সাময়িক প্রসঙ্গ
শীতের মৌসুমে বাড়তি সাওয়াব লাভের সুযোগ
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন

পৌষ-মাঘ এ দুই মাস শীতকাল। ঈসায়ী সনে গণনা করলে হয় ‘মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি’ পর্যন্ত। তবে শীতের আমেজ শুরু হয় মধ্য অক্টোবর থেকে, যা স্থায়ী হয় মার্চ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৫/৬ মাস নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য সময়টি অনুকূল আবহাওয়াসম্পন্ন। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার সুযোগে এ সময় বিভিন্ন সামাজিক, সংস্কৃতিক, ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমরা যারা মুসলিম, তাদের কাছেও এ মৌসুম বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এ মৌসুমে বাড়তি ‘ইবাদত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যেমন-

প্রথমত: শীতকালের রাত বেশ বড় হওয়ার দরুন বেশি সময় পাওয়া যায়, ফলে শীতের রাতে বেশি বেশি নফল ‘ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং কেউ ইচ্ছা করলে এ সময় বেশি বেশি নফল ‘ইবাদত করে নিজের নেক ‘আমলের পাল্লা বাড়াতে পারেন। এমন সুযোগ গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায় না। শীতের রাত যেমন সালাত, তিলাওয়াত, যিক্র-আযকার ইত্যাদি নফল ‘ইবাদতের জন্য উপযোগী, শীতের দিনগুলোও নফল সিয়াম পালনের শ্রেষ্ঠ সময়। কেননা শীতের দিনগুলো ছোট হয় এবং আবহাওয়াও অনুকূলে থাকে। এ সময় সওম পালন করলে ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হতে হয় না। তাই যারা সিয়াম পালনে অভ্যস্ত নয় তারাও এ মৌসুমে নফল সিয়াম পালনের চেষ্টা করতে পারেন। প্রাথমিভাবে আমরা প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার এবং আইয়্যামে বীয তথা প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সওম পালন করতে পারি! এতে একদিকে যেমন নবী (সা.)-এর সুন্নাহ পালন করা হবে, অপরদিকে সওম পালনের অভ্যাস গড়ে উঠবে।

দ্বিতীয়ত: আমাদের এ উপমহাদেশে শীত মৌসুম ঘিরে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এটি আমাদের ইসলামী সংস্কৃতির অংশ বলা চলে। উৎসবমুখর পরিবেশে দীন শিক্ষার এক ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এসব মাহফিল থেকে মানুষ দীনের দীক্ষা গ্রহণ করে নতুন জীবন গঠনের শপথ নেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখন মাহফিলগুলোর মধ্যে অহংকার, প্রদর্শন ও পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ এবং নিয়তের অস্বচ্ছতা প্রবেশ করেছে। অথচ নিকট অতীতেও মাহফিলগুলো দ্বীন প্রচার-প্রসার ও তাক্বওয়ার চাদরে ঢাকা থাকতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখন আয়োজক কমিটির নানরকম উদ্দেশ্য থাকে। পাশের পাড়া বা পাশের গ্রামের মাহফিল থেকে আমাদের মাহফিলে অধিক লোকের সমাগম ঘটাতে হবে এবং বেশি জৌলুসপূর্ণ হতে হবে। তাই আয়োজক কমিটি ওয়ায়েজিন বা বক্তা আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে তেমন একটা বাছ-বিচার করেন না। আমন্ত্রিত বক্তা কি কুরআন ও সহীহ হাদীসের তা’লীম করবেন, না-কি শির্ক-বিদআত মিশ্রিত মাঠ জমানো আলোচনা করবেন- এটাও খতিয়ে দেখা হয় না। আবার যারা কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসারী তারাও মাঠ জমানোর উদ্দেশ্যে একই ভুল করছেন। তারা একবারও চিন্তা করছেন না যে, বক্তা সহীহ হাদীসভিত্তিক আলোচনা করলেও তিনি কি আপন স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে যাচ্ছেন? না-কি আহলে হাদীসগণের ঐতিহ্যবাহী ঐক্যের পথে আহ্বান জানাচ্ছেন? কেননা আজকাল অধিকাংশ বক্তা এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অতএব বক্তা আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রধানত দু’টি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে- (এক) বক্তা যেন কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক আলোচনা করেন, (দুই) বক্তা যেন এমন পেশাদার বক্তা না হোন, যারা ভাইয়ে-ভাইয়ে, পাড়ায়-পাড়ায় বিভাজন সৃষ্টি করে কৌশলে আপন স্বার্থ হাসিল করে থাকেন। আমরা এ শীত মৌসুমে কেবল দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে মাহফিলের আয়োজন করবো। যেখানে কোনোভাবেই যেন স্থান না পায় শির্ক-বিদআত ও অনৈক্যের বীজ বপনের সুযোগ।

তৃতীয়ত: আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমাদের দেশে এই শীতে বিবাহ-শাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিবাহ অনুষ্ঠান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হলেও ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলোÑ এ বিবাহ-শাদির মধ্যেও প্রবেশ করেছে বিদআতী ও অনৈসলামী কালচার। মুসলিম হয়েও বিবাহের ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মের রীতিকে বাঙালি সংস্কৃতি মনে করে আমরা এ বৈবাহিক পবিত্র বন্ধনকে অপবিত্র করছি। অতএব এ ক্ষেত্রেও আমরা সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করব। যাতে আমাদের বিবাহগুলো ইসলামের সঠিক রীতি অনুসারে উদ্যাপিত ও প্রতিপালিত হয়। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম বিপথগামী হবে তাতে সন্দেহ নেই।

চতুর্থত: এ মৌসুম মানব সেবার উর্বর ক্ষেত্রে। ছিন্নমূল অসহায় ও বয়োবৃদ্ধ অনেক আছেন, যারা শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার আকুতি করছেন। কিন্তু সামর্থ না থাকায় পেরে উঠছেন না। আবার কেউ কেউ প্রচণ্ড শীতে মারা যাচ্ছেন। এ সময়ে অসহায় শীতার্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের যার যা আছে, তা নিয়ে একাকি কিংবা সম্মিলিত উদ্যোগে এগিয়ে আসলে অসহায় মানুষেরা সামান্য হলেও উপকৃত হবে। আর তাদের দু‘আ আমাদের জীবন চলার পথে উদ্যমী হতে আগ্রহী করে তোলবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এ কাজটি কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে; কখনো যেন লোক দেখানো বা ফটোশেসন না হয়।

পরিশেষে আমাদের আহ্বান! এ শীত মৌসুম আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ নিয়ামত। অতএব এই দিনগুলোকে কেবল আনন্দ-উৎসব, ভ্রমণ-শিক্ষা সফর, পিঠা-উৎসব, হই-হুল্লোড়, বন-ভোজন ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে অনুকূল পরিবেশে বেশি বেশি নফল ‘ইবাদত-বন্দেগীর প্র্যাকটিস করি! মহান আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করি! এতে আমাদের ইহলৌকিক জীবন হবে শান্তিময় এবং পারলৌকিক জীবন হবে সমৃদ্ধ। আসুন! আল্লাহ তা‘আলার বিধান পালনে আমরা যথাসাধ্য যত্নবান হই! আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নেকীর কাজে পরস্পরকে এগিয়ে আসার তাওফীক্ব দিন Ñআমীন।



weeklyarafat


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:37:39 সূর্যাস্ত : 5:48:02

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত