সাময়িক প্রসঙ্গ
বিত্তের কাছে নৈতিকতার পরাজয়
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন

মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণিকের পৃথিবীর মায়াজালে জড়িয়ে মানুষ নানাবিধ কর্মচাঞ্চল্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ভুলেই যায় যে, এই ক্ষণিকের জীবন সাঙ্গ হলেই তাকে অনন্ত জীবনের পথে পাড়ি জমাতে হবে। দুনিয়াবি জীবনের সমৃদ্ধি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভব, ঐশ্বর্য-মহিমা করায়ত্তের নেশায় মানুষ আজ পাগলপারা। এ জগতে যার যত বেশি বিত্ত-বৈভব, তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদা ততো বেশি। সর্বক্ষেত্রে তার মূল্যায়ন। কী পারিবারিক অঙ্গনে, কী সামাজিক অঙ্গনে। মানুষ চরকির মতো তার পিছনে ঘোরে। তাই তো অধিকাংশ মানুষ আজ নীতি-নৈতিকতা ও বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে অর্থ-সম্পদ উপার্জন ও অধিগতকরণে চরমভাবে আসক্ত। সৃষ্টির সেরা জীব আজ বিত্তের দাসত্বে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে নীতি-সততা, বিদ্যা-বিবেক ও ন্যায়মার্গ বড্ড অসহায়ত্ব বোধ করছে। অর্থের কাছে সভ্যতা পরাজিত। বিত্তের কাছে মানবতা নির্জিত। ঐশ্বর্যের কাছে আদর্শ বশীভূত। প্রতিপত্তির কাছে বিবেক পরাভূত। বলা যায়-নৈতিকতা আজ অথৈ ঢেউয়ে ভাসমান খড়কুটোর মতো অথবা ধূসর মুরুর বুকে তৃষ্ণার্ত চাতকসদৃশ।

মানবজীবনে অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বৈধ উপায়ে বিত্তবান হওয়া দোষের নয়। কিন্তু মনুষ্যত্ব ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে, বিত্তকে প্রভুর আসনে বসিয়ে, স্বকীয়তা ও ব্যক্তিত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে আপন সত্তাকে দাসত্বের বন্দিশালায় শৃঙ্খলিত করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এসবই সভ্যতার পরিপন্থী।

আমরা নৈতিকতার কথা বলি, সভ্যতার চর্চা করি, সততার আবৃত্তি করি, ন্যায়ের অনুশীলনের উপদেশ দিই। কিন্তু এগুলোর সাথে বাস্তবতা যোজন যোজন দূরে। “কাজির গোরু কিতাবে আছে গোশালায় নেই” এই প্রবাদবাক্য সত্যিই যথার্থ। কেননা, আমরা মুখে যে বুলিই আওড়ায় না কেন, বিত্তের দাসত্ব আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ফলে বাহ্যিকদৃষ্টিতে সমৃদ্ধির সাগরে ভাসলেও চরম আধ্যাত্মিক সংকটে আমরা নিমজ্জিত। বাহ্যিক সৌন্দর্য ও চাকচিক্য বাড়লে সুখপাখিটা অন্তরিক্ষে ভাসে।

এ কথা চিরন্তন সত্য যে, দুনিয়ার জীবন নিতান্তই তুচ্ছ ও নগণ্য। অথচ আমরা এতটাই বোধশক্তিহীন হয়ে পড়েছি যে, ক্ষণিকের এই জীবনকে সাজাতে পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছি। সকলেই চাচ্ছি আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। সর্বক্ষেত্রেই যেন একধরনের যু্দ্ধংদেহি অবস্থা বিরাজ করছে। বাড়ছে যুল্ম-অত্যাচার, নির্যাতন-নিষ্পেষণ। রক্তাক্ত হচ্ছে জনপদ, বাড়ছে ধ্বংসযজ্ঞ। প্রাপ্তি শূন্য! সৃষ্টি হচ্ছে সভ্যতা ও মানবতার সংকট। এসবই করছি বিত্তের জন্য। কর্তৃত্বের জন্য। আপন স্বার্থ চরিতার্থের মানসে। অথচ আমরা ভুলতে বসেছি মহামহিম স্রষ্টার বাণী-

“আমি আল্লাহ অবশ্যই আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও জলে বিচরণ করার সক্ষমতা দিয়েছি। তাদেরকে পবিত্র রিযিক দিয়েছি আর আমি তাদেরকে আমার অধিকাংশ সৃষ্টির উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।”

আজ সর্বত্রই ইনসাফের সংকট। আল্লাহ তা‘আলা সামাজিক স্থিতিশিলতার জন্য ন্যায়-ইনসাফ, প্রতিটি কর্মে নিষ্ঠাবোধ ও নিকটাত্মীয়দের অধিকার নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর ফাহেশা, গর্হিত কাজ এবং সর্বপ্রকার সীমালঙ্ঘনকে সর্বোতভাবে নিষেধ করেছেন। বাস্তবে এ নির্দেশনার মধ্যেই প্রকৃত মনুষ্যত্ব ও বিবেকের জাগরণ ঘটানো হয়েছে। আজ তা প্রয়োগিক জীবনে প্রতিফল আবশ্যক। অথচ আমাদের সমাজে এখনো এমন কিছু মানুষ বেঁচে আছেন, যারা সত্যিকারার্থে শিষ্ট-সুশীল, বিনীত-বিনম্র মার্জিত-নীতিবান। সমাজে তাঁদের অবস্থান ম্রিয়মাণ মনে হলেও, তাঁদের কারণে জগৎ আজও করোজ্জ্বল। 



weeklyarafat


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত