সাময়িক প্রসঙ্গ
পাত্র-পাত্রী পছন্দে ভুল মানদণ্ড
শাইখ আরিফুল ইসলাম বিন আনিসুর রহমান
সবকিছুর একটা মাপকাঠি রয়েছে। মাপকাঠি/মানদণ্ড যদি ভুল হয় তাহলে ফলাফল ভুল আসবে, কখনই সঠিক মান পাওয়া সম্ভব না।
অনেক ভাইকে বলতে শুনেছি যে, আমি কলেজে পড়ে এমন মেয়েকে বিয়ে করব না, কারণ তাঁরা পর্দা করে না, আধুনিকতার ছোয়ায় নিজের গাঁ ভাষিয়ে দেয়। এক ভাই বলেছেন, আমার নার্স পছন্দ না, নার্সদের উপর আমার কোনো ভরসা নেই। কেউ মনে করে, ভার্সিটিতে পড়লেই কোনো মেয়ে খারাপ হয়ে যায়। অনেক ভাই আছে, যাঁরা মাদ্রাসায় পড়ে, দাওরা করেছে, কুরআনের হাফেয এমন মেয়ে হলে এক পায়ে খাড়া হয়ে যায়; যাচাইয়ের প্রয়োজন মনে করে না। উপরোক্ত সবগুলোই ভুল মানদণ্ড। কলেজে পড়লেই কেউ খারাপ হয়ে যায় না। সব জায়গাতে ভালো আর মন্দ আছে। কলেজের সব মেয়ে খারাপ এমন না, নার্সরা সবাই খারাপ এমন না। এদের মধ্যেও অনেক ভালো আছে। মাদ্রাসায় পড়লে, দাওরা করলেই, হাফেয হলেই কেউ ভালো/দ্বীনদার হয়ে যায় না। শিক্ষা বাধা নয়, ‘আয়িশাহ্ (রযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) সাহাবীদের শিক্ষক ছিলেন। অনেকে বলবে, সহ-শিক্ষা হারাম। জ্বি, সেটা তো অবশ্যই। কিন্তু সেটা শুধু বউয়ের ক্ষেত্রে না, আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অনেকে আছে, চাকরি করে এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু সবাই ইচ্ছে করে চাকরি করে না। অনেকে আছে বৃদ্ধ মা-বাবার ভরণপোষণের জন্য চাকরী করে। মনে রাখবেন, বাড়িতে কোনো কর্মঠ লোক না থাকায় বৃদ্ধ শু‘আইব (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর দু’টি মেয়েই ছাগল-দুম্বা চরাতেন। এটা অবশ্যই চাকরী, আর এই মেয়েদের মধ্য থেকেই একজনকে বিয়ে করেন মূসা (‘আলাইহিস্ সালাম)। আর বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষ ইসলাম এবং ইসলামের আদর্শ জানে না, এই পরিস্থিতিতে মেয়েরা যে চাকরী করে সেজন্য কেবল তাঁদের দোষ দিলে হবে না; দোষ সমাজ, রাষ্ট্রের, অভিভাবকদের, যাঁরা আমরা ইসলামের আদর্শ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছি না তাদের।
অনেকেই মনে করেন, শহরের ছেলে-মেয়েরা তেমন আদর্শিক হোন না। যার কারণে অনেকেই গ্রামের ছেলে-মেয়েকে অগ্রধিকার দিয়ে থাকেন। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, আধুনিকতার ছোয়া শহরে অনেক আগে থেকেই ছিলো, সেই শ্রোত এখন তীব্র গতিতে গ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যার কারণে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এই জোয়ারে এতটাই গাঁ ভাসিয়ে দিচ্ছে যে, শহরের চাইতে গ্রাম দ্বিগুণ গতিতে চারিত্রিক অধঃপতনে যাচ্ছে। আমি বলবো না, গ্রামের সবাই এখন খারাপ হয়ে গেছে। আমি শহরের সাফাই গাচ্ছি এমনটাও না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে, গ্রামেও এখন মারাত্মক চারিত্রিক অধঃপতন হয়েছে, যা শহরের চাইতে কোনো অংশে কম না। আর আধুনিক এবং উন্নত এই সময়ে গ্রামকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। শহরের যত সুযোগ-সুবিধা তা এখন গ্রামেও পাওয়া যাচ্ছে। মনে রাখবেন, কলেজে পড়ে, চাকরি করে, শহরে থেকে এই খারাপ অবস্থানে থেকেও যে ভালো হয়, সে অত্যাধিক ভালো হয় এবং কোনো পরিস্থিতিই তাকে আর খারাপ বানাতে পারে না। কিন্তু গ্রামে থেকে, মাদ্রাসায় পড়ে, ভালো অবস্থানে থেকে যে ছেলে-মেয়ে খারাপ হয় তাঁর চাইতে আর কেউ খারাপ হতে পারে না।
আমরা অনেকেই কালো-শ্যামলা মেয়েকে পছন্দ করি না। মুখে দ্বীনকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেও সৌন্দর্য ভালো না হলে আমরা বিয়ে করতে চায় না। এমন যদি হয় মন-মানসিকতা তাহলে মনে রাখবেন, দ্বীনদার ছেলে-মেয়ে পাওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব না। অনেকেই বলে, সুন্দর মেয়েদের উপর ভরসা নেই, এরা খারাপ হয়। যদিও অনেকেই সুন্দরের ঠেলায় কি করবে দিশা পায় না, নিজেকে যাঁর তাঁর কাছে বিলিয়ে দেয়, তবুও সব সুন্দর মেয়েরা খারাপ না। মনে রাখবেন, অনেক শ্যামলা মেয়ে আছে, যাঁরা এত খারাপ যে, সুন্দর মেয়েদেরও হার মানায়। সুন্দর হলেই খারাপ হয় না। কেননা সকল নাবীর স্ত্রীরা ছিলো সেরা সুন্দরী।
ধনী মানেই অবৈধ উপার্জন এমন ভাবা ঠিক না। ‘উসমান (রযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) ধনী ছিলেন, তিনি অবৈধ উপার্জন করেননি। ধনীরাও ভালো, আদর্শিক হতে পারেন। আবার আমরা বিয়ের সময় সম্পদ দেখি, উপার্জন দেখি। অথচ রিকসা চালকও সংসার চালাতে পারে, স্ত্রী-সন্তানের দেখাশুনা করতে পারে। কিন্তু সংসার চালাতে দ্বীনদারিতা, আদর্শ যে অপরিহার্য, সেটা আমরা দেখি না। যার কারণে সংসার নামক গাড়ির চাকা কখনই সুখের সাথে চলতে পারে না। আমরা সম্পদ আর সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি, অথচ তা ভঙ্গুর এবং একেবারে অস্থায়ী; সংসারের সুখের জন্য যার কোনো ভূমিকাই নেই, প্রয়োজনীয়তা নেই। আদর্শবান গরীব ঘরের ছেলের সাথে আমরা কখনই মেয়ের বিয়ে দিতে চাই না। মেয়ে দ্বীনদার কিন্তু বাবা হয়তো রিকসা চালক, কুঁড়ে ঘরে থাকে; তখন আমরা সেই মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে চাই না। আর এজন্য আজ পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝি না, সংসার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা পাওয়ার পরও কি করে মা-বাবা সন্তানের জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অর্থের দরিদ্রতা দরিদ্রতা নয়, মনের দরিদ্রতা বড় দরিদ্রতা। অনেক গরীব আছে যে ধনী হলেও মন আর প্রসস্থ হয় না; সংকীর্ণই থেকে যায়। আমরা সম্পদের স্বচ্ছলতা দেখলেও মনের স্বচ্ছলতা ও প্রসস্থতা দেখি না, অথচ মনের অভাব বড় অভাব।
মূল মাপকাঠি হলো দ্বীনদারিতা, মনের প্রশস্ততা; আদর্শ হলো মানদণ্ড। এই কারণেই ‘উমার (রযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা হওয়ার পরও নিজের পুত্রবধূ করেছিলেন এক হতদরিদ্র পরিবারের দ্বীনদার মেয়েকে। তিনি দ্বীনকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এই কারণে ধনী বাবা তাঁর এক মাত্র মেয়েকে নিজের বাগানের কর্মচারী দ্বীনদার গরীব ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি বলবো না যে, এরা খারাপ এরা ভালো। সব জায়গায় ভালো-খারাপ আছে। শিক্ষিকা, নার্স, ডাক্তার, চাকরি করে এরাও ভালো হতে পারে। আপনাকে যাচাই করতে হবে। যাচাইয়ের মানদণ্ডটা লেখাপড়া না, চাকরি না, সৌন্দর্য না, সম্পদ না। যাচাইয়ের মানদণ্ড হবে আদর্শ, দ্বীনদার, চরিত্র। জাহেলিয়াতের যুগেও আদর্শ নারী ছিলো, সে যুগে, সে পরিস্থিতিতেই বড় হয়েছিলেন খাদিজাহ্ (রযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা), রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর মা আমেনা। সেই জাহেলিয়াতের যুগে বড় হওয়া আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বলেছিলো, স্বাধীন মেয়ে যিনা করতে পারে না, যিনা তো করে ক্রিতদাসী।
আমরা সৌন্দর্য, সম্পদ, অবস্থান, লেখাপড়া এসব দেখি; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এসবের কিছুই দেখে না। ইসলাম এগুলো দেখতে বলেনি। যাচাই করতে বলেছেন দ্বীনদারী, আদর্শ দেখতে বলেছেন। মহান আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তিই প্রিয় যাঁর আছে তাক্বওয়া, আল্লাহ ভীতি।

++


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত