সাময়িক প্রসঙ্গ
করোনা ভাইরাস ও আল্লাহ তা‘আলার হিক্মাহ্
হারুনুর রশীদ ত্রিশালী

প্রথম খুৎবাহ্
الحمد لله رب الأرض والسماء، الوهاب للنعماء، يكشف البأساء والضراء، ويرفع البلاء، ذو الرحمة الواسعة والحكمة البالغة، لربي الحمد والشكر على آلائه كلها ما علمنا منها وما لم نعلم، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، سميع الدعاء، وأشهد أن نبينا وسيدنا محمدا عبده ورسوله صاحب الحمد واللواء، اللهم صلِّ وسلم وبارك على عبدك ورسولك محمد وعلى آله وصحبه الأتقياء.
অতঃপর!
আপনারা সৎকর্ম ও নাজাতের উসিলা হয় এমন ‘আমল করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করুন। আর যাবতীয় ঈমান বিধ্বংসী ও সকল হারাম উপকরণ পরিহার করুন। কেননা যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করে তিনি তাকে রক্ষা করেন, আর যে মহান আল্লাহর অবাধ্য হয় ও তাঁর বিধানের লঙ্ঘন করে তাকে তিনি ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করেন।
হে মানবজাতি!
আপনারা লক্ষ্য করছেন যে পৃথিবীবাসীর উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে ও তারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন যে, এটা মানুষকে আকস্মিকভাবে আক্রান্ত করছে ও দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা খুবই ভায়াবহ। এই ভাইরাসটি যে কোনো বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে তা মানবসভ্যতাকে হুমকি দিচ্ছে, অথচ আমাদের রব পরম করুণাময় ও দয়ালু।
তিনি ইচ্ছা করলে করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ মহামারী রোগ দিতে পারেন। মহান আল্লাহর কৃপায় গুটিকয়েক ছাড়া মানবজাতি মহান আল্লাহর অবাধ্য, সীমালঙ্ঘন ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর আল্লাহ মানুষদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করলে, ভূ-পৃষ্ঠে কোনো প্রাণীকেই তিনি রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের নির্দিষ্ট সময় এসে যাবে, তখন তো আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা।”
তিনি আরো বলেন : “আর তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তোমাদের হাত যা অর্জন করেছে তার কারণে এবং অনেক অপরাধই তিনি ক্ষমা করে দেন।”
হে আমাদের রব!
আপনি যেমন অনেক কিছুই ক্ষমা করেন তেমনি বাকী অল্পও মাফ করে দিন। হে আল্লাহ! আপনিই তো আরশের উপরে আপনার নিজের কাছে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন : “আমার রহমত আমার ক্রোধকে ছাড়িয়ে গেছে।” অতএব হে আল্লাহ! আমাদের সাথে আপনি আপনার দয়া, বদান্যতা, করুণা, ইহসান ও ক্ষমার আচরণ করুন। আমাদের সাথে বদলা ও হিসাব গ্রহণকারীর ন্যায় আচরণ করবেন না। আপনি নিজগুণে (পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল) আমাদের প্রতি সদয় হোন, আমরা -পাপ ও অনিষ্টতার কারণে- যা আমাদের প্রাপ্য সে অনুযায়ী শাস্তি দিবেন না; হে পরিপূর্ণ দয়া ও উদারতার মালিক, হে মহামহিম ও সম্মানের অধিকারী।
ইবনু ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “হে মুহাজিরগণ! জেনে রাখো যে, পাঁচটি কর্মের পাঁচটি প্রতিফল : যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে এমন রোগ বালাই দেখা দিবে যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন তাদের শাসকবর্গ মহান আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করবে না, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ বাধিয়ে দেন। আর যে জাতিই তার সম্পদের যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে, সে জাতির উপর আকাশ হতে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণী না থাকত, তাহলে তাদের মাঝে আদৌ বৃষ্টি হত না। আর যে জাতি মাপ ও ওজনে কম দিবে, সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট ও শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে। আর যে জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে, তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের দুশমনকে ক্ষমতাসীন করে দেন যারা তাদের ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করবে।[১]
হে মানবজাতি!
এটার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আপনাদেরকে অনুগ্রহ করতে চান, অতএব আপনারা তাঁকে সন্তুষ্ট করুন। তিনি আপনাদেরকে শিক্ষা, উপদেশ ও সতর্ক করতে চান; অতএব তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলুন। তিনি চান আপনাদের ক্ষমা করতে; ফলে আপনারা যেনো তাঁর কাছে তাওবাহ্ করেন, তাঁর প্রতি বিনয়ী হন এবং তাঁর কাছে দু‘আ করেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাওবাহ্কারীদের ভালবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালবাসেন এবং এ কারণে তাদেরকে মহা প্রতিদান দিবেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর আপনি যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে- আমরা তো সুসংবাদ দিন ধৈর্য্যশীলদেরকে; এরাই তারা মহান আল্লাহর জন্যই। আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। যাদের প্রতি তাদের রব-এর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর তারাই সৎপথে পরিচালিত।”
যারা বিপদমুহূর্তে উপদেশ গ্রহণ করে না, তাওবাহ্ করে না ও বিনয়ী হয় না তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভর্ৎসনা করেছেন ও শাস্তি দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি বলেন : “আর অবশ্যই আপনার আগে আমরা বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি; অতঃপর তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে সুতরাং যখন আমাদের শাস্তি তাদের পাকড়াও করেছি, যাতে তারা অনুনয়-বিনয় করে। উপর আপতিত হলো, তখন তারা কেনো বিনীত হলো না? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়ত্বান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল।”
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : “তারা কি দেখে না যে, তাদেরকে প্রতি বছর একবার বা দু’বার বিপর্যস্ত করা হয়? এরপরও তারা তাওবাহ্ করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না?”
তিনি আরো বলেন : “আর আমরা তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, তারপরও তারা তাদের রবের প্রতি অবনত হলো না এবং কাতর প্রার্থনাও করল না।”
হে মানবসকল!
পূর্ব যুগের মানুষ ও প্রজন্মের অবস্থার কথা চিন্তা করে দেখুন, বিভিন্ন অপরাধের কারণে আল্লাহ তা‘আলা কীভাবে তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন! অথচ তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাবীদের সন্তানও ছিল! পূর্ব যুগের মানুষদেরকে আল্লাহ তা‘আলা যে সকল পাপের কারণে ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো এ যুগেও ব্যাপকহারে বর্তমান রয়েছে এবং তা অবিরত বেড়েই চলেছে।
আর আল্লাহ তা‘আলার শ্বাশত বিধানগুলো মু’মিন ও কাফির সকলের ওপরই বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে ভাল? নাকি তোমাদের অব্যাহতির কোনো সনদ রয়েছে পূর্ববর্তী কিতাবে?” তিনি আরো বলেন : “এটাও কি তাদেরকে হিদায়াত করল না যে, আমরা তাদের পূর্বে ধ্বংস করেছি বহু প্রজন্মকে- যাদের বাসভূমিতে তারা বিচরণ করে থাকে? নিশ্চয়ই এতে প্রচুর নিদর্শন রয়েছে; তবুও কি তারা শুনবে না?”
হে মানবজাতি!
এমন কোনো দানবীর ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যিনি পুরস্কার ও শাস্তি উভয়ই দেয়ার ক্ষমতা রাখেন, তিনি যদি বিশাল বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাসকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয়, আসবাবপত্র, চিকিৎসা, বস্ত্র ইত্যাদি সবকিছুর ব্যবস্থা করে মানুষদেরকে সাময়িকভাবে বসবাসের অনুমতি দিয়ে বলেন : তোমরা এ বাড়িতে শর্তাবলী ও নিয়ম-কানুন মেনে থাকতে থাকো; যারা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শর্তাবলী মেনে বসবাস করতে পারবে, তাদেরকে এর চেয়ে বহুগুণ উত্তম বাড়িতে স্থানান্তরিত করব। আর যারা শর্তভঙ্গ করে ও নিয়ম না মেনে থাকবে, ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশৃংখলা, অন্যায় ও অশ্লীলতা করে বেড়াবে, তাদেরকে অনিষ্টকর, কষ্টদায়ক এক বাড়িতে স্থানান্তর করব; আপনারা কি মনে করেন না যে এটা ঐ বাড়িওয়ালার করুণা ও ইনসাফের অন্তর্ভূক্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই।
আর আল্লাহ তা‘আলার জন্যই ভূমণ্ডল ও নভোম-লের সর্বোত্তম উদাহারণ! সেই অস্থায়ী বাড়িটি হলো দুনিয়া, আর পরবর্তী বাড়ি হচ্ছে জান্নাত বা জাহান্নাম। মহান আল্লাহই আমাদের জন্য আসমান তৈরি করেছেন, যমীনকে বিছিয়ে দিয়েছেন, সমুদ্র ও নদ-নালাকে অনুগত করেছেন এবং সকল উপকারী বস্তুকে অধীনস্ত করে দিয়েছেন। আর এ সবকিছুর উপর আদম সন্তানদের কর্তৃত্ব দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর আসমানকে আমরা  আর নির্মাণ করেছি আমাদের ক্ষমতা বলে এবং আমরা নিশ্চয়ই মহাসম্প্রসারণকারী। যমীনকে আমরা বিছিয়ে দিয়েছি, অতঃপর আমরা কত সুন্দর ব্যবস্থাপনাকারী।”
তিনি আরো বলেন : “আল্লাহ, যিনি সাগরকে তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন, যেনো তাঁর আদেশে তাতে নৌযানসমূহ চলাচল করতে পারে। আর যেনো তোমরা তাঁর অনুগ্রহ আর তিনি তোমাদের তালাশ করতে পারো এবং যেনো তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও যমীনের সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে। নিশ্চয়ই এতে অনেক নিদর্শনাবলী রয়েছে, এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।”
তিনি আরো বলেন : “এবং তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীসমূহকে।”
তিনি আরো বলেন : “তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিন, না আসমান সৃষ্টি? তিনিই তা আর তিনি এর ছাদকে সুউচ্চ করেছেন ও সুবিন্যস্ত করেছেন। নির্মাণ করেছেন; আর তিনি এর রাতকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং প্রকাশ করেছেন এর সূর্যালোক;  তিনি তা থেকে বের করেছেন তার পানি ও যমীনকে এরপর বিস্তৃত করেছেন। এসব তোমাদের ও তোমাদের আর পর্বতকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেছেন; তৃণভূমি,  অতঃপর যখন মহাসংকট উপস্থিত হব চতুষ্পদ জন্তুগুলোর ভোগের জন্য। মানুষত্বে,  আর প্রকাশ করা হবে জাহান্নামকে দর্শকদের যা করেছে তা সে সেদিন স্মরণ করবে এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়; সুতরাং যে সীমালংঘন করে, জন্য।  আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং জাহান্নামই হবে তার আবাস। জান্নাতই হবে তার আবাস।”
কু-প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে; আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর তাঁর নি‘আমতকে পরিপূর্ণ করেছেন; যেনো আমরা তাঁরই ‘ইবাদত করি, তাঁর সাথে কোনো অংশীদার স্থাপন না করি এবং কিতাব ও সুন্নাত মোতাবেক ‘আমল করি। এতেই রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের নিশ্চয়তা এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতি হতে সুরক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “এভাবেই তিনি তোমাদের ওপর তাঁর নি‘আমতকে পরিপূর্ণ করেছেন, যেনো তোমরা আত্মসমর্পন করো।”
হে মানবজাতি!
বালা মুসিবত আপতিত হয় পাপের কারণে, আর তা উঠিয়ে নেয়া হয় তাওবার মাধ্যমে। মানুষকে যে ভাইরাস আক্রান্ত করেছে, তা থেকে বাঁচতে বেশি বেশি দু‘আ করুন এবং শরী‘আতসম্মত উপকরণগুলো মেনে চলুন। মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার পাশাপাশি সতর্কতাবলম্বন করা এবং স্বাস্থ্যগত দিক-নির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করুন। দেশবাসি ও প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদেমুল হারামাইন শরীফাইনের বক্তব্যে যে আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, সেই সাথে তার নেতৃত্বে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন করছে সেজন্যও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যাবতীয় বিপদাপদ হতে সুরক্ষার জন্য মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলই হচ্ছে একমাত্র ঠিকানা ও ঢাল। সেই সাথে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণও শরী‘আত ও বিবেক নির্দেশিত। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধুই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার উপরই নির্ভর করল, সে যেনো মহান আল্লাহর সাথে র্শিক করল। আর যে ব্যক্তি সতর্কতা অবলম্বন করল না সে যেনো শরী‘আত ও বিবেক উভয়কেই অস্বীকার করল। তবে এই বিপদকে আল্লাহ তা‘আলা অচিরেই দূরীভূত করবেন -ইন্শা-আল্লাহ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।”
ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “জেনে রাখো যে, কষ্টের সাথে মুক্তির উপায়ও রয়েছে।”[২]
মহান আল্লাহর বান্দাগণ!
আপনারা মহান আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদীরে পূর্ণ বিশ্বাসী হোন, কেননা তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম। এটার অর্থ হচ্ছে- এই মর্মে জ্ঞান রাখা ও পূর্ণ বিশ্বাস করা যে, এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছুই ঘটে না এবং মহান আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আমি প্রত্যেক বস্তুই সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।” অতএব ভাগ্যের ভাল মন্দের উপর ঈমান আনা আবশ্যক। আর আমাদের রব আমাদের সংবাদ দিয়েছেন যে কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই। তিনি বলেন : “তিনি গায়েব সম্পর্কে সম্যক অবগত; আসমানসমূহে ও যমীনে তাঁর অগোচরে নয় অণু পরিমান কিছু কিংবা তার চেয়ে ছোট বা বড় কিছু; এর প্রত্যেকটিই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।”
তিনি আরো বলেন : “তিনি প্রত্যেকটি বস্তু গণনা করে হিসেব রেখেছেন।” একমাত্র আমাদের রবই জানেন যা কিছু ঘটেছে, যা কিছু ঘটবে এবং যা কিছু ঘটবার নয়। আর যদি কিছু ঘটে তবে তা কীভাবে ঘটবে সেটাও তিনিই জানেন। যেমন- তিনি বলেন : “আপনি যদি দেখতে পেতেন যখন তাদেরকে আগুনের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবে, হায়! যদি আমাদেরকে ফেরত পাঠানো হত, আর আমরা আমাদের রবের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ না করতাম এবং বরং আগে তারা যা গোপন করত তা এখন তাদের আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভূক্ত হতাম। কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। আর তাদের আবার (দুনিয়ায়) ফেরত পাঠানো হলে, তাদেরকে যা করতে নিষেধ করা হয়েছিল আবার তারা তাই করত এবং নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।”
তাকদীরের ভিত্তি হচ্ছে- মহান আল্লাহর জ্ঞান ও সে বিষয় লিপিবদ্ধ থাকার উপর। মহান আল্লাহর নির্ধারিত বিষয়গুলো হিকমত ও তাৎপর্যপূর্ণ। তা কিঞ্চিত পরিমাণই প্রকাশ পায়। রহস্য ও উপকারবিহীন কোনো অকল্যাণ আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেন না। করোনা ভাইরাস আপতিত হওয়ার অন্যতম হিকমত হচ্ছে- মানুষ যেনো স্মরণ করে যে, ইতোপূর্বে তারা কত প্রশান্তি ও তৃপ্তির সাথে রাতে দিনে ‘ইবাদত ও অন্যান্য কাজে সহজে চলাচল করতে পারত! তারা যেনো সুস্থতা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মহান আল্লাহর প্রশংসা করে এবং অন্যায় থেকে ফিরে এসে তাওবাহ্ করে।
এমন দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে- সৃষ্টির কাছে মহান আল্লাহর সম্মান, তার অপরিসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে প্রকাশ করা; যেনো সন্দিহান ব্যক্তির পূর্ণ বিশ্বাস আসে। কেননা এই ভাইরাস খালি চোখে দেখা যায় না, অথচ তা মানবজাতিকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে! মানুষের পাপের কারণে আল্লাহ তা‘আলা যদি এর চেয়েও শক্তিশালী কিছু চাপিয়ে দেন তাহলে কী অবস্থা হবে? তিনি তো বলেন : “তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ কিছুই জানে না।”
সমকালীন এই দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে- একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী মহান আল্লাহর সামনে মানুষের দুর্বলতা ও অক্ষমতার শিক্ষা লাভ করা। মানুষের কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা যদি তাঁর সূক্ষ্ম কোন সৃষ্টি তাদের উপর চাপিয়ে দেন, তারা তা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছে করেন তবে তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক নেই।”
হে মানুষ! আপনি কি জানেন না যে, আপনি পিপীলিকার চেয়েও দুর্বল? কেননা পিপীলিকার দেহের অর্ধেক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও সে বেঁচে থাকে, আর মানুষের ক্ষুদ্র অঙ্গহানী হলেও সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
এ রকম দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলা এমন লঘু শাস্তি দিয়ে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন মহা শাস্তির কথা; যেনো তারা তাওবাহ্ করে মহান আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে মহা শাস্তির পূর্বে কিছু লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।” মহান আল্লাহই তাঁর সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু।
এই দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে- সন্দেহ পোষণকারীদের নিকটে এই মর্মে প্রমাণাদি প্রকাশিত হওয়া যে, বিশ্ব প্রভু মহান আল্লাহই এককভাবে সৃষ্টিজগতকে পরিচালনা করেন, তিনি একক, এ ক্ষেত্রে অণু পরিমানও তাঁর শরীক নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তিনি যা ইচ্ছা তা-ই বাস্তবায়ন করেন।”
এই ভাইরাস যদি এমনিতেই নিজ ইচ্ছা ও ক্ষমতাবলে এক ব্যক্তি হতে অপর ব্যক্তির কাছে পৌঁছত, তাহলে সকল মানবজাতিকেই বা অধিকাংশকেই আক্রান্ত করত! বরং তা মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আক্রান্ত করছেন, যাকে ইচ্ছে তা থেকে রেহাই দিচ্ছেন; সবই তাঁর ইনসাফ ও অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত।
তাওহীদের শিক্ষায় রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) নিম্নের হাদীসে এমনটিই সাব্যস্ত করেছেন : “রোগের কোনো সংক্রমণ নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, আর সফর মাসের কোনো অশুভ নেই।”[৩]
রোগের সংক্রমণকে অস্বীকারের বিষয়ে হাদীসটির ব্যাখ্যায় মুহাক্কিক ‘আলেমগণ বলেন : আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছে না করলে কোনো রোগ নিজে নিজেই এক ব্যক্তি হতে অপর ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে না এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া রোগ স্বভাবতঃ এমনি এমনি ছড়ায় না। আল্লাহ তা‘আলা না চাইলে রোগীর সংস্পর্শে থাকলেও সে রোগ ব্যক্তিকে সংক্রমণ করতে পারে না। ফলে উক্ত হাদীসে (রোগের কোনো সংক্রমণ নেই) বলতে জাহেলী যুগের মানুষের বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে; যেখানে তারা ধারণা করত যে, রোগ-ব্যাধি মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই স্বভাবতঃ নিজে নিজেই সংক্রমণ করে। আর একজন মুসলিমকে মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার পাশাপাশি সতর্কতামূলক শরী‘আতসম্মত উপকরণ ও বৈধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “তুমি কুষ্ঠ রোগী হতে সেভাবে পালাও যেভাবে সিংহের ভয়ে পালাও।”[৪]
সাহাবীদের যুগেও প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সে সময় ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) সিরিয়ায় আগমণ করেননি। আবূ ‘উবায়দাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু)-সহ আরো অনেক সাহাবা সেখানে সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ‘আম্ র ইবনু ‘আস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) সিরিয়ায় জনগণকে মহামারী রোগের কারণে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বলেন, অবশেষে তাকে আল্লাহ তা‘আলা সেই রোগে তুলে নেন।
এই রোগকেও আল্লাহ তা‘আলা অচিরেই উঠিয়ে নিবেন -ইন্শা-আল্লাহ। একজন মুসলিমের উচিত এমন সময়ে আতঙ্ক, ভয় ও উদ্বেগ পরিহার করে চলা।
অতএব মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলই বান্দাকে দৃঢ় প্রত্যয়ী করে এবং দেহ-মনে শক্তি যোগায়। পক্ষান্তরে ভয়, আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণে সবকিছুতে শরীরে অস্থিরতা অনুভব হয় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আর তাওহীদেই রয়েছে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা।
হে মানবসকল!
আপনারা এই দুর্যোগকে স্বাগত জানান বেশি বেশি দু‘আ করার মাধ্যমে এবং সকল অন্যায় অশ্লীলতা ও তা প্রকাশ করা হতে তাওবাহ্ করার মাধ্যমে। কেননা প্রকাশ্যে পাপকর্ম করাই সকল অনিষ্টতা ও দুনিয়ায় গজবের কারণ। মানুষের সাথে সে রকম আচরণ করুন যেমনটি আপনি তাদের কাছ থেকে আশা করেন, কোনো ব্যাপারেই কেউ যেনো কারো প্রতি অবিচার না করে। বর্তমানে মানুষের প্রতি মানুষের যুল্ম নির্যাতন এতই সীমালংঘন করেছে যে তা পর্বতমালাও সহ্য করতে পারবে না। যুল্মের শাস্তি অধিকাংশ সময় খাসভাবে জালিম ব্যক্তির উপরই আসে, তবে ক্ষেত্রবিশেষ কখনো কখনো তা সর্বসাধারনের উপরও আপতিত হয়।
বেশি বেশি দান-সাদাক্বাহ্ করুন, কেননা এর মাধ্যমে বালা মুসিবত দূর হয়। বেশি বেশি মহান আল্লাহর যিক্র করুন, কেননা যিক্রেই রয়েছে পথ্য, চিকিৎসা ও বিভিন্ন রোগের সুরক্ষা। সকাল সন্ধ্যার যিক্রগুলো নিয়মিত পাঠ করুন, এ ক্ষেত্রে যিক্র সম্পর্কে কিতাব সংগ্রহ করুন। যিক্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব হলো- তুহফাতুয যাকিরীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো তোমাদের কাছে শাস্তি আসার আগে; তার পরে তোমাদের সাহায্য করা হবে না।”
بارك الله لي ولكم في القرآن العظيم.
দ্বিতীয় খুৎবাহ্
الحمد لله رب العالمين، الرحمن الرحيم، مالك يوم الدين، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له القوي المتين. وأشهد أن نبينا وسيدنا محمدا عبده ورسوله الأمين، اللهم صلِّ وسلم وبارك على عبدك ورسولك محمد وعلى آله وصحبه والتابعين.
অতঃপর :
আপনারা মহান আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করুন, তবেই শুভ পরিণাম পেয়ে সফল ও বিজয়ী হবেন এবং সকল অনিষ্টতা ও ধ্বংস হতে নাজাত পাবেন। মুত্তাকীরাই বিজয়ী হয়েছেন আর কাফিররাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “যমীনে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয়ই আসে তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমরা তা কিতাবে লিপিবদ্ধ রেখেছি। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহর পক্ষে এটা এটা এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেনো তোমরা বিমর্ষ না হও, খুব সহজ এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য আনন্দিত না হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না কোনো উদ্ধত- অহংকারীদেরকে।”
ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “জেনে রাখো, যা তোমার কাছ থেকে এড়িয়ে গেছে, তা তোমাকে আক্রান্ত করার ছিল না। আর যা তোমাকে আক্রান্ত করেছে, তা তোমার কাছ থেকে এড়িয়ে যাওয়ার ছিল না।” মুস্তাদরাক হাকেম। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলা যা আপনার তাকদীরে রাখেননি তা মোটেও আপনাকে স্পর্শ করবে না। আর যা তিনি আপনার ভাগ্যে রেখেছেন তা আপনাকে স্পর্শ করবেই। হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, শুধু সতর্ক থাকলেই তাকদীরের ফয়সালা থেকে বাঁচা যাবে না। বরং আগত ও অনাগত সকল দুর্যোগে মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করাই বেশি উপকারী।
মহান আল্লাহর বান্দগণ!
“নিশ্চয় আল্লাহ নাবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নাবীর জন্য দু‘আ-ইস্তিগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নাবীর উপর দরুদ পাঠ করো এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।”
[খতীব : শাইখ ড. আলী আব্দুর রহমান হুযাইফী (হাফিযাহুল্লাহ), ২৭ মার্চ- ২০২০ শুক্রবার প্রদত্ত খুতবার বঙ্গানুবাদ]


[১] সুনান ইবনু মাজাহ্- হাদীসটি হাসান পর্যায়ের।
[২] মুস্তাদরাক হাকিম।
[৩] সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসটি আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত হয়েছে।
[৪] সহীহুল বুখারীতে হাদীসটি আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) হতে বর্ণিত হয়েছে।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত