সাময়িক প্রসঙ্গ
বিশিষ্ট মুহাক্কিক শায়খ ওযায়ের শামস (রাহিমাহুল্লাহ)
মুহাম্মাদ আরমান

ভূমিকা : মাওলানা মুহাম্মাদ উযায়ের শামস মুসলিম বিশ্বের একজন প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত মুহাক্কিক আলেমে দীন। তিনি জ্ঞান-গবেষণার সুমিষ্ট সাগরে অবগাহন করেছেন অত্যন্ত নীরবে-নিভৃতে। পড়াশুনা ও গবেষণাই ছিল তাঁর জীবন একমাত্র লক্ষ্য। জামিয়া সালাফিয়া বানারসে ছাত্রত্বকালীন বই পড়া ও গবেষণার যে নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তা অটুট ছিল। মাস্টার্স ও ডক্টরেট পর্যায়ে তিনি প্রতিদিন প্রায় দুইশত পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করতেন বলে জানা যায়। তীক্ষ্ণ ধী-শক্তির অধিকারী এই গবেষক তার মেধা, গভীর অধ্যবসায় ও বৈদগ্ধ্যের মাধ্যমে মাখতুতাত বা পাণ্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ হিসেবে গবেষণার জগতে নিজের মজবুত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রাহি.)-এর মাখতুতাত বা পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার; এক্ষেত্রে তিনি সফলও ছিলেন। এজন্য আরব শাইখরা শাইখ উযায়েরকে গুরু জানতেন। [১]

জন্ম : মুহাম্মাদ উযায়ের বিন শামসুল হক বিন রিযাউল্লাহ ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সালেহডাঙ্গায় এক সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা শামসুল হক সালাফী (১৯১৫-১৯৮৬) ভারতের অন্যতম খ্যাতিমান আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি জামিয়া সালাফিয়া বানারসের দ্বিতীয় শাইখুল হাদীস ছিলেন। শাইখ উযায়েরের বাবা ছিলেন উর্দুভাষী। কিন্তু মা ছিলেন মুর্শিদাবাদের বাঙালি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েল সাবেক প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মুজিবর রহমানের নিকটাত্মীয়। শাইখ উযায়ের বাংলা বলতে পারলেও বাংলা বর্ণ চিনতেন না। [২]

শিক্ষাজীবন : ১৯৬৬ সালে মাদ্রাসা ফাইযে আম, মৌ-এ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। সেখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর বিহারের প্রখ্যাত আহলে হাদীস মাদ্রাসা দারভাঙ্গায় অবস্থিত “দারুল উলুম আহমাদিয়া আস-সালাফিয়্যাহ”-তে ভর্তি হয়ে আরবি শিক্ষা শুরু করেন। পরের বছর তার পিতার ইস্তফার কারণে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গায় অবস্থিত “দারুল হাদীস মাদ্রাসা”-তে তিনি দোসরি জামা‘আত শেষ করেন। অতঃপর জামিয়া সালাফিয়া বানারসের শাইখুল হাদীস মাওলানা আযাদ রহমানী যখন তার পিতাকে পুনরায় বানারসে ডেকে পাঠান, তখন ১৯৬৯ সালে জামিয়া রহমানিয়া বেনারসে তেসরি জামা‘আত থেকে চৌথি জামা‘আত পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর তিনি আলিমিয়্যাত-এর ৪ বছর এবং ফাযিলিয়্যাতের ২ বছর মারকাযী দারুল উলুম খ্যাত “জামিয়া সালাফিয়া বানারাস” থেকে ১৯৭৬ সালে ফারেগ হন। অতঃপর তিনি ১৯৭৮ সালে মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা অনুষদে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে তিনি হাজারের মধ্যে ৯৯৬ মার্কস পেয়ে অনার্স শেষ করেন। এরপর তিনি মক্কা শহরে অবস্থিত “উম্মুল কুরা” বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৮৫ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। এমফিলে তার থিসিসের বিষয় ছিল : التأثير العربي في شعر حالي ونقده “হালির কবিতায় আরবীয় প্রভাব ও তার সমালোচনা”। পি. এইচ. ডি-তে তার গবেষণার শিরোনাম ছিল : الشعر العربي في الهند دراسة نقدية “ভারতে আরবি কবিতা : একটি পর্যালোচনা”। ১৯৯০ সালে থিসিস জমাদানের সময় সুপারভাইজারের সাথে তার মতোবিরোধের কারণে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ থেকে বঞ্চিত হন। এভাবেই তার শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। [৩] 

ওস্তাদবৃন্দ : দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে তিনি জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করেছেন। হিন্দুস্তানী শিক্ষকগণের মধ্যে অন্যতম হলেন তার সম্মানিত পিতা শামসুল হক সালাফি। তার নিকটে তিনি মুয়াত্তা মালিক, সহীহুল বুখারীসহ অন্যান্য কিতাব অধ্যয়ন করেন।

 শাইখ মুহাম্মাদ রঈস নদভী (তার নিকটে জামে‘ আত্ তিরমিযী পড়েছেন)।  মুহাম্মাদ ইদরীস রহমানী (তার নিকটে সহীহ মুসলিমের ১ম খণ্ড পড়েছেন)।  শায়েখ আব্দুল মুঈদ বানারসী (তার নিকটে সুনান আন্ নাসায়ী পড়েছেন)।  শাইখ আব্দুস সালাম রহমানী (তার নিকটে বুলুগুল মারাম পড়েছেন)।  শাইখ সফিউর রহমান মুবারকপুরী।  আব্দুস সালাম মাদানী।  আব্দুন নূর নদভী।  আব্দুল ওয়াহিদ রাহমানী (তার নিকটে সহীহ মুসলিমের ২য় খণ্ড পড়েছেন)।  আইনুল হক সালাফী (চাচা) (তার নিকটে নাহু-সরফ পড়েছেন)।  শাইখ আবিদ হাসান রহমানী (তার নিকটে সুনান আবূ দাঊদ পড়েছেন)।  শাইখ আব্দুস সালাম বাসাউয়ী।  শায়েখ আব্দুস সালাম ত্বীবী (তার নিকটে মিশকা-তুল মাসা-বীহ প্রথম খণ্ড পড়েছেন)। [৪]

ইযাযতকারী শাইখগণ :  তার সম্মানিত পিতা শাইখ শামসুল হক সালাফী।  শাইখ আবু মুহাম্মাদ আলিমুদ্দীন (রাহি.) বাংলাদেশী। [৫]

লেখনীসমূহ:  হায়াতুল মুহাদ্দিস শামসুল হক ওয়া আসারুহু (বানারস, হিন্দ থেকে প্রকাশিত)।  হায়াতুল মুহাদ্দিস শামসুল হক (উর্দু) (করাচী থেকে প্রকাশিত)।  ই‘লামু আহলাল হাদীস ফিল হিন্দ (উর্দু) (অপ্রকাশিত)।  মুআল্লিফাত ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম। [৬]

তাহ্ক্বীক্বসমূহ:  রাফউল ইলতিবাস আন বা‘দান নাস লি আযীমাবাদী।  গয়াতুল মাকসুদ ফি শারহু সুনান আবূ দাঊদ লি আযীমাবাদী (১ম খণ্ড)।  মাজমাআ‘তুল ফাতাওয়া লি শাইখ আযীমাবাদী (উর্দু-ফার্সি)।  রুদ্দুল ইশরাক লি শাহ ইসমাঈল শহীদ দেহলভী।  জুস ফি ইসতিদরাক উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ্ (রাহি.) আলাস সাহাবা লি আবি মনসুর আল বাগদাদী।  মাজমাআ‘তু রাসায়েল লি ইমাম ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (অপ্রকাশিত)।  আল জামিউ লি সিরাতি শাইখুল ইসলাম ইবনি তাইমিয়্যাহ্।  জামিউল মাসায়েল (৬ খণ্ড) তার জীবনের অন্যতম কীর্তি।

এছাড়াও তিনি কিছু কিতাব আরবি থেকে উর্দুতে অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন উর্দু এবং আরব বিশ্বের বিভিন্ন আরবি পত্রিকাতে। তার কলম ছিল সৈনিকী কলম, যা দিয়ে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

মনীষীদের প্রশংসায় শাইখ উযায়ের (রাহি.): রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ও চেয়ারম্যান এবং শাইখ (রাহি.)’র ক্লাসমেট (উম্মুল কুরা) প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, উযায়ের উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেখানে হাজারের মধ্যে ৯৯৬ মার্কস পেয়ে আরবি সাহিত্যের উপর অনার্স সম্পন্ন করেন। মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমাদের পাঠ্যে আব্দুল কাহের জুরজানীর বিখ্যাত গ্রন্থ اسرار البلاغة ونظم القران الكريم পড়েছিলাম। শিক্ষক ছিলেন মিশরের ড. আহমাদ মাক্কী আল আনসারী। জটিল কঠিন ইবারত, এক পর্যায়ে ওস্তাযের সাথে উযায়ের দ্বিমত পোষণ করেন, ওস্তায পড়া বন্ধ করে চলে গেলেন, পরদিন সকালে ওস্তায হাসিমুখে এসে বললেন, আমি গতকাল ভুল বলেছিলাম,

كنت غلتان تعال يا عزير انا أفتخر بل فوقك ههنا اشار الى صفحة مذكورته اليومية.

আহমাদ মাক্কী আল আনসারী জামে‘ আযহারের একজন ব্যাকারণ বিশেষজ্ঞ, তার বাপ-দাদা সাত পুরুষ জামে‘ আযহারের ব্যাকারণবিদ, অথচ তিনি ছাত্রের কাছে ভুল স্বীকার করে নিজ ডায়রি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এসো এতে (ডায়রি) একটা স্বাক্ষর করো, আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করি, ভবিষ্যতে তুমি একজন স্মরণীয় ও খ্যাতিমান ব্যক্তি হবে। [৭]

শাইখ (রাহি.)’র খ্যাতিমান সহপাঠীগণ :  রিযাউল্লাহ মুবারকপুরী, বিশিষ্ট মুহাক্কিক আলেম।  শেখ সালাউদ্দিন মাকবুল আহমাদ, লেখক।  বদরুজ্জামান মুহাম্মাদ শফিক নেপালী। [৮]

মৃত্যু ও দাফন : শাইখ উযায়ের শামস ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর ‘ইশার সালাতের পর হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ১৬ অক্টোবর বাদ ফজর মাসজিদুল হারামে জানাযা শেষে তাঁকে মক্কার মু‘আল্লা কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, শাইখ উযায়ের (রাহি.) ছিলেন খ্যতিমান একজন মুহাক্কিক। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ ও ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম আল—জাওযিয়া বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ ( )’র হাতের লেখা নাকি বেশ জটিল ছিল। তার হস্তলেখা বুঝা ও উদ্ধার করা সবার জন্য ছিল অত্যন্ত জটিল। কিন্তু এ কাজে আল্লামা উযাইর শামস ছিলেন পারদর্শী।

তার শুধু প্রতিটি গ্রন্থের নাম, লেখকের নাম, লেখকের মৃত্যুসাল মুখস্থ ছিল না; বরং প্রতিটি কিতাবের মধ্যকার আলোচনা প্রায় মুখস্থ থাকতো। তাই তার ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির কথা উপযুক্ত যিনি তাকে ‘জীবন্ত গ্রন্থাগার’ বলেছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশের কিবারুল উলামার অন্যতম একজন ছিলেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাকার বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য ছিল অতুলনীয়। তার কিছু ইন্টারভিউ দেখেছি এবং বিস্মিত হয়েছি। সেগুলোতে প্রতিটি ছাত্রের জন্য বিশাল খোরাক রয়েছে।

বর্তমান আহলে হাদীস আলেমদের মধ্যে এমন ধারার বিদগ্ধ গবেষক আর নেই বললে মোটেই ভুল হবে না। এই প্রখ্যাত মুহাক্কিককে আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন জান্নাতুল ফেরদাঊসে স্থান দিয়ে সম্মানিত করুন আমীন। 



« wk¶v_©x, `viæj û`v Bmjvgx Kg‡cø·, ivRkvnx|

[1] G†KGg kvgmyj Avjg m¨v‡ii UvBgjvBb †_‡K 16 A‡±veiÕ22|

[2]gvKZvevZzk& kvwgjvn&; G†KGg kvgmyj Avjg m¨v‡ii UvBgjvBb †_‡K|

[3]gvKZvevZzk& kvwgjvn&; mv¶vrKvi : gvwmK gynvwÏm †g, 2016 evbvim, fviZ|

[4] gvKZvevZzk& kvwgjvn&|

[5] gvKZvevZzk& kvwgjvn&|

[6] gvKZvevZzk& kvwgjvn&|

[7]¯§…wZPviY : cÖ‡dmi G†KGg kvgmyj Avjg m¨v‡ii UvBgjvBb †_‡K|

[8] gvKZvevZzk& kvwgjvn&|


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত