সাময়িক প্রসঙ্গ
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান : একটি পর্যালোচনা
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট সোমবার, স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্ত মাড়িয়ে, শত শত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয় বাংলাদেশের সম্ভাবনার দুয়ারকে উন্মুক্ত করেছে। গণমানুষ ফিরে পেয়েছে তাদের বাকস্বাধীনতা। ঘটেছে জালিমের শাসনের সমাপ্তি। আবারও প্রমাণিত হয়েছে-দলীয়করণ, গুম-খুন নির্যাতন কিংবা গণহত্যা কোনো কিছুই বাংলার ছাত্র-জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে না।

সর্বস্তরের মানুষ এ বিজয়কে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা মনে করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মতো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী গণরোষের কবলে পড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। ফলে ঢাকাসহ সারা দেশ প্রায় পুলিশশূন্য, যা ইতিহাসের বিরল ঘটনা বললেও অতিশয়োক্তি হবে না। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা মাঠে ময়দানে কাজ করছেন। দিনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান এবং রাতে হানাদারদের কবল থেকে গৃহবাসীকে রক্ষা, সবই করছেন আমাদের কমলমতি শিক্ষার্থীরা। আমাদের পক্ষ থেকে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি রইল আন্তরিক ভালোবাসা ও দু‘আ।

আন্দোলনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কগণ যে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার্হ। তাদের পরামর্শে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করা হয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ মুহূর্তে ড. ইউনূসই একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি বলে প্রাজ্ঞমহলও মনে করছেন। কেননা একদিকে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা অপরদিকে বহির্দেশের শ্যেনদৃষ্টি মোকাবেলা, সবমিলিয়ে তাঁর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এছাড়াও যাঁদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে তাঁরাও সর্বজন স্বীকৃত সজ্জন ও কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আমরা নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে মহানমহিম মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের সাফল্যের প্রার্থনা করি।

ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে তা কোনো রাজনৈতিক দলের অর্জন না হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা ও সর্বাত্মক সমর্থন ছিল। এখন দলমত নির্বিশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং বহির্দেশের শ্যেনদৃষ্টি থেকে দেশেকে হিফাযত করা। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়া করা সমীচীন হবে বলে আমরা মনে করি না। তবে সাংবিধানিক সংকট যেন সৃষ্টি না হয় বর্তমান সরকারকে সে দিকেও নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, “দেশ ও জনগণের জন্যই সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ ও দেশ নয়।”

স্মর্তব্য যে, মহান আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী এই জগৎসংসারে পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটে। কোনো সভ্যতার উত্থান অথবা পতন সবই তাঁর অমোঘ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কোনোটিই এর ব্যতিক্রম নয়। একসময় যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, তাদের প্রস্থানে আরেক শ্রেণি এসে সে শূন্যতা পূরণ করেছেন। তবে কারো আগমন-প্রস্থান ঘটে সম্মানের সাথে; কারো বেলায় তার ব্যতিক্রম, অপমান ও লাঞ্ছনা তাদেরকে গ্রাস করে। করো প্রস্থানে মানুষ ব্যথিত হয়, আবার কারো প্রস্থানে হয় উল্লাসিত। এ বৈচিত্রতা দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা এ জগৎসংসারকে সাজিয়েছেন।

সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ তা‘আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য-শাসনভার দেন। যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, আবার যাকে ইচ্ছা অপদস্ত করেন। যাবতীয় কল্যাণ তারই হাতে! তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিলকিস রাজ্য শাসন করছিল; কিন্তু হুদহুদ পাখি তা অপছন্দ করল। সুলাইমান (আ.)-কে অবিষ্মরনীয় রাজত্ব পেয়েছিলেন। রাণী বিলকিস তাঁর দাওয়াত পেয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন শাসনভার ন্যস্ত করেন। তদরূপ সর্বপ্রকার নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ইউসুফ (আ.)-কে আল্লাহ তা‘আলা রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠান করলেন। নমরূদের নির্মম পতন আর ইব্রা-হীম (আ.)-এর আবুল ‘আম্বিয়াহ্ হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে দেদীপ্যমান। স্বৈরশাসক ফিরআঊনের সলিলসমাধি এবং মূসা ও হারুন (আ.)-সহ বানী ইস্রা-ঈলের পরিত্রাণ। আবূ লাহাব, আবূ জাহালগণদের মর্মান্তিক পরিণতি ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহা বিজয়-এ সব মহান আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন। তবে আল্লাহ তা‘আলা কোনো জাতির পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না সে জাতি তার পরিবর্তনের চেষ্টা করে।

আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের ছাত্র-জনতার প্রচেষ্টায় ৫ আগস্ট, সোমবার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন স্বাধীনতার অভূতপূর্ব আমেজ আস্বাদন করলাম। সর্বপ্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। আবূ সাঈদ-সহ অসংখ্য ছাত্র-জনতা, এমনকি শিশু-কিশোরও এ আন্দোলনে প্রাণ হারায়। দেশের মানুষের মনের গভীরে থাকা ধূমায়িত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। নতুন বিপ্লবের এ পর্যায়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। যারা ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন। আর যারা অমুসলিম তাদেরকে তাঁর বিধান অনুযায়ী পারিতৌষিক প্রদান করুন -আমীন। 



weeklyarafat


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত