সাময়িক প্রসঙ্গ
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার সুস্পষ্ট নিদর্শন সাফা ও মারওয়া
আব্দুল মোহাইমেন সা'আদ

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত সুস্পষ্ট দু’টি নিদর্শন হলো সাফা ও মারওয়া নামের দু’টি পাহাড়। যা সৌদি আরবের মক্কা নগরীর মসজিদ আল-হারাম সংলগ্ন অবস্থিত। এই পাহাড়দ্বয় হজ্জ ও ‘উমরার সাথে সম্পর্কিত। হজ্জ ও ‘উমরার অংশ হিসেবে এই পাহাড় দু’টির মাঝে সাতবার সাঈ‘ বা আসা-যাওয়া করতে হয়। হজ্জ ও ‘উমরায় হাজী সাহেবদের জন্য সাফা-মারওয়া সাঈ‘ করা ফরজ।

ইতিহাস : কুরআন থেকে যতদূর জানা যায় আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা ইব্রাহীম ('আ.)-কে কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষার মুখোমুখি করেছিলেন তার মধ্যে ইসমা‘ঈল ('আ.)-এর জন্ম গ্রহণের পর এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো তাঁকে। পরীক্ষাটি ছিলো আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার আদেশে স্ত্রী হাজেরা এবং প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে সিরিয়া থেকে মক্কার মরুভূমিতে রেখে যেতে হয়েছিল একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে স্বল্প পরিমাণ পানি দিয়ে। তখন মক্কা ছিল নির্জন ধু ধু মরুপ্রান্তর। এটি ছিল এমন একটি উপত্যকা, যেখানে মানুষ তো দূরের কথা কোনো পশু-পাখিরও অস্তিত্ব ছিল না। তখন স্ত্রী হাজেরা ইব্রাহীম ('আ.)-কে চিৎকার করে বলেন, হে ইব্রা-হীম! আপনি আমাদের কার কাছে রেখে যাচ্ছেন? এমন এক ময়দানে, যেখানে না আছে কোনো সাহায্যকারী না আছে পানাহারের কোনো বস্তু। তিনি বার বার এ কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু ইব্রাহীম ('আ.) সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। তখন হাজেরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন? ইব্রাহীম ('আ.) জবাব দিলেন, হ্যাঁ। একথা শুনে হাজেরা বললেন আমি মহান আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। আপনি তাহলে যান। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের ধ্বংস ও বরবাদ করবেন না। তারপর হাজেরা ফিরে আসলেন। ইব্রাহীম ('আ.)-ও নিজ গৃহ অভিমুখে ফিরে চললেন। ইসমা‘ঈলের মা বিবি হাজেরা ইসমা‘ঈলকে বুকের দুধ খাওয়াতেন আর নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। পরিশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তখন তিনি নিজেও তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তার শিশুপুত্রটিও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন হাজেরা! অস্থির হয়ে তিনি ছুটে চলেন পাহাড়ের দিকে। একবার সাফা পাহাড়ে আরোহণ করেন, আবার সেখান থেকে নেমে আসেন। আর ফিরে দেখেন নিজের কলিজার টুকরা শিশু ইসমা‘ঈল এখনো বেঁচে আছেন কি না? ঢালুতে এলেই কলিজার টুকরা তাঁর চোখের আড়াল হয়ে যেত, তাই তিনি দৌড়ে পার হন, আর আরোহণ করেন মারওয়ায়। এভাবে তিনি সাতবার দৌড়ান। হাজেরা যখন নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন, তখন মহান আল্লাহর রহমত নাযিল হলো। জিবরীল ('আ.) আগমন করলেন এবং শুষ্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার কাছে হাজেরার এই দৌড় এতটাই পছন্দ হয়েছে যে হজ্জ ও ‘উমরায় সাফা-মারওয়া সাঈ‘ করা র্ফয করে দিয়েছেন। (এ ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যেই সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাতবার দৌড়ানো কিয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য হজ্জের বিধি-বিধানে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে)। সীরাত-ই মুহাম্মদ বিন ইশাক নামক গ্রন্থে রয়েছে যে সাফা পাহাড়ের উপর আসাফের এবং মারওয়া পাহাড়ের উপর নায়েলার মূর্তি ছিল। তাদের একজন পুরুষ লোক ও অপরজন স্ত্রীলোক ছিল। এই অসৎ ও অসতী দু’জন কাবা গৃহে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা তাদের পাথরে পরিণত করেন। কুরাইশরা তাদের কা’বার বাইরে রেখে দেয় যেন জনগণ এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষ তাদের পূজা করতে আরাম্ভ করে এবং তাদের সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে এনে দাঁড় করিয়ে তাদের তাওয়াফ শুরু করে। তাই ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে মদিনার আনসারেরা সাফা-মারওয়া সাঈ‘ দূষণীয় মনে করত। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে সাফা-মারওয়ার দোষ-এর কথা জিজ্ঞেস করলে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আয়াত নাযিল করে বলেন সাফা-মারওয়া সাঈয়ে কোনো দোষ নেই অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) সাফা-মারওয়া সাঈ‘ করেছেন।


অবস্থান : ‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত কা’বার নিকটবর্তী দু’টি ছোট পাহাড়ের নাম। যা যথাক্রমে বৃহত্তর আবূ কুবাইস এবং কাইকান পর্বতগুলোর সাথে সংযুক্ত। কা’বার উত্তর-পূর্ব কোণে মাতাফ বা কা’বা চত্বর ঘেঁষেই সাফা পাহাড়ের অবস্থান। সাফা পাহাড় কা’বা ঘর থেকে প্রায় ১০০ মি. (৩৩০ ফুট) দূরে অবস্থিত। মারওয়া কা’বা থেকে ৩৫০ মি. (১১৫০ ফুট) দূরে অবস্থিত। সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী দূরত্ব ৩০০ মি. (৯৮০ ফুট)।
কুরআনে সাফা-মারওয়ার উল্লেখ : আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা পবিত্র কুরআনে সাফা-মারওয়াকে হজ্জ ও ‘উমরায় সাঈ করতে বলেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন-
﴿إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللهَ شَاكِرٌ عَلِيْمٌ﴾
“নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে বাইতুল্লাহর হজ্জ করবে কিংবা ‘উমরাহ্ করবে তার কোনো অপরাধ হবে না যে, সে এগুলোর সা’ঈ করবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কল্যাণ করবে, তবে নিশ্চয় শোকরকারী, সর্বজ্ঞ।” (সূরা আল বাক্বারাহ্ : ১৫৮)
হাদীসে সাফা-মারওয়ার উল্লেখ : সাফা-মারওয়ার ব্যাপারে অনেক হাদীস সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ (ﷺ) كَانَ إِذَا طَافَ فِيْ الْحَجِّ أَوْ الْعُمْرَةِ أَوَّلَ مَا يَقْدَمُ سَعَى ثَلَاثَةَ أَطْوَافٍ وَمَشَى أَرْبَعَةً ثُمَّ سَجَدَ سَجْدَتَيْنِ ثُمَّ يَطُوْفُ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ.
‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) মক্ক্য়া উপনীত হয়ে হজ্জ বা ‘উমরাহ্ উভয় অবস্থায় সর্বপ্রথম যে তাওয়াফ করতেন, তার প্রথম তিন চক্করে রামল করতেন এবং পরবর্তী চার চক্করে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলতেন। তাওয়াফ শেষে দু’রাকআত সালাত আদায় করে সাফা ও মারওয়ায় সা‘ঈ করতেন। (বুখারী- হা. ১৬১৬)


আমাদের জন্য শিক্ষা : আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার প্রতি হাজেরার বিশ্বাস থেকে আমাদের এই শিক্ষা গ্রহণ করা যে, অনুকূল-প্রতিকূল যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সাহায্য করতে পারেন ধারণাতীত জায়গা থেকে এবং মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার পাশাপাশি নিজেও চেষ্টা করা ও উপায় অবলম্বন করা। যেমন হাজেরা-এর পানি শেষ হয়ে গেলে আপাতদৃষ্টিতে তখন কোনো উপায় ছিল না তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি বসে না থেকে ধু ধু মরুপ্রান্তরে চেষ্টা করে ছিলেন। আর আল্লাহ সুবহ্া-নাহু তা’আলাও পানির ব্যবস্থা করে দিয়ে ছিলেন। 


সাপ্তাহিক আরাফাতঃ বর্ষ : ৬৪, সংখ্যা : ৩৭-৩৮


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:59:35 সূর্যাস্ত : 5:27:01

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত