সাময়িক প্রসঙ্গ
সদাচরণ মানবতার মহিমা
শাইখ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অমীয় বাণী-
عَن جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ : ্রلَا يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لَا يَرْحَمُ النَّاسَ
অর্থ : জারীর ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির উপর দয়া করেন না, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না।1
হাদীসের শব্দার্থসমূহ- لَا يَرْحَمُ -দয়া করেন না বা দয়া করবেন না। النَّاسَ -মানুষের প্রতি।
রাবী পরিচিতি : জারীর ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আনহু), জালীলুল কদর একজন সাহাবী। তাঁর কুনিয়াত ছিল আবূ ‘আম্র। তিনি অত্যন্ত সুঠামদেহী ও সুশ্রী ছিলেন। ‘উমার ইবনু খাত্তাব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) তাকে এই উম্মাতের ইউসুফ বলতেন। জারীর ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু)-কে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বেশ সম্মান দিতেন। তাঁর বুকে হাত দিয়ে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দু‘আ করেছেন-
اللهم ثَبِّتْهُ وَاجَعَلْهُ هَادِ يًا مَهْدِيَّا.
হে আল্লাহ! তাঁকে সুদৃঢ় রাখুন। তাকে সঠিক পথের দিশাদানকারী এবং সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। ফুরাত সন্নীকটবর্তী কিরমি সিয়াতে ৫১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।2
হাদীসের মূল ভাষ্য : মানবতা আজ চরম নিষ্ঠুর ও অসদাচারী হয়ে পড়েছে। সবারই আবার মহান স্রষ্টা আল্লাহর সন্তোষভাজন হওয়ারও অভিপ্রায়। নিষ্ঠুরতা আর অমানবিকতা দিয়ে কেউ কখনো আল্লাহ তা‘আলাকে পেতে পারে না। মহান আল্লাহর রহমত ও দয়া আর নি‘আমত লাভ করতে হলে সকলকে মানবিক, দয়াদ্রচিত্ত, সদাচারী এবং দয়া-মায়াশীল হতে হবে।
হাদীসের বিশ্লেষণ :
্রلَا يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لَا يَرْحَمُ النَّاسَগ্ধ.
“আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির উপর দয়া করেন না, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না।”
সদাচরণ, দয়া ও অনুকম্পা মহান আল্লাহর রহমতের অংশ বিশেষ। এ সবের মাধ্যমে মহান আল্লাহর রহমত পাওয়া সহজ হয় এবং হাতের নাগালে পাওয়া সম্ভবপর হয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
(إِنَّ رَحْمَتَ اللهِ قَرِيْبٌ مِنَ الْمُحْسِنِيْنَ)
“আল্লাহর ‘ইবাদতে সৎ কর্মশীল, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সদাচারী ও রহমত দিল এবং সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়াদ্রচিত্তগণ।”3
দয়াহীনতা, পাষ-তা ও নিষ্ঠুরতা প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহর গযব। মায়া-মমতা, দয়াদ্রচিত্ততা এবং সদাচরণ মহান আল্লাহর বিরাট দানস্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদরের কন্যা যয়নাব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু)’র কন্যা শৈশবে মৃত্যু বরণ করল, যাকে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অশেষ স্নেহ করতেন, কোলে নিতেন এবং আদর করতেন। তার মৃত্যুতে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তখন সা‘দ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) বলেন,
্রمَا هَذَا يَا رَسُوْلَ اللهِ؟গ্ধ.
“এটা কী, হে আল্লাহর রাসূল!? মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
্রهَذِهِ رَحْمَةٌ جَعَلَهَا اللهُ فِيْ قُلُوْبِ عِبَادِهِ، وَإِنَّمَا يَرْحَمُ اللهُ مِنْ عِبَادِهِ الرُّحَمَاءَগ্ধ.
“এটি মহান আল্লাহর রহমত যা আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের অন্তরে বর্ষন করেন, আর আল্লাহ তা‘আলা তার দয়ার্দ্রচিত্ত বান্দাদেরকে দয়া করেন।”
মহান আল্লাহর বান্দা-বান্দীদের প্রতি সদাচারী ও দয়াদ্রচিত্ত। পরোপকারিতার প্রচেষ্টাকে ইসলামে সুমহান ‘আমলে সালেহ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন,
্রالسَّاعِيْ عَلٰى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِيْنِ كَالسَّاعِيْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِগ্ধ وَأَحْسَبُهُ قَالَ : ্রكَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لَا يفْطرগ্ধ.
“বিধবা ও মিসকীনদের দেখাশুনাকারী মহান আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো। রাবী বলেন, আমার ধারণা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটাও বলেছেন : রাত্রি জাগরণকারীর ন্যায় যে অলসতা করে না এবং ঐ সিয়াম পালনকারীর ন্যায় যে সিয়াম ছাড়ে না।”4
হাদীসের অর্থের সামগ্রিকতা : আলোচ্য হাদীসে নববীতে যে রহমতের কথা বলা হয়েছে তা দয়া, করুণা, সদাচরণ সকল অর্থে এবং সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইবনু বাত্তাল (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, হাদীসটিতে গোটা সৃষ্টি তথা মু’মিন, কাফির, জীব, জন্তু, দাস-দাসী এবং অন্যান্য সকলের প্রতি রহমত বা দয়ার বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং দয়ার মধ্যে রয়েছে খাবার ও পানীয় দানের বিষয়, বোঝা কমিয়ে দেয়া, প্রহার না করা ইত্যাদী।5
মানবতার সেবা আর সৃষ্টিকুলের প্রতি সদয় হওয়ার মধ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োজিত থাকা মহান আল্লাহকে লাভ করার বিরাট মাধ্যম। আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন :
্রإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ : يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِيْ، قَالَ : يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُوْدُكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ، قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِيْ فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِيْ عِنْدَهُ؟ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِيْ، قَالَ : يَا رَبِّ وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ، قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِيْ فُلَانٌ، فَلَمْ تُطْعِمْهُ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذٰلِكَ عِنْدِيْ، يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ، فَلَمْ تَسْقِنِيْ، قَالَ : يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيْكَ؟ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ، قَالَ : اسْتَسْقَاكَ عَبْدِيْ فُلَانٌ فَلَمْ تَسْقِهِ، أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذٰلِكَ عِنْدِيْগ্ধ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, আমার সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে রব! আপনি জগৎসমূহের প্রভু, কেমন করে আপনার সেবা আমি করব? আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, অমুক বান্দাহ আমার অসুস্থ হয়েছিল, তার সেবা করলেই সেথায় আমাকে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম, আমাকে তুমি খাদ্য দাওনি। বান্দা বলবে, হে রব! কিভাবে তোমাকে খাওয়াব, তুমি যে জগৎসমূহের প্রতিপালক? আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, তাকে খাওয়া তথায় আমাকে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পান করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে পান করাওনি। বান্দা বলবে, হে রব! তুমি জগৎসমূহের প্রতিপালক, তোমাকে কিভাবে পান করাব? আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পান করতে চেয়েছিল তাকে তুমি পান করাওনি, তাকে পান করালেই তথায় আমাকে পেতে।6
আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক সৎ কর্মশীলগণকে বড় বেশী ভালোবাসেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদের সঙ্গে রয়েছেন।”7
দয়া-মায়ার বৃহৎ পরিসর থেকে বিশেষ পরিসরে ঈমানদারগণকে পরস্পর মমতার সুদৃঢ় বাঁধনে আবদ্ধ হতে হবে। মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই বন্ধনের কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন,
্রالْمُسْلِمُ أَخُوْ الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِيْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ اللهُ فِيْ حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِগ্ধ.
“এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই, সে তার উপর যুল্ম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজনে সাহায্য করবে মহান আল্লাহ তা‘আলা তার প্রয়োজনে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন।”8
সুতরাং প্রতিটি ব্যক্তিকে মানবতার শ্রেষ্ঠ সবক দয়া-মায়া ও মানবতাবোধের আঁকড় হওয়া উচিত। ইহসান তথা সদাচরণের ব্যাপক বাস্তবায়নে মানুষ হিসেবে আমাদের অগ্রণী ভূমিকা চাই। সদাচরণ মানবতার মহিমা হওয়া উচিত।
হাদীসের শিক্ষা :
মহান আল্লাহর অনুকম্পা পেতে আমাদের সদয় ও সদাচারী হতে হবে।
সদাচরণকারীগণ দুনিয়া ও আখিরাতে মহান আল্লাহর বড় নিকটবর্তী।
সদাচরণ ও দয়া-মায়া দিয়ে পৃথিবীকে শান্তির নিবাস উপহার দেয়া সম্ভব।
নিঃস্ব ও অসহায় মানবতার প্রয়োজন পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়া সুহৃদ ও মহানুভব ব্যক্তির কাজ।
সদাচারী হওয়া ও দয়াদ্রচিত্ত হওয়া মানবতার মহান মুকুট।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ইহসানকামী, দয়া-মায়ার উপমা আর সদাচারিতায় অগ্রগামী হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন।

1 সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম, মিশকাত- হাঃ ৪৯৪৭।
2 উসদুল গাবাহ- ২/১০৪।
3 সূরাতুল আ‘রাফ : ৫৬।
4 বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত- ৪৭৩৪, মাঃ শাঃ, ৪৯৫১।
5 ফাতহুল বারী- ১০/৪৫৫।
6 সহীহ মুসলিম- হাঃ ২৫৬৯।
7 সূরা আল ‘আনকাবূত : ৬৯।
8 সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম, মিশকাত- হাঃ ৪৯৫৮।

আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:59:35 সূর্যাস্ত : 5:27:01

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত