সাময়িক প্রসঙ্গ
নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর দরূদ পাঠের ফযীলত
হারুনুর রশীদ ত্রিশালী
খতীব : শাইখ ড. আব্দুল্লাহ আল বুয়াইজান
১৯ জুন- ২০২০ শুক্রবার প্রদত্ত খুতবার বঙ্গানুবাদ
প্রথম খুতবাহ্
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য; যিনি আসমানী রিসালাতের ইতি টেনেছেন আমাদের শরী‘আত ইসলাম ধর্ম দিয়ে, নাবী ও রাসূলের ধারা শেষ করেছেন আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে প্রেরণ করার মাধ্যমে এবং আমাদের এই জাতিকে করেছেন জমিনের বুকে সর্বোত্তম মধ্যমপন্থী জাতি।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই; তিনি এক, তার কোনো অংশীদার নেই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি ও চয়ন করেন। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দা ও মনোনীত রাসূল, উচ্চ বংশীয় শ্রেষ্ঠ মানব।
তিনি সত্য নাবী, সত্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনিই সৃষ্টির সেরা এবং উত্তম চরিত্র ও গঠন বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ।
তিনি নিজের উপর অর্পিত আমানত আদায় করেছেন, উম্মাতকে নসিহত করেছেন এবং মৃত্যু অবধি মহান আল্লাহর পথে যথাযথভাবে জিহাদ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর, তাঁর পরিবার, সকল সাহাবী এবং ক্বিয়ামত অবধি তাদের সত্যনিষ্ঠ অনুসারীদের উপর রহমত বর্ষণ করুন।
অতঃপর : সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে মহান আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পথ। আর সর্বনিকৃষ্ট কাজ হলো দ্বীনের মাঝে বিদ‘আত করা, আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, সকল ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু বরণ করো।”
হে মুসলিমবৃন্দ! আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশ্তা ও মানুষের মধ্য থেকে রাসূল নির্বাচিত করেন। তিনি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ বংশ হতে মনোনীত করেছেন এবং সকল মানুষের উপর তাকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তার আদর্শকে করেছেন সকল ভাল কাজ ও কল্যাণের মানদণ্ড। তিনি বিভ্রান্ত ও বিপথগামী নন। আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না, যা বলেন তা কেবল ওয়াহী, যা তার প্রতি ওয়াহীরূপে প্রেরিত হয়। তাকে শিক্ষা প্রদান করেছেন প্রচণ্ড শক্তিশালী, সৌন্দর্য্যপূর্ণ সত্তা। অতঃপর তিনি স্থির হয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাধ্যমে মানবজাতিকে শিরক, অজ্ঞতা ও অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে উদ্ধার করেছেন। নৈতিক অবক্ষয়, বিকৃত রুচি, যুল্ম-নির্যাতন, পাপাচারিতা ও বিচ্ছিন্নবাদিতা হতে রক্ষা করেছেন। ফলে তিনি আমাদের হিদায়াত, মুক্তি ও মঙ্গলের জন্য চরম হিতাকাঙ্খী ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদের যে দুঃখ-কষ্ট হয়ে থাকে তা তার জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মু’মিনদের প্রতি করুণাশীল ও অতি দয়ালু।”
‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনু ‘আস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : “একদা রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কুরআনে ইব্রা-হীম (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর দু‘আ সম্বলিত আয়াত : “হে আমার রব! এ সকল প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত।” তিলাওয়াত করলেন। আর ‘ঈসা (‘আলাইহিস্ সালাম) বলেন : “তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করো তবে তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” তারপর তিনি তার উভয় হাত উঠালেন এবং বললেন : “হে আল্লাহ! আমার উম্মাত, আমার উম্মাত!” আর কেঁদে ফেললেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন : হে জিবরীল! তুমি মুহাম্মাদের কাছে যাও এবং তাকে বলো, নিশ্চয় আমি (আল্লাহ) আপনার উম্মাতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিব, আপনাকে অসন্তুষ্ট করব না।”[১]
আর জাবির (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “আমার উপমা ও তোমাদের উপমা সে লোকের উপমার ন্যায় যে আগুন প্রজ্জলিত করল, আর ফরিং ও পতঙ্গ তাতে ঝাপিয়ে পড়তে লাগল, আর সে লোক তাদেরকে তা থেকে বিতাড়িত করতে লাগল। আমিও তোমাদেরকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমর ধরে টানছি, কিন্তু তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ।”[২]
উম্মাতের জন্য তার হিতাকাঙ্খার অন্যতম নমুনা হলো যে, তিনি তাদের জন্য সেই ক্বিয়ামতের দিনে বিশেষ একটি দু‘আ বরাদ্দ রেখেছেন, যেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে, পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের থেকে, সেদিন তাদের প্রত্যেকের হবে এমন গুরুতর অবস্থা যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে। এ মর্মে আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “প্রত্যেক নাবীরই একটি করে দু‘আ আছে যা কবুল হয়। আর আমি আমার উক্ত দু‘আ (ক্বিয়ামতের দিন) আমার উম্মাতের শাফা‘আতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি। ইন্শা-আল্লাহ- সেই দু‘আটি সে ব্যক্তিই পাবে যে মহান আল্লাহর সাথে শিরক না করে মৃত্যুবরণ করবে।”[৩]
আল্লাহর বান্দাগণ! যারা আমাদের প্রতি ইহসান করেন তাদেরকে তার প্রতিদান দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন : “ইহসানের প্রতিদান ইহসান ছাড়া আর কী হতে পারে?” রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “যে ব্যক্তি তোমাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে তোমরা তার উত্তম প্রতিদান দাও।”
জেনে রাখুন যে, আমাদের উপর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অন্যতম হক্ব হলো, তিনি যে আমাদের উপর ইহসান ও সদ্ব্যবহার করেছেন তার প্রতিদান দেয়া, তার উপর বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করা। কেননা তার উপর দরুদ পাঠ হচ্ছে নাজাতের অন্যতম বড় ওয়াসীলা, উত্তম ‘ইবাদত, উৎকৃষ্ট ‘আমল, সময়কে কাজে লাগানোর শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এর মাধ্যমে বহুগুণ সওয়াব বৃদ্ধি পায়, সম্মান বাড়ে, গুনাহ মোচন করা হয়, দুশ্চিন্তা ও বিপদাপদ দূরীভূত হয় এবং মহান আল্লাহর পক্ষ হতে দশবার রহমত নাযিল হয়। হাদীসে এসেছে- রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : “যে কোনো বান্দা আমার নাম স্মরণ করে আমার উপর দরুদ পাঠ করবে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য দশটি নেকী লিপিবদ্ধ করবেন, তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করবেন এবং তার দশ মর্তবা সম্মান বৃদ্ধি করবেন।”[৪]
আর উবাই ইবনু কা’ব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি বললাম : “হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো খুব অধিক হারে আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করি। আপনার প্রতি দরুদ পাঠের জন্য আমি আমার সময়ের কতটুকু খরচ করব? তিনি বললেন : তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা করো। আমি বললাম : এক চতুর্থাংশ সময়? তিনি বললেন : তোমার ইচ্ছা, তবে এর চেয়ে বেশি করলে তোমারই মঙ্গল হবে। আমি বললাম : তাহলে আমি কি অর্ধেক সময় দরুদ পাঠ করব? তিনি বললেন : তোমার ইচ্ছা, তবে এর চেয়েও বেশি করলে তোমারই মঙ্গল হবে। আমি বললাম : তাহলে আমি কি দুই তৃতীয়াংশ সময় দরুদ পাঠ করব? তিনি বললেন : তোমার ইচ্ছা, তবে এর চেয়েও বেশি করলে তোমারই মঙ্গল হবে। আমি বললাম : তাহলে আমার পুরো সময়টাই আপনার প্রতি দরুদ পাঠে কাটিয়ে দিব? তিনি বললেন : “তাহলে তো (এ কাজ) তোমার দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য যথেষ্ট হবে এবং তোমার পাপকে মোচন করা হবে।”[৫]
হে মুসলিমবৃন্দ! নিশ্চয়ই মানুষদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হচ্ছেন মহান আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত বান্দা। তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনা, আনুগত্য করা, মুহব্বত করা ও যিক্র করাকে তার [মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)] প্রতি ঈমান আনা, আনুগত্য করা, মুহব্বত করা ও স্মরণ করার সাথে সংযুক্ত করেছেন।
তাওহীদের সাক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে ইসলামের নিদর্শন, ঈমানের ঠিকানা, নিরাপত্তার প্রতীক, আযানের বাক্য; যা মুয়াজ্জিনগণ প্রতিদিন বারবার উচ্চারণ করে বলেন : “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।” আর ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না এই উভয় শাহাদাতের স্বীকৃতি দেয়া হবে।
ফলে মহান আল্লাহর বিধান, আমাদের কর্তব্য ও আমাদের নাজাতের আকাঙ্খার ভিত্তিতে আমাদের উপর আবশ্যক হলো যেনো নাবীর মুহব্বত, সম্মান, ভালবাসা, সুন্নাতের অনুসরণে অন্তরসমূহ পরিপূর্ণ থাকে।
জেনে রাখুন যে, তাঁর প্রতি মুহব্বত, তাঁর হক্ব ও সুন্নাত আদায় এবং তাঁর আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে তার প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “নিশ্চয়ই আল্লাহ নাবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশ্তাগণ নাবীর জন্য দু‘আ-ইস্তিগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নাবীর উপর সালাত পাঠ করো এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।”
অতএব হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা বেশি বেশি করে রাসূলের উপর দরুদ পাঠ করুন এবং তা পাঠের মাধ্যমে মুখ ও জিহ্বাকে সিক্ত করুন।
আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর দরুদ পাঠের জন্য বিশাল প্রতিদান রেখেছেন, বহুগুণ সওয়াব রেখেছেন, দরুদ পাঠকারীকে সম্মানিত করবেন। এ মর্মে আবূ ত্বালহা আনসারী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সকালে প্রসন্ন হৃদয়ে দেখা গেল, তাঁর চেহারায় আনন্দানুভূতি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তারা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আজকে আপনাকে আনন্দিত দেখছি ও আপনার চেহারা খুশি খুশি লাগছে! তিনি বললেন : “হ্যাঁ, আমার রবের পক্ষ হতে একজন এসে আমাকে বললেন, ‘আপনার উম্মাতের যে কেউ আপনার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য দশটি নেকী লিপিবদ্ধ করবেন, তার দশটি গুনাহ মোচন করবেন এবং তার দশ মর্তবা সম্মান বৃদ্ধি করবেন।”
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “ক্বিয়ামতের দিন আমার অধিক ঘনিষ্ট হবে সে ব্যক্তি যে আমার প্রতি বেশি পরিমাণে দরুদ পাঠ করেছে।”
অতএব হে আল্লাহর বান্দারা! আপনারা তাকে স্মরণ করে অন্তরকে সজীব রাখুন। তার নির্দেশ মেনে, সুন্নাত পালন করে, মহান আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার আশায়, রাসূলের সম্মানে ও মুহব্বতে, অধিক নেকীর আশায় এবং গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্য তার উপর দরুদ পাঠ করুন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “নিশ্চয় আল্লাহ নাবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশ্তাগণ নাবীর জন্য দু‘আ-ইস্তিগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নাবীর উপর সালাত পাঠ করো এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।”
।।। দ্বিতীয় খুৎবাহ্।।।
الحمد لله رب العالمين، بعث في الأميين رسولا منهم يتلوا عليهم آياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وإن كانوا من قبل لفي ضلال مبين.
হে মুসলিমবৃন্দ! সর্বোত্তম দু‘আ ও যিক্র এবং জ্যোতিময় ‘আমল হচ্ছে মনোনীত নাবীর উপর সকাল-সন্ধ্যা বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করা। এটা নাবী প্রেমিকদের বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শন। বিশেষ করে সপ্তাহের সেরা দিন জুমু‘আর দিনে তা বেশি বেশি পাঠ করা। আউস ইবনু আউস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “তোমাদের দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো জুমু‘আর দিন। এ দিন আদম (‘আলাইহিস্ সালাম)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এ দিনই তাঁর রুহ্ কবজ করা হয়েছিল, এ দিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং এ দিনই বিকট শব্দ করা হবে (অর্থাৎ- ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে)। কাজেই তোমরা এই দিনে আমার উপর বেশি করে দরুদ পাঠ করো। কারণ তোমাদের দরুদ আমার কাছে পেশ করা হয়।”[৬]
অতএব যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর কাছ থেকে প্রশংসা ও সম্মান পেতে চায়, ফেরেশ্তাদের মুখে মুখে আলোচিত হতে চায়, তার সম্মান-মর্যাদা ও অবস্থানকে সমুন্নত করতে চায়; সে যেনো সর্বদা নাবীর উপর বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করে, বিশেষ করে যখন তার (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাম উল্লেখ করা হয় তখন। ‘আলী ইবনু হুসাইন (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) তার পিতা হুসাইন (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন : “কৃপণ সেই ব্যক্তি যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হলো, অথচ সে (আমার নাম শুনেও) আমার উপর দরুদ পড়ল না।”[৭]
আল্লাহর বান্দাগণ! নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর দরুদ পাঠ এমন একটি ‘আমল যা কোনো স্থান বা কালের সাথে সম্পৃক্ত না। তবে তা কিছু কিছু অবস্থায় গুরুত্ববহ। যেমন- যখন তার নাম মুখে উচ্চারণ করা হয়, অথবা আযানের ধ্বনিতে শুনা হয়। এ মর্মে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনে ‘আস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, একদা তিনি রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন : “তোমরা যখন মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাও তখন সে যা বলে তোমরা তেমনি বলো। অতঃপর তোমরা আমার উপর দরুদ পাঠ করো, কেননা যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করে, বিনিময়ে তার উপর আল্লাহ তা‘আলা দশবার রহমত বর্ষণ করেন। তারপর আমার জন্য মহান আল্লাহর কাছে ওয়াসীলা কামনা করো। কেননা তা জান্নাতের একটি সম্মানিত স্থান, যা মহান আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একজনকেই দেয়া হবে। আমি আশা করি যে, আমিই হব সে বান্দা। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর কাছে আমার জন্য ওয়াসীলা প্রার্থনা করবে তার জন্য আমার শাফা‘আত ওয়াজিব হয়ে যাবে।”[৮]
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “সে ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হলো, অথচ আমার উপর দরুদ পাঠ করল না।”[৯]
আল্লাহর বান্দাগণ! বেশ কিছু সময়ে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর দরুদ পাঠ করা অতিব জরুরি। যেমন- নামাযের শেষ বৈঠকে, মাসজিদে প্রবেশের সময় ও বের হবার সময়, দু‘আ করার সময়, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায়, সম্মেলন বা বৈঠকে, ঈদের তাকবীরের মাঝে, আযানের উত্তর দেয়ার পর ইত্যাদি সুন্নাতসম্মত স্থানে ও সময়ে।
আল্লাহর বান্দাগণ! যে কোনো শব্দ ও বাক্য দ্বারা নাবীর উপর দরুদ পাঠ করা যায়। এ ব্যাপারে বেশ কিছু বাক্য বর্ণিত হয়েছে, এগুলো সবই যথেষ্ট এবং নাবীর উপর দরুদ পাঠের উপযুক্ত। আবূ মাস‘ঊদ আনসারী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : “আমরা একদা সা‘দ ইবনু ‘উবাদার বৈঠকে ছিলাম, এমতবস্থায় রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন। তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বশির ইবনু সা‘দ বললেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আপনার উপর দরুদ পাঠ করতে নির্দেশ করেছেন, আমরা কীভাবে আপনার উপর দরুদ পাঠ করব?’ তখন রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এত সময় চুপ রইলেন যে আমাদের মনে হলো যদি তাকে প্রশ্নটি না করা হত! তারপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : তোমরা বলো-
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى آلِ إِبْرَاهِيْمَ وَبَارِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى آلِ إِبْرَاهِيْمَ فِيْ الْعَالَمِيْنَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ.
আর আবূ হুমাইদ সা‘ঈদী হতে বর্ণিত, তারা (সাহাবারা) বললেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কীভাবে আপনার উপর দরুদ পাঠ করব?’ তখন রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : তোমরা বলো-
"اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ، كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ".
হে রাসূল প্রেমিক আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয়ই নাবীর উপর দরুদ পাঠে অগণিত ফায়দা রয়েছে, এর অসংখ্য প্রভাব ও ভাল ফলাফল রয়েছে এবং এতে দুনিয়া ও আখিরাতের পর্যাপ্ত কল্যাণ রয়েছে। নাবী প্রেমিক যতই তার প্রিয় রাসূলকে স্মরণ করবে, অন্তরে ঠাই দিবে, তার উত্তম আদর্শকে লালন করবে; ততই তার প্রতি মুহব্বত ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। ফলে এটাই তাকে সুন্নাতের অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করে। প্রেমিকের জন্য তার প্রিয়কে স্বচক্ষে দেখার চেয়ে চোখ জুড়ানো আর কি-ই বা থাকতে পারে? তাকে স্মরণ করা ও তার সুন্দর জিনিসগুলো লালন করার চেয়ে আত্মপ্রশান্তিমূলক বস্তু আর কিছু থাকতে পারে না।
মানুষ যতই তাঁর স্মরণ থেকে বিমুখ হবে ততই তার অন্তরে তাঁর প্রতি মুহব্বত হ্রাস পাবে।
অতঃপর জেনে রাখুন যে, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর দরুদ পাঠ এমন নেকীর কাজ যা তাঁর কাছে পেশ করা হয়। কাজেই তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর রীতির উপর থাকার চেষ্টা করুন এবং বাড়াবাড়ি, প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিদ‘আত হতে বেঁচে থাকুন। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “যে ব্যক্তি এমন ‘আমল করল যার উপর আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত।”
সম্পাদনায় : আব্দুল মতিন
শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক- জমঈয়ত শুব্বানে আহলে আহলে হাদীস বাংলাদেশ ও যুগ্ম-পরিচালক, শুব্বান রিসার্চ সেন্টার।

[১] সহীহ মুসলিম।
[২] সহীহ মুসলিম।
[৩] সুনান আত্ তিরমিযী।
[৪] ইমাম হায়তামী হাদীসটিকে হাসান পর্যায়ের বলেছেন।
[৫] ইমাম আত্ তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এটাকে হাসান পর্যায়ের বলেছেন।
[৬] আবূ দাঊদ। হাদীসটিকে ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন।
[৭] ইমাম আত্ তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এটাকে হাসান পর্যায়ের বলেছেন।
[৮] সহীহ মুসলিম।
[৯] সুনান আত্ তিরমিযী।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত