সাময়িক প্রসঙ্গ
“শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম মহান আল্লাহর আনুগত্যের ধারাবাহিকতার স্বাক্ষর”
শাইখ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
عَنْ أَبِىْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِيِّ (رَضِيَ اللهُ عَنْهُ) أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ : ্রمَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِগ্ধ.
সরল অনুবাদ : আবূ আইয়্যূব আল আনসারী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি রামাযানের সিয়াম পালন করল অতঃপর শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম পালন করল সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল।[১]
সাহাবী আবূ আইয়্যূব আল আনসারী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)’র পরিচয় : তাঁর নাম খালিদ ইবনু যায়েদ ইবনু কুলাইব। তিনি তাঁর উপাধিতেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি একজন আনসারী সাহাবী। তিনি খাযরাজ গোত্রের। তিনি আকাবার শপথে অংশ নিয়েছিলেন। নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হিজরত করে মাদীনায় আগমন করলে তার বাড়িতেই নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মহান অতিথি হিসেবে রাখেন যতদিননা নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য হুজরা তৈরী করা হয়। তিনি ৫২ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন।
মুত্তাফাকুন ‘আলাইহিতে তাঁর বর্ণনায় ৭টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[২]
হাদীসের মূল বক্তব্য : দীর্ঘ একটি মাস রামাযানের সিয়াম আদায়ের পর শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি ফাযীলাতপূর্ণ নফল সিয়াম পুন্য সন্ধানীদের জন্য বড়ই প্রাপ্তির বিষয়। তাতে আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বছরের সিয়াম পালনের সাওয়াব বান্দাকে দান করে থাকেন। এর স্বাভাবিক হিসাব হলো প্রতিটি ‘আমলের সাওয়াব দশগুণ হওয়ায় এক মাসের রামাযানের সিয়ামে উপরন্তু দশ মাসের সওয়াব ধার্য হয় এবং তদসঙ্গে শাওয়ালের ছয়টি সিয়ামে ছয় দশে ষাটটি তথা দু’মাসের সিয়ামের সাওয়াব অর্জিত হয় সর্বমোট ১২ মাসের সিয়ামের সাওয়াব বান্দা প্রাপ্ত হয়। হাদীসের মূল ভাষ্যের সুন্দর ব্যাখ্যা এটাই। এটি আল্লাহ তা‘আলার বাণীর পূর্ণতা। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
﴿مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا﴾
“যে ব্যক্তি কোন পুণ্যকর্ম সম্পাদন করবে, তার জন্য তার দশগুণ সাওয়াব রয়েছে।”[৩]
হাদীসের ব্যাখ্যা :
্রمَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍগ্ধ.
“যে ব্যক্তি রামাযানের সিয়াম পালন করবে অতঃপর শাওয়ালে ছয়টি সিয়াম পালন করবে।”
আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠতম আনুগত্যমূলক কাজ হলো সিয়াম সাধনা। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নৈকট্যভাজন হওয়ার জন্য এটি একটি বড় মাধ্যম। সিয়ামের মাধ্যমে অগণিত সাওয়াব, কৃত অপরাধের ক্ষমা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলে এবং জান্নাতের দরজা খোলা হয়ে যায়। মাহে রামাযানের কঠিনতর সাধনার পর এ বরকতময় ‘ইবাদত ধারার আরো পরিপূরক পুণ্য প্রাপ্তির স্বাক্ষর হলো ছয়টি সিয়াম।
বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে এই ছয়টি সিয়াম ভারমূলক কেউ মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর বিনীত বান্দাগণ এই সিয়ামের জন্য অদম্য আগ্রহে দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন থাকে। এটি যেন সাওয়াবের পর সাওয়াবের জন্য ঝাপিয়ে পড়ার ঐকান্তিক প্রয়াস। প্রতি একটি সিয়াম মু’মিন প্রাণ সাওয়াবের পুন্য অনুভূতিতে হৃদয় মনকে আচ্ছন্ন করে নেয়। মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন-
্রمَا مِنْ عَبْدٍ يَصُوْمُ يَوْمًا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ، إِلَّا بَاعَدَ اللهُ، بِذَلِكَ الْيَوْمِ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًاগ্ধ.
“কোন বান্দা মহান আল্লাহর পথে একদিন সিয়াম পালন করলে তাতে তার বদলে আল্লাহ তা‘আলা তার চেহারাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছর দূরত্ব করে দিবেন।”[৪]
ثُمَّ أَتْبَعَهُ অর্থ হলো রামাযানের পর সিয়াম রাখা। আর سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ অর্থ হলো, শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়াম হওয়া। সেটি শাওয়াল মাসের প্রারম্ভে, মধ্যভাগে কিংবা শেষাংশে হতে পারে এবং তা আলাদা আলাদাভাবে হতে পারে, আবার একাধারেও হতে পারে।[৫]
্রكَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِগ্ধ.
“সে যেনো সারা বছর সিয়াম পালন করল।”
রামাযানের পরপরই কোন মু’মিন ব্যক্তির শাওয়ালে আরো ১০টি সিয়াম পূর্ণ একটি বছর সিয়ামের সওয়াবকে পূর্ণতা দিবে। প্রতিটি নেক ‘আমলের সাওয়াব ১০ গুণ হওয়ায় রামাযানের ১ মাস দ্ধ ১০ গুণ = ১০ মাস হলো। আবার শাওয়ালের ৬ সিয়াম দ্ধ ১০ গুণ = ৬০ দিন বা ২ মাস। ফলে পরিপূর্ণ ১২ মাসের সিয়ামের সাওয়াব সে ব্যক্তি লাভ করল।
প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন ও জওয়াব : প্রশ্নটি হলো- কোন ব্যক্তির উপর রামাযানের র্ফয সিয়াম কাযা রয়ে গেলে সে ব্যক্তির র্ফয সিয়ামগুলোর কাযা আদায়ের পূর্বে শাওয়ালের সিয়াম আদায় করা বৈধ কি-না?
এর জবাবে স্পষ্টতই বলা যায়- বিশেষ ওযরবশত যাদের রামাযানের সিয়াম কাযা পড়ে যায় যেমন- মহিলাদের ঋতু অবস্থাকালীন বা নিফাসগ্রস্ত অবস্থায় কিংবা কোন ব্যক্তির অসুস্থতা বা সফরজনিত কারণে সিয়াম ভঙ্গ হয় -এমতাবস্থায় বৈধ রয়েছে রামাযানের সিয়ামের কাযা পরে আদায় করে নেয়া। ইমামগণের মাঝে এ প্রসঙ্গে মত-পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও আল্লাহ তা‘আলার আয়াত-এ বিশেষ সুযোগকে অবারিত রেখেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيْضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ﴾
“তোমাদের মধ্যে কেউ রোগাক্রান্ত থাকলে বা সফরে পরিভ্রমণরত থাকলে পরবর্তী দিবসগুলোতে সিয়ামের কাযা আদায় করে নেবে।”[৬]
এ মর্মে ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বর্ণিত হাদীস প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেন,
্রكَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ، فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَ إِلَّا فِىْ شَعْبَانَগ্ধ.
“আমার রামাযানের কাযা সাওম থাকত, শা‘বান আসা পর্যন্ত তার কাযা আদায় করতে পারতাম না।”[৭]
“এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ওয়াজিব কাযা আদায়ের ব্যাপারটিতে সুযোগ ও সময়ের প্রশস্থতা রয়েছে।”[৮]
আর ইতোমধ্যে শাওয়াল মাসে সুযোগ মতো ছয়টি নফল সাওম রেখে নেয়া যায়।
হাদীসের শিক্ষা :
০১. শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম রামাযানের সিয়াম আদায়কারীর জন্য বড়ই অনুরক্তির স্বাক্ষর যাতে বান্দা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনে অগ্রবর্তী হতে পারে।
০২. সিয়াম আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের শ্রেষ্ঠতম ‘আমল। আর শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম বান্দাকে মহান আল্লাহর আনুগত্যের ধারাবাহিকতার প্রশিক্ষণ দেয়।
০৩. সিয়ামে রামাযান শেষ হলেই মহান আল্লাহর ‘ইবাদত ফুরিয়ে যায় না; বরং সালাতে পাবন্দ হওয়া এবং শাওয়ালের ছয়টি সিয়ামসহ অন্যান্য মসনূন সিয়ামে অনুরক্তি রাখা সব সময়ের জন্য প্রয়োজন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ﴾
“আর তোমার রবের ‘ইবাদত করে তোমার নিশ্চিত কথা অর্থাৎ- মৃত্যু আসা পর্যন্ত।”[৯]
উপসংহারে বলা যায় যে, শাওয়াল মাসের ছয়টি নফল সাওমের যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। কাজেই এ সিয়াম পালন করা খুবই ফযীলাতপূর্ণ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ মাসে ছয়টি নফল সাওম রাখার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন। ###

[১]  সহীহ মুসলিম- হা: ২০৪/১১৬৪; সুনান আবূ দাঊদ- হা: ২৪৩৩, সহীহ; আত্ তিরমিযী- হা: ৭৫৯, হাসান সহীহ।
[২] সিয়াব আ’লাম অন নুবালা এবং উসদুলগাবাহ ফী মা‘রিফাতিস সাহাবাহ অবলম্বনে।
[৩] সূরা আল আন‘আম ৬ : ১৬০।
[৪] সহীহুল বুখারী- হা: ২৮৪০, মুসলিম- হা: ১৬৭/১১৫৩।
[৫] ইতহাফুল কিরাম- আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, পৃ: ১৯১।
[৬] সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৮৪।
[৭] সহীহুল বুখারী- হা: ১৯৫০।
[৮] সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ- আস সাইয়িদ সালিম, পৃ: ১২৬।
[৯] সূরা আল হিজর ১৫ : ৯৯।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত