‘নফসে মুতমাইন্নাহ’ কাকে বলে?
‘নফসে মুতমাইন্নাহ’ একটি ইসলামী পরিভাষা। এর অর্থ- প্রশান্ত আত্মা বা স্থির চিত্ত।
মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস পোষণকারী সত্যের অনুগামী স্থির চিত্তের নামই নফসে মুতমাইন্নাহ। যা সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা, বিপদ-মুসিবত ও জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা পোষণ করে এবং এর উপর অবিচল থাকে। সামান্য সমস্যা ও দুর্বিপাকে অস্থির হয় না, হা-হুতাশ করে না, আশাহত হয় না এবং মহান আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা পোষণ করে না; বরং সকল অবস্থায় মহান আল্লাহর প্রশংসা করে এবং তাঁর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে। এ ধরণের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী যে হৃদয়ে মধ্যে বিদ্যমান থাকে সেটাই ইসলামের পরিভাষায় নফসে মুতমাইন্নাহ।
❑ ‘নফসে মুতমইন্নাহ’ (প্রশান্ত আত্মা)-এর মর্যাদা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِيْ إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ - وَادْخُلِيْ جَنَّتِيْ﴾
“হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।”
মহান রবের পক্ষ থেকে প্রশান্ত আত্মাকে লক্ষ্য করে এ কথাগুলো বলা হবে জান কবজের সময় আবার ক্বিয়ামত দিবসে। (তাফসীরে ইবনু কাসীর) অর্থাৎ- এ গুণ-বৈশিষ্টের অধিকারী আত্মার জন্য এটি সরাসরি জান্নাতের ঘোষণা। সুতরাং এখান থেকেই বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
❑ নফসে মুতমাইন্না (প্রশান্ত আত্মা) এবং আবূ বক্র (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) :
ইবনু আবী হাতিম ইবনে ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণনা করেন, উক্ত আয়াতটি নাযিল হওয়ার সময় আবূ বক্র (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট বসা ছিলেন। আয়াতটি শুনে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কত চমৎকার এই কথাটি!
তখন রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,
"أَمَا إِنَّهُ سَيُقَالُ لَكَ هَذَا".
“একথাটি (মৃত্যুর সময়) তোমাকে বলা হবে।”
❑ আমরা কিভাবে নফসে মুতমাইন্নাহ বা প্রশান্ত মনের অধিকারী হতে পারব?
নি¤েœাক্ত গুণাবলীগুলো অর্জন করলে আমরাও এ ধরণের নফসের অধিকারী হতে পারব Ñইন্শা-আল্লাহ। যথা-
❖ ১) ইখলাস বা একনিষ্ঠতা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوْا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ﴾
“তাদেরকে একমাত্র এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ‘ইবাদত করবে।”
ইখলাসের আলামত :
● ক) জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সাহায্য অনুভব করা। মহান আল্লাহর সাহায্যের কারণে একজন ব্যক্তির ‘ইবাদত-বন্দেগী ও কার্যক্রম ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পদস্খলন থেকে রক্ষা পায়। ইবনুল জাউযী (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন :
إنما يتعثر من لم يخلص.
“যার মধ্যে ইখলাস নেই তারই পদস্খলন ঘটে।”
● খ) ‘ইবাদতে পর্যাপ্ত সময় ও শ্রম ব্যয় করা।
● গ) গোপনে ‘ইবাদত করার আগ্রহ থাকা। তবে যে সব ‘ইবাদত জনসম্মুখে করতে হয় সেগুলোর কথা ভিন্ন। যেমন- জামা‘আতে সালাত, মহান আল্লাহর পথে দা‘ওয়াত, জিহাদ ইত্যাদি।
● ঘ) অতি যতœ সহকারে সুন্দরভাবে ‘ইবাদত করা এবং এ ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনে আন্তরিক হওয়া।
● ঙ) মহান আল্লাহর দরবারে ‘ইবাদত গৃহীত না হওয়ার ভয় থাকা।
❖ ২) রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে অনুসরণ করা : নফসে মুতমাইন্নার অধিকারী হতে হলে ‘ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, চরিত্র, পারিবারিক, সামাজিক তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ ও আদর্শের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিজের জানমাল, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা ও সকল প্রিয়জন থেকে তার ভালবাসাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলেই কেবল পূর্ণ মু’মিন হওয়ার সম্ভব।
রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتّٰى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ.
“তোমাদের কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না যে পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা পুত্র এবং অন্য সকল লোক হতে অধিক প্রিয় না হই।”
আর এতে কোন সন্দেহ নাই যে, যে হৃদয়ে প্রিয় নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ভালবাসা সকল ভালবাসার উপরে স্থান পাবে সে হৃদয় হবে সবচেয়ে প্রশান্ত ও স্থির এবং তার জন্যই অপেক্ষা করছে উপরোক্ত সুসংবাদ।
❑ রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে অনুসরণের আলামত :
● ক) রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং তা গ্রহণে উদগ্রীব থাকা।
● খ) সীরাত তথা রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবন-চরিত সম্পর্কিত বই-পুস্তক অধ্যয়ন করা।
● গ) বিদ‘আত থেকে সাবধান থাকা।
● ঘ) রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে অনুসরণ-অনুকরণে অগ্রণী থাকা।
❖ ৩) আল্লাহ তা‘আলাকে গভীরভাবে ভালবাসা : আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবেসে যখন কেউ আল্লাহর রঙ্গে জীবন রাঙ্গিয়ে দিতে পারে তখন সকল বিপদ-মুসিবতে সবর করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। সর্বাবস্থায় সে তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণ করে। শত কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে। বিপদে ধৈর্যের পরিচয় দেয় আর সুখ ও আনন্দের সংবাদে কৃতজ্ঞতা আদায় করে। এসব কারণে তার মন থেকে অস্থিরতা, হাহাকার, না পাওয়ার বেদনা দূরভিত হয় যায়। মন ভরে উঠে পরম প্রশান্তিতে।
❑ মহান আল্লাহকে ভালবাসার কতিপয় আলামত :
● ক) নিভৃতে আল্লাহর ‘ইবাদত করতে ভালো লাগা।
● খ) মহান আল্লাহর বাণী মহাগ্রন্থ আল কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণ করে আনন্দ পাওয়া।
● গ) নামায, রোযা, দান-সাদাক্বাহ্ ইত্যাদি ‘ইবাদতে তৃপ্তি অনুভব করা।
● ঘ) তাসবীহ, তাহলীল, যিক্র, দু‘আ, ইস্তিগফার ইত্যাদির মাধ্যমে জিহ্বাকে সিক্ত রাখা।
● ঙ) মহান আল্লাহর পছন্দ ও অপছন্দনীয় বিষয়ে মানসিকভাবে পূর্ণ সম্মতি থাকা।
● চ) কোন ‘ইবাদত ও নেকির কাছে ছুটে গেলে মনে কষ্ট অনুভূত হওয়া এবং আফসোস করা।
● ছ) মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘিত হতে দেখলে মনে প্রচ- রাগ সৃষ্টি হওয়া।
❖ ৪) মহান আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি : রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
"ذَاقَ طَعْمَ الْإِيْمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِيْنًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُوْلًا".
“ওই ব্যক্তিই ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে যে ব্যক্তি মহান আল্লাহকে প্রতিপালক, ইসলামকে দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে রাসূল হিসেবে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিলো।”
যে আল্লাহ তা‘আলাকে প্রতিপালক হিসেবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে স্বাভাবিকভাবে তার অন্তরে অস্থিরতা ও দুঃশ্চিন্তা স্থান পাবে না। কারণ সে জানে আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ও কুশলী আর তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তই প্রজ্ঞাপূর্ণ। তাই তাঁর ভাল-মন্দ সকল সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি থাকার মাধ্যমেই হৃদয়ে জাগ্রত হয় অনাবিল প্রশান্তি।
❖ ৫) সত্যবাদিতা : সত্যবাদিতার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত প্রশান্তি। পক্ষান্তরে মিথ্যায় রয়েছে মানসিক অশান্তি, সন্দেহ, সংশয় ও অস্থিরতা। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
الصِّدْقَ طُمَأْنِيْنَةٌ ، وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيْبَةٌ.
“সত্য হলো প্রশান্তি আর মিথ্যা হলো সংশয়।”
সত্যবাদিতার তিনটি ক্ষেত্রে রয়েছে। যথা-
● ক) মহান আল্লাহর সাথে সত্যবাদিতা : প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী মু’মিন হবেÑ
- কথায় সত্যবাদী। সুতরাং তার মুখ থেকে কখনও অসত্য কথা বের হবে না।
- আচরণে সত্যবাদী। সুতরাং সে হঠাৎ করেই রঙ বদলাবে না বা ধোঁকাবাজি ও মুনাফেকি করবে না।
- কর্মে সত্যবাদী। সুতরাং সে ‘আমল করবে ইখলাসের সাথে এবং রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দেখানো পদ্ধতির আলোকে।
● খ) বান্দাদের সাথে সত্যবাদিতা : আল্লাহ ও তার মাঝে যে চেহারা থাকে মানুষের সাথে উঠ-বস ও লেনদেনের সময় তার চেয়ে ভিন্ন চেহারা নিয়ে হাজির হবে না।
● গ) নিজের সাথে সত্যবাদিতা : যা সে বিশ্বাস করে তা সে কর্মে বাস্তবায়ন করে। নিজেকে সংশোধন করে, আত্ম সমালোচনা করে এবং প্রবৃত্তির টানে ছুটে বেড়ায় না আর একান্ত একাকীত্বেও মহান আল্লাহর ভয় হৃদয়ে জাগ্রত রেখে হারাম থেকে দূরে থাকে।
❖ ৬) তাক্বওয়া অবলম্বন : তাক্বওয়া বা মহান আল্লাহর ভয় তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার কারণে সে মহান আল্লাহর ‘ইবাদত করে; অবাধ্যতা করে না। কৃতজ্ঞতা আদায় করে; অকৃতজ্ঞ হয় না। মহান আল্লাহকে স্মরণ করে; তাকে ভুলে থাকে না আর বড়-ছোট সকল প্রকার পাপাচার থেকে বেঁচে থাকে।
স্বাভাবিকভাবে মানুষ যখন আল্লাহর ভয় হৃদয়ে জাগ্রত রাখে তখন সে যেমন মহান আল্লাহর অধিকার লঙ্ঘন করে না ঠিক তেমনি বান্দার হক্বও নষ্ট করে না। এতে হৃদয়ে বিরাজ করে এক অভূতপূর্ব তৃপ্তি ও অবর্ণনীয় প্রশান্তি। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর দাসত্ব থেকে বের হয়ে গেলে এবং বান্দার অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে অপরাধীর হৃদয়ে অশান্তির দাবানল জ্বলতে থাকে আর অস্থিরতা ও দুঃশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে।
❖ ৭) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ : মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করা, আল্লাহ তা‘আলা যে কাজে রাগ করেন সে কাজ থেকে সতর্ক করা এবং এ পথে ধৈর্য ধারণ করা।
❖ ৮) মানুষের কল্যাণে কাজ করা, গরীব, অসহায়, বিধবা ও এতিমদের সাহায্য করা ইত্যাদি।
❖ ৯) সুন্দর চরিত্র : হাসিমুখে থাকা, দেখা হলে সালাম দেয়া, মানুষের সুখে সুখী হওয়া, দুঃখে-দুঃখী হওয়া, প্রতিবেশী ও মেহমানকে সম্মান করা ইত্যাদি।
উপসংহার : শাইখ সালিহ আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লা-হ)-এর একটি মূল্যবান বক্তব্য দ্বারা উপসংহার টানতে চাই। তিনি বলেন :
“মনকে নফসে মুতমাইন্নাহ-এর পর্যায়ে উন্নীত করার উপায় হলো, মনকে মহান আল্লাহর আনুগত্যে বাধ্য করা আর কু-প্রবৃত্তি ও হারাম কাজ থেকে বিরত রাখা।”
দু‘আ করি, আল্লাহ তা‘আলা যেনো আমাদের মনকে মহান আল্লাহর আনুগত্যে বশীভূত করার পাশাপাশি কু-প্রবৃত্তির আহ্বান এবং পাপাচার থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে সেই প্রশান্ত আত্মার অধিকারী হওয়ার তাওফিক্ব দান করেন যাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশের জন্য নিজেই আহ্বান করেছেন। নিশ্চয় তিনি দু‘আ কবুলকারী Ñআমীন। ###
সূরা আল ফাজ্র : ২৭-৩০।
তাফসীরে ইবনু কাসীর।
সূরা আল বাইয়্যিনাহ্ : ৫।
সায়দুল খাতের- ১ : ১১৯।
বুখারী ও সহীহ মুসলিম, আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত।
মুসলিম- কিতাবুল ঈমান, আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত।
আহমাদ, হাকিম, মিশকাত, আলবানী সহীহ।
আপনার মন্তব্য