বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে বা মনুষ্য সৃষ্ট কঠিন বর্জ্য পদার্থ বা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ঘনত্ব বায়ুতে যদি স্বাভাবিক অনুপাতের কম বা বেশি হয় তখনই বায়ু দূষিত হয়ে পড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অনিষ্টকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতি করে তখনই বায়ুদূষণ হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাব প্রকট।
বায়ুদূষণের ফলে মানুষকে তিলে তিলে অসুস্থ করে তোলে। বায়ুদূষণের সবচাইতে ভয়ঙ্কর বার্তা হলো মানুষের মৃত্যু। ইতিপূর্বে বিশ্বের মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণের নির্মম প্রভাব ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল গার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টের প্রতিবেদনে দেখা যায়। সেখানে বায়ুদূষণ মৃত্যুর চার নম্বর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মোতাবেক এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দারা বায়ুদুষণের প্রধান শিকার। সংস্থাটির সাথে গড়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া সীমার ১০ গুণের বেশি।
আমরা নিজেদের উন্নতির যতই ঢাকঢাল পিটাই না কেন, আমাদের নিত্যদিনের স্বাস্থ্য সমাচার তা ভুল প্রমাণ করছে। মাত্র ক’দিন আগে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদনে পরিষ্কার বলা হয়েছে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭০তম গরীব দেশ। দেশের গরিবিহাল দিনে দিনে অসহনীয় রূপ নিচ্ছে। বায়ুদূষণের মতো মারাত্মক পরিস্থিতি সামলানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত নির্গত ধোয়া, বন ধ্বংস ও প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার দূষণ ব্যবস্থাকে ভয়াবহ করে তুলেছে। ১ টাকার চকলেট থেকে শুরু করে লাখ টাকার রেফ্রিজাটার পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশের মুখকে ক্রমাগত বিমর্ষ করে চলেছে। দূষিত হচ্ছে বায়ু। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে, মাটির নিচে চাপা পড়া পলিথিন বা প্লাস্টিক পচনের সময়কাল ৪০০ থেকে ৫০০ বছর। অন্যদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন শুধু ঢাকা শহরে ২ কোটি পলিথিন বিক্রি হচ্ছে। এর অধিকাংশই মাটির নিচে স্থান পায়। এগুলো মাটির কৈশিক ছিদ্রকে অচল করে দেয়। ফলে উপযুক্ত পানির অভাবে গাছ পরিবেশকে অক্সিজেনের পরিবর্তে কার্বন মনোক্সাইড দিতে বাধ্য হচ্ছে, যেটা রক্তের লোহিত কণিকার সাথে মিশে যায়। ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, যা-মৃত্যুর কারণ। অতিসম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন যে, দেশীয় প্রায় প্রতিটি মাছে প্রচুর পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। এসব মাছ খাওয়ার ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত আন্ত্রিক ও কিডনি জটিলতা জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একটা গবেষণায় মাতৃদুগ্ধেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। যা শিশুরা পান করে নানা অকাল দৈহিক জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে।
পলিথিন যে, মানবজাতির জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতি উপাদান তা আমরা ভুলতে বসেছি। গবেষণার ফল অনুসারে, প্লাস্টিক বা পলিথিনে গরম পানি বা গরম খাবার রাখলে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ‘বিসফেলন-এ’ তৈরি হয়, যা থাইরয়েড হরমোনকে বাধা দেয়। বাধাগ্রস্ত হয় মস্তিষ্কের গঠন। এছাড়া গর্ভবতী নারীদের রক্ত থেকে বিসফেনল—এ যায় ভ্রƒনে আসে। এতে নষ্ট হতে পারে ভ্রƒণ, দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব। শিশুও হতে পারে বিকলাঙ্গ।
বাংলাদেশে প্রচুর মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে চলেছে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম ১০টি কারণের একটি কিন্তু প্লাস্টিকের ব্যবহার। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে পলিথিন ব্যাগকে চর্মরোগের এজেন্ট বলা হয়। পলিথিনে মাছ, মাংস মুড়িয়ে রাখলে কিছুক্ষণ পর এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়ে উঠে। পলিথিনকে সুদৃশ্য করার জন্য রং ব্যবহার করা হয়। রং করার জন্য ব্যবহৃত ক্যাডিয়াম মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। প্লাষ্টিকের বহুল ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মফস্বলের হাটে—বাজারে, মেলায় কিংবা শহরের যত্রতত্র পলিথিনের ব্যবহার ও প্রক্ষেপণ বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। বায়ুদূষণের কারণে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা কিন্তু বিশ্বের প্রথম সারিতে এসে গেছে। বায়ুদূষণের কারণে অ্যাজমা, নিউমোনিয়ার মতো রোগী প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্রংকাইটিস, ফুসফুসে প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ। এতদ্ব্যতীত, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) সংক্রমনের মূল কারণ বায়ুদূষণ।
বায়ুদূষণের জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের নির্গত ধোয়া কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউটের (ইপিআইসি) এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশিরা গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছে। ইট ভাটার চিমনি ও গাড়ির ধেঁায়া পরিবেশ সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলছে। তথ্যানুযায়ী ঢাকার ১৬ লাখ গাড়ির মধ্যে ৫ লাখই তীব্র মাত্রায় বায়ুদূষণ করে থাকে। এসব কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِيْ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْ النَّاسِ لِيُذِيْقَهُمْ بَعْضَ الَّذِيْ عَمِلُوْا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ
“মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে; ফলে তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।” ৫৪
এ অবস্থার উত্তরণ প্রয়োজন। অন্যথায় ক্রমাগতভাবে এ অবস্থা চলতে থাকলে বাঙালিরা ব্যাধিগ্রস্ত জাতিতে পরিণত হবে। কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন এখনই সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সদাশয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ভাইস০প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস; প্রফেসর ও ডিন, স্কুল অব আর্টস, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
৫৪.সূরা আর্ রূম : ৪১।
অর্থাৎ-স্থলে, জলে তথা সারা বিশ্বে মানুষের কুকর্মের বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বিপর্যয়’ বলে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলীর প্রাচুর্য, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি আপদ-বিপদ বুঝানো হয়েছে। (সা’দী, কুরতুবী, বাগভী) অন্য এক আয়াতে এই বিষয়বস্তু এভাবে বর্ণিত হয়েছেÑ
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيْبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْكُمْ وَيَعْفُوْ عَنْ كَثِيْرٍ
“তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে। অনেক গুনাহ তো আল্লাহ ক্ষমাই করে দেন।” (সূরা আশ্ শূরা-:৩০)
উদ্দেশ্য এই যে, এই দুনিয়ায় বিপদাপদের সত্যিকার কারণ তোমাদের গুনাহ; যদিও দুনিয়াতে এসব গুনাহের পুরোপুরি প্রতিফল দেয়া হয় না এবং প্রত্যেক গুনাহর কারণেই বিপদ আসে না; বরং অনেক গুনাহ তো ক্ষমা করে দেয়া হয়। তবে এটা সত্য যে, সমস্ত গুনাহর কারণে বিপদ আসে না; বরং কোনো কোনো গুনাহর কারণেই বিপদ আসে। দুনিয়াতে প্রত্যেক গুনাহর কারণে বিপদ আসলে একটি মানুষও পৃথিবীতে বেঁচে থাকত না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى
“আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোনো জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন।” (সূরা আন্ নাহ্ল : ৬১) আল্লাহ আরো বলেন,
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوْا مَا تَرَكَ عَلٰى ظَهْرِهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى
“আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে ভূ-পৃষ্ঠে কোনো জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন।” (সূরা ফা-ত্বির : ৪৫) বরং অনেক গুনাহ তো আল্লাহ তা‘আলা মাফই করে দেন। যেগুলো মাফ করেন না, সেগুলোরও পুরোপুরি শাস্তি দুনিয়াতে দেন না; বরং সামান্য স্বাদ আস্বাদন করান।
ক্বাতাদাহ্ বলেন, এটা আল্লাহ কর্তৃক মুহাম্মদ (ﷺ)-কে রাসূল হিসেবে পাঠানোর আগের অবস্থার বর্ণনা। যখন যমীন ভ্রষ্টতা ও অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তারপর আল্লাহ যখন তাঁর নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-কে পাঠালেন, তখন মানুষের মধ্যে যারা ফিরে আসার তারা ফিরে আসলো। (তাবারী) [দ্র. কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর)- পৃ. ২০৯৯-২১০০।]
আপনার মন্তব্য