আল কুরআনুল হাকীম
কুরবানী আত্মত্যাগের এক অনুপম দৃষ্টান্ত
আবূ সা‘আদ আব্দুল মোমেন বিন আব্দুস্ সামাদ
আল্লাহ তা‘আলার বাণী
﴿وَاتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَلَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ ؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ ؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ﴾
সরল বাংলায় আনুবাদ
“আর তুমি তাদের কাছে যথাযথভাবে আদমের দুই ছেলের বর্ণনা করো, যখন তারা দু’জনে কুরবানী পেশ করলো। অতঃপর তাদের একজনের কুরবানী গ্রহণ করা হলো আর অন্য জনের কুরবানী গ্রহণ করা হলো না। সে (যার কুরবানী কবুল হলো না) বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে (যার কুরবানী কবুল হয়েছিল) হত্যা করবো। সে বলল, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের থেকে (কুরবানী) গ্রহণ করেন।”[১]
শাব্দিক অনুবাদ
وَ—আর/এবং,اُتۡلُ —তুমি বর্ণনা করো,عَلَیۡهِمۡ —তাদের কাছে, نَبَاَ—সংবাদ, ابۡنَیۡ اٰدَمَ—আদম সন্তানের,بِالۡحَقِّ —যথাযথভাবে/সঠিকভাবে, اِذۡ—যখন, قَرَّبَا—তারা দু’জনে নিকটবর্তী হলো, قُرۡبَانًا—কুরবানীর, فَتُقُبِّلَ—কবুল করা হয়েছিল, مِنۡ—হতে/থেকে, اَحَدِهِمَا—তাদের একজনের, وَ—আর/এবং,لَمۡ یُتَقَبَّلۡ —কবুল করা হয়নি, مِنَ—হতে/থেকে, الۡاٰخَرِ—অন্যজন, قَالَ—সে বলল, لَاَقۡتُلَنَّکَ —অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করবো, قَالَ—সে বলল, اِنَّمَا—নিশ্চয় যা,یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ—আল্লাহ কবুল করেন, مِنْ—হতে/থেকে, الۡمُتَّقِیۡنَ—মুত্তাক্বী/আল্লাহভীরু।
বিষয়বস্তু ও অবতরণের প্রেক্ষাপট
দরসে বর্ণিত আয়াতটি সূরা আল মায়িদাহ্’র ২৭ নং আয়াত। সূরা আল মায়িদাহ্ কুরআনুল কারীমের পাঁচ নম্বর সূরা। এই সূরার ১৫নং রুকুর ১১২নং আয়াতে উল্লেখিত مَائِدَةً শব্দটি থেকে এই সূরাটির নাম করণ করা হয়েছে। অধিকাংশ সূরার নামের মতো এই সূরার নামের সাথেও এর বিষয়বস্তুর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। নিছক অন্যান্য সূরা থেকে আলাদা করার জন্য একে এ নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্ণনার ধারাবাহিকতা থেকে বুঝা যায় এই সূরাটি একটি মাত্র ভাষণের অন্তর্ভুক্ত এবং সম্পূর্ণ সূরাটি একই সংগে নাযিল হয়েছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষের দিকে অথবা ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে সূরাটি নাযিল হয়। হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা এর সত্যতা প্রমাণ করে। এই সূরায় মুসলমানদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিধি—বিধানসহ হজ্জ সফরের রীতি—নীতি ও পানাহার দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যে হালাল—হারামের চূড়ান্ত সীমা নির্ধারিত হয়। এই সূরায় আহলে কিতাবদের সাথে পানাহার ও তাদের মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি প্রদানসহ ওযূ, গোসল ও তায়াম্মুম করার রীতি—পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টি এবং চুরি—ডাকাতির শাস্তি ও সাক্ষ্য প্রদানের আরো কয়েকটি ধারাসহ কসম ভাঙার কাফ্ফারার বিষয়ে আলোচ্য সূরায় আলোচিত হয়।
আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীর
﴿وَاتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ﴾
“আদম (‘আ.)—এর পুত্রদ্বয়ের ঘটনা তুমি তাদের কাছে যথাযথভাবে বর্ণনা করো।”
আল্লাহ তা‘আলার এই বর্ণনা থেকে বুঝা যায় আদম (‘আ.) পুত্রদ্বয়ের ঘটনা তৎকালীন সময়ে মানুষের কাছে বিকৃতভাবে প্রচার হয়েছিল। কুরআন কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয় যে, সে অতীতের কোনো ঘটনাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করবে। তবে অতীতের কোনো বিকৃত ঘটনার প্রকৃতরূপ কিংবা যে ঘটনার মাঝে যতটুকুতে মানুষের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে মানুষের প্রয়োজনে ততটুকু ঘটনা কুরআন বর্ণনা করেছে। আদম (‘আ.)—এর পুত্রদ্বয়ের কাহিনীটিও এই বিজ্ঞ রীতির ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে।
তৎকালীন সময়ে সমাজে প্রচলিত ঘটনাটির বিকৃতরূপ
বাইবেলের জেনেসিসের চার নম্বর অধ্যায়ের বর্ণনা অনুসারে আদম (‘আ.) তাঁর স্ত্রীর কাছে গেলে সে গর্ভবতী হয় এবং তারপর কেইন (কাবীলের) জন্ম হয়। কেইন ছিল কৃষক। তখন সে বলল, ঈশ্বর (আল্লাহ) আমাকে একটি পুত্র সন্তান দিয়েছে। তারপর কেইন (কাবীলের) ভাই এবেল (হাবীলের) জন্ম হয়। আর এই এবেল (হাবীল) ভেড়া—বকরি চরাত। কেইন তার ভাই এবেলকে মাঠে নিয়ে হত্যা করে। এরফলে সদাপ্রভূ তাকে বলে তুমি যেই জমিই চাষ করো না কেন তাতে ফসল ফলবে না। তুমি পলাতক হয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে। তখন কেইন সদাপ্রভুর কাছে আরজ করলো- পৃথিবীতে যে আমাকে দেখবে সে আমাকে হত্যা করবে। তখন সদাপ্রভু বলল, পৃথিবীতে যে তোমাকে হত্যা করবে তার উপর সাতগুণ প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এরপর সদাপ্রভু তার উপর একটি চিহ্নের ব্যবস্থা করে দেন যাতে মানুষজন তাকে চিনতে না পারে। তারপর সে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বাইবেলের এই বর্ণনাটি যথাযথ নয়। তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে- কাবিলকে অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। সে এডেনের পূর্ব দিকে অবস্থিত নুদ অঞ্চলে বসবাস করে যাকে তারা ‘কান্নীম’ নামে চিনে। অন্য এক বর্ণনায় দামেশকের উত্তর সীমান্তে কাসিউন পাহাড়ের সন্নিকটে একটি বধ্যভূমি রয়েছে বলে কথিত আছে এই স্থানটিকে মাগারাতুদ দাম বলা হয়ে থাকে সেখানেই কাবিল তার ভাই হবিলকে খুন করেছিল।
ঘটনাটির প্রকৃতরূপ : যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো অন্য জনের কুরবানী কবুল হলো না। যার কুরবানী কবুল হলো না সে বলল- আমি তোমাকে হত্যা করবই। অন্য জন বলল- আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাক্বীদের কুরবানী কবুল করেন। আমাকে হত্যার জন্য আমার প্রতি তুমি হাত বাড়ালেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত বাড়াব না। আমি বিশ্বজাহানের প্রভু মহান আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করে জাহান্নামী হও আর এটাই যালিমদের কর্মফল। তারপর তার প্রবৃত্তি তাকে তার ভাইকে হত্যায় প্ররোচিত করল এবং সে তাকে হত্যা করল ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো। তারপর আল্লাহ তা‘আলা একটি কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের লাশ কিভাবে গোপন করা যায় তা দেখানোর জন্য মাটি খঁুড়তে লাগলো। সে বলল হায়! আমি কি এই কাকটির মতো হতে পারলাম না যাতে আমি আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি। অতঃপর সে অনুতপ্ত হলো।[২]
বর্তমানে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হাবীল ও কাবীলের ঘটনা : হাবীল ও কাবীলের মধ্যে সুশ্রী বোনকে বিয়ে করার জন্য যে দ্বন্দ্ব হয় তারই যের ধরে তাদের মধ্যে হত্যাকান্ড সংঘঠিত হওয়ার যে ঘটনা প্রচলিত আছে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহের কোথাও সে ঘটনার অস্তিত্ব নেই। সেই ঘটনাটি এসেছে ইয়াহুদীদের কিংবদন্তী “Legends of the Jews”—এর Volume 1:3 থেকে। ধারণা করা হয় ইহুদী পণ্ডিত কা‘ব আল—আহবার (যে পরবর্তীতে মুসলিম হয়েছিল) তার থেকে ঘটনাটি নকল করা হয়েছে।
সুদ্দী (রহ্.) ইবনু ‘আব্বাস ও ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.)—সহ কতিপয় সাহাবী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আদম (‘আ.) এক গর্ভের পুত্র সন্তানের সঙ্গী অন্য গর্ভের কন্যা সন্তানের বিয়ে দিতেন। হাবীল সে মতে কাবীলের যমজ বোনকে বিয়ে করতে চাইলে কাবীল তা অস্বীকার করে সে তার যমজ বোনকে বিয়ে করতে চাইল। কারণ তার যমজ বোনটি ছিল অত্যাধিক রূপসী। আদম (‘আ.) হাবীলের সাথে কাবীলের যমজ বোনকে বিয়ে দিতে চাইলে কাবীল তা অগ্রাহ্য করলো। ফলে আদম (‘আ.) তাদের দু’জনকে কুরবানী করতে আদেশ করলেন।[৩]
ইবনু কাসীর বলেন যে, আদম পুত্রদ্বয়ের কুরবানী বিশেষ কোনো কারণ বশে ছিল না বা কোনো নারীঘটিত বিষয় এর মধ্যে জড়িত ছিল না। কুরআনের প্রকাশ্য অর্থ দ্বারা এই কথাই স্পষ্ট হয় যে, ভ্রাতৃ হত্যার কারণ ছিল ে¯্রফ এই হিংসা বশতঃ যে, হাবীলের কুরবানী কবুল হয়েছিল, কিন্তু কাবীলের কুরবানী কবুল হয়নি।[৪]
﴿اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَلَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ﴾
“তারা (আদমের দুই পুত্র হাবীল ও কাবীল) যখন কুরবানী পেশ করল তাদের একজনের কুরবানী গ্রহণ করা হলো অন্যজনের কুরবানী গৃহীত হলো না।”
কাবীল [আদম (‘আ.)—এর বড় সন্তান] ছিল একজন কৃষক সে কৃষি কাজ করত। কার্পণ্যের বশে সে তার উৎপাদিত নিকৃষ্ট ও নিম্নমানের এক বোঝা শস্য কুরবানীর জন্য পেশ করলো। আর হাবীল ভেড়া—বকরি চড়াত। মহান আল্লাহকে ভালোবেসে তাঁর নৈকট্য লাভের আশায় সে তার বকরি পাল হতে মোটা—তাজা ও পছন্দনীয় একটি ভেড়া/বকরি কুরবানী করলো।
উল্লেখ্য যে, সে যুগে কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন ছিল এই যে, আসমান থেকে একটি আগুন এসে কুরবানী নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানীকে উক্ত আগুন গ্রহণ করত না, সে কুরবানীকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো।
আকাশ থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানীটি গ্রাস করলো আর কাবীলের কুরবানীটি এমনিতেই পড়ে রইল। এতে বুঝা গেলো হাবীলের কুরবানী আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করেছেন। ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) বলেন- হাবীলের কুরবানী দেওয়া এই পশুটিই পরবর্তীতে ইব্রাহীম (রাযি.) কর্তৃক ইসমা‘ঈলকে কুরবানীর বিনিময় হিসেবে জান্নাত থেকে পাঠানো হয়। আর ঐদিকে কাবীলের কুরবানী আগুন গ্রাস করেনি বলে বুঝা গেলো তার কুরবানী কবুল হয়নি। এতে কাবীল ক্ষুব্ধ হলো। তাই সে তার ভাই হাবীলকে লক্ষ্য করে বললো- لَاَقۡتُلَنَّکَ অর্থাৎ— আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব[৫]।
﴿قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ﴾
“সে বলল- নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বী বান্দাদের কুরবানী কবুল করেন।”
এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, তাক্বওয়া অর্জন কুরবানী কবুলের পূর্ব শর্ত। কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা মূলতঃ তাক্বওয়ার পরীক্ষাই নেন। যেমন— আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন-
﴿لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰکِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡؕ﴾
“আল্লাহর কাছে পেঁৗছে না এগুলোর গোশ্ত ও রক্ত; বরং তার কাছে পেঁৗছে তোমাদের তাক্বওয়া। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আম্র (রাযি.) বলেন- আল্লাহর কসম! তাদের দুইজনের মধ্যে নিহত লোকটি—ই (অর্থাৎ— কাবীল) অধিকতর শক্তিশালী ছিল। তারপরও সে তার ভাই হাবীলকে উপদেশ দিয়ে মার্জিত ভাষায় বলল- “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াশীল বান্দাদের থেকে (কুরবানী) কবুল করে থাকেন। তারপরও যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও, তবুও আমি তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হব না। কেননা, আমি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।[৬]
কুরবানীর বিধান
আলোচ্য আয়াতে আদম (রাযি.)—এর দুই পুত্রের কুরবানীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনুল কারীমের ৩৭ নং সূরা (সূরা আস্ সা—ফ্ফা—ত)—এর ১০২—১০৯ নং আয়াতে ইব্রাহীম (‘আ.) কর্তৃক ইসমাঈল (‘আ.)—কে কুরবানীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ২২ নং সূরা (সূরা আল হজ্জ)—এর ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেন-
﴿وَ لِکُلِّ اُمَّۃٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا﴾
অর্থাৎ— “আর প্রত্যেক উম্মাতের জন্য আমি কুরবানী নির্ধারণ করেছি।”
তাছাড়া মৌলিকভাবে কুরবানীর বিধান রয়েছে- ২ নং সূরা আল বাক্বারাহ্—র ১৯৬ নং আয়াতে। রয়েছে- ৪৮ নং সূরা ফাত্হ—র ২৫ নং আয়াতে ও ৬ নং সূরা আল আন‘আম—এর ১৬১—১৬৩ নং আয়াতে। রয়েছে- সূরা আল কাউসার—এর ২ নং আয়াতে। এই বর্ণনাগুলো থেকে এই কথা স্পষ্ট হয় যে, কুরবানীর বিধান প্রত্যেক জাতির উপরেই অর্পিত হয়েছিল। শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)—এর উম্মাতের উপরেও এই বিধান আবশ্যিক তথা ওয়াজিব। কারো কারো মতে কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। কুরবানী সুন্নাত না ওয়াজিব এ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও কুরবানী করতে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন এতে কারো দ্বিমত নেই। মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে একমত যে, কুরবানী কুরআন—সুন্নাহর নির্দেশ ও মুসলিমদের পালনীয় একটি ‘ইবাদত।
কুরবানীর সংজ্ঞা
ফার্সি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত قُرۡبَانِي শব্দটি আরবী قرب মূলধাতু থেকে নির্গত, যার অর্থ হচ্ছে নৈকট্য। তাই আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের জন্য শরিয়তসম্মত পন্থায় আদায়কৃত বান্দার যে কোনো ‘আমলকে আভিধানিক দিক থেকে ‘কুরবানী’ বলা যেতে পারে। হোক সেটা যবেহকৃত বা অন্য কোনো দান—খয়রাত (ইমাম রাগিব)। তাফসীরে মাযহারীর বর্ণনা মতে, মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নযর—মান্নত রূপে যা পেশ করা হয় তাকে বলা হয় ‘কুরবানী’। ইমাম আবূ বক্র জাস্সাস (*) বলেন, মহান আল্লাহর রহমতের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কৃত প্রত্যেক নেক ‘আমলকে ‘কুরবানী’ বলা হয়। তবে প্রচলিত অর্থে এই উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করাকে বলা হয় কুরবানী। কুরবানীর সমর্থক শব্দ ‘উযহিয়া, ‘নাহর’।
গুরুত্ব ও তাৎপর্য
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক বছর কুরবানী দিতেন। এই কুরবানীর যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। ‘ওয়াফাউল ওয়াফা’ ও ‘কিতাবুল ফিকাহ্ আলাল্ মাযাহিবিল আরবাআ’ নামক কিতাবদ্বয়ে রয়েছে রাসূল (সা.) ঈদের নামায আদায় করেন এবং এরপর কুরবানী করেন। ইবনুল আসীর লিখিত ‘তারিখুল কামিল’ গ্রন্থে দ্বিতীয় হিজরীর ঘটনাবলী বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়- রাসূল (সা.) ‘বনী কায়নুকা’ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করলে কুরবানীর সময় উপস্থিত হয়। তাই তিনি ঈদগাহের দিকে গমন করেন এবং মুসলমানদের নিয়ে ঈদুল আযহার নামায আদায় করেন। আর এটিই ছিল মাদানী যুগের প্রথম কুরবানীর ঈদ। অতঃপর তিনি দু’টি ছাগল, অন্য বর্ণনা মতে একটি ছাগল কুরবানী করেন। আর এটিই ছিল তাঁর প্রথম কুরবানী। এরপর কোনো বছর তিনি কুরবানী থেকে বিরত থাকেননি। তিনি তাঁর কর্ম দ্বারা জাতিকে কুরবানী করতে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ১০ বছর মদীনায় অবস্থান করেছেন। মদীনায় অবস্থানকালীন প্রত্যেক বছরই তিনি কুরবানী করেছেন।[৭] যায়েদ ইবনু আরকাম (রাযি.) বর্ণনা করেন, সাহাবায়ে কিরাম একদিন নবীজি (সা.)—কে জিজ্ঞাসা করলেন- কুরবানী কি? তিনি (সা.) উত্তরে বললেন, এটি তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (‘আ.)—এর সুন্নাত (রীতিনীতি)। তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হলো এতে আমাদের জন্য কি রয়েছে? নবীজি (সা.) বললেন- কুরবানীর জন্তুর প্রতিটি লোমের পরিবর্তে একটি করে নেকী রয়েছে। এই হাদীস থেকে একথা বুঝা যায় যে, কুরবানী অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্যপুর্ণ একটি ‘ইবাদত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পদ ব্যয় করে, স্বার্থ ত্যাগ করে এই কুরবানী করতে হয়। কুরবানীর পর পরিবার ও দরিদ্রজনের মাঝে কুরবানীর পশুর গোশ্ত বণ্টন করা হয় এবং আত্মীয়—স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য হাদিয়া ও উপঢৌকন পাঠানো হয়। কুরবানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর আনুগত্যের প্রকাশ ঘটে। কুরবানী দ্বীন ইসলামের নিদর্শন এবং প্রতীক। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ (রহ্.) বলেন- কুরবানী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ এবং সমস্ত মুসলিম জাতির একটি ‘আমল। সুতরাং কুরবানী কুরবানীই এর বিকল্প নেই। কেউ যদি কুরবানী না করে সমপরিমাণ সম্পদ সাদাক্বাহ্ করে তাতে তার কুরবানীর হক্ব আদায় হবে না। যদি তা বৈধ বা উত্তম হতো তাহলে নিশ্চয় তাঁরা (পূর্ববর্তীগণ) তার ব্যতিক্রম করতেন না।[৮]
কুরবানী কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত
শুধু কুরবানীই নয়; বরং প্রত্যেকটি ‘ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত প্রধানত দু’টি। যথা-
(১) ইখলাস : কারো মনোরঞ্জন বা প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য নয় ‘ইবাদতটি হবে ে¯্রফ মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿قُلْ إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ﴾
“তুমি বলে দাও- আমার নামায, আমার সকল ‘ইবাদত, (কুরবানী ও হজ্জ) আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্যে।”[৯]
মহান আল্লাহর ভয়ও থাকতে হবে তার সঙ্গে যাকে বলে তাক্বওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰکِنۡ یَّنَالُهُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡؕ﴾
“আল্লাহর কাছে পেঁৗছে না এগুলোর গোশ্ত ও রক্ত; বরং তার কাছে পেঁৗছে তোমাদের তাক্বওয়া।”[১০]
(২) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ ও অনুকরণে কুরবানী সংক্রান্ত শরিয়তের সকল নিয়ম-কানুন মেনে কুরবানী করতে হবে। তাহলেই কুরবানী কবুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের শিক্ষা
(১) আদাম (‘আ.)-এর সময়েও কুরবানীর প্রচলন ছিল যার কারণে কাবীল ও হাবীল কুরবানী করেছে।
(২) কাবীল কর্তৃক হাবীলকে হত্যার কাহিনীর মধ্যে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায় প্ররোচিত হওয়ার ও তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার প্রমাণ নিহিত রয়েছে।
(৩) মুত্তাক্বী ব্যক্তিগণ কখনো অন্যায়ের পাল্টা অন্যায় করেন না; বরং মহান আল্লাহর উপর ভরসা করেন। মহান আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকেন। দুনিয়ার দুঃখ—কষ্টকে মহান আল্লাহর পরীক্ষা মনে করেন এবং এতে ধৈর্য ধারণ করেন।
(৪) আল্লাহভীরু ব্যক্তিগণ সাধারণতঃ বিনয়ী ও মার্জিত আচরণের অধিকারী হয়।
(৫) আল্লাহ তা‘আলা কেবল মুত্তাক্বীদের কর্মগুলোই কবুল করেন।
[১] সূরা আল মায়িদাহ্ : ২৭।
[২] সূরা আল মায়িদাহ্ : ২৭—৩১।
[৩] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- প্রথম খণ্ড, পৃ. ২১৭।
[৪] তাফসীরে ইবনু কাসীর।
[৫] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া- প্রথম খণ্ড, পৃ. ২১৭।
[৬] সূরা আল মায়িদাহ্ : ২৭-২৮।
[৭] মুসনাদে আহমাদ; জামে‘ আত্ তিরমিযী।
[৮] ফাতাওয়ায়ে ইবনু তাইমিয়্যাহ্।
[৯] সূরা আল আন’আম : ১৬২।
[১০] সূরা আল হাজ্জ : ৩৭।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য