[পর্ব- ০২]
৬. গাছের গুড়ির কান্নার মু‘জিযাহ্ : উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রায়ই একটি গাছের গুড়ির দিকে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতেন এবং এর পাশে দাঁড়িয়ে খুতবাহ্ দিতেন। মাসজিদটি একটি তাবুর মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর একজন সাহাবী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখেন, আমরা কি এমন একটি কাঠামো বানাবো না যাতে দাঁড়িয়ে আপনি বৃক্ততা রাখবেন? যাতে মানুষজন জুমু‘আর দিন আপনাকে দেখতে পারে এবং আপনার খুতবাহ্ শুনতে পারে। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বলেন, হ্যাঁ।
তাই সে একটি তিন স্তর বিশিষ্ট মেহরাব তৈরি করে। তিনি (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, যখন মেহরাবটি বানানো শেষ হয় এবং আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে বসানো হয়। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আসলেন এবং মেহরাবটির দিকে এসে গাছের গুড়িটি অতিক্রম করে যেতে লাগলেন। তখন গুড়িটি বিলাপ করে কেঁদে উঠলো। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গাছের গুড়ির নিকট ফিরে এলেন। তারপর তিনি মেহরাবটির কাছে আসেন।
তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, এরপর যখনই তিনি (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামায পড়তেন এ গুড়িটির নিকট দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন। যখন মাসজিদটি ধ্বংস করা হয় উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) গুড়িটি নিজের কাছে রাখেন। তারপর উইপোকায় খাওয়া ময়লায় পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার কাছেই ছিল।
যায়েদ ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত যে, আনসারী এক মহিলা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমি কি আপনার জন্য এমন একটি জিনিস বানাব না যার উপরে আপনি বসবেন? যেহেতু আমার একজন কাঠমিস্ত্রি দাস আছে। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন তুমি যদি চাও (বানাতে পার) অতঃপর সে তাঁর জন্য একটা মেহরাব বানালো। এরপর পরের জুমু‘আর দিনে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বানানো মেহবারটিতে বসলেন। আর তার পাশে খেজুর গাছের গুড়িটি, যাতে তিনি খুতবাহ্ দেয়ার সময় হেলান দিতেন কেঁদে ওঠে, যতক্ষণ না গগন বিদারী শব্দে ফেটে পড়ে। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেহবার থেকে নেমে আসেন এবং গুড়িটিকে ধরেন ও কোলাকুলি করেন তারপর গুড়িটি গোঙানি দিতে থাকে ঠিক শিশুদের গোঙানির মতো। তারপর ধীরে ধীরে এটা শান্ত হয়।
আনাস ইবনু মালেক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিহরাবে বসলেন গাছের গুড়িটি আগের মতো চিৎকার করে উঠে যতক্ষণ না মাসজিদটি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে দুঃখ ধনায় কেঁদে উঠে। এ কান্না শুনে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেহরাব থেকে নেমে এলেন এবং গুড়িটিকে হাত দিয়ে ধরেন গুড়িটি শান্ত হওয়ার পর বলেন,
সেই সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! যদি আমি একে না ধরতাম তবে এ গুড়ি রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য ক্বিয়ামতের দিন পর্যন্ত কাঁদতে থাকত। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একে কবরস্থ করে দিতে আদেশ করেন। [আদ্ দারেমী কর্তৃক বর্ণিত।]
সাহ্ল ইবনু সা‘দ সা‘ঈদী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, পুরো মদীনা শহরে একজন মাত্র কাঠমিস্ত্রি ছিল। আর আমিও সেই মিস্ত্রি আল খাফিক্বাইন নামক স্থান হতে ঝাউগাছের কাঠ কাটতে গেলাম মেহরাব বানাতে। মেহরাবটি বানানো হলে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে দাঁড়ান : আর তখনই গাছের গুড়িটি কেঁদে উঠে। তখন রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
“তোমরা কি গুড়িটির কান্নায় বিস্মিত নও?”
তারপর উপস্থিত সবাই এগিয়ে আসে এর কান্না দেখে ভীত বিহবল হয়ে পড়ে এবং কাঁদতে শুরু করে এরপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেহরাব থেকে নেমে আসেন। গুড়িটির কাছে এসে দাঁড়ান। একে হাত দিয়ে ধরেন ফলে গুড়িটি শান্ত হয়। অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একে তার মেহরাবের নিচে কবরস্থ করার আদেশ করেন অথবা এটিকে মাটির নিচে রাখা হয়েছিল।
৭. জিন্দের ইসলাম গ্রহণ : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন গোত্রে পরিভ্রমণ করছিলেন। এই উপলক্ষে ‘উকায মেলায় তশরীফ নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে রাত্রিকালে নাখলা নামক স্থানে অবস্থান করলেন। প্রাতঃকালে রাসূলুল্লহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথীদের নিয়ে ফজরের নামায পড়ছেন। অনুসন্ধানের জন্য জিন্দের যে-দল ‘তিহামা’ অভিমুখে আসছিল এবং এ স্থান অতিক্রম করছিল তখন কুরআন মাজীদের আয়াত শুনে সমস্বরে বলে উঠল- এটাই তো সেই সত্যের আলো যা আমরা উজ্জ্বল নক্ষত্রে দেখতে পাই। তারা প্রত্যাবর্তন করে স্বীয় সম্প্রদায়ের নিকট গেল এবং তাদেরকে সর্বশেষ নাবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ জানাল।
দ্বিতীয়বারের ঘটনায় ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সঙ্গে ছিলেন। ইমাম আত্ তিরমিযী’র সুনান গ্রন্থে আছে, তাঁর শাগরেদ্ ‘আলকামা একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : জিন্রে ঘটনার রাতে আপনাদের মধ্যে কেহ ছিলেন কি? তিনি বললেন : না, তবে আর একবার রাতে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে পাচ্ছিলাম না। উপত্যকায় কোথাও তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল না। তাঁকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেল, না চক্রান্ত করে হত্যা করে ফেলল ইত্যাদি নানা চিন্তায় আমরা অতি উদ্বিগ্নের সাথে রাত যাপন করলাম। প্রত্যুষে দেখতে পেলাম, তিনি হিরা পর্বতের দিক হতে আসছেন। তিনি বললেন : রাতে জিন্দের দূত এসে আমাকে নিয়ে গেল। আমি তাদেরকে কুরআন পড়ে শুনাচ্ছিলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে সেখানে গেলেন এবং জিন্দের অবস্থান ও আগুন জ্বালানোর নিদর্শনসমূহ দেখালেন। তিনি বললেন : আমার নিকট পথের খাদ্য চেয়েছিল। আমি তাদের জন্য দু‘আ করলাম- তারা যে হাড় ও গোবরের নিকট দিয়ে গমন করবে তারা যেন খাদ্যে পরিণত হয়ে যায়।
৮. কুরায়শদের দুর্ভিক্ষ : কুরায়শদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য বদদু‘আ করেন : ইয়া আল্লাহ! ইঊসুফ (‘আলাইহিস্ সালাম)-এর যামানায় যেভাবে সাত বৎসর যাবৎ দুর্ভিক্ষ স্থায়ী রেখেছিলেন তদ্রুপ আপনি এদের মধ্যে সাত বৎসর দুর্ভিক্ষ স্থায়ী রাখুন। ফলে এদের মধ্যে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এমনকি মৃত প্রাণী ও তার চামড়া পর্যন্তও এরা খাওয়া আরম্ভ করে। ক্ষুধার জ্বালায় তারা সমগ্র পৃথিবী অন্ধকার দেখতে লাগল। আকাশের দিকে তাকালে ধু¤্রবৎ দৃষ্টিগোচর হত। অবশেষে নিরূপায় হয়ে কুরায়শ সরদার আবূ সুফ্ইয়ান রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট হাযির হয়ে বললেন : হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনি মহান আল্লাহর ‘ইবাদত এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করতে আদেশ দিয়ে থাকেন। অথচ আপনার বংশধর দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়ে ধবংস হয়ে যাচ্ছে, আপনি মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দু‘আ করলে বৃষ্টিপাত হলো, তারা দুর্ভিক্ষের কবল হতে মুক্তি পেল।
৯. দুধ বিহীন ছাগলের দুধ হওয়া : ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, আমি উঠতি বয়সের বালক ছিলাম। কুরায়শ কাফির সর্দার ‘উক্বা ইবনু মু‘ঈত-এর ছাগপাল চরাচ্ছিলাম। এমন সময় রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং আবূ বক্র সিদ্দীক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) ঐ পথে কোথাও গমন করছিলেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, হে বৎস! তোমার কোন ছাগলের স্তনে দুধ আছে কি? আমাদেরকে পান করাবে? উত্তরে বললাম, আমার জানা মতে এমন কোন দুধের ছাগল নেই। অতঃপর তিনি আমার নিকট একটি ছাগল শাবক চাইলে আমি তাঁর নিকট একটি ছাগল-শাবক নিয়ে গেলাম। আবূ বক্র সিদ্দীক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) শাবকটি ধরে রাখলেন এবং রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার পায়ে ধরে হাত রেখে দু‘আ করলেন। আবূ বক্র (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) পাথরের একটি পাত্র তাঁকে দিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উক্ত ছাগল শাবকের স্তন হতে দুধ দোহন করে নিজে পান করলেন অতঃপর আবূ বক্র (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) পান করলেন। ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে দুধ পান করালেন। দুধ পান শেষে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছাগল শাবকের স্তনকে সম্বোধন করে বললেন, হে দুধের স্তন! পূর্ববৎ হযে যাও। তখন উক্ত ছাগলের বাচ্চাটি পূর্ববৎ হয়ে গেল। এর পর আমি রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সমীপে আরয করলাম, আমাকে কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিন। তখন আমি তাঁর নিকট হতে সত্তরটি সূরা শিক্ষা করলাম যাতে কেউ আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না।
১০. ভাঙ্গা পা ভালো হওয়া : ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আতীক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করতঃ আবূ রাফি‘ ‘ইয়াহূদীকে হত্যা করে নেমে আসার সময় সিঁড়ি হতে পড়ে গিয়ে তিনি পায়ে আঘাত পান। প্রাথমিক অবস্থায় আঘাত ততটা অনুভব করতে পারেননি, কিন্তু পরে চরম অবস্থা দাঁড়ায়। ইবনু ইসহাকের বর্ণনানুযায়ী সঙ্গীগণ তাঁকে উঠিয়ে এনেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকটে এসে সমস্ত ঘটনা শুনালেন। তিনি আহত পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। তৎক্ষনাৎ তিনি সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়ে গেলেন। মনে হলো যেনো কোন আঘাতই পাননি।
১১. অগ্নিদগ্ধ শিশু সুস্থ হওয়া : মুহাম্মদ ইবনু হাতির (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) একজন সাহাবী। তিনি যখন মাতৃক্রোড়ে শিশু ছিলেন তখন হঠাৎ মায়ের কোল হতে ছুটে অগ্নিতে পড়ে যান এবং দেহের কিছু অংশ পুড়ে যায়। তাঁর মাতা তাঁকে সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহ লুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খিদমতে আগমন করলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুখের লালা শিশুর জ্বলন্ত স্থানসমূহে মালিশ করে দিলেন এবং দু‘আ পড়ে ফূঁক দিয়ে দিলেন। তায়ালিসী এবং ইবনু হাম্বলের আল মুসনাদ গ্রন্থদ্বয়ে এতটুকুই বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ইমাম বুখারী (রাহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) তদীয় তারিখে সনদসহ বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মদ ইবনু হাতিব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর আম্মা বলতেন, শিশুকে নিয়ে আমি সেখান হতে ফেরার পূর্বেই তার জ্বলা-ক্ষত সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেল।
১২. এক পেয়ালা দুধে বরকত : একদিন আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির হয়ে রাস্তার উপর পরে গেলেন। আবূ বক্র (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) যাচ্ছিলেন, তিনি তাঁকে কুরআন মাজীদের একটি আয়াত জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু এতে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজের দুরবস্থার প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করা। তিনি এতটুকু লক্ষ্য না করেই চলে গেলেন। তৎপর ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) ঐ পথ দিয়ে গমন করলেন তিনি সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর নিকটও একটি আয়াত জিজ্ঞাসা করলেন; কিন্তু তিনিও অমনোযোগিভাবেই চলে গেলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ পথ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি তাঁকে দেখামাত্রই বিষয়টি উপলব্ধি করে তাঁকে গৃহে নিয়ে গেলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গৃহে প্রবেশ করতঃ পরিপূর্ণ এক পেয়ালা দুধ দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, হাদিয়া স্বরূপ এই দুগ্ধ এসেছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আস্হাবুস সুফ্ফাকে ডেকে আনার জন্য আবূ হুরাইরাকে আদেশ দিলেন। এতে আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলতে লাগলেন, আমার ক্ষুধা মিটানোর জন্য এই এক পেয়ালা দুধ আমারই প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ পালন না করে পারেন না তাই আস্হাবুস্ সুফ্ফাকে ডেকে আনলেন। সকলেই নিজ নিজ স্থানে বসে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশে আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) সকলকে দুধ পান করাতে আরম্ভ করলেন। সকলেই দুগ্ধ পান করে তৃপ্তি লাভ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুগ্ধপাত্র হাতে নিয়ে হাসি-মুখে আবূ হুরাইরার দিকে লক্ষ্য করে বললেন : এখন তুমি আর আমিই অবশিষ্ট আছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে পান করাতে আরম্ভ করলেন। শেষ পর্যন্ত আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলে উঠলেন : উদর পূর্তি হয়ে গেছে আর পান করতে পারব না)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পেয়ালা হাতে নিয়ে বিসমিল্লা-হ্ বলে অবশিষ্ট সমস্ত দুধ পান করে ফেললেন।
১৩. অল্প পানিতে অনেক বরকত : একবার সফরের অবস্থায় ভোর রাত্রে কাফেলা হতে পৃথক হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শয়ন করলেন। আর কতিপয় সাথীকে বলে দিলেন যে, নামাযের প্রতি লক্ষ্য রেখ। কিন্তু তাঁরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সর্বপ্রথম মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ই নিদ্রা হতে জাগ্রত হলেন। তখন দিন হয়ে গেছে। এখন সকলেই ব্যস্ত হয়ে গাত্রোত্থান করলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে তথা হতে প্রস্থান করতে নির্দেশ দিলেন। যখন বেলা বেড়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাওয়ারী হতে নামিয়া ওযূ করলেন। ওযূ করার পর সামান্য একটু পানি বাঁচল, তিনি আবূ ক্বাতাদাহ্কে বললেন, এই পানিটুকু যত্ন করে রাখো। এটা থেকে এক অসাধারণ নিদর্শন প্রকাশিত হবে। বেলা যখন অনেক বেড়ে গেল তখন তিনি কাফেলার সাথে মিলিত হলেন। লোকেরা বলতে লাগল : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! পিপাসায় আমরা মৃত প্রায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : তোমরা বিনাশপ্রাপ্ত হতে পার না। এই বলে তিনি ওযূর অবশিষ্ট পানি আবূ ক্বাতাদার নিকট থেকে নিয়ে তাদেরকে পান করাতে আরম্ভ করলেন। কাফেলার সমস্ত লোক ইচ্ছা মতো পানি পান করে তৃপ্তি লাভ করলেন।
১৪. বোবার বাকশক্তিমান হওয়া : বিদায় হাজ্জের সময় এক মহিলা তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খিদমতে হাজির হয়ে আরয করল, এই বালকটি কথা বলতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পানি আনিয়ে হাত ধৌত করলেন এবং কুলি করলেন। তৎপর বললেন : এই পানি তাকে পান করাও এবং কিয়দংশ তার শরীরে ছিটিয়ে দাও। পরবর্তী বৎসর উক্ত মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খিদমতে আগমন করে বলল : বালকটি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছে। এখন সে যথারীতি কথা বলতে পারে।
১৫. অলস অশ্বের তেজস্বী হওয়া : আবূ ত্বালহাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর একটি অলস অশ্ব ছিল। এটা ছিল অত্যন্ত ধীরগতির। একদা মদীনা শহরে হৈ-চৈ গ-গোল আরম্ভ হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেই ঘোড়াটির উপর আরোহণ করতঃ মদীনা শহর ঘুরে আসলেন। তিনি আরোহণ করার বরকতে ঘোড়াটি তেজস্বী ও দ্রুতগামী হয়ে গেল যে, তিনি প্রত্যাগমনের পর বললেন : এতো খুবই দ্রুতগামী। তৎপর কোন ঘোড়াই এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্রগামী হতে পারত না।
১৬. একমুঠো ধুলোবালিতে এক বাহিনী ছত্রভঙ্গ : বদর প্রান্তরে যখন উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল তখন নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ পূর্বক রণাঙ্গনে প্রশাস্ত অন্তঃকরণে নির্ভীক চিত্তে সাজদাবনত মস্তকে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছিলেন। সাজদাহ্ হতে মাথা উত্তোলন করে এক মুষ্টি কঙ্কর মিশ্রিত মাটি হাতে নিয়ে শত্রু সৈন্যের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। ফলে শত্রুগণ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَلَمْ تَقْتُلُوْهُمْ وَلٰكِنَّ اللهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ اِذْ رَمَيْتَ وَلٰكِنَّ اللهَ رَمَى وَلِيُبْلِىَ الْمُؤْمِنِيْنَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا اِنَّ اللهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾
হে মুসলমানগণ! তোমরা তাদেরকে নিহত করোনি; বরং স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নিহত করেছেন। (আ রহে নাবী!) যখন আপনি (কঙ্কর) নিক্ষেপ করেছিলেন তখন আপনি নিক্ষেপ করেননি; বরং আল্লাহ তা‘আলা নিক্ষেপ করেছিলেন, যেন মুসলমানদেরকে (বিজয় লাভস্বরূপ) উত্তম পুরস্কার প্রদান করেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ প্রার্থনা শ্রবণ করেন এবং রহস্যসমূহ জানেন।”
১৭. খন্দক খননকারীদের খাদ্যে বিস্ময়কর বরকত : পরিখা খননকালে নবুওয়াতের কতিপয় নিদর্শন প্রকাশিত হয়। সহীহুল বুখারী’র বর্ণনায় আছে যে, নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তীব্র ক্ষুধার ব্যাপারটি অবগত হয়ে জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ একটি বকরীর বাচ্চা জবেহ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী এক সা (আনুমানিক আড়াই কেজি) যব পিশে আটা তৈরি করলেন। অতঃপর কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীসহ একান্তে তাঁর বাসায় তাশরীফ আনার জন্য নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে অনুরোধ পেশ করলেন। কিন্তু নাবী কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরিখা খননরত সকল সাহাবীকে যাদের সংখ্যা ছিল এক হাজার) সঙ্গে নিয়ে তাঁর গৃহে গমন করলেন।
আল্লাহ তা‘আলার অশেষ অনুগ্রহে এই স্বল্প খাদ্যে সাহাবীগণের সকলেই পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেলেন অথচ গোশতের পাত্রে গোশ্ত অবশিষ্ট রইল এবং আটার পাত্রেও আগের মতোই আটা অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় ক্রমাগতভাবে রুটি তৈরি হতে থাকল।
পিতা এবং মামাকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে নোমান ইবনু বাশীরের বোন অল্প খেজুরসহ খন্দকের নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা চেয়ে নিয়ে একটি কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে দেন। অতঃপর খননরত সাহাবীদের দা‘ওয়াত দিয়ে তা খেতে বললেন। সাহাবীগণ খেতে থাকলে খেজুরের পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকল। পূর্ণ পরিতৃপ্তি সহকারে সকল সাহাবীর খাওয়ার পরেও এ পরিমাণ খেজুর অবশিষ্ট রইল যে, তার কিছু পরিমাণ
কাপড়ের বাইরেও পড়েছিল। [সমাপ্ত] ###
মুসলিম, ১মখ-, পৃঃ ১৮৪; বুখারী- ১মখ-, পৃঃ ১০৬; বুখারী- ২য় খ-, পৃঃ ৭৩২; তিরমিযী- ২য় খ-, পৃঃ ১৬৯-১৭০; আল্ মুসনাদ লি আহমাদ ইবনু হাম্বল- ১ম খ-, পৃঃ ২৫২।
সুনানুত্ তিরমিযী- ২য় খ-, পৃঃ ১৬১।
সুনানুত্ তিরমিযী- ২য় খ-, পৃঃ ১৬৩।
আহমদ ইবনু হাম্বল, আল মুসনাদ- ১ম খ-, পৃঃ ৩৭৯
সহীহুল বুখারী- ২য় খ-, পৃঃ ৫৭৭।
আল মুসনাদ লি আবী দাঊদ তায়ালিসী- পৃঃ ১৬৫; আল মুসনাদ লি আহমাদ ইবনু হাম্বল- ৪র্থ খ-, পৃঃ ২৫৯।
সহীহুল বুখারী- ২য় খ-, পৃঃ ৯৫৫-৯৫৬; আল মুস্তাদরিক লিল হাকিম- ৩য় খ-, পৃঃ ১৬।
সহীহ মুসলিম- ১ম খ-, পৃঃ ২৩৮।
বুখারী- অধ্যায় : জিহাদ ও যুদ্ধকালীন আচার-আচরণ, হাঃ ২৮২০, আবূ না‘ঈম, দালায়িলুন নুবুওয়ত- পৃঃ ১৬৭।
জালালুদ্দীন সুয়ূতী, আল্ খাসায়িসুল কুব্রা উর্দু অনুবাদক মুফতী গোলাম মু‘ঈনুদ্দীন, (দিল্লী : ই‘তিকাদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৮৮), ২য় খ-, পৃঃ ১০০।
আল কুরআন, সুরাতুল আনফাল : ১৭।
সহীহুল বুখারী- ২য় খ-, পৃঃ ৫৮৮ ও ৫৮৯।
ইবনু হিশাম- ২য় খ-, ২১৮ পৃঃ।
আপনার মন্তব্য