ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ইসলামের অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করা। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (OIC) সেক্রেটারিয়েট কর্তৃক প্রদত্ত এবং ১৯৭৮ সালে ডাকারে অনুষ্ঠিত সদস্যভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের যে সংজ্ঞা অনুমোদিত হয়েছে তা হলো-
“Islami Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Shariah and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its operations.”
অর্থাৎ- “ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার উদ্দেশ্য, মূলনীতি এবং কর্মপদ্ধতির সকল স্তরে ইসলামী শরীআহ সকল নীতিমালা মেনে চলে এবং তার সকল কার্যক্রমে সুদের লেনদেন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে।”
আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ডক্টর মাহাথির মুহাম্মদ ‘ইসলামিক ফিনান্সের ভবিষ্যৎ সুদৃঢ়’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “ইসলামী অর্থব্যবস্থা হলো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থা, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আকস্মিক ধ্বসের কারণ হয় না।” যেমনটি আমরা সম্প্রতি দেখেছি। এর ফলে মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালার আলোকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।
মাহাথির মুহাম্মদকে মালয়েশিয়ার ইসলামী ব্যাংকিং তথা ইসলামী অর্থব্যবস্থার নির্মাতা বা স্থপতি বলা হয়। কারণ, ১৯৮১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে মালয়েশিয়ায় মাহাথির প্রথমে যেসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন তার অন্যতম হলো- ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের টিকে থাকার সক্ষমতা ও কর্মকৌশলসংক্রান্ত এই কমিটির প্রতিবেদনই মূলত মালয়েশিয়ায় ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পের সূচনা এবং এর ব্যাপক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এর পরেরটা সর্বজনবিদিত অনবদ্য ইতিহাস। তাইতো মাহাথির পৃথিবীর অন্যান্য ইসলামী দেশের অনুসরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিং ও ফিনান্স পেশাদারদের বৃহত্তম সমাবেশ WIBC (ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ব্যাংকিং কনফারেন্স)-২০১৯ এর তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ইসলামী ফিনান্সের অবদান প্রায় ৭১ শতাংশ। বিশ্বময় এ অর্থব্যবস্থা পরিমিতভাবে বিস্তৃত হচ্ছে কারণ হলো- হালাল খাত, অবকাঠামো ও সুকুক বন্ডে এর বিনিয়োগ এবং বিশেষত সকল পণ্য ও পরিষেবায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ। বিপুল প্রবৃদ্ধির আশায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইসলামী খাতগুলিতে বিনিয়োগ পরিচালিত হওয়াও বাজারে এই প্রবৃদ্ধি ঘটার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।
Ernst & Young’s (E&Y) এর বার্ষিক রিপোর্টের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাসেট ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। তন্মধ্যে, সৌদি আরব সর্ববৃহৎ মার্কেটে পরিণত হয়ে এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করছে। World Economic Forum-এর ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট ইসলামী ফিনান্স অ্যাসেটের সর্বোচ্চ শেয়ারটি (৩১.৭%) সৌদি আরবের। আর অ্যাসেট বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি (৪৩%) ইন্দোনেশিয়ায় এবং বিশ্বব্যাপী এ হার গড়ে ১৭ শতাংশ।
ইসলামিক ফিনান্স ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন সেক্টরে যখন ডিজিটালাইজেশন একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে স্থান পেয়েছে তখন বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে দুলিয়ে দেওয়ার মতো ২০২৩ সালের মধ্যে এ শিল্পের প্রকল্পগুলিকে ৩.৮ ট্রিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলারে উন্নীত করার সম্ভাবনা প্রবল বলে মনে করা হচ্ছে।
এতে প্রমাণিত হয়- আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী অর্থব্যবস্থা চিরকল্যাণকর ও দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক। ইসলামী অর্থব্যবস্থা কেবল রিবা (সুদ) ও গারার (অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তা) থেকে বেঁচে থাকার নাম নয়। এটি শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা, বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণের বলিষ্ঠ হাতিয়ার। এর কিছু অনন্য লেনদেন ও বিনিয়োগ পদ্ধতি রয়েছে, যা সমাজ কল্যাণকর ও পরিবেশবান্ধব। কারণ, এতে রয়েছে মানবিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ উৎপাদন ও সুষম বণ্টনের ইনসাফভিত্তিক ব্যবস্থা। আর ইসলামী অর্থনীতির সাথে প্রকৃত অর্থনীতির (Real Economy) বেশি সামঞ্জস্য রয়েছে; ফটকা অর্থনীতির (Speculative Economy) সাথে নয়। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক প্রদর্শিত শাশ্বত ও কল্যাণমুখী এ অর্থব্যবস্থার বাস্তবায়ন করেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীন।
ইংরেজ ঐতিহাসিক ওয়েল্জ বলেন, “ইউরোপ তার প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক আইনের জন্যে ইসলামের কাছে ঋণী।[১] বিখ্যাত পণ্ডিত লিউড্রোশ বলেন, “যে দু’টো কঠিন সামাজিক সমস্যা গোটা বিশ্বকে জর্জরিত করে তুলেছে, তার সমাধান আমি ইসলামে পেয়েছি। প্রথমত, আল্লাহর ঘোষণা ‘সব মু’মিন ভাই ভাই’। সামাজিক মৌল বিধানের সংক্ষিপ্ত ঘোষণা এটা। আর দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক সম্পদশালীর ওপর যাকাত ফরয করা, এমনকি গরিবদেরকে তাদের প্রাপ্য জোরপূর্বক নিয়ে নেয়ার সুযোগ দান-যদি ধনীরা তা দিতে ইচ্ছুক না হয়। এটাই প্রকৃত সাম্য।”[২]
ইসলামের দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে বিল দিউরান্ট তার ‘সভ্যতার গল্প’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “আমরা মানবজাতির গোটা ইতিহাসে মুহাম্মদের ন্যায় অন্য কোনো সংস্কারককে ফকিরের সাহায্যার্থে ধনীদের ওপর এতো বেশি ট্যাক্স ধার্য করতে আর দেখিনি। তিনি সব মানুষকেই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্রদের জন্যে ধার্য করতে আদেশ করতেন।”[৩]
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আজ একথা বলা যায় যে, আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ইসলামী পদ্ধতি পৃথিবীকে অনেক কিছু দেয়ার সামর্থ্য রাখে, গত দশকে আর্থিক সংকট, সার্বভৌম ঋণ (Sovereign Debt) ও আর্থিক মন্দার ভয়াবহ সময়ে যা প্রমাণ দিয়েছে। অনতিবিলম্বে এই শিল্প বিশ্বে দৃঢ় অবস্থান করে নিবে এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় এর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুপ্রতিষ্ঠা পাবে।
বিশ্বের বহু দেশেই এখন ইসলামের অর্থায়ন পদ্ধতি গুরুত্বের সাথে আলোচিত ও পঠিত হয়। নামী-দামী বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এমনকি বিশ্বের ৫৫টি শীর্ষস্থানীয় আর্থিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাজার (ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম)-এর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় লা ট্রবি ইউনিভার্সিটিতে ইসলামী অর্থায়ন বিষয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। এছাড়া ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, ডারহাম, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের ৭৫টি দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে পাঠ দান করা হয়।[৪]
ইসলামিক ফাইন্যান্সের প্রসারের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কনভেনশনাল ব্যাংকগুলো তাদের ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো/শাখার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং-এর দ্রুত বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। কেননা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চেয়ে কনভেনশনাল ব্যাংকের শাখা বা উইন্ডো চালু করা সহজতর যদিও অপারেশনের দিক বিবেচনায় কাজটি জটিল। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৭৫টি দেশে ছয় শতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকিং চালু রয়েছে[৫] এবং প্রায় চারশ’ উইন্ডো/শাখাধারী প্রচলিত ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও আরব বিশ্বের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশ যেমন- দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, আফ্রিকার মিশর, নাইজেরিয়া ও মরক্কোসহ সোভিয়েতভুক্ত মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্রুত প্রসার বেশ লক্ষণীয়। লন্ডনে ২০০ মিলিয়ন ইউরোর ইসলামী বন্ড চালু হয়েছে। দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের পর এখন লন্ডন, হংকং ও লুক্সেমবার্গ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের হাবে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে। এ ছাড়াও অন্যান্য লিজিং ও ফিনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো বটবৃক্ষের মতো তাদের কার্যক্রম বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ধর্মপ্রাণ ও সৎ মানুষের গভীর আগ্রহ-উদ্দীপনা ও সীমাহীন চাহিদার প্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ১৯৮৭ সালে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিঃ, ১৯৯৫ সালে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (পূর্বনাম সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিঃ), ২০০১ সালে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ২০০৪ সালে এক্সিম ব্যাংক, ২০০৯ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ২০১৩ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও যমুনা ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে ধাপে ধাপে শরী‘আহ্ভিত্তিক মোট ১১টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে তেরো শতাধিক শাখার মাধ্যমে জনসাধারণকে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। এরমধ্যে এক্সিম ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিঃ প্রচলিত ধারার ব্যাংক থেকে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়েছে।
সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকরূপে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। আর প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং থেকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং-এর অনুমোদন লাভকারী সর্বশেষ ব্যাংক হলো ‘স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড’, ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ এবং ‘যমুনা ব্যাংক লিমিটেড’। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ নামে। সদ্য অনুমোদন লাভকারী ব্যাংক তিনটি এখনো পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। বর্তমানে তারা রূপান্তরের আইনগত ও প্রক্রিয়াগত প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। ব্যাংকগুলো ইসলামী ভাবধারায় পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যক্রম শুরু করলে দেশে মোট পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াবে এগারোতে। দীর্ঘদিনের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন উদারতা নিঃসন্দেহে ইসলামী ব্যাংকিং প্রেমী ব্যাংক মালিক, পরিচালক ও সর্বসাধারণের মনে আশাব্যঞ্জক উদ্দীপনার রং ছড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সরকারি ও বেসরকারি ১৬টি প্রচলিত ব্যাংক আংশিকভাবে শরী‘আহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাসহ বেশকিছু ইসলামিক ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন তাদের আর্থিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ডুয়েল ব্যাংকিংয়ে সর্বপ্রথম পথিকৃৎ হিসেবে দেশে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড ১৯৯৫ সালে ‘হাসানাহ’ নামে ৫টি শাখা চালুর অনুমোদন নিয়ে তাদের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম শুরু করে। তার পথ ধরে এ ধারার শাখাভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমে পর্যায়ক্রমে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড (২০০৩), যমুনা ব্যাংক লিমিটেড (২০০৩), সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড (২০০৩), প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড (২০০৩), দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড (২০০৩) ‘মানারাহ’ নামে, এবি ব্যাংক লিমিটেড (২০০৫) এবং সর্বশেষ ব্যাংক আল-ফালাহ লিমিটেড মোট ১৯টি শাখার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা অব্যাহত রেখেছে। শাখাভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন থাকলেও এখন পর্যন্ত অপারেশনে আসেনি জনতা ব্যাংক লিমিটেড ও এইচএসবিসি লিমিটেড।
আবার একই শাখায় প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি উইন্ডো ভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে যাত্রা শুরু করা প্রথম ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (২০০৪) ‘সাদিক’ নামে, ট্রাষ্ট ব্যাংক লিমিটেড (২০০৮), ব্যাংক এশিয়া লিঃ (২০০৮) ‘সালামাহ’ নামে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড (২০০৯), সোনালী ব্যাংক লিমিটেড (২০১০), অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড (২০১০) এবং পূবালী ব্যাংক লিমিটেড (২০১০) তাদের মোট ৬১টি ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। এছাড়া এই সেক্টরে সর্বশেষ যুক্ত হওয়া মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (১০টি উইন্ডো), মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড (১৫টি উইন্ডো), ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড (২টি উইন্ডো) এবং মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড (২টি উইন্ডো) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাভের পর তাদের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এছাড়া অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কার্যক্রমে ইসলামী ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয় করণের চেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের পনেরোশ’র অধিক শাখা এবং উইন্ডোতে প্রায় সাঁইত্রিশ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
গত দশ বছরে (২০০৯-২০১৯) দেশের ব্যাংকিং খাতে গড় আমানত প্রবৃদ্ধির তুলনায় ইসলামী ব্যাংকগুলোর গড় আমানত ও বিনিয়োগ বেশি ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট বিনিয়োগের ২৪.৫৯% এবং মোট মূলধনের ২৩.৯৮% নিয়ন্ত্রণ করছে ইসলামী ব্যাংকিং।[৬] দেশের সকল ব্যাংকের মোট শাখার মাত্র ১২.৫% হয়ে মোট রেমিটেন্সের ৩১.১২ শতাংশ আজ ইসলামী ব্যাংকসমূহের, যা ২০১৭ সালে ছিল ৩৬.১৪ শতাংশ। সাঁইত্রিশ বছর আগেও যে পদ্ধতির যৌক্তিকতা ও অস্তিত্বের ব্যাপারে মানুষের সংশয় ছিল আজ সে পদ্ধতি দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় সবগুলো সূচকেই প্রচলিত ব্যাংকিং থেকে ভাল করছে। শরী‘আহ্ভিত্তিক ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনের ক্রমবর্ধমান এ বিকাশ নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির জন্য একটি সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আগাম বার্তা। এজন্য প্রচলিত আরো কিছু ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক এ রূপান্তরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অর্জনের নেপথ্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেশের ৬ জন ইসলামী ব্যাংকিং ব্যক্তিত্ব ও দু’টি প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে দেশের ইসলামী ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাপেক্স বডি সেন্ট্রাল শরী‘আহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ (সিএসবিআইবি)। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত চার ব্যক্তিত্ব হলেন, এম আযীযুল হক (২০০৫) শাহ্ আব্দুল হান্নান (২০০৬), মুফতী মোঃ আব্দুর রহমান (২০০৭), অধ্যক্ষ সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী (২০১০), এম ফরীদ উদ্দিন আহমাদ (২০১১) ও মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান (২০১২) এবং অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ হলো, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (২০০৮) ও এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ লিমিটেড (২০০৯)।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং ২০১৫ সালে সরকারের তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (এফসিএ) এর উপস্থিতিতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংক ও দেশের ব্যাংকিং খাতে অব্যাহতভাবে অসামান্য অবদান রাখায় ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ এবং অন্যদিকে কনভেনশনাল ব্যাংকিং থেকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তর ও আধুনিক ব্যাংকিং সেবা প্রচলনের জন্য এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ লিমিটেডকে এই অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর হোটেল রেডিসনে অনুষ্ঠিত অ্যাওয়ার্ড প্রদানের ২য় অনুষ্ঠানে জনাব আ হ ম মুস্তফা কামাল লোটাস বলেন, “ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টর দেশের অর্থনীতিকে বৃহৎ মাত্রায় পরিচালনা করছে।”[৭]
এছাড়া এই অ্যাওয়ার্ডের জন্য সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড কর্তৃক সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (২০১৩), আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (২০১৪), ডক্টর মুহাম্মদ হায়দার ‘আলী মিয়া (২০১৫), শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান (২০১৬) ও বায়তুশ শরফ ফাউন্ডেশন (২০১৭)-কে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অ্যাওয়ার্ড হস্তান্তর করা হবে।
সুতরাং বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিস্তার ও সমাজে এর প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। বাংলাদেশের গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে বিশ্বের প্রায় ছয়শো ইসলামী ব্যাংকের মোট হিসাব সংখ্যার প্রায় পঁয়ত্রিশ শতাংশই রয়েছে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোতে। সারাবিশ্বে ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগের প্রায় পঞ্চাশ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে এ দেশের ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনাকারী এসকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরামর্শক, সমন্বয়কারী ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেন্ট্রাল শরী‘আহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার বর্তমান মোট সদস্যসংখ্যা ২২টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাহরাইন ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান অ্যাআওফির (AAOIFI) সাথে বর্তমানে সেন্ট্রাল শরী‘আহ বোর্ড সমন্বিতভাবে কাজ করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহতভাবে পেলে এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মান বৃদ্ধিসহ সর্বসাধারণের কাছে তা আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
সাম্প্রতিককালে ইসলামী ফাইন্যান্সে বাংলাদেশের অর্জনসমূহ-
১. বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের জন্য মালয়েশিয়া ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান IFSB’র চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কাবীর ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি হতে আইএফএসবির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন যেখানে ব্যাংক নেগারা মালয়েশিয়ার গভর্নর নর শামসিয়াহ্ মুহাম্মদ ইউনূস উপ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন কুয়েতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. মুহাম্মদ ওয়াই আল হাশেল।[৮]
২. বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংক নেগারা যৌথভাবে ইসলামিক আর্থিক স্থিতিশীলতা ফোরামের (IFSF) হোস্ট করেছে- ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ফোরাম (IFSF) এর অধিবেশন ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংক নেগারার এই সমন্বিত ফোরামে ষোলটি দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর এবং নিয়ন্ত্রণ ও তদারককারী কর্তৃপক্ষের ডেপুটি গভর্নরবৃন্দ, আইএফএসবি সদস্যদের জ্যৈষ্ঠ প্রতিনিধিগণ, ২২টি বিচার বিভাগ এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক থেকে শতাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ আবদুর রহিম IFSF-এর এই অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ও শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন এবং ডিনারের আহ্বান করেন।[৯]
৩. বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন জেনারেল কাউন্সিল ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স (সিবাফি) প্রদত্ত “বিশ্বসেরা ইসলামিক ব্যাংক সিবাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৯” এককভাবে অর্জন করেছে- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পে উদ্ভাবনী বিনিয়োগের জন্য এ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ১৩ মে, ২০১৯ সৌদি আরবের জেদ্দায় সিবাফির ১৯তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সিবাফির বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের চেয়ারম্যান শেখ সালেহ ‘আব্দুল্লাহ কামেল এই অ্যাওয়ার্ড হস্তান্তর করেন।
৪. নাইজেরিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কাসহ বহু দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থাপিত নিবন্ধে মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে শরী‘আহ পরিপালনের অবস্থা ভালো বলে উল্লেখ করা হয়।
৫. গ্লোবাল ফিন্যান্স প্রদত্ত ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯-এর বেস্ট ইসলামিক রিটেইল ব্যাংক এবং বেস্ট ইসলামিক উইন্ডো এ দুই ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড (সাদিক)। এছাড়া ব্যাংকটির ইসলামিক উইন্ডো (সাদিক) কান্ট্রি উইনারও হয়েছে।
সাধারণ মানুষের চাহিদানুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি নির্ভর নতুন নতুন ইসলামী প্রডাক্ট মানুষের সামনে উপস্থাপন করে যাচ্ছে। একইসাথে বেশি লাভ করার পরিবর্তে মাসলাহা তথা জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করায় গুরুত্বারোপ করছে। জনস্বার্থ ও জনকল্যাণকে মুখ্য করে ইসলামী ব্যাংকগুলো গ্রামমুখী ব্যাংকিংয়ের উপর জোর দিচ্ছে। ফলে, ধনী-দরিদ্রের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সে ব্যবধান দ্রুত কমে আসবে -ইন্শা-আল্লাহ।
সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে আমরা দারিদ্র্যের মধ্যে অবস্থান করছি এ ধারণা সঠিক নয়। আমাদের অনেক সম্পদ রয়েছে, রয়েছে অপার সম্ভাবনাও। কিন্তু যথাযথ বণ্টন ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমাদের সম্পদ গুটিকতক মানুষের মাঝে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। সম্পদ যেনো মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না হয় সেজন্য সকল ইসলামী ব্যাংকের ডাইভারসিফাইড ইনভেসমেন্ট-এর মাধ্যমে দেশজুড়ে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন খাতে পরিমাণ ও পরিধির ভিত্তিতে ইনভেস্টমেন্টকে উৎসাহিত করতে হবে। বিনিয়োগ ক্ষেত্র নির্বাচনে মুনাফাকে সর্বাগ্রাধিকার না দিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে মাকাসিদে শারী‘আর আলোকে নিবেদিত ও কল্যাণমুখী হতে হবে।
ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পৃথিবীর ইসলামী ব্যাংকিং-এর মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করে। নাইজেরিয়াসহ অন্যান্য দেশের ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অবদান রেখেছে। আমরা যদি ইসলামী ব্যাংকিংকে আরো এগিয়ে নিতে পারি তবে কুয়েত, মালয়েশিয়া, বাহরাইন থেকেও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব -ইন্শা-আল্লাহ।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তার অগ্রযাত্রার প্রায় চার দশক অতিক্রম করতে চলেছে এবং ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পের অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনসহ ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণির গ্রাহকের মানসে স্থান করে নিয়েছে। এতে আমাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনো অবকাশ নেই। কেননা ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমে সকল ক্ষেত্রে শার‘ঈ নীতিমালার নিঃশর্ত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিপালন নিশ্চিতকরণে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করাই এ শিল্পের অন্যতম ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ। কেবল অধিক মুনাফার আকর্ষণে মোহাবিষ্ট হয়ে শরী‘আহ্ পরিপালনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করলে, যা ব্যাংক মালিক ও গ্রাহকের বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেইসাথে প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির প্রবক্তাদের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে রণে ভঙ্গ হতে পারে। সর্বোপরি এজন্য মহান আল্লাহর কাছেও করতে হবে কঠোর জবাবদিহি। অতএব, আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হতে হবে- সর্বাগ্রে শরী‘আহ্ পরিপালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে সহজ জবাবদিহি ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন; সাথে প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা অর্জন।
একটি ব্যাংক শরী‘আর নীতিমালার আলোকে পরিচালনা করতে হলে প্রয়োজন এমন দক্ষ, যোগ্য ও নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন কর্মীবাহিনী, যারা শরী‘আহভিত্তিক ব্যাংকিং ও এর কর্মকৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন এবং তা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ বা আংশিকভাবে শরী‘আহভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেগুলোতে এমন গুণাবলিসম্পন্ন জনশক্তির প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলত সাধারণ মানুষের তীব্র ধর্মীয় আবেগ-উৎসাহকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এবং নিবেদিত উদ্যোক্তাবৃন্দের প্রাণপ্রিয় অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর গ্রাহক, উন্নত সেবা, হাই ডেকোরেশনসহ সবই বিদ্যমান থাকে; শেষ পর্যন্ত যা থাকে না তা হলো- ইসলামী শরী‘আর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টরের এ অভাব মোচনে একদল যথোপযুক্ত শরী‘আহ্ বিশেষজ্ঞ ও ইসলামী ব্যাংকার তৈরি করা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা, তেমনি প্রয়োজন যুগোপযোগী তাত্ত্বিক জ্ঞান ও শরী‘আহ্ পরিপালনে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা। এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া না হলে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং সেক্টর দারুণ আদর্শিক সংকটের মুখে নিপতিত হওয়ার তীব্র আশংকা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ভিত্তিই হলো নৈতিকতা। নৈতিকতা বিবর্জিত জনবল দিয়ে প্রকৃত ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পকে এগিয়ে নেয়া তো দূরের কথা; বেশিদিন জিইয়ে রাখাই সম্ভব নয়।
দেশ ও জাতির কল্যাণ হিতৈষী তরুণ ও যুবসমাজকে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে ভাববার সময় হয়েছে। দেশে সুদমুক্ত অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সমালোচনার চেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ বেশি জরুরি। ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক ও পেশাজীবীদের ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে পড়ালেখা, গবেষণা ও প্রায়োগিক জ্ঞানার্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যোগ্য অর্থনীতিবিদ, শার‘ঈ জ্ঞানে পারদর্শী, পরিশ্রমী ও নিবেদিত ব্যাংকার হওয়ার ব্রত নিয়ে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে ছাত্রজীবন থেকেই। কঠোর সাধনা, জ্ঞান আহরণের তীব্র নেশা এবং মজ্জাগতভাবে দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকার প্রত্যয় নিয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সুদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। কেবল সমালোচনা, নিন্দা ও চরমপন্থা অবলম্বন করে দেশে ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করায় ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি ইসলামী অর্থব্যবস্থার জন্য সময়োগযোগী গবেষণাও করা দরকার।
যেহেতু ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থাকে মজবুত করতে একদল শরী‘আহ্ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন সেহেতু শারী‘আহ্ বিশেষজ্ঞগণকেও দেশের ইসলামী ব্যাংকিং ও ফিনান্সে অবদান রাখতে হবে। একদিকে যেমন অনেক ইসলামিক স্কলার আছেন যাদের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই অপরদিকে তেমন অনেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ আছেন যারা ইসলামী শরী‘আহ্ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান কিংবা ধারণা রাখেন না। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থাকে বিশ্বজনীন আদর্শ ও কল্যাণকর ব্যবস্থারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ইসলামিক স্কলার, শিক্ষাবিদ ও পেশাদার ব্যাংকারদের মধ্যে জ্ঞান, চিন্তা ও অনুশীলনের সমন্বয় ঘটাতে হবে। বিশেষকরে পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নিত্য-নতুন আর্থিক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে শরী‘আহ্ বিশেষজ্ঞদের নব-জাগরণ ইসলামী ব্যাংকিংকে সমৃদ্ধ করবে।
হানাফী মাযহাবের অন্যতম ফকীহ ইমাম মুহাম্মদ (রাহিমাহুল্লা-হ)। তাঁর বাজারে বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে ওঠাবসা করা এবং ব্যাবসায়িক লেনদেন সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেয়ার নিত্য অভ্যাস ছিল। একদিন এক ব্যক্তি তাকে বাজারে দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি ‘আলেম মানুষ, কিতাব অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাই আপনার কাজ। আপনি বাজারে কী করছেন? তিনি উত্তরে বললেন, আমি ব্যবসায়ীদের রীতিনীতি ও তাদের পরিভাষা সম্পর্কে জানতে এসেছি। কারণ এছাড়া সঠিক মাসয়ালা বের করা যায় না।
ইসলামী ব্যাংকিং শিল্পকে সাফল্যের শীর্ষে অবিচল রাখতে হলে প্রয়োজন নিবিড় প্রশিক্ষণ ও নিরবচ্ছিন্ন তদারকি। কথায় বলে, ‘প্রশিক্ষণ উৎকর্ষের সোপান’। এজন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোয় নিয়োজিত জনশক্তিকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে দক্ষ, যোগ্য, চৌকস ও আদর্শ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
অধিকন্তু, শরী‘আহ্ সুপারভাইজরি কমিটিতে কর্মরত সদস্যদের জন্য ইসলামী ব্যাংকিংয়ের গভীর জ্ঞান প্রয়োজন। কেবল জনপ্রিয় হলেই তাকে এই বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব প্রদান কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। এই সেক্টরে জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও অধিকতর যোগ্যদেরকেই নির্বাচন করা এ শিল্পের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য একাডেমি ফর বিজনেস প্রফেশনাল (এবিপি) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ইসলামিক ব্যাংকিং ডিপ্লোমা দিচ্ছে। তদুপরি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি) জ্ঞান বিকাশের জন্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এছাড়াও সেন্ট্রাল শরী‘আহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ (সিএসবিআইবি) AAOIFI সার্টিফাইড ইসলামিক প্রফেশনাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CIPA) প্রোগ্রামটি নিয়মিত পরিচালনা করছে এবং সম্প্রতি সার্টিফিকেট কোর্স অন ইসলামিক ফাইন্যান্স-এর ক্লাস উদ্বোধন করেছে, যেখানে প্রায় সকল ব্যাংকের কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করছেন।
অপরদিকে শরী‘আহ্ স্কলারদের মান-মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়েও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবতে হবে যাতে ইসলামী অর্থনীতিতে মেধা বিনিয়োগে বিশেষজ্ঞগণ অনীহা প্রকাশ না করেন কিংবা আগ্রহ হারিয়ে না ফেলেন।
আবার এ শিল্পের কর্মী ও কর্মকর্তাগণ যেন ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে ভোক্তাসাধারণের অজ্ঞতাকে অবহেলা কিংবা দুর্বলতা মনে না করেন এবং তাদের হৃদয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাহাত্ম্য ও এর প্রতি ভালবাসার কোমল পরশ বুলিয়ে দেন। তাদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও সেবার মান যেন ইসলামী আদর্শকে সামনে রেখে হয়।
আর এ লক্ষ্য অর্জনে ঘনঘন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে হবে। কর্মীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে পেশাগত মানের সাথে সততা-নৈতিকতা, সদাচারণ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার বিষয়টিকেও মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে গভীর আগ্রহ-অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি এবং এ ক্ষেত্রে প্রচলিত ভুল ধারণা অপনোদনের উদ্দেশ্যে বিভাগীয় শহরগুলোতে বছরে অন্তত একটি ‘ইসলামী ব্যাংকিং মেলা’র আয়োজন এবং গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ ও অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ বর্তমানে এক অনিবার্য বাস্তবতা।
[১] ড. ইউসূফ আল-কারযাভী, ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়ন, খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৯, পৃ. ১১৪।
[২]
ড. ইউসূফ আল-কারযাভী, ইসলামের যাকাত বিধান (ফিকহুয যাকাত), অনুবাদ :
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৮, পৃ. ৬৯৯।
[৩] ড. ইউসূফ আল-কারযাভী, ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১।
[৪] মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ খন্দকার, ইসলামী ব্যাংকিং মডেল সক্ষমতা ও ভবিষ্যত, দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭।
[৫] প্রাগুক্ত।
[৬] বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট।
[৭] সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড অ্যাওয়ার্ড স্মরণিকা-২০১৫।
[৮] আইএফএসবি বুলেটিন, ইস্যু: ১৬, এপ্রিল-২০১৯।
[৯] আইএফএসবি বুলেটিন, সংখ্যা ১৭, সেপ্টেম্বর ২০১৯।
আপনার মন্তব্য