম্মদ আবূ তালেব, পৃঃ ১২২।
[৫] প্রাগুক্ত।
[৬] প্রাগুক্ত।
[৭] মুহাম্মদ আবূ তালেব, পৃঃ ১২২।
[৮] সূরা আল ক্বিয়া-মাহ্ : ৩৭।
[৯] সূরা আন্ নিসা : ১।
[১০] সূরা আন্ নাহ্ল : ৪।
[১১] সূরা আন্ নূহ্ : ১৪।
[১২] সূরা আয্ যুমার : ৬।
[১৩] সূরা আন্ নিসা : ১।
[১৪] উচ্চ মাধ্যমিক জীব বিজ্ঞান ২য় পত্র : প্রাণিবিজ্ঞান, গাজী আজমল ও গাজী আসমত, পৃ. ৪৯ ও ৫০।
[১৫] সূরা আল ফা-ত্বির : ১১।
[১৬] সূরা আল মু’মিনূন : ১২ ও ১৪।
[১৭] মানুষ ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য, ইঃ ফাঃ বাং, পৃ. ১৪২।
[১৮] সূরা আল আহ্যা-ব, ৭১-৭৩।
আপনার মন্তব্য