সাময়িক প্রসঙ্গ
স্বনাম ধন্য চার নক্ষত্রের মৃত্যু বরণ : কিছু কথা
অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ রঈসুদ্দীন
الحمد ولله رب العلمين والصلاة ءالسلام على رسوله الكريم، وبعد :
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের। অতঃপর দরূদ ও সালাম পেশ করছি প্রিয় নাবী মুহাম্মদ ﷺ-এর প্রতি।
দীর্ঘদিন পর ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি। করোনা ভাইরাসের কারণে সমগ্র পৃথিবী আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। সারা দুনিয়া আজ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির চাকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়েছে। যা কিনা ভাষায় প্রকাশের নয়। সাপ্তাহিক আরাফাত প্রকাশনার কাজ লক ডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তবে আশার আলো হলো, গত সংখ্যা আমরা অন-লাইনে প্রকাশ করতে পেরেছি -আল-হামদুলিল্লাহ।
যাক এসব কথা! আমরা বাস্তবিকভাবেই শোকাহত। কারণ আমাদের নিকট থেকে চারজন জমঈয়ত নেতা প্রখ্যাত ‘আলেমে দীন, বাগ্মী এবং খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ অল্প সময়ের ব্যবধানে মহান আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইহজগত থেকে পরজগতে চলে গেছেন। যাদের অভাব পূরণ হওয়ার মতো নয়। তাঁদের একজন হলেন আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রফেসর শাইখ মুহাম্মদ মোবারক আলী (রহিমাহুল্লা-হ)। যিনি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। সরকারী মাদরাসা-ই-আলীয়া থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করার পর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. অনার্সসহ অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। তারপর কর্ম জীবনের শুরুতে মাদরাসায় চাকুরী শুরু করেন। অতঃপর বেসরকারী কলেজে কিছুদিন চাকরি করার পর সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। সর্বশেষ সরকারী কবি নজরুল কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর অল্প কিছুদিন মাদরাসাতুল হাদীস নাজির বাজারের অধ্যক্ষ হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি জীবনের পাশাপাশি বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের বড় বড় জেলা সদরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীনের দাঈ‘ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যা সর্বজন বিদিত। সবশেষে তিনি বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের মাননীয় সভাপতি হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। মানুষ হিসেবে তিনি খুবই সহজ-সরল ও প্রাঞ্জলভাষী ছিলেন। নিঃসন্দেহে তিনি একজন গুণী ও সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। অপরজন হলেন জমঈয়তে আহলে হাদীসের মাননীয় উপদেষ্টা, সাবেক সভাপতি ও ব্যানবেইজের সাবেক পরিচালক এবং প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইলিয়াস আলী। যিনি একাধারে অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। ছাত্র জীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। কর্মজীবনে কর্মবীর হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি একাধারে বহু ভাষা-জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ এবং ব্যবহারে ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের প্রস্তাবিত ইসলামী ইউনিভার্সিটির প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আমাদের একজন বলিষ্ঠ অভিভাবক ছিলেন। যাকে আমরা কোনো দিন ভুলতে পারব না।
আরেকজন হলেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন প্রখ্যাত ‘আলেমে দ্বীন, অত্যন্ত সৌখিন, নরম মেজাজের গুণী মনীষী মাওলানা যিল্লুল বাসেত (রহিমাহুল্লা-হ)। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের উপদেষ্টা ছিলেন। প্রফেসর ড. আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল বারী (রহিমাহুল্লা-হ) স্যারের ‘আমলে তিনি জমঈয়তের সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকার অদূরে বেরাইদ ভূঁইয়াপাড়া জামে মাসজিদ এবং ঐতিহ্যবাহী বংশাল বড় জামে মাসজিদের খতীব হিসেবেও অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পাশাপাশি টঙ্গী থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের ম্যারিজ রেজিস্টার ও কাজী হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি সহজ-সরল জীবন-যাপন করতেন।
আরেকজন মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন, যার নিবাস ছিল ভারতের পশ্চিম বঙ্গে। যিনি কিনা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। যার নাম হলো হাফিয শাইখ প্রফেসর আইনুল বারী আলিয়াবী (রহিমাহুল্লা-হ)। যিনি কলিকাতা আলীয়া মাদরাসার সনামধন্য প্রফেসর ছিলেন। দীর্ঘদিন যিনি অল-ইন্ডিয়া জমঈয়তে আহলে হাদীসের মাননীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও প্রখ্যাত বাগ্মীও ছিলেন। যার পরিচিতি ছিল সমগ্র মুসলিম দুনিয়া জুড়ে।
কয়েক বছর পূর্বেও তিনি বাংলাদেশের বড় বড় সম্মেলনে যোগদান করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তাঁর সাথে কয়েকটি সম্মেলনে যোগদান করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি তাকে খুবই কাছে থেকে দেখেছি। তিনি খুবই সহজ-সরল ও গুণীজন ছিলেন।
উপর্যুক্ত চারজন মনীষীর মৃত্যুতে আমরা চারজন সুযোগ্য অভিভাবক হারালাম। কোনোদিন তাদের চেহারা আমরা আর দেখতে পারব না। সবাই তারা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাদের সকল স্মৃতি শুধু আমাদের অন্তরেই লুকিয়ে থাকবে। আর শুনব না কোনো দিন তাদের সুন্দর বক্তৃতা ও উপদেশ। ঠিক এমনিভাবে আমাদের সবাইকে একদিন চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে মহান আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে। কেউ ঠেকাতে পারবে না এই আহ্বান। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
“বলো, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালাচ্ছ তা অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাত করবে। তারপর তোমাদের দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী মহান আল্লাহর নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। তারপর জানিয়ে দেয়া হবে যা তোমরা করতে।”[১]
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : “বলো, পলায়নে তোমাদের কোনোই লাভ হবে না, যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যা থেকে পলায়ন করো তাহলে তোমাদের সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে।”[২]
সুতরাং মহান আল্লাহর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বা মৃত্যু থেকে পালাবার কোনোই পথ নেই; বরং সবাইকে মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। তবে আমরা যেনো নেক ‘আমল নিয়ে মহান আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা যেনো আমাদেরকে সেই তাওফীক্বই দান করুন -আমীন।
পরিশেষে উপর্যুক্ত গুণী চারজন মনীষীর জন্য মহান আল্লাহর নিকট আবেদন করি- তিনি যেনো তাদের প্রতি দয়াপরশ হয়ে জান্নাতুল ফিরদাউসে উচ্চ মাকাম দান করেন -আমীন।
اللهم اغفرلهم وارحمهم...
হে আল্লাহ! তুমি মেহেরবানী করে আমাদের দু‘আ ক্ববূল করো -আমীন, আল্লাহুম্মা আমীন। ###

[১] সূরা আল জুমু‘আহ্ : ৮।

[২] সূরা আল আহযা-ব : ১৬।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত