সাময়িক প্রসঙ্গ
ওহে মুসলিম! কারবালার ঘটনায় বাড়াবাড়ি কেন?
শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী

প্রতি বছর মুহার্রম মাস আসলেই মুসলিম নামধারী একটি গোষ্ঠি ইসলামের ইতিহাসের একটি রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে মেতে উঠে। সেটা হচ্ছে ৬১ হিজরির মুহার্রম মাসের ১০ তারিখে ইরাকের কারবালায় রাসূল (সা.)-এর পবিত্র দৌহিত্র হুসাইন (রা.)’র শাহাদাত ও তাঁর পরিবারের বেশ কিছু সদস্যের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। এটাকে কেন্দ্র করে তারা এতটাই বাড়াবাড়ি করে যে, তাতে মনে হয় ইসলামের ইতিহাসে এছাড়া আর কোনো ঘটনা নেই। আশুরার দিন তারা তাজিয়া মিছিল, মাতম এবং ইসলামী ‘আক্বীদাহ্ বিরোধী আরো অনেক কিছুই করে থাকে। এ বিষয়ে তাদের প্রচারণা ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী শুনে সুন্নী মুসলিমদের অনেকেই ধোঁকা খায়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ্ অনুযায়ী হুসাইন বা অন্য কারও মৃত্যুতে মাতম করা কিংবা তিনদিনের বেশি শোক পালন করা জায়িয নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো মুসলিম নামধারি এক শ্রেণীর মানুষ ৬১ হিজরির মুহার্রমের দশ তারিখে কারবালায় হুসাইন (রা.) নিহত হওয়ার কারণে শতশত বছর যাবৎ শোকদিবস হিসেবে পালন করে আসছে। সেই সঙ্গে তারা আশুরার পবিত্রতাকে জড়িয়ে দিচ্ছে। শিয়া-রাফেযীদের প্রচারণা, মিথ্যা কাহিনী ও বাড়াবাড়ির কারণে যেসব সুন্নী মুসলিম হুসাইনের মৃত্যু ও কারবালার ঘটনায় ধ্রুম্রজালে আটকে পড়েছেন, তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন করছি। যারা কারবালার সঠিক ঘটনা ও প্রকৃত তথ্য না জানার কারণে এ ব্যাপারে সন্দিহান ও বিভ্রান্তিতে আছেন, তারা প্রশ্নগুলো ভালোভাবে বুঝলে নিজে নিজেই প্রকৃত ঘটনা সহজভাবে বুঝে যাবেন ইন্শা-আল্লাহ। সেই সঙ্গে কারবালার ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয়টাও সহজভাবেই বুঝা যাবে।



প্রথম প্রশ্ন : হুসাইন (রা.)’র পিতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলীফা ‘আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রা.) হুসাইনের চেয়ে অধিক উত্তম ছিলেন। তিনি ৪০ হিজরি সালে রমাযান মাসের ১৭ তারিখ জুমু‘আর দিন ফজরের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় ‘আব্দুর রহ্মান ইবনু মুলজিম নামক খারেজীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। তারা হুসাইনের মৃত্যু দিবস উদযাপনের ন্যায় তাঁর পিতার মৃত্যু উপলক্ষে মাতম করে না কেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ্ অনুযায়ী ‘উসমান ইবনু আফ্ফান (রা.) ছিলেন ‘আলী ও হুসাইন (রা.)’র চেয়ে উত্তম। তিনি ৩৬ হিজরি সালে যুলহাজ্জ মাসের আইয়্যামে তাশরীকে স্বীয় বাস ভবনে অবরুদ্ধ অবস্থায় মাজলুমভাবে নিহত হন। ন্যায় পরায়ণ এই খলীফাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। তারা তাঁর হত্যা দিবসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করে না কেন?

তৃতীয় প্রশ্ন : এমনিভাবে খলীফাতুল মুসলিমীন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) ‘উসমান এবং ‘আলী (রা.) থেকেও উত্তম ছিলেন। তিনি ফজরের নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন এবং মুসলমানদেরকে নিয়ে জামা‘আতের ইমামতি করছিলেন। এমন অবস্থায় আবূ লুলু নামক একজন অগ্নি পূজক তাঁকে দু’দিকে ধারালো একটি ছুরি দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথে তিনি ধরাশায়ী হয়ে যান এবং তিন দিন পর শহীদ হন। লোকেরা সেই দিনে মাতম করে না কেন?

চতুর্থ প্রশ্ন : ইসলামের প্রথম খলীফা এবং রাসূলের বিপদের দিনের সাথী আবূ বক্র (রা.)’র মৃত্যু কি মুসলিমদের জন্য বেদনাদায়ক নয়? তিনি কি রাসূলের পরে এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন না? তার মৃত্যু দিবসে তারা তাজিয়া করে না কেন?

পঞ্চম প্রশ্ন : সর্বোপরি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়া ও আখিরাতে সমস্ত বানী আদমের সরদার। আল্লাহ‌ তাঁকে অন্যান্য নবীদের ন্যায় স্বীয় সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছেন। সাহাবীদের জন্য রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর চেয়ে বড় আর কোনো মুসীবত ছিল না। তিনি ছিলেন তাদের কাছে স্বীয় জীবন, সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের চেয়েও অধিক প্রিয়। তারপরও তাদের কেউ রাসূলের মৃত্যুতে মাতম করেননি। হুসাইনের প্রেমে মাতালগণকে রাসূলের মৃত্যু দিবসকে উৎসব ও শোক প্রকাশের দিন হিসেবে নির্ধারণ করতে দেখা যায় না কেন?

ষষ্ঠ প্রশ্ন : হুসাইন (রা.)’র চেয়ে বহুগুণ বেশি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মৃত্যু দিবসকে বাদ দিয়ে হুসাইনের মৃত্যুকে বেছে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি শুরু করা হলো কেন?

সপ্তম প্রশ্ন : সর্বোপরি সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে- নবী (সা.)-এর অন্য নাতনি ফাতিমাহ্ (রা.)’র সন্তান এবং হুসাইনের বড় ভাই হাসানের মৃত্যুতে তারা মাতম করে না কেন? তিনি কি হুসাইনের চেয়ে কম মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন?

এবার আসুন, আমরা কারবালার ঘটনা ও হুসাইন (রা.)’র শাহাদাতের ঘটনায় বাংলাভাষী সুন্নী মুসলিমদের বিভ্রান্ত হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

১) বিষাদসিন্ধুর কাল্পনিক ও মিথ্যা কাহিনী : বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ মীর মোশাররফ হুসাইন রচিত বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসটি পড়ে থাকেন। কারবালায় হুসাইন (রা.) নিহত হওয়ার ঘটনাকে বিষয় বস্তু করে এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে। এতে ইমাম হুসাইনের ফযীলাতে অসংখ্য বানোয়াট কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। অপরপক্ষে ইয়াযীদকে এমন এমন অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার সঠিক কোনো দলিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বইটি বাংলাভাষী মুসলিমগণ বিশেষ গুরুত্বের সাথে পাঠ করে থাকেন। পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিলেবাসের বাংলা সাহিত্য বইয়েও প্রবন্ধ আকারে বিষাদ সিন্ধু থেকে নির্বাচন করে বেশ কিছু বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সব পড়ে ও শুনে মুসলিম ছাত্রগণ কারবালার ঘটনা সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে গড়ে উঠছে। দাখিল দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমাদের বাংলা সাহিত্য বইয়ে হায়রে অর্থ নামে একটি প্রবন্ধ ছিল। এই প্রবন্ধে ইয়াযীদকে যে সমস্ত দোষে দোষারোপ করা হয়েছে, তা পাঠ করে বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। কারণ এগুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে সাহিত্যিক মান দিয়ে লেখা হয়েছে, যা খুবই আকর্ষণীয়।

এসব প্রবন্ধ ও কাহিনী কারবালার ব্যাপারে সুন্নী মুসলিমদের ভিতরে ভুল ধারণা প্রবেশের অন্যতম একটি কারণ।

২) দেশের সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মিয় দলের কর্মসূচী : আমাদের দেশে রাষ্ট্রিয়ভাবে এবং বিভিন্ন সংঘঠন ও সংস্থার লোকেরা আশুরার দিন হুসাইন (রা.) কারবালায় শহীদ হওয়ার কারণে এই দিনটি মুসলিমদের নিকট পবিত্র বলে আখ্যা দেয়া এবং জনগণের মধ্যে তার ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

মুহার্রম ও আশুরা উপলক্ষে আমাদের দেশের সকল সরকারই তার নিয়ন্ত্রিত রেডিও, টেলিভিশন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে বিশেষ কর্মসূচী ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে। এই দিন সরকারী ছুটি থাকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রীদের বাণীও প্রচার করা হয়। ইয়াজীদের প্রতি দোষারোপ ও হুসাইনের প্রশংসাই থাকে এগুলোর মূল বিষয়। আরও উল্লেখ করা হয় যে, কারবালায় মুহার্রম মাসের ১০ তারিখে স্বৈরাচারী ও পৈশাচিক নরপশুর হাতে রাসূলের পবিত্র দৌহিত্র হুসাইনের শাহাদতকে কেন্দ্র করেই এ দিনটি মুসলিম উম্মার নিকট একটি পবিত্র দিন হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সুতরাং তাদের ভাষায় এটি একটি ধর্মীয় পবিত্র দিন। তারা এ কথাটি একবারের জন্যও উচ্চারণ করে না যে, আশুরার দিনটি ইসলাম আসার অনেক আগে থেকেই ফযীলাতপূর্ণ ও পবিত্র। আল্লাহর নবী মূসা (আ.) এই দিনে ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ রোযা রেখেছেন। পরবর্তীতে আমাদের নবী (সা.)-ও এর উপর জোর দিয়েছেন।

তারা এটি জানে না যে, ইমাম হুসাইন (রা.) শহীদ হয়েছেন ৬১ হিজরির মুহার্রম মাসের ১০ তারিখে আর আল্লাহর রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন ১১ হিজরি সালে। রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর সাথে সাথে ওয়াহী আসার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ওয়াহীর দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৫০ বছর পর যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে কোন অনুষ্ঠান ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। যে দিন সেই ঘটনা ঘটেছে সেই দিনও পবিত্র হতে পারে না। কুরআন ও সহীহ হাদীস যে সমস্ত স্থান ও সময়কে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছে, তা ব্যতীত কোনো দিন ও সময় পবিত্র হতে পারে না। মোটকথা সরকারী ও বেসরকারীভাবে দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালন করার কারণে কারবালার ঘটনা ও ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশের মুসলিমগণ বিভ্রান্তিতে পড়েছে।

৩) শিয়া-রাফেযীদের প্রচারণা : আমাদের দেশে শিয়াদের সংখ্যা একেবারে কম হলেও ইসলামের লেবাস পড়ে তারা আশুরার দিন তাজিয়া মিছিল, মার্সিয়া এবং আরও অনেক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তারা প্রতি বছর এই দিনে ঢাকা শহরে প্রকাশ্যেই হুসাইনের প্রতীকি লাশ বহন করে শোক মিছিল করে, শরীরে ছুরি দিয়ে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করে। শরীরে রক্তের মতো লাল রং লাগিয়ে হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! করে চিৎকার করে এবং বুক ও গালে চপেটাঘাত করে। হুসাইনের প্রতি তাদের এই আবেগ ও কল্পিত ভালোবাসা দেখে সরল মনা ও নবী পরিবারের প্রেমিক সুন্নী-মুসলিমগণ প্রভাবিত হয়ে তাদের বর্ণনা বিশ্বাস করে থাকে। যার কারণে আমাদের দেশের সুন্নী-মুসলিমগণ শিয়াদের প্রতিবাদে কোনো কথা শুনতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। আসলে এটি যে, মাছের মায়ের পুত্র শোকের মতো তা বুঝার মতো পর্যাপ্ত দ্বীনি জ্ঞান ও সঠিক ইতিহাস তাদের জানা নেই।

৪) দাপটের সাথে পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়ার প্রচার : আমাদের দেশের সকল জাতীয় পত্রিকা, আঞ্চলিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিন এবং সকল প্রকার বেসরকারী ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়া কারবালার ঘটনাটি অন্যের অন্ধ অনুসরণ করে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। প্রতি বছর মুহার্রম মাস আসার সাথে সাথেই প্রতিদিন পত্রিকাগুলোতে এ উপলক্ষ্যে বিশেষ কলাম দেয়া হয়। এগুলো পড়ে সুন্নী মুসলিমগণ আবেগে আপ্লুত হয়ে পত্রিকাগুলোতে যা লেখা হয় তাই বিশ্বাস করেন। অপরপক্ষে মূল সত্যটি কমই প্রকাশ করা হয়। অনেকের জানা থাকলেও শ্রোতের বিপরীতে নৌকা চালাতে তারা সাহসিকতা প্রদর্শন করতে চান না। এ কারণেও সুন্নী-মুসলিমগণ যুগ যুগ ধরে বিভ্রান্ত হচ্ছে।

৫) সুফী ও পীরদের ভূমিকা : আমাদের দেশের মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ সুফীবাদ ও পীর-মুরীদিবাদে বিশ্বাসী। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, এ সকল পীরদের তরীকা ও সিলসিলা কোনো এক পর্যায়ে শিয়া-ইমামদের কারও না কারও সাথে মিলে যায়। সুতরাং পীরেরা এক দিকে যেমন ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে মুরীদ বানিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে অপরপক্ষে তারা সুন্নী লেবাস পড়ে অনেক ক্ষেত্রে শিয়া মাযহাবের ‘আক্বীদাই প্রচার করে যাচ্ছে। সুতরাং তাদের দ্বারা মুহার্রম, কারবালা ও ইমাম হুসাইনের শাহাদাত নিয়ে সুন্নী-মুসলিমদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি রয়েছে তার প্রতিবাদের আশা করা আদৌ সম্ভব নয়।

৬) ইরানী মিডিয়ার ভূমিকা : বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই কিছু শিয়া নাগরিক রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান বিশ্বব্যাপি শিয়া মতবাদ প্রচারের যে এজেন্ডা হাতে নিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ইরানী মিশনারী তৎপর হয়ে উঠেছে। ইরানী দূতাবাস বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে, মুসলিম ছাত্রদেরকে শিক্ষা বৃত্তি দেওয়ার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সুন্নী মুসলিমদেরকে শিয়া মতবাদের দিকে টেনে নিচ্ছে। প্রতি বছর যখন মুহার্রম মাসের দশ তারিখ আসে, এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান করে থাকে। এতে দেশের উচ্চ পর্যায়ের কিছু বিদআতী আলেম ও শিক্ষাবিদদেরকে আমন্ত্রণ জানায়। এসব অনুষ্ঠানে সুকৌশলে এমন বক্তব্য আদায় করা হয়, যা সুন্নী মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করে এবং তাদেরকে ইরানী ও শিয়া গোষ্ঠির প্রতি দুর্বল করে ফেলে।

৭) হাসান ও হুসাইনের ফযীলাতে বর্ণিত হাদীসসমূহ পড়ে অতি আবেগী হওয়া : আহলে বাইত এবং রাসূল (সা.)-এর সকল সাহাবীকে ভালোবাসা আহলে সুন্নাত ও ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদার অন্যতম অংশ। হাসান ও হুসাইন যেহেতু রাসূল (সা.)-এর সম্মানিত কন্যা ফাতিমার সন্তান এবং তাদের ফযীলাতে বেশ কিছু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত তাদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। তাই আমরা হাসান ও হুসাইনকে ভালোবাসি। তাদের ফযীলাতে যে সমস্ত সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে-

ক) বারা ইবনু ‘আযিব (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন :

رأيت النبي (ﷺ) والحسن بن علي على عاتقه يقول اللهم إني أحبه فأحب وأحب من يحبه.

আমি রাসূল (সা,)-কে দেখেছি, তিনি হাসান ইবনু ‘আলীকে কাঁধে নিয়ে বলেছেন : হে আল্লাহ! আমি একে ভালোবাসি। সুতরাং তুমিও তাঁকে ভালোবাসো এবং যে তাঁকে ভালোবাসে তুমি তাকেও ভালোবাসো। [১]

খ) রাসূল (সা.) আরও বলেন :

اَلْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ.

হাসান ও হুসাইন জান্নাতবাসী যুবকদের সরদার হবেন। [২]

গ) আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন : হুসাইনের মাথা উবাইদুল্লাহ’র কাছে নিয়ে যাওয়া হলে সে তাঁর মাথাকে একটি থালার মধ্যে রেখে একটি কাঠি হাতে নিয়ে তা নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নাড়াচাড়া করছিল এবং তাঁর সৌন্দর্য দেখে সম্ভবত বেখেয়ালে কিছুটা বর্ণনাও করে ফেলেছিল। হাদীসের শেষের দিকে আনাস (রা.) বলেন : হুসাইন (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। [৩]

ঘ) ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন : আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এরা দু’জন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দু’টি ফুল। [৪]

তাদের ফযীলাতে এমনি আরও অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) তাদের প্রতি হৃদয়ের ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন।

ইসলাম সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী একজন মুসলিম এ সমস্ত হাদীস পড়ে বা শুনে এবং সেই সাথে কারবালা নিয়ে অনেক লেখকের কাল্পনিক ও মিথ্যা কাহিনী পড়ে আবেগময়ী হয়ে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পড়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাই বলে রাসূল (সা.)-এর আদরের নাতি ও ফাতিমাহ্ (রা,)’র পুত্র হওয়ার কারণে অতি আবেগী হয়ে তাদের প্রতি ভালোবাসায় বাড়াবাড়ি করা এবং মু‘আবীয়াহ্ (রা.) বা অন্য কোনো সাহাবীর প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করা বা গালি দেয়া যাবে না।

মুসলিমগণকে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাসূলের অন্যান্য সাহাবীদের ফযীলাতেও অসংখ্য সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনেও তাদের ফযীলাতে রয়েছে সুস্পষ্ট ঘোষণা। সুতরাং সকল সাহাবীকেই ভালোবাসতে হবে। কারও ব্যাপারে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করা চলবে না।

ইয়াযীদের ব্যাপারেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ যে মূলনীতি বেঁধে দিয়েছেন, তার বাইরে যাওয়া যাবে না। তাদের কথা হচ্ছেÑ তার উপর লানত বর্ষণ করা এবং তাকে গালি দেয়া যাবে না। এমনিভাবে হাসান ও হুসাইন এবং আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসায় কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করা যাবে না। যেমনটি করে থাকে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (সা.) দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। 

উপরোক্ত ৭টি কারণ ছাড়া আরও অনেক কারণে আমাদের বাংলাদেশী সুন্নী-মুসলিমদের মাঝে কারবালার ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। দ্বীনের সঠিক শিক্ষার বিস্তার হলে এবং ইসলামের ইতিহাসের সঠিক তথ্য তুলে ধরে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হলে অচিরেই সুন্নী মুসলিমগণের ভুল ধারণা পাল্টে যাবে ইন্শা-আল্লাহ। যোগ্য আলেম ও দাঈ‘দের এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।

সর্বোপরি ইসলামে কারও জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালন করার এবং কারও মৃত্যুতে মাতম করা, উচ্চঃস্বরে বিলাপ করা এবং অন্য কোনো প্রকার অনুষ্ঠান করার কোনো ভিত্তি নেই। শুধু তাই নয়; এটি একটি জঘন্য বিদআত, যা পরিত্যাগ করা জরুরি। নবী (সা.) বা তাঁর সাহাবীগণ কারও জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস পালন করেননি। 


* ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক সেক্রেটারি-বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস।

[১] সহীহুল বুখারী।

[২]  জামে‘ আত্ তিরমিযী-ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন; দেখুন : সিলসিলায়ে সহীহাহ্- হা. ৭৯৬।

[৩] সহীহুল বুখারী।

[৪] সহীহুল বুখারী-হা. ৫৯৯৪।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত