সাময়িক প্রসঙ্গ
কুরবানী দেয়া ওয়াজিব নাকি সুন্নত? কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য দান করা যাবে কি?
আরাফাত ডেস্ক

কুরবানী দেয়া ওয়াজিব নাকি সুন্নত? কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য দান করা যাবে কি?
“রাসূল (সা.) তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো, আর যা কিছু নিষেধ করেছেন তা বর্জন করো।” (সূরা আল হাশ্র : ৭)
কুরবানী দেয়া ওয়াজিব না-কি সুন্নত?

কুরবানী দেয়া কি ওয়াজিব না কি সুন্নত? কেউ যদি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে কুরবানী না দেয় তাহলে কি গুনাহ হবে? এ প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব, সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা সুন্নতে মুআক্কাদা। এটিই জুমহুর তথা অধিকাংশ ইমামদের অভিমত। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে তা বাদ দেয়া ঠিক নয়। কিন্তু যেহেতু ওয়াজিব নয় সেহেতু কেউ যদি কুরবানী না করে তাহলে গুনাহগার হবে না -ইন্শা-আল্লাহ।
পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফাহ্ (*)’র নিকট ধনী শ্রেণির উপর কুরবানী দেয়া ওয়াজিব। তার নিকট ধনী বলতে তাকে বুঝায় যে যাকাতের নেসাবের মালিক। এমতানুসারে সামর্থ থাকার পর কুরবানী না করলে গুনাগার হতে হবে।
কিন্তু তার ছাত্র আবূ ইউসুফ (‌'আ.) তা বিরোধিতা করে জুমহুরের সাথে ঐকমত প্রকাশ করেছেন।
যাহোক নিম্নে এ বিষয়ে সাহাবী ও তাবঈদের অভিমত পরিবেশন করা হলো। তাহলে এর মাধ্যমে কুরবানী ওয়াজিব বা সুন্নত হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে -ইন্শা-আল্লাহ।
দলিলের আলোকে কুরবানী সুন্নত না কি ওয়াজিব?

জমহুর তথা অধিকাংশ বিদ্বানের মতে কুরবানী দেয়া সুন্নাত বা মুস্তাহাব। আবূ বক্র (রাযি.), ‘উমার (রাযি.), আবূ সা‘ঈদ (রাযি.), আবূ মাস‘ঊদ বাদারী (রাযি.), বিলাল (রাযি.) প্রমুখ সাহাবী এই মতই প্রকাশ করতেন।[১]
দলিল :
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ (ﷺ) قَالَ : ্রإِذَا دَخَلَتِ الْعَشْرُ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعَرِهِ وَبَشَرِهِ شَيْئًا.
উম্মে সালামাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন : “যিলহজ্জের (প্রথম) দশক প্রবেশ করলে তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী দিতে ইচ্ছুক সে যেন তার চুল এবং (শরীরের) চর্ম হতে কিছুই স্পর্শ না করে (অর্থাৎ- না কাটে)।”[২]
ইমাম শাফে‘য়ী (রহ্.) বলেন : উক্ত হাদীসের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কুরবানী দেয়া ওয়াজিব নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : “তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করতে ইচ্ছা করে তাহলে সে যেন না করে।” যদি কুরবানী করা ওয়াজিব হতো তাহলে এভাবে বলা হতো; তাহলে সে যেন কুরবানী না দেয়া পর্যন্ত নিজের চুল প্রভৃতি স্পর্শ না করে।”[৩]

ইমাম আত্ তিরমিযী বলেন :
اَلْعَمَلُ عَلٰى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ أَنَّ الْأُضْحِيَّةَ لَيْسَتْ بِوَاجِبَةٍ وَلَكِنَّهَا سُنَّةٌ مِنْ سُنَنِ رَسُوْلِ اللهِ (ﷺ) يُسْتَحَبُّ أَنْ يُعْمَلَ بِهَا، وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ، وَابْنِ المُبَارَكِ.
“এর উপরই আহলে ‘ইল্মদের ‘আমল রয়েছে যে, কুরবানী দেয়া ওয়াজিব নয়। তবে সেটা নবী (সা.)-এর অন্যতম সুন্নাত যার উপর ‘আমল করা মুস্তাহাব। এটা সুফিয়ান সাওরী ও ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক প্রমুখদের কথা অভিমত।”[৪]
সালাফে সালেহীনের অধিকাংশের এটাই অভিমত যে কুরবানী দেয়া ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
হাজীদের কুরবানী প্রসঙ্গ : হাজীগণ হজ্জের মাঠে যে পশু কুরবানী দেয় তাকে আরবীতে ‘হাদী’ বলা হয়; কুরবানী বলা হয় না। যারা তামাত্তু ও ক্বেরান হজ্জ করেন তাদের উপর এ ‘হাদী’ যবেহ করা ওয়াজিব। অবশ্য হাজীগণ আলাদাভাবে কুরবানীও করতে পারে। তবে এটা তাদের উপর ওয়াজিব নয়।[৫]
কুরবানী সুন্নতে মুআক্কাদা হওয়ার ব্যাপারে পূর্বসূরীদের মতামত ও কর্মনীতি : নি¤েœ সালাফে সালেহীনের কুরবানী সম্পর্কে কতিপয় বক্তব্য ও কর্মনীতি পরিবেশিত হলো যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে কুরবানী দেয়া ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ।

১ম :
عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ أَبِيْ سُرَيْحَةَ قَالَ : لَقَدْ رَأَيْتُ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ (ু) وَمَا يُضَحِّيَانِ. عَنْ أَهْلِهِمَا خَشْيَةَ أَنْ يَسْتَنَّ بِهِمَا. أَخْرَجَهُ عَبْدُ الرَّزَّاقِ فِيْ مُصَنَّفِهِ بِإِسْنَادٍ صَحِيْحٍ.
ইমাম শাবী সুরাইহা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : “আমি আবূ বক্র ও ‘উমার (রাযি.)-কে দেখেছি তাঁরা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দিতেন না এই আশংকায় যে, মানুষ তাদের এ কাজকে সুন্নত বানিয়ে নিবে।”[৬]

২য় :
عَنْ أَبِيْ وَائِلٍ قَالَ : قَالَ أَبُوْ مَسْعُوْدٍ الْأَنْصَارِيُّ : ্রإِنِّيْ لَأَدَعُ الْأَضْحَى، وَإِنِّيْ لَمُوْسِرٌ مَخَافَةَ أَنْ يَرَى جِيْرَانِيْ أَنَّهُ حَتْمٌ عَلَيَّগ্ধ.
আবূ ওয়াইল হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ মাস‘ঊদ আনসারী বলেন : “আমি সচ্ছল হওয়ার পরেও কুরবানী করা পরিত্যাগ করি এজন্য যে, যাতে আমার প্রতিবেশীরা মনে না করে যে তা আমার উপর ওয়াজিব।”[৭]
আলোচ্য হাদীসের আ’মাশ ‘মুদাল্লেস’ হলেও যেহেতু মানসূর তার ‘মুতাবাআত’ করেছে তাই ওটা আর ধর্তব্য নয়।[৮]

৩য় : ইবনু ‘উমার (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি কুরবানী সম্পর্কে বলেন :
্রهِيَ سُنَّةٌ وَمَعْرُوْفٌ.
অর্থ : “সেটা সুন্নাত ও সওয়াবের কাজ।”[৯]

৪র্থ :
عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ قَالَ : قُلْتُ لِعَطَاءٍ : أَوَاجِبَةٌ الضَّحِيَّةُ عَلَى النَّاسِ؟ قَالَ : ্রلَا، وَقَدْ ذَبَحَ رَسُوْلُ اللهِ (ﷺ)গ্ধ.
ইবনু জুরাইজ বলেন : আমি আত্বাকে প্রশ্ন করলাম, কুরবানী করা কি মানুষের উপর ওয়াজিব? তিনি বললেন : “না, ওয়াজিব নয়। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানী করেছেন।”[১০]
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে হানাফীগণ যে সব দলিল পেশ করেন তা হয় দুর্বল নতুবা দাবীর সাথে মিল নেই।[১১]

কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য দান করা যাবে কি?
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদেরকে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফযীলতের বিভিন্ন ধরণের ‘ইবাদত দিয়েছেন। প্রত্যেকটি ‘ইবাদতের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রয়েছে। তাই কুরআন ও হাদীসে যখন যেভাবে যে ‘ইবাদত করার নির্দেশনা এসেছে তখন তা সেভাবে সম্পাদন করাই কর্তব্য।
যেমন- কারো সম্পদের যাকাত র্ফয হলে গরীব-অসহায় মানুষের কল্যাণে আর্থিক যাকাত প্রদান করবে এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। হজ্জ র্ফয হলে হজ্জ আদায় করবে। রামাযান মাস শেষে খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা দিবে, কুরবানীর সময় কুরবানী দিবে ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা এ সব বৈচিত্র্যময় ‘ইবাদত দিয়েছেন যেন মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে এবং বিভিন্ন প্রকার ফযীলত লাভ করতে পারে।
নানা যুক্তি ও অজুহাত দাঁড় করিয়ে মহান আল্লাহর দেওয়া বিধানের বিপরীত কাজ করা সমীচীন নয়।
সুতরাং কুরবানীর সময় কুরবানী করাই উত্তম। বিধানগতভাবে এটি সুন্নত মুয়াক্বাদা-মতান্তরে ওয়াজিব।
কুরবানীর পরিবর্তে অন্য কিছু করার বিধান থাকলে অবশ্যই রাসূল (সা.) তা বলে যেতেন।
সুতরাং কুরবানী না দিয়ে তার মূল্য টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করার চিন্তা বর্জনীয়। এ ক্ষেত্রে পশু কুরবানী দিয়ে তার গোশ্তের একটা অংশ গরীবদেরকে দিবেন, পশুর চামড়ার অর্থ তাদেরকে দেবেন (যদি নিজে ব্যবহার না করেন) এবং সম্ভব হলে কিছু আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। তাহলে উভয় দিক থেকে সওয়াব পাওয়া যাবে -ইন্শা-আল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক্ব দান করুন -আমিন।

সৌদি আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির ফাতাওয়া :
الضحية عن نفس المسلم وعن أهل بيته (الحي) سنة مؤكدة للقادر عليها، وذبحها أفضل من الصدقة بثمنها. (انتهى من فتاوى اللجنة الدائمة- ১১/৪১৯)
সামর্থ্যবান মুসলিম ব্যক্তি এবং তার (জীবিত) পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আর তা জবেহ্ করা অধিক উত্তম তার মূল্য দান করার থেকে।[১২]
তবে ইসলাম সবসময় বিশেষ পরিস্থিতিকে ব্যতিক্রমভাবে মূল্যায়ন করে। অর্থাৎ- পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে মানুষ চরম বিপদগ্রস্ত, প্রচ- ক্ষুধা-দারিদ্র্য, হাহাকার, অথবা কোনো গরীব অসহায় ব্যক্তি চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর পথযাত্রী অথচ তাকে সাহায্য করার কেউ নেই অথবা কেউ যদি দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে সে ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে কুরবানী না করে তার অর্থ দ্বারা বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা জায়িয বলে কারো কারো অভিমত রয়েছে। যেমন-
সাওরির সূত্রে ‘ইমরান ইবনু মুসলিম থেকে সুওয়াইদ ইবনু গাফলাহ বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আমি বিলালকে বলতে শুনেছি-
لَأَنْ أَتَصَدَّقَ بِثَمَنِهَا – يعني الأضحية - عَلٰى يَتِيْمٍ أَوْ مُغَبَّرٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أُضَحِّيَ بِهَا.
“আমার কাছে একজন ইয়াতীমকে বা ধূলিধূসরিত ব্যক্তিকে এর (কুরবানীর) মূল্য দান করা কুরবানী করার চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।” তিনি বলেন, আমি জানি না এটা আসওয়াদ নিজেই বলেছেন নাকি বিলালের বক্তব্য থেকে।[১৩]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ্ বলেন, নফল দান-সাদাক্বার চেয়ে নফল হজ্জ অধিক উত্তম কিন্তু যদি নিকটাত্মীয়ের মধ্যে অভাবী থাকে তবে তাদেরকে দান করা নফল হজ্জের চেয়ে অধিক উত্তম।[১৪]
আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ উসাইমিন (রহ্.) বলেন,
إذا دار الأمر بين الأضحية وقضاء الدين عن الفقير فقضاء الدين أولى، لاسيما إذا كان المدين من ذوي القربى.
“যদি বিষয়টি কুরবানী করা এবং গরীবদের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের মধ্যে আবর্তিত হয় তাহলে ঋণ পরিশোধ করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি ঋণগ্রহীতা নিকটাত্মীয় হয়।”[১৫]


[১] তাফসীর কুরতুবী।
[২] সহীহ মুসলিম- হা. ৩৯/১৯৭৭।
[৩] বায়হাক্বী ফিস সুনান- ৭/২৬৩; ফিকহুল উযহিয়াহ্- ১২-১৩।
[৪] জামে‘ আত্ তিরমিযী- ৪/৯২, হা. ১৫০৬, য‘ঈফ।
[৫] দ্র. আল মুগণী ফি ফিক্বহিল হাজ্জে ওয়াল ‘উমরাহ্।
[৬]  মুসান্নাফ ‘আব্দুর রাযযাক- হা. ৮১৩৯, সনদ সহীহ; দ্র. ফিকহুল উযহিয়্যাহ- হা. ১৫।
[৭] মুসান্নাফ ‘আব্দুর রাযযাক- হা. ৮১৪৯।
[৮] মুসান্নাফ ‘আব্দুর রাযযাক- হা. ৮১৪৮।
[৯]  তালীকে বুখারী, ফাতহুলবারী- ১০/৬; সহীহুল বুখারী- মা. শা., ৭/৯৯।
[১০] মুহান্নাফ ‘আব্দুর রাযযাক- হা. ৮১৩৪, সনদ সহীহ, দ্র. ফিকহুল উযহিয়্যাহ- হা. ১৭।
[১১] দ্র. ফিকহুল উযহিয়া- পৃ. ১৯।
[১২] স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি- ১১/৪১৯।
[১৩] মুসান্নাফে ‘আব্দুর রায্যাক- হা. ৮১৫৬।
[১৪] ফাতাওয়া কুবরা- ৫/৩৮২।
[১৫] মাজমূ‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল- ১৩/১৪৯৬।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত