প্রবন্ধ
ভালো মৃত্যুর প্রত্যাশা কিন্তু কীভাবে!
আরাফাত ডেস্ক
রাতের পর দিন যেমন সুনিশ্চিন্ত, তেমনি দিনের পর রাতের আগমনও সুবিদিত। একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটির অস্তিত্ব অপরটির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তেমন জীবনের আগমন এর অবসানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ মানব জাতিকে স্মরণ করিয়ে বলেন :
﴿كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ﴾“সকল প্রাণকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।”[১]
আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই দুনিয়ার সকল সমস্যার সুরাহা বা সমাধানের চেষ্টা চলে, কিন্তু মৃত্যু সমস্যার কোনো সমাধান নেই। মৃত্যু শাশ্বত ও চিরন্তন সত্য এটাকে প্রতিরোধ করা যায় না। একজন আরব কবি আরবী কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এভাবে-
الموت كاس كل نفس شاربه
والقبر باب كل ناس داخله.
মৃত্যু এমন এক শরবতের পেয়ালা,
যা সবাইকে পান করতে হবে,
এবং কবর এমন দরজা,
যা দিয়ে সবাইকে প্রবেশ করতে হবে।”
ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে মৃত্যু সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। মানুষ, জিন্, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, উদ্ভিদ, তরুলতা সবার জন্য মৃত্যু অবধারিত। ফেরেশ্তাদের মৃত্যু আছে, এমনকি সকলের প্রাণ হরণকারী মালাকুল মাউত-এরও মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যু থেকে কারো রেহাই নেই, পালানোরও কোনো সুযোগ নেই। কেবল আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন হলেন চিরঞ্জীব। তিনিই একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর উর্ধ্বে। এ মর্মে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে :
﴿كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوْ الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ﴾
“পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। (হে নাবী!) একমাত্র তোমার রবের পবিত্র চেহারা (সত্তা) অবশিষ্ট থাকবে।”[২]
মানুষ মরণশীল। ছোট-বড়ো, ধনী-গরীব সবাইকে মরতে হবে। তাই কবি আকাশচুম্বী অট্টালিকায় অবস্থিত লোকদের লক্ষ্য করে বলেছেন :
ايها الساكن فى القصر المعلى،
ستدفن عن قريبٍ فِىْ التراب.
“হে উঁচু অট্টালিকার বাসিন্দা!
সহসাই তোমাকে মাটির নীচে দাফন করা হবে।”
মৃত্যু এমনই যে, এর সামনে সবাই অসহায়। কোনো শক্তি ও সম্পদের বিনিময়ে মৃত্যুকে এক মুহূর্ত পিছানো যায় না। এ জগতে শক্তিহীন ও শক্তিধর সবাইকে এর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে উপস্থিত হবে। কে কোথায় আছে তা বিবেচ্য নয়।
মৃত্যুর লক্ষ্য হলো- সবাইকে মহান আল্লাহর কাছে যেতে হবে। কেননা যে মানুষ আজ দুনিয়াতে এসে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি ভুলে গেছে, মৃত্যু তাদেরকে সেই বিস্মিত ভুলে যাওয়া স্মৃতির বাস্তব ময়দানে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। অবুঝ শিশুরা যেসব ঘর থেকে খেলতে বেরিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা ভুলে যায়, তেমনি এ মাটির পৃথিবীর অস্থায়ী মানুষও তার পরকালের আসল ঠিকানা ভুলে যায়।
মানুষ ও জিন্কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে অল্প সময়ের জন্য। এ পৃথিবী হচ্ছে অস্থায়ী বিশ্রাম কেন্দ্র। তারপর তাদেরকে পারলৌকিক আসল ঠিকানায় যেতে হবে। কিন্তু পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় মানুষ এত কিছু জানার পরও অস্থায়ী দুনিয়াকে স্থায়ী বসবাসের জায়গা মনে করে বসে আছে।
অথচ কুরআন ও হাদীস মৃত্যু সম্পর্কে বহু উদাহরণ পেশ করে মানুষের দৃষ্টি আখিরাতের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। মানুষ যদি সেগুলো পাঠ করে, তাহলে মৃত্যু তথা পরকাল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে। রাসূল (সা.) নিজের বাস্তব জীবনের বহু ঘটনার মাধ্যমে মু’মিনদের দৃষ্টি মৃত্যুর দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।
কবির কন্ঠে মৃত্যুর অসহায় করুণ বর্ণনা-
“তারপর এ শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি
শত কাফনের, শত কবরের অংক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।”
“মাসজিদ হতে আযান হাঁকিছে বড়ো সুকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজ ক্বিয়ামত ভাবিতেছি কতদূর।”
কবি জসীমউদ্দিনের “কবর” কবিতা থেকে-
মৃত্যু সম্পর্কে কুরআন
আল কুরআনের বহু জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা মৃত্যু সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেমন- মৃত্যু চিরন্তন সত্য। অপ্রতিরোধ্য। তা আসবেই। মৃত্যু অবশম্ভাবী।
﴿أَيْنَمَا تَكُوْنُوْا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ﴾
“তোমরা যেখানেই থাকো, মৃত্যু তোমাদেরকে পাবেই।”[৩] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
﴿قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِيْ تَفِرُّوْنَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيْكُمْ ثُمَّ تُرَدُّوْنَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ﴾
“তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালাতে চাও, সেই মৃত্যুর সাথে অবশ্যই তোমাদের সাক্ষাৎ হবে। তারপর তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফেরত পাঠানো হবে, যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল বিষয় জানেন এবং তিনি তোমাদেরকে তোমাদের ‘আমল ও কাজ-কর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।”[৪] কুরআনে আরো বলা হয়েছে-
﴿وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ﴾
“(হে নাবী!) আপনার আগে কোনো মানুষকে আমি চিরস্থায়ী করিনি।”[৫] আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿لِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ إِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُوْنَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُوْنَ﴾
“সকল উম্মাতের রয়েছে সুনির্দিষ্ট সময় বা হায়াত। যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হবে তখন তারা সেই সময়কে মুহূর্তের জন্যও আগে-পিছে করতে পারবে না।”[৬] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿الَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا﴾
“তোমাদের মধ্যে কে উত্তম ‘আমলকারী সে বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন।”[৭] মৃত্যুর সাথে হায়াতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ حَقّٰ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوْتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُوْنَ﴾
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে সত্যিকার অর্থে ভয় করো এবং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মৃত্যুবরণ করো না।”[৮]
হায়াতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো- মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করা এবং তাঁর হুকুমের আনুগত্য করা। কাজেই কেউ যেন সে সকল আদেশ-নিষেধের আনুগত্য ব্যতিরেকে মৃত্যুবরণ না করে। যদি কেউ এর বিপরীত কাজ করে, তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বলতে র্ফয, ওয়াজিব ও হারামকে বুঝায়। তাই কি কি র্ফয, ওয়াজিব ও হারাম আছে, তা আগে জানতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে এ বিষয়ে আরো বলেছেন :
﴿وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ﴾
“হাশ্রের দিন তোমাদেরকে তোমাদের পারিশ্রমিক পরিপূর্ণ দেওয়া হবে। যাকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে অবশ্যই সফলকাম।”[৯]
মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন লোকের সংখ্যাই বেশি। এ উদাসীন লোকেরা ভুলেও মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে চায় না। তাই তারা মহান আল্লাহর হুকুমের নাফরমানী করে, তাঁর নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করে না, ফরয, ওয়াজিব লঙ্ঘন করে অহরহ হারাম কাজে লিপ্ত হয়, তাদের অন্তর মহান আল্লাহর ভয়ে ভীত হয় না।
তাদের কাছে কবীরা, সগীরা, শিরক ও বিদআতের বরং কোনোটারই বালাই নেই। তারা একাধারে পাপ ও গুনাহর কাজে লিপ্ত হচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُوْنَ﴾
“নিশ্চয়ই আপনার মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে।”[১০] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
﴿وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُوْنَ﴾
“আর তোমার পূর্বে কোনো মানুষকে আমি স্থায়ী জীবন দান করিনি; সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে তারা কি অনন্ত জীবনসম্পন্ন হয়ে থাকবে।”[১১]
এ মৃত্যু থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। মানুষ নিদ্রার মাধ্যমে মৃত অবস্থার সম্মুখীন হয়। ঘুমের সময় বাহ্যিকভাবে শরীর থেকে তার প্রাণকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আর মৃত্যুর সময় শরীরকে প্রাণ থেকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দু’ভাবেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿اَللهُ يَتَوَفَّى الْأَنْفُسَ حِيْنَ مَوْتِهَا وَالَّتِيْ لَمْ تَمُتْ فِيْ مَنَامِهَا﴾
“আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন মৃত্যুর সময়, আর যে মরেনি তাদের নিদ্রার সময়।”[১২]
অর্থাৎ মানুষের প্রাণ হরণ করা হলে তাদের দুনিয়াবী জীবনের সমাপ্তি ঘটে চিরতরে। কিন্তু মানুষের নিদ্রাকালে সাময়িক প্রাণ হরণ করা হয়, অতঃপর সে পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়।
‘আলী (রাযি.) বলেন : নিদ্রার সময় মানুষের প্রাণ দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু প্রাণের একটি রেশ দেহে বাকী থাকে, ফলে মানুষ জীবিত থাকে।
তিনি আরো বলেন : নিদ্রাবস্থায় প্রাণ দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু জাগরণের সময় এক নিমিষের ও কম সময়ে দেহে ফিরে আসে।[১৩]
প্রবাদ আছে- (الَنومُ اخو الموتِ) -ঘুম হলো মৃত্যুর সহোদর। এ থেকে বড়ো মৃত্যু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
আল্লাহ তা‘আলা মৃত্যুর ফেরেশ্তাকে মূসা ('আ.)-এর কাছে পাঠান। তিনি যখন মূসা ('আ.)-এর কাছে আসেন তখন তিনি ফেরেশ্তাকে থাপ্পড় মারেন ও তাঁর চোখ কানা করে দেন। ফেরেশ্তা মহান আল্লাহর কাছে ফিরে যান এবং বলেন, আপনি আমাকে এমন লোকের কাছে পাঠিয়েছেন যিনি মৃত্যু চান না।
আল্লাহ তা‘আলা তাকে পুনরায় চোখ ফিরিয়ে দেন এবং বলেন : তুমি তাঁকে গিয়ে বলো, আপনি একটা বলদ গরুর পিঠে হাত রাখুন। তাঁর হাত যতগুলো পশম স্পর্শ করবে তিনি ততদিন হায়াত পাবেন এবং প্রত্যেক চুলের মুকাবিলায় এক বছর করে জীবন পাবেন।
মূসা জিজ্ঞেস করেন, হে আমার রব! তারপর কি? তিনি বলেন, তারপর মৃত্যু। তখন মূসা ('আ.) বলেন, তাহলে এখনই। তারপর আল্লাহর কাছে দু‘আ করেন তাকে যেন বাইতুল মাকদিসের কাছাকাছি মৃত্যু দেওয়া হয় এবং পবিত্র জেরুসালেম শহর থেকে যেন তাঁর কবরের দূরত্ব পাথর নিক্ষেপের দূরত্বের সমান হয়। রাসূল (সা.) বলেন, আমি সেখানে থাকলে তোমাদেরকে রাস্তার পাশে লাল বালুর স্তূপের কাছে তাঁর কবর দেখাতে পারতাম।[১৪]
সুনান আত্ তিরমিযীতে আবূ হুরাইরাহ্ থেকে বর্ণিত, মৃত্যুর ফেরেশ্তা মূসা ('আ.) পর্যন্ত প্রকাশ্যে মানুষের কাছে আসতেন। মূসা ('আ.) থাপ্পড় দিয়ে তাঁকে কানা করে দেন। ...এরপর থেকে ফেরেশ্তা গোপনে আসেন।
মহান আল্লাহর দেওয়া মৃত্যু থেকে নাবী-রাসূল এবং ফেরেশ্তারাও রক্ষা পাননি
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন- দাঊদ (রাযি.) ছিলেন নিজ ইজ্জত, আবরু, সম্মানের ব্যাপারে অতি সজাগ ও অভিমানী। তিনি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে বের হতেন। এমনিভাবে তিনি একদিন দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যান। তাঁর স্ত্রী সকালে হঠাৎ করে দেখেন যে, ঘরে একজন লোক। স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, এ লোকটিকে কে ঘরে প্রবেশ করিয়েছে? দাঊদ (রাযি.) আসলে সে বিপদের সম্মুখীন হবে। দাঊদ (রাযি.) আসেন এবং লোকটিকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে? লোকটি উত্তর দেয়, আমি এমন এক ব্যক্তি, বাদশাহকে ভয় করি না এবং পর্দাও আমার জন্য কোনো বাধা নয়। তখন তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! তাহলে তুমি মৃত্যুর ফেরেশ্তা। ঘটনাস্থলেই ফেরেশ্তা দাঊদ (সা.)-কে জাপটে ধরেন।[১৫]
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরেক হাদীসে মানুষের সৃষ্টি থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের একটি জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। জাবির (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বানী আদমকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তারা সে উদ্দেশ্য থেকে গাফিল বা উদাসীন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোনো মা’বূদ নেই, তিনি যখন মানুষ সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তখন ফেরেশ্তাকে বলেন, তার রিয্ক, হায়াত, মৃত্যু এবং ভালো ও মন্দ লিখে রাখো। তারপর ঐ ফেরেশ্তা উপরে চলে যান এবং অন্য একজন ফেরেশ্তাকে পাঠান, ব্যক্তি বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐ ফেরেশ্তা তাকে হিফাযত করেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কাছে দুইজন ফেরেশ্তা পাঠান। তারা দুইজনেই তার সওয়াব ও গুনাহ লিখেন। তারপর যখন মৃত্যুর সময় আসে তখন মৃত্যুর ফেরেশ্তা তার রূহ্ হরণ করেন। কবরে প্রবেশ করানোর পর রূহ্কে তার দেহে ফেরত দেওয়া হয়। তারপর কবরের জন্য নির্ধারিত দুইজন ফেরেশ্তা আসেন এবং তাকে পরীক্ষা করেন। তারপর তারা উপরে চলে যান।
হাশ্রের দিন নেক কাজ ও পাপ কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশ্তারা তার ‘আমলনামা তার গলায় ঝুলিয়ে দেন। তাদের সাথে একজন চালক এবং একজন সাক্ষী উপস্থিত থাকেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন :
﴿لَقَدْ كُنْتَ فِيْ غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنْكَ غِطَاءَكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيْدٌ﴾
“(বলা হবে) ‘এ দিন সম্পর্কে তুমি ছিলে উদাসীন। তোমার সামনে যে পর্র্দা ছিলো তা আমি সরিয়ে দিয়েছি। (সে কারণে) তোমার দৃষ্টি আজ খুব তীক্ষ্ম।”[১৬]
হাদীসে মৃত্যুর বিভীষিকাময় চিত্র
মৃত্যু সম্পর্কে অনেক হাদীস রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন :
"يَتْبَعُ المَيِّتَ ثَلَاثَةٌ، فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ : يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ، فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَيَبْقَى عَمَلُهُ".
“মৃতের সাথে তিনটি জিনিস কবর পর্যন্ত যায়। এর মধ্যে দুইটি ফিরে আসে এবং একটি থেকে যায়। যে তিনটি জিনিস কবর পর্যন্ত যায় সেগুলো হচ্ছে- (১) মৃতের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন, (২) মাল-সম্পদ ও (৩) ‘আমল। কিন্তু ২টি : তার (মৃতের) পরিবার-পরিজন ও মাল-সম্পদ ফিরে আসে এবং ‘আমল কবরে থেকে যায়।”[১৭]
এই হাদীস আমাদেরকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছে- কবর ও পরকালে নেক ‘আমল ছাড়া আর কিছুই সাথে যাবে না। আমরা সন্তান, অর্থ-সম্পদ ও পরিবারকে বেশি ভালোবাসি-এর পিছনে সকল সময় ব্যয় করি, মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে চিন্তা করার সময় পাই না এবং নেক ‘আমল ও নেক কাজ করার সুযোগ পাই না। অথচ সেই অর্থ-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন সবাই কবর পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে আর যে জিনিস কবরে সাথে যাবে, সেই জিনিসের প্রতিই আমরা উদাসীন।
আর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কাছে যে সম্পদ আছে, তাঁর মালিক কে? সাহাবায়ে কিরাম জবাব দেন, আমরা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ওয়ারীশ যে সম্পদের মালিক হয় সেটার আসল মালিক তো তোমরা নও। তোমরা ঐ সম্পদের মালিক যা মহান আল্লাহর রাস্তায় দান করেছ।”[১৮]
ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেন :
"اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ".
তুমি পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের উপর গুরুত্ব দাও। (১) বার্ধক্যের আগে তোমার যৌবনকে, (২) অসুস্থতার আগে তোমার সুস্থতাকে, (৩) অভাবের আগে তোমার সচ্ছলতাকে, (৪) ব্যস্ততার আগে তোমার অবসরতাকে এবং (৫) মৃত্যুর আগের জীবনকে।[১৯]
এ হাদীসে মৃত্যু আসার আগে জীবনের সময়ের সদ্ব্যবহারসহ পাঁচটি জিনিসের সদ্ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। বৃদ্ধ, অসুস্থ ও অভাবী লোক ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় নেক কাজ করতে পারে না।
تركتُ قِيكم نَاطِقًا وصَامِتًا.
বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি তোমাদের মধ্যে সরব ও নীরব এ দুটো জিনিস রেখে গেলাম।”[২০]
এখানে ‘সরব’ বলতে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, যেহেতু তা পাঠ করার সময় শব্দ করে পড়তে হয়। আর নীরব বলতে মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। এটা এক নীরব সত্য। এ মৃত্যু নীরবে সবার কাছেই আসবে। মহানাবী (সা.) মানুষকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
্রكُنْ فِيْ الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيْبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيْلٍগ্ধ.
“তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে জীবন-যাপন করো যেন তুমি প্রবাসে আছো কিংবা পথিক বা মুসাফির অবস্থায় আছো।”[২১]
আহমাদ ও ইবনু মাজাহ্’র হাদীসে আরও একটু শব্দ বর্ধিত আছে। আর তা হলো-
্রوَعُدَّ نَفْسَكَ مِنْ أَهْلِ الْقُبُوْرِগ্ধ.
অর্থাৎ- এবং তুমি নিজেকে কবরের বাসিন্দা গন্য করো।[২২]
এ হাদীস দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে এক পরিপূর্ণ দর্শন পেশ করে। যেমন- কেউ যদি প্রবাসে থাকে তাহলে নিজের মূল ঠিকানায় ফিরে আসার চিন্তায় থাকে- কখন সে নিজ বাসস্থানে ফিরে আসবে। মুসাফিরের চিন্তাও অনুরূপ। মূলতঃ সফর এবং প্রবাস জীবন অস্থায়ী। দুনিয়ার জীবনও তাই।
মৃত্যুর ফেরেশ্তা প্রতিদিন দুইবার বান্দার প্রতি দৃষ্টি দেয় এবং হায়াত শেষ হয়েছে কি-না তা দেখে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি তোমরা মৃত্যু ও মৃত্যু সম্পর্কিত অবস্থাগুলো জানতে, তাহলে তোমরা গগণচুম্বী উচ্চ আকাঙ্খার অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে না। এমন কোনো ঘর নেই, যে ঘরের প্রতি মৃত্যুর ফেরেশ্তা দৈনিক দুইবার নজর দেয় না।[২৩] আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿حَتّٰى إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا وَهُمْ لَا يُفَرِّطُوْنَ﴾
“এমনকি যখন তোমাদের কারো মৃত্যু আসে তখন আমার প্রেরিত ফেরেশ্তারা তার আত্মা নিয়ে চলে যায় এবং তারা বাড়াবাড়ি ও ত্রুটি করে না।”[২৪]
আসলে সবাই মৃত্যুকে অপছন্দ করে। কারণ সবাই বাঁচতে চায়। এ প্রসঙ্গে আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন :
﴿لَقَدْ كُنْتَ فِيْ غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنْكَ غِطَاءَكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيْدٌ﴾
“তুমি এর আগে গাফলতির মধ্যে ডুবে ছিলে। আমরা এখন চোখের পর্দা খুলে দিলাম। আজ তোমার চোখ খুবই তেজ-প্রখর।”[২৫] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍ﴾
“তোমরা অবশ্যই এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায় অতিক্রম করবে।”[২৬]
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, “তোমরা কবরের প্রস্তুতি নাও। তোমাদের কবর প্রতিদিন তোমাদেরকে সাতবার ডেকে ডেকে বলে, হে দুর্বল বনী আদম! আমার সাথে সাক্ষাতের আগে তুমি তোমার নিজের উপর দয়া করো। তুমি কি তোমার উপর দয়া করছো এবং আমার নিকট থেকে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছো?”[২৭]
অন্য বর্ণনায় এসেছে- যমীন প্রতিদিন ৭০ বার ডেকে ডেকে বলে- হে আদম সন্তান! তোমরা যা ইচ্ছা খাও। আল্লাহর শপথ! আমিও তোমার চামড়া ও গোশ্ত খাবো।[২৮]
সবাই কবরবাসী। তাই মূল বাসস্থানের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে এবং সে জন্য ঈমান-‘আমলের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিতে হবে। [চলবে...]
টীকা :
[১] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৮৫।[২] সূরা আর রহমান ৫৫ : ২৬-২৭।
[৩] সূরা আন্ নিসা ৪ : ৭৮।
[৪] সূরা আল জুমু‘আহ্ ৬২ : ৮।
[৫] সূরা আল আম্বিয়া- ২১ : ৩৪।
[৬] সূরা ইউনুস ১০ : ৪৯।
[৭] সূরা আল মুলক ৬৭ : ২।
[৮] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১০২।
[৯] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৮৫।
[১০] সূরা আয্ যুমার ৩৯ : ৩০।
[১১] সূরা আল আম্বিয়া- ২১ : ৩৪।
[১২] সূরা আয্ যুমার ৩৯ : ৪২।
[১৩] মাআরিফুল কুরআন।
[১৪] সহীহুল বুখারী।
[১৫] এহইয়া উলুমুদ্দিন- ইমাম গায্যালী।
[১৬] সূরা ক্বাফ ৫০ : ২২।
[১৭] সহীহুল বুখারী- বাবু সাকরাতেল মাউত, হাঃ ৬৫১৪।
[১৮] সহীহুল বুখারী।
[১৯] মুসস্তাদরাক হাকিম- হাঃ ৭৮৪৬।
[২০] আল ইসতিদাদ-লিল মাউত; সিলসিলাত আহাদীসুস্ সহীহাহ্।
[২১] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৬৪১৬।
[২২] আহমাদ- হাঃ ৫০০২, সুনান ইবনু মাজাহ্- হাঃ ৪১১৪।
[২৩] মুস্তাখাব কানযুল উম্মাল- ৬টি খণ্ড, ২৪৮ পৃঃ।
[২৪] সূরা আল আন‘আম ৬ : ৬১।
[২৫] সূরা ক্বাফ ৫০ : ২২।
[২৬] আল ইনশিক্বা-ক্ব ৮৪ : ১৯।
[২৭] মাসিক আল মানহাল- সৌদী আরব।
[২৮] মাসিক আল মানহাল- জুলাই-১৯৯৩, সৌদী আরব।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য