সাময়িক প্রসঙ্গ
কুরবানীর পশু জবেহর সঠিক পদ্ধতি ও উত্তম সময়
আবু মুহাম্মাদ

ইসলাম দয়া ও মমতার ধর্ম। যে কারণে ইসলামে পশুর প্রতিও দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন- হাদীসে এসেছে- সাহাবী শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন :
্রإِنَّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوْا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيْحَتَهُ.
“আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি বিষয়ে সুন্দর ও দয়া সুলভ আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবেহ করবে তখনও তা সুন্দর ভাবে করবে। তোমাদের কেউ (জবেহ করতে চাইলে) যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যবেহ্-এর পশুটিকে প্রশান্তি দেয়।”[১]
‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি একটি ছাগল যবেহ্ করার জন্য মাটিতে শুইয়ে ছুরি ধার করতে লাগল। তখন প্রিয়নবী (সা.) তাকে ধমক দিয়ে বললেন,
أَتُرِيْدُ أَنْ تُمِيْتَهَا مَوْتَاتٍ هَلَا حَدَدْتَ شَفْرَتَكَ قَبْلَ أَنْ تُضْجِعَهَا.
“তুমি কি একে কয়েকবার মৃত্যু দিতে চাও? তাকে মাটিতে শোয়ানোর আগে কেন তোমার ছুরি ধার দিলে না!”[২]


◈ পশু জবেহ করার সঠিক পদ্ধতি :
১. আল্লামা ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ্.) বলেন : “(গরু, ছাগল, দুম্বা ইত্যাদি পশু) জবেহ করার সময় ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং গলদেশের দু পার্শ্বস্থ দু’টি মোটা রগ কর্তন করা উত্তম। তবে যদি কেবল খাদ্য ও শ্বাসনালী এবং এক পাশের একটা মোটা রগ কাটা হয় তাহলেও যথেষ্ট। এমনকি শুধু খাদ্য ও শ্বাসনালী কাটা হলেও যথেষ্ট। তবে উক্ত চারটা রগ কর্তন করা অধিক উত্তম।”[৩]
ধারালো অস্ত্র দ্বারা এভাবে কর্তন করার পর পশুকে কিছুক্ষণ ধরে রাখলেই ভেতর থেকে রক্তগুলো বের হয়ে দ্রুতই নিস্তেজ হয়ে যাবে এবং প্রাণ ত্যাগ করবে।
২. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোনো অঙ্গ কেটে কষ্ট দেয়া হারাম। যেমন- ঘাড় মটকানো, পায়ের রগ কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি।
৩. অনুরূপভাবে, দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে, তাহলে প্রাণ ত্যাগ করার কাল পর্যন্ত আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া আদৌ বৈধ নয়।
৪. পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না; বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে চেপে রাখা যায়।
৫. জবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল করা উচিত। কিন্তু যদি অসতর্কতা বশতঃ মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলেও হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে আল্লাহর নামে ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে প্রথমে বর্ণিত পদ্ধতির আলোকে জবেহ করার পর প্রাণ ত্যাগের পূর্বে যদি পশুর শরীরের কোথাও ছুরি ঢুকানো হয়, ছুরি দ্বারা গুঁতা দেয়া হয় বা আঘাত করা হয় তাহলে তাতে পশুটি হারাম হবে না। কিন্তু এভাবে করলে পশুটিকে কষ্ট দেয়ার কারণে গুনাহ হবে। আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করুন -আমীন।
৬. পশুকে শুইয়ে জবেহকারী কেবলামুখী হয়ে এবং পশুর মাথাটা কেবলার দিকে একটু ঘুরিয়ে জবেহ করা উত্তম। তবে আবশ্যক নয়। অর্থাৎ- কিবলা ছাড়া অন্য দিকে মুখ করে আল্লাহর নামে যবেহ করলেও তা হালাল হবে।[৪]
৭. আল্লাহর নামে জবেহ করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَأْكُلُوْا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ﴾
“(জবেহ করার সময়) যে পশুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না, তোমরা তা ভক্ষণ করো না।”[৫]
৮. জবেহ করার সময় “বিস্মিল্লা-হ, আল্লাহু আকবার” বলে পশুর কাঁধের পার্শ্বে পা দ্বারা চেপে ধরে ধারালো অস্ত্র দ্বারা শক্তি দিয়ে গলায় ছুরি চালাবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسٍ، قَالَ : ্রضَحَّى النَّبِيُّ (ﷺ) بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ، ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ، وَسَمَّى وَكَبَّرَ، وَوَضَعَ رِجْلَهُ عَلٰى صِفَاحِهِمَاগ্ধ.
আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজ হাতে দু’টি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানী করেছেন। (জবেহ করার সময়) তিনি ‘বিস্মিল্লা-হ ও আল্লাহু আকবার’ বলেছেন এবং পা দিয়ে সেগুলোর কাঁধের পার্শ্বদেশ চেপে রাখেন।[৬]
সহীহুল বুখারীতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিং ওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে।


উল্লেখ্য যে, কোনো মুসলিম জবেহ করার সময় অসাবধানতা বশতঃ মুখে বিস্মিল্লা-হ-আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করতে ভুলে গেলে উক্ত জবেহকৃত প্রাণী হারাম হবে না। কেননা, মুসলিমের অন্তরে মহান আল্লাহর নাম রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে তা পরিত্যাগ করা বৈধ নয়। আল্লাহু আ’লাম।
কুরবানী করার উত্তম সময় কোনটি?
ইসলামে যে কোনো ভালো কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فَاسْتَبِقُوْا الْخَيْرَاتِ﴾
“অতএব তোমরা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করো।”[৭]
রাসূল (সা.) বলেন,
্রبَادِرُوْا بِالْأَعْمَالِগ্ধ.
“তোমরা আগেভাগে নেকির কাজ সম্পন্ন করো।”[৮]
সুতরাং যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কুরবানী করা উচিত। বিনা কারণে বিলম্ব করা ঠিক নয়।
কুরবানী করার সর্বমোট সময় কয় দিন এবং উত্তম সময় কোনটি?
যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আযহার সালাত আদায়ের পর থেকে শুরু করে ১৩ তারিখের সূর্য ডোবা পর্যন্ত মোট চার দিন (রাত-দিন) যে কোনো সময় কুরবানী করা জায়িয। তবে সর্বোত্তম সময় হলো, ঈদের সালাত শেষ করার পরই কুরবানী করা। সালাতের আগে পশু জবেহ করলে কুরবানী সহীহ হবে না। বারা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন,
্রإِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِيْ يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، مَنْ فَعَلَهُ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلُ، فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لِأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِيْ شَيْءٍগ্ধ.
“ঈদের দিন আমরা প্রথমে সালাত আদায় করব। অতঃপর ফিরে এসে কুরবানী করব। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে সালাতের আগেই পশু জবেহ্ করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে; এটা কুরবানী হবে না।”[৯]
তাই সালাত শেষ করার পরপর কুরবানী করার চেষ্টা করতে হবে। (খুতবাহ্ শেষ করার পর কুরবানী করা আরও অধিক উত্তম)
এতে কুরবানী দাতার জন্য আরেকটি সুন্নত পালন করা সম্ভব হয়। তা হলো- ঈদের দিন কোনো কিছু না খেয়ে ঈদের সালাত পড়া। তারপর ফিরে এসে সর্বপ্রথম কুরবানীর গোশ্ত খাওয়া। বেশি বিলম্ব করলে বা পরের দিন কুরবানী করলে এ সুন্নতটি আদায় করা হয়ত সম্ভব হবে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- বুরাইদা (রাযি.) বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ (ﷺ) لَا يَغْدُوْ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّٰى يَأْكُلَ وَلَا يَأْكُلُ يَوْمَ الْأَضْحَى حَتّٰى يَرْجِعَ فَيَأْكُلَ مِنْ أُضْحِيَّتِهِ.
“নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের জন্য না খেয়ে বের হতেন না। আর ঈদুল আযহায় সালাত থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত কিছু খেতেন না। এরপর তিনি তাঁর কুরবানী থেকে খেতেন।”[১০]
উল্লেখ্য যে, ঈদের সালাত থেকে ফিরে এসে তিনি সর্বপ্রথম কুরবানীর ‘কলিজা’ খেতেন মর্মে বর্ণিত হাদীসটি সহীহ নয়।
বিনা কারণে বিলম্ব করা এ কারণেও ঠিক নয় যে, এতে কুরবানীর পশুর মৃত্যু, চুরি হওয়া, হারিয়ে যাওয়া বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ও বিপদাপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন হয়ত কুরবানী দেয়াই সম্ভব হবে না। তাই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মহান আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতে হবে।
শাইখ বিন বায (রহ্.) বলেন, “কুরবানী করা অধিক উত্তম ঈদের দিন, তারপর ২য় দিন, তারপর ৩য় দিন, তারপর ৪র্থ দিন।”[১১] আল্লাহু আ‘লম।


[১] সহীহ মুসলিম- হা. ১৯৫৫।
[২] মুস্তাদরাকে হাকিম- হা. ৭৫৬৩।
[৩] শাইখ বিন বায (রহ্.)।
[৪] আল্লামা বিন বায. (রহ্.)।
[৫] সূরা আল আন‘আম : ২১।
[৬] সহীহুল বুখারী- হা. ৫৫৬৫; সহীহ মুসলিম- হা. ১৯৬৬।
[৭] সূরা আল বাক্বারাহ্ : ১৮৪।
[৮] সহীহ মুসলিম- হা. ১৮৬/১১৮, ১২৮/২৯৪৭, ১২৯/২৯৪৭।
[৯] সহীহুল বুখারী- হা. ৫৫৪৫; সহীহ মুসলিম- ২/১৫৪।
[১০] মুসনাদে আহমাদ- মা. শা., হা. ২২৯৮৪; সুনানে দারাকুত্বনী- ১/৪৫, হা. ১৭১৫; হাদীসটিকে শু‘আইব আরনাবুত হাসান বলেছেন; তাখরিজুল মুসনাদ- হা. ২২৯৮৪, অনুরূপভাবে ইমাম নব্বীও হাসান বলেছেন; আল মাজমূ‘- ৫/৫।
[১১] শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট।


আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত