সাময়িক প্রসঙ্গ
পেছনে ফিরে দেখা ইসলামের ইতিহাসে মহামারি
অধ্যাপক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)। এ সময় প্রতিটি দেশে কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ইসলামিক স্কলারদের দাবি হলো কোয়ারেন্টিন পদ্ধতিটি মহামারির বিস্তার রোধে প্রিয়নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি নির্দেশনা। এ পন্থার সর্ব প্রথম প্রয়োগ ছিল ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর যুগে। তাই বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত এই পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়েছেন বিশ্বনাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
কোয়ারেন্টিন বলতে যা বুঝায় : Quarantine শব্দটি মূলতঃ ইতালীয় শব্দ Quaranta থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হলো ৪০ দিন। প্রাচীনকাল থেকে উপকূলীয় অঞ্চল সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখতে আগত জাহাজকে ৩০ বা ৪০ দিন পর্যন্ত পৃথক রাখার নিয়ম ছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জাহাজ অবতরণের আগে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নোংর করে থাকত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া প্লেগের মহামারি থেকে রক্ষার প্রয়াসে আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোয় কোয়ারেন্টিনের অনুশীলন শুরু হয়।[১]
মূলতঃ কোয়ারেন্টিন বলতে বুঝায়, সংক্রামক রোগে সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে কোনো এক স্থানে আবদ্ধ রাখবে, যেনো রোগের ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়া যায় এবং অন্যের মধ্যে রোগটি বিস্তার না করে। সুনিশ্চিতভাবে মহামারিতে আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তাকে নিবিড় পরিচর্যায় থাকতে হবে।
মহামারির বিষয়ে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুস্পষ্ট ভাষায় কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূলের নির্দেশনা মতে, কেউ যেনো আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ না করে এবং সেখান থেকে বেরও না হয়; বরং সেখান থেকে বের হওয়াকে রণাঙ্গন থেকে পলায়নের মতো বলা হয়েছে, যা কাবীরা গুনাহের শামিল। তেমনি মহামারিতে ধৈর্যধারণকারীদের জন্য থাকবে শহীদের মতো সওয়াব।
হাসপাতালে প্রথম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা : কুষ্ঠরোগীসহ অন্য গুরুতর সংক্রামক রোগীদের হাসপাতালে পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা শুরু হয় হিজরী প্রথম শতাব্দীতে (৭০৬-৭০৭ খ্রি.)। ইসলামের ইতিহাসের উমাইয়া খেলাফতের ষষ্ঠ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের তত্ত্বাবধানে দামেস্কে সর্ব প্রথম হাসপাতাল তৈরি করা হয়। সেখানে কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের পৃথক রাখার নির্দেশনা দেন।[২]
মহামারি বিষয়ে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মূলনীতি : এ বিষয়ে কয়েকটি হাদীস উসুল তথা মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা যাবে।
প্রথমত : ‘উসামাহ্ বিন জায়েদ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তুমি কোনো অঞ্চলে মহামারির প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে তাতে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তুমি সেখান থেকে বের হবে না।’[৩]
‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মহামারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি ইরশাদ করেছেন, তা একটি আজাব। আল্লাহ তা‘আলা যাদের ইচ্ছা তাদের কাছে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা তা মু’মিনদের জন্য রহমত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাই কেউ মহামারিতে আক্রান্ত হলে সে যেনো ধৈর্যধারণ করে এবং সওয়াবের আশা করে নিজের এলাকায় অবস্থান করে। এ বিশ্বাস রাখবে যে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন সে তাতে আক্রান্ত  হবে, তাহলে সে শাহাদাত বরণকারীর সওয়াব লাভ করবে।’[৪]
ইসলামের দৃষ্টিতে সংক্রামক রোগ : ইসলামের দৃষ্টিতে শরীরে রোগ-ব্যাধি দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ, আবার তাঁর ইচ্ছায়ই আরোগ্য লাভ করা যায়। কোনো বস্তুর বা ব্যক্তি কাউকে রোগাক্রান্ত করতে পারে না, আবার তা থেকে সুস্থ করে তুলতেও পারে না। আমাদের জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা অসুস্থতা একমাত্র মহান আল্লাহর হাতেই। তাই আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন রোগ যেমন সৃষ্টি করেছেন, তার প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন, বান্দা কখনো কখনো তাঁর দয়ায় সেই প্রতিষেধক জানতে পারে, আবার কখনো কখনো জানতে পারে না। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) সূত্রে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি।[৫]
কোনো রোগ আপন শক্তিতে মানুষকে আক্রান্ত কিংবা হত্যা করার শক্তি রাখে না, এটাও সত্য। কিন্তু তাই বলে কোনো এলাকায় রোগ-ব্যাধি দেখা দিলে সেখানে অসতর্ক অবস্থায় চলাফেরার অনুমতিও ইসলাম দেয়নি। কোনো এলাকায় মহামারি কিংবা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে যাতায়াত করতে বারণ করেছেন। এর আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে কোথাও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আমাদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আর ‘সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই’ বলতে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে, তার মানে হলো, রোগের কোনো নিজস্ব শক্তি নেই মানুষকে আক্রান্ত করার। তবে যেহেতু রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ সময় সতর্ক থাকতে বলেছেন, তাই কোথাও এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আমাদের অবশ্যই যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ কারণেই রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বর্ণনা করেন যে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই বললে বেদুঈন আরব জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! তবে সেই উটপালের অবস্থা কি যা কোনো বালুকাময় প্রান্তরে অবস্থান করে এবং সুস্থ সবল থাকে? অতঃপর সেখানে কোনো খুজলি-পাঁচড়ায় আক্রান্ত উট তাদের মধ্যে এসে পড়ে এবং সবগুলোকে ওই রোগে আক্রান্ত করে ছাড়ে? (এর জবাবে) তিনি বলেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে রোগাক্রান্ত করেছিল? যে আল্লাহ তা‘আলা প্রথম উটটিকে রোগাক্রান্ত করেছিলেন তিনিই তো অন্যান্য উটকে আক্রান্ত করেছেন।[৬]
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘অসুস্থ উটগুলোর মালিক তাঁর উটগুলোকে সুস্থ পশুর দলে পাঠিয়ে দেবে না (কারণ এতে ওই সুস্থ প্রাণীগুলো রোগাক্রান্ত হতে পারে)।[৭]
তাই আমরা সংক্রামক রোগকে মহান আল্লাহর হুকুমের চেয়ে শক্তিশালী ভাবার যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি কোথাও এ ধরনের রোগ দেখা দিলে তাকে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা।
মহামারি থেকে যেভাবে ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বেঁচে ছিলেন : ফিলিস্তিনের আল কুদস ও রামলার মধ্যভাগে অবস্থিত একটি অঞ্চল হলো আমওয়াস বা ইমওয়াস। সেখানে প্লেগ রোগ প্রথম প্রকাশ পায়। অতঃপর তা শামে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাসে তা ‘তাউন ইমওয়াস’ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ইমওয়াস অঞ্চল পুরোপুরি ধ্বংস করে ওই স্থানে কানাডাভিত্তিক ইহুদি তহবিলের অর্থায়নে একটি পার্ক তৈরি করা হয়। বর্তমানে তা ‘কানাডা পার্ক’ নামে সবার কাছে পরিচিত।
১৭ হিজরী ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) দ্বিতীয়বারের মতো শাম পরিদর্শনের জন্য বের হন। ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) শামে পৌঁছার পর শুনতে পান যে সেখানে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে।
‘আব্দুল্লাহ বিন ‘আব্বাস থেকে বর্ণিত। ‘উমার বিন খাত্তাব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) শামের উদ্দেশে বের হন। শামে অবস্থিত তাবুক গ্রামের ‘সারগ’ নামক এলাকার কাছে এলে সেনাপতি আবূ উবাদাহ ও অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়। ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-কে তাঁরা অবহিত করল যে শামে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের কথা শুনে ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) আমাকে বলেন, ‘ইসলামের প্রথম পর্যায়ের মুহাজিরদের ডাক দাও।’ তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলো। কেউ বললেন, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তা না করে ফিরে যাওয়া আমরা সমীচীন মনে করছি না। অনেকে বলল, আপনার সঙ্গে অনেক মানুষ ও রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মহান সাহাবিরা আছেন। এমতাবস্থায় তাঁদের নিয়ে আপনি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবেন না।
সবার কথা শুনে ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, ‘তোমরা চলে যাও।’ অতঃপর ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) আমাকে বললেন, ‘আনসারদের আমার কাছে ডেকে আনো।’ তাঁদের ডেকে পরামর্শ করলেন। তাঁরাও মুহাজিরদের মতো মতবিরোধ করল। তিনি বলেন, ‘তোমরা চলে যাও।’ অতঃপর আমাকে বলেন, ‘এখানে কুরাইশ বংশের প্রবীণ মুহাজির সাহাবিদের ডাক দাও।’ আমি তাদের ডেকে আনি। তাঁদের মধ্যে দুজনও মতবিরোধ করল না। সবাই অভিন্ন কথা ব্যক্ত করে বলল, আমরা মনে করছি, আপনি সব মানুষকে নিয়ে ফিরে যাবেন। মানুষকে এই মহামারিতে নেবেন না।’
অতঃপর ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) সবাইকে সামনে নিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি চলে যাব। তোমরাও চলে যাও।’ [তখন শামের গভর্নর ছিলেন আবূ উবাদায় বিন জাররাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)] এ কথা শুনে আবূ উবাদাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বললেন, ‘আপনি মহান আল্লাহর তাকদির থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন?’ ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, ‘আহ, হে আবূ উবাদাহ! এমন কথা তুমি ছাড়া অন্য কেউ বলত!’ মূলতঃ ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) তাঁর মতভিন্নতাকে অপছন্দ করেছেন।
‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) আবূ উবায়দার প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদির থেকে অন্য তাকদিরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছি। যেমন মনে করো, তোমার অনেক উট আছে। তা নিয়ে তুমি এক উপত্যকায় এসেছ। উপত্যকার দু’টি প্রান্ত আছে। এক প্রান্ত উর্বর। আরেক প্রান্ত শুষ্ক। তুমি উর্বর প্রান্তে উট চরালে কি মহান আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না? এবং শুষ্ক প্রান্তে  চরালেও কি মহান আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না?’
কিছুক্ষণ পর আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) এলেন। কোনো এক প্রয়োজনে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, এ বিষয় সম্পর্কে আমার জ্ঞান আছে। আমি রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে শুনেছি, ‘তোমরা কোনো অঞ্চলে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে তাতে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।’ এ কথা শুনে ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) আল-হামদুলিল্লাহ বললেন। অতঃপর সবাই ফিরে গেলেন।’[৮]
‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) মহামারি চরম আকার ধারণের খবর অবগত হন। ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) চাইলেন সেনাপতি আবূ উবায়দা (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-কে ফিরিয়ে আনতে। তাই ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) একটি চিঠি লিখলেন, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ হোক। তোমার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সরাসরি তোমাকে বলতে চাই। তাই তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলছি, আমার পত্র পড়ে আমার উদ্দেশে বের হওয়ার আগে পত্রটি তোমার হাতছাড়া করবে না। রাতে পত্র পৌঁছলে সকাল হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে। আর দিনের বেলায় পৌঁছলে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে।’ আবূ উবায়দা (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) পত্র পড়ে উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমিরুল মু’মিনীনকে ক্ষমা করুন।’ অতঃপর ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর উদ্দেশে একটি পত্র লিখলেন, ‘হে আমিরুল মু’মিনীন! আমি আপনার প্রয়োজনের বিষয় বুঝেছি। আমি এখন মুসলিম সেনাবাহিনীতে অবস্থান করছি। তাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আল্লাহ তা‘আলা আমিসহ সবার ব্যাপারে ফায়সালা করবেন। অতএব হে আমিরুল মু’মিনীন! আপনার সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে মুক্ত করুন। আমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিন।’
আবূ উবায়দা (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর পত্র পড়ে ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) কাঁদতে থাকেন। আশপাশের মুসলিমরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আবূ উবায়দা কি শহীদ হয়েছেন? ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, ‘না, তিনি এখনো শহীদ হননি। কিন্তু ...।’ অর্থাৎ- শিগগির তিনি শহীদ হবেন।’  এর পরই আবূ উবায়দা (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।[৯]
মহামারিতে বড় সাহাবিদের ওফাত : অনেক বড় বড় সাহাবি আমওয়াস নামক মহামারিতে আক্রান্ত  হয়ে ইন্তেকাল করেন। আবূ উবায়দা বিন জাররাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু), মুআজ বিন জাবাল (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু), ইয়াজিদ বিন আবূ সুফিয়ান (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু), হারিস বিন হিশাম (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) সুহাইল বিন আমর (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু), উতবাহ বিন সুহাইল (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-সহ আরো অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহামারি দীর্ঘদিন পর্যন্ত শামে বিরাজ করে। শামের অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ থেকে ৩৬ হাজারের মতো। আর মহামারিতে এ সময় মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বহাল থাকে।
‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর যুগে যেভাবে মহামারির সমাপ্তি ঘটে : আবূ উবায়দা (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) পরবর্তী সেনাপতি হিসেবে মুআজ বিন জাবাল (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-কে নির্ধারণ করেন। মুআজ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর মৃত্যুর পর আমর ইবনুল আস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তিনি মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘হে লোকেরা, এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও। এক বর্ণনা মতে, তোমরা পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন উপত্যকায় চলে যাও।’ অতঃপর সবাই বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এই বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করেন। আমর (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর গৃহীত পন্থা খলিফা ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) জানতে পারেন। তিনি তা অপছন্দ করেননি।[১০]
হিজরী নবম শতাব্দীতে পবিত্র মক্কার মহামারির চিত্র : ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মহামারির কারণে অনেক সময় মাসজিদও বন্ধ ছিল। এমনকি পবিত্র মক্কা নগরীর হারাম শরিফও নিরাপদ ছিল না তখন। তাই সবই জনশূন্য।
প্রখ্যাত হাদীসবিশেষজ্ঞ আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানি (রাহিমাহুল্লা-হ) (মৃত্যু : ৮৫২ হি.) ৮২৭ হিজরিতে মক্কায় প্রকাশ পাওয়া মহামারির ঘটনা বর্ণনা করেন, ‘এ বছরের শুরুতে মক্কায় মহামারি দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন ৪০ এরও বেশি লোক মারা গিয়েছে। শুধু রবিউল আউওয়াল মাসে ১৭ শয়ের বেশি লোক মৃত্যুবরণ করেছে। ওই সময় কেবল দুজনকে নিয়ে মাকামে ইবরাহিমের সামনে (শাফেয়ি মাযহাবের অনুসারী) ইমাম নামায পড়াত। আর অন্যান্য মাজহাবের অনুসারী ইমামরা মুসল্লির অভাবে নামাজের ইমামতি করত না। তবে এখানে হারামে নামায পুরোপুরি বন্ধ থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়। তবে মৃতের সংখ্যা, অসুস্থ ব্যক্তি ও সংক্রামক রোগ-ব্যাধির কারণে মানুষের উপস্থিতি তেমন ছিল না। কারণ মহামারি সংক্রমণের ভয় সবার মধ্যে।[১১]
হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে তিউনিশিয়ায় মহামারি : সপ্তম শতাব্দীর মরক্কোর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু আজারি মারাকাশি বর্ণনা করেন, ৩৯৫ হিজরিতে তিউনিশিয়াতে মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ফলে বস্ত্রের সংকট দেখা দেয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অনেক ধনী নিঃস্ব হয়ে পড়ে। চিকিৎসা, শুশ্রূষা ও মৃতের দাফনকর্মে সবাই ব্যস্ত ছিল। কাইরাওয়ান নগরীর মাসজিদগুলো বিরান হয়ে পড়েছিল তখন।’[১২]
হিজরী পঞ্চম শতাব্দীতে আন্দালুসের মহামারি : প্রখ্যাত হাদীসবিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক ইমাম জাহাবি (রাহিমাহুল্লা-হ) (মৃত্যু : ৭৪৮ হি.) লিখেছেন, আন্দালুসে (বর্তমান স্পেন) ৪৪৮ হিজরিতে কঠিন দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রানাডায় এত লোকের মৃত্যু হয়েছিল যে সেখানকার মাসজিদগুলো মুসল্লি না থাকায় বন্ধ হয়ে যায়। কর্ডোভা নগরী এ ধরনের দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সম্মুখীন হয়নি কখনো। তাই এ বছরটি ক্ষুধার বছর হিসেবে পরিচিত।’[১৩]
পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় মহামারি : প্রখ্যাত ফকিহ ও হাদীসবিশেষজ্ঞ আল্লামা ইবনুল জাওজি (রাহিমাহুল্লা-হ) (মৃত্যু : ৫৯৭ হি.) মধ্য এশিয়া ছড়িয়ে পড়া ভয়ংকর মহামারির কথা বর্ণনা করেছেন। প্রায় ২০ লাখের মতো লোক মৃত্যুবরণ করে এতে। তিনি লিখেছেন, “৪৪৯ হিজরির জুমাদাল উখরায় ‘মাওয়ারাআন নাহার’ বা ট্রান্সঅস্কিয়ানার ব্যবসায়ীদের একটি পত্র পাওয়া যায়। সেখানে সীমাহীন কষ্টের এক মহামারি দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন এই অঞ্চল থেকে ১৮ হাজার মৃতদেহ দাফনের জন্য বের করা হয়েছে। এই পত্র লেখা পর্যন্ত  মৃতের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজারের মতো!”
লেখক তখনকার কঠিন সময়ের বর্ণনা দিলেও তা বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশের চিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পূরক। তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘এই অঞ্চলে মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল। কিন্তু এখন আর মানুষের কোনো চিহ্নও দেখা যায় না। সব বাজার বিরান হয়ে আছে। জনশূন্য পথ-ঘাঁট। সব ঘরের দরজাও বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সব কাজকর্ম থেমে আছে। মানুষের রাত-দিনের পুরো সময় কাটে মৃতলোকদের গোসল ও দাফনের ব্যবস্থা করতে করতে। বেশিরভাগ মাসজিদ মুসল্লিশূন্য হয়ে পড়ে আছে।[১৪]
দু‘আ মাহফিলে সমাগম মহামারি বাড়িয়ে দিলো!
আল্লামা ইবনু হাজর (রাহিমাহুল্লা-হ) (মৃত্যু : ৮৫২ হি.) মহামারির সময় জমায়েতের বিরূপ প্রভাবের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে তিনি বর্ণনা করেন, ‘৮৩৩ হিজরিতে মহামারির সময়ে শিহাবুদ্দিন শরিফ নামের এক ক্ষমতাধর লোক ৪০ জন সম্মানিত ব্যক্তিকে একত্রিত করেন। তাঁদের প্রত্যেকের নাম ছিল মুহাম্মাদ। সবাইকে অর্থ প্রদান করা হয়। শুক্রবারে জুমার পর থেকে জামিউল আজহারে বসে তাঁরা কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকেন। আসরের সময় সন্নিকটে হলে তাঁরা উচ্চৈঃস্বরে দু‘আ করা শুরু করেন। তাঁদের আওয়াজ শুনে অনেক লোক আসা শুরু করে। অতঃপর ৪০ জন মিলে দালানের ছাদে উঠে আজান দেওয়া শুরু করেন। তাঁদের এমন অবস্থা দেখে এক লোক শরিফকে বলল, এঁদের কারণে মহামারি আরো ছড়াবে। অতঃপর তাই হয়েছে। মহামারি দিন দিন আরো বাড়তে থাকে।’[১৫]
মহামারি বেড়ে গেল হাজ্জযাত্রীদের আগমনে : ৮৪৮ হিজরিতে মিসরে মহামারি ছিল। মহামারির কারণে প্রতিদিনই একশ বা দুইশ লোক মারা যেত। মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। অতঃপর হজের সময়ে হাজিরা আসতে শুরু করে। এতে করে মৃতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এমনকি হাজিদের শিশুসন্তান ও দাসদের অনেকে মারা যায়। প্রতিদিন হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। দেখা যায়, হাজিদের আগমনে মহামারি আরো বিস্তার লাভ করেছে।’[১৬]
ইবনু হানবলি আল হালবি (রাহিমাহুল্লা-হ) (মৃত্যু : ৯৭১ হি.) বর্ণনা করেছেন, হালবে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। শাহ মুহাম্মাদ দাকনি নামের এক শিক্ষার্থীর বাবা হোম কোয়ারেন্টিন পরিত্যাগ করে সঙ্গে থাকা সবাইকে নিয়ে এক বাগানে গিয়ে ওঠেন। মৃত্যুকে তিনি খুবই ভয় করতেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এবার রক্ষা করেন। কিন্তু অন্য এক মহামারিতে পিতা-পুত্র উভয়ে মৃত্যুবরণ করে।[১৭]


[১] https://bit.ly/2yevTQ8।
[২] https://bit.ly/33VTDEs।
[৩] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৭২৮।
[৪] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৩৪৭৪।
[৫] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৬৭৮।
[৬] সহীহ মুসলিম- হাঃ ৫৭৪২।
[৭] সহীহ মুসলিম- হাঃ ২৮৭৩।
[৮] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৭২৯।
[৯] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৭/৪৪।
[১০] ফাতহুল বারি- ১০/১৯৯।
[১১] ইনবাউল গুমরি ফি আবনাইল উমুরি- ৩/৩২৬।
[১২] আল বায়ানুল মুগরিব ফি আখবারিল আন্দালুস ওয়াল মাগরিব- পৃঃ ২৭৪।
[১৩] তারিখুল ইসলাম, সিয়ারু আলামিন নুবালা।
[১৪] আল মুনতাজাম ফি তারিখিল উমাম- ১৬/১৭।
[১৫] ইনবাউল গুমরি ফি আবনাইল উমুর- ৩/৩৫৬।
[১৬] ইনবাউল গুমরি ফি আবনাইল উমুরি।
[১৭] দুররুল হুবাব ফি তারিখিল হালব।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত