সাময়িক প্রসঙ্গ
নাজাতের সিঁড়ি তাওবা ও মাগফিরাত
এম. জি. রহমান

 নিষ্পাপ শিশু অবস্থায় এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন। পাপশূন্য জীবন নিয়েই তার পথচলা শুরু। এভাবে সে একটি নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রম করে। তারপর বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে পাপের বোঝাও ভারি হতে থাকে- ইচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায়, সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞাতসারে। এক পর্যায়ে সেই পাপের প্রতিচ্ছবি তার চেহারায়ও প্রতিফলিত হয়। মলিন হয়ে যায় শিশুকালের কমলতা, অন্তরের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে এই অপবিত্র-অপরিচ্ছন্ন অন্তরে সঙ্কীর্ণতা ও বিষন্নতা জেঁকে বসে। এ পাপময় জীবন সত্যিই কলঙ্কিত। কতই না ঘৃণিত।

কিন্তু নাজাত কোন পথে? আমি তো পাপের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে চাই! আমি যে চাই পাপ ও কলঙ্কমুক্ত পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবন গড়তে। চাই নাজাতের পথে হাঁটতে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাও চান, তাঁর প্রিয় বান্দা কলঙ্কিত-পাপীষ্ঠ জীবন পরিত্যাগ করে কল্যাণ ও নাজাতের পথে প্রত্যাবর্তন করুক। এ  জন্য তিনি নিজ বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করে তাওবা ও মাগফিরাতের বিধান প্রবর্তন করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিক পছন্দনীয় যে, বান্দা বিশুদ্ধচিত্তে তাঁর কাছে তাওবাহ্ ও মাগফিরাত প্রার্থনা করুক। আর এটাই তো নাযাতের সোনালী পথ। এ পথেই রয়েছে আল্লাহর আল্লাহ সন্তুষ্টি। এটই জান্নাতের মসৃণ পথ। একনিষ্ঠ তাওবার মধ্যেই রয়েছে মানবজীবনের চূড়ান্ত স্বার্থকতা ও মহাসাফল্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا تُوْبُوْا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَصُوْحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ...﴾
“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ্ করো, বিশুদ্ধ তাওবাহ্; আশা করা যায়, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলোকে মিটিয়ে দেবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত।”[১]
পাপের উপলব্ধিবোধ
আমরা কীভাবে পাপমুক্ত জীবন যাপন করবো? কীভাবে পুণ্যময় জীবনের পথে প্রত্যাবর্তন (তাওবাহ্) করবো? ইত্যাদি বিষয় জানার আগে পাপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা আবশ্যক। আমরা জানি, শিরক সবচেয়ে বড় পাপ। এছাড়া দ্বীনের মধ্যে কিছু নতুন উদ্ভাবন (বিদআত) করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করা, কোনো ব্যক্তির সম্পদ আত্মসাৎ করা, ওয়ারীসকে মিরাস থেকে বঞ্চিত করা, ইয়াতীমের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা, হারাম ভক্ষণ ও গ্রহণ করা, তাক্বদীর (ভাগ্য) অস্বীকার করা, নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ বা সেবন করা, মিথ্যা শপথ করা, চোগলখোরী ও পরনিন্দা করা, উপকার করে খোটা দেওয়া ইত্যাদি কবীরা গুনাহ বা বড় বড় পাপ। এ জাতীয় সকল কবীরা গুনাহ থেকে তাওবা না করলে, নাজাতের পথে প্রতিবন্ধকতা অবশ্যম্ভাবী।
বড়ো বড়ো গুনাহ সম্পর্কে আমাদের সাধারণ জনগণ মোটামুটি অবগত। কিন্তু ছোট পাপ বা সগীরা গুনাহ সম্পর্কে আমরা অনেকটাই বে-খবর বলা চলে। আমাদের অনেকেই ছোট ছোট পাপগুলো আমলে নিতে চাই না। আবার অনেকেরই ছোট পাপ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও নেই।
তবে পাপ চেনার সাধারণ একটি ফর্মূলা আছে, যা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। একান্ত নির্জনে বসে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আজ আমি যা কিছু করেছি, তার সবটাই কি সঠিক ছিল- না-কি ইনসাফের ব্যত্যয় ঘটেছে? কিংবা আজ আমি যা বলেছি, তার সবটুকুই কি যথাযথ ছিলো- না-কি অনুচিত কিছু বলেছি? তখন মন থেকে প্রতি-উত্তর আসবে, এটা ঠিক ছিলো, কিন্তু ঐটা ছিলো অনুচিত-ভুল।
তদরূপ কোনো কিছু করার কিংবা বলার আগে অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার ভয় জাগ্রত রেখে নিজেকে প্রশ্ন করুন- এ মুহূর্তে আমি যা করতে যাচ্ছি কিংবা বলতে চাচ্ছি, তার মধ্যে কি কোনো পাপ লুকিয়ে আছে? এভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে গ্রহণ করলে, ছোট-বড় পাপগুলো এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে -ইন্শা-আল্লাহ। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
عَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سَمْعَانَ الْأَنْصَارِيِّ، قَالَ : سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ، عَنِ الْبِرِّ وَالْإِثْمِ فَقَالَ : ্রالْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ، وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِيْ صَدْرِكَ، وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُগ্ধ.
নাউওয়াস ইবনু সাম‘আন আনসারী (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন : আমি রাসূল (সা.)-কে পাপ ও পূণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পুণ্য হলো সচ্চরিত্র; আর পাপ হলো তা-ই, যা তোমার অন্তরে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং মানুষ জেনে যাক, তা তুমি অপছন্দ করো।[২] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِيْ الحَوْرَاءِ السَّعْدِيِّ، قَالَ : قُلْتُ لِلْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ : مَا حَفِظْتَ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ؟ قَالَ : حَفِظْتُ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ : ্রدَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيْبُكَগ্ধ.
আবূ হাওরা আস-সা‘দী (রহ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি হাসান ইবনু ‘আলী (রাযি.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে কী (বাণী) সংরক্ষণ রেখেছেন? তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে (এ হাদীস) সংরক্ষণ করে রেখেছি যে, (তিনি হালাল-হারাম বিষয়ে বলেছেন), তা-ই বর্জন করো, যা তোমাকে সন্দেহে নিমজ্জিত করে এবং সেটাই গ্রহণ করো, যাতে তোমার মনে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি হয় না।[৩]
অতএব, এমন কথা, কাজ, আচার-আচরণ বর্জনীয়, যা অন্তরে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করে। সংশয়-সন্দেহ মিশ্রিত কাজে শয়ত্বানের কুমন্ত্রণা এবং পাপের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
পাপকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই
হালযামানার অধিকাংশ মানুষ ছোট ছোট পাপকে (সগীরা গুনাহ) তুচ্ছ বিষয় মনে করে। ফলে দৈনন্দিন জীবনে অহরহ ছোট ছোট পাপে লিপ্ত হলেও বিবেক তাকে দংশন করে না এবং অনুতপ্তও হয় না। কারণ প্রতিনিয়ত পাপে লিপ্ত হওয়ার দরুণ সে উপলব্ধিবোধ হারিয়ে ফেলেছে; অথচ ছোট পাপেরও ভয়ংকর ও নেতিবাচক দুইটি দিক রয়েছে-
প্রথমত: ছোট ছোট পাপের সমষ্টি বড় বা কবীরা গুনাহের জন্ম দেয়। কবীর ভাষায়-
“ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল;
গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।”
দ্বিতীয়ত: ছোট পাপকে তুচ্ছজ্ঞান করার অর্থ হলো, সুমহান আল্লাহর নিষেধ লঙ্ঘন বা অমান্য করার মাধ্যমে তাঁর না-ফরমানী করা। আর মহান আল্লাহর না-ফরমানী কাবীরাহ গুনাহ।
ছোট ছোট পাপের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত হাদীসগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা সতর্ক-সচেতন হতে পারি। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন :
্রإِنَّ المُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوْبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الفَاجِرَ يَرَى ذُنُوْبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلٰى أَنْفِهِগ্ধ.
নিশ্চয়ই মু’মিন ব্যক্তি পাপকে এমন ভয় করে, যেন সে একটি পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে এবং ঐ পাহাড় তার উপর ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর পাপে অভ্যস্ত ব্যক্তি গুনাহকে এরূপ মনে করে, যেন একটি মাছি তার নাকের উপর দিয়ে উড়ে গেলো; অর্থাৎ সে তার কোন পাত্তা দিলো না।[৪]
অথচ সে উপলব্ধি করে না যে, এই ছোট ছোট পাপের সমষ্টিই এক সময় পাহাড়সম হবে, যা বহন করার সক্ষমতা তার নেই। রাসূল (সা.) পুনশ্চ সতর্কবাণী শুনিয়েছেন :
عَنْ أَنَسٍ ঃ، قَالَ : ্রإِنَّكُمْ لَتَعْمَلُوْنَ أَعْمَالًا، هِيَ أَدَقُّ فِيْ أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ، إِنْ كُنَّا لَنَعُدُّهَا عَلٰى عَهْدِ النَّبِيِّ ﷺ مِنَ المُوْبِقَاتِগ্ধ.
আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নিশ্চয়ই তোমরা এমন কাজ করো, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলের থেকেও হালকা। অথচ রাসূল (সা.)-এর যুগে এ কাজগুলোকে আমরা ‘মুবিক্বাত’ ধ্বংসকারী বলে মনে করতাম।[৫]
ছোট পাপের ভয়াবহতা এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে আরো বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
"إِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوْبِ فَإِنَّمَا مَثَلُ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوْبِ كَقَوْمٍ نَزَلُوْا فِيْ بَطْنِ وَادٍ، فَجَاءَ ذَا بِعُوْدٍ، وَجَاءَ ذَا بِعُوْدٍ حَتّٰى أَنْضَجُوْا خُبْزَتَهُمْ، وَإِنَّ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوْبِ مَتَى يُؤْخَذْ بِهَا صَاحِبُهَا تُهْلِكْهُ".
ছোট গণ্য করা হয়, তোমরা এমন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো! কেননা, ছোট ছোট পাপের দৃষ্টান্ত হলো, একটি গোত্র কোনো এক উপত্যকায় গমন করলো, তারপর তাদের প্রত্যেকেই একটি করে খড়ি (জ্বালানি কাঠ) নিয়ে আসলো। এভাবে তাদের খড়ির পরিমাণ এতো বেশি হলো যে, তা দিয়ে তাদের খাদ্য পাকিয়ে নিতে পারলো। নিশ্চয়ই ছোট ছোট পাপের কারণে পাপীকে পাকড়াও করা হলে, সেই পাপসমষ্টি তাকে ধ্বংস করে দেবে।
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ছোট গণ্য করা হয়, এমন গুনাহ থেকে তোমরা বেঁচে থাকো। কেননা এগুলো যখন একত্রিত করা হয়, তা তাকে ধ্বংস করে দেয়।[৬]
মানুষের উপর পাপের প্রভাব
সাধারণতঃ সামাজিকভাবে সংঘটিত অন্যায় বা অপরাধকে আমরা পাপকার্য বলে গণ্য করি। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ হলো, ইসলামী শরী‘আতের বিধি-বিধানসমূহ অমান্য করা। শরী‘আতের দৃষ্টিতে যা পাপ, সামাজিকভাবে তা পাপ বলে গণ্য নাও হতে পারে। যেমন- র্ফয ‘ইবাদতসমূহ যথাযথ প্রতিপালন না করা ইসলামের দৃষ্টিতে কাবীরাহ গুনাহ হলেও, সামাজিকভাবে তা অনেকেই পাপ বলে গণ্য করেন না। তবে শরী‘আতের মানদণ্ডে যা কিছু পাপ বলে গণ্য, তার সবটুকুই আবশ্যিকভাবে বর্জনীয়। অন্যথায় সে দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জগতে লাঞ্ছিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) পাপের ধ্বংসাত্মক কিছু বিষয় অবতারনা করেছেন, যা সৌদি আরবের প্রথিতযশা আলেম শাইখ সলেহ আল মুনাজ্জিদ তাঁর রচিত اريد أن أتوب... ولكن গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
পাপের দরুন পাপী ‘ইল্ম থেকে বঞ্চিত হয়।
পাপীর অন্তরে নিঃসঙ্গতা অনুভূত হয়।
কাজ-কর্ম তার জন্য কঠিন হয়ে যায়।
তার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
সে ‘ইবাদত থেকে বঞ্চিত হয়।
তার উপর থেকে বরকত উঠে যায়।
তার উপর আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক্ব কমে যায়।
তার অন্তর সংকীর্ণ হয়ে যায়।
সে মন্দ কাজের জন্ম দেয় এবং পাপে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে লাঞ্ছিত হয়।
সে মানুষের কাছে লাঞ্ছিত এবং প্রাণিকুল থেকে অভিশপ্ত হয়।
অপমান দ্বারা সে নিজেকে আবৃত করে।
তার অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেওয়া হয়।
সে অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
তার দুআ ক্ববূল হয় না।
তার দ্বারা জলেস্থলে ফাসাদ সৃষ্টি হয়।
তার আত্মমর্যাদাবোধ লোপ পায় এবং সে হয় নির্লজ্জ।
তার উপর থেকে নি‘আমত মিটে যায়।
তার উপর শাস্তি অবতরণ হয় এবং অন্তরে ভীতি সঞ্চার হয়।
সে শয়ত্বানের কয়েদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
তার শেষ পরিণতি মন্দ এবং আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি।
উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা স্বীকৃত যে, পাপীকে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না, বরং এ দুনিয়াতেই সে লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়।
এছাড়া মানুষের পাপের প্রভাবে এ দুনিয়াতে নানাবিধ বিপদ-আপদ নিমজ্জিত হয়। আমরা বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জ্বলোচ্ছ্বাস, সুনামী এবং মহামারিসহ বিভিন্নপ্রকর ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হই। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ তাদের মতো ব্যাখ্যা করে থাকের, কিন্তু এ জাতীয় আসমানী কিংবা বালা-মুসিবতের মূল কারণ হলো, মানুষের কৃতকর্মের আংশিক প্রতিফল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُمْ مَنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَنْ أَغْرَقْنَا ۚ وَمَا كَانَ اللهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَٰكِنْ كَانُوْا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ﴾
“প্রত্যেককেই তাদের পাপের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম, তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচ- ঝটিকা, তাদের কাউকে আঘাত করেছিল বিকট শব্দ, কাউকেও আমি প্রথিত করেছিলাম ভূ-গর্ভে এবং কাউকেও করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো যুল্ম করেননি, তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুল্ম করেছিল।”[৭] এ বিষয়ে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ ঃ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ : فِيْ هَذِهِ الْأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ. فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ الْمُسْلِمِيْنَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ، وَمَتَى ذٰاكَ؟ قَالَ إِذَا ظَهَرَتْ الْقَيْنَاتُ وَالْمَعَازِفُ وَشُرِبَتْ الْخُمُوْرُ.
“‘ইমরান ইবনু হুসাইন (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এই উম্মাতের মাঝে ভূমিধ্বস, আকৃতি পরিবর্তন, সলিলসমাধি হবে, কোনো এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কখন হবে? তিনি বললেন, যখন এই উম্মাতের মাঝে গায়িকা, বাদ্যযন্ত্র এবং মদপান দেখা দিবে (অর্থাৎ- পাপকর্ম বৃদ্ধি পাবে)।”[৮] পবিত্র কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে-
﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِيْ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْ النَّاسِ لِيُذِيْقَهُمْ بَعْضَ الَّذِيْ عَمِلُوْا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ﴾
“মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্রে এবং স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান যাতে তারা ফিরে আসে।”[৯]
সুতরাং ইহকালীন কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং পরকালীন নাযাতের জন্য যাবতীয় পাপকে ‘না’ বলে সুমহান আল্লাহর মাগফিরাতের (ক্ষমার) প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন (তাওবাহ্) করা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানের দাবি।
তাওবার পরিচয়
اَلتَّوْبَةً (তাওবা) শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। অর্থাৎ- মানুষরূপী দাস তার প্রকৃত মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা বা অমান্য করার কারণে যে অন্যায়-অপরাধ করেছে- সেই কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিশুদ্ধচিত্তে অবনত মস্তকে তার মালিক আল্লাহর কাছে ক্ষমা-প্রার্থনা করবে এবং তাঁর নির্দেশিত পথে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করবে- এর নামই তাওবাহ্। এর মধ্যেই রয়েছে মানবজীবনের মহাকল্যাণ ও পূর্ণ সাফল্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾
“হে মু’মিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন (তাওবাহ্) করো যাতে সফলকাম হতে পারো।”[১০]
উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো, তবেই সফল হতে পারবে। এই সাফল্য (দুনিয়া-আখিরাত) উভয় জগতের জন্য প্রযোজ্য।
এ আয়াতের মর্মার্থ হলো, প্রথমত সকলপ্রকার পাপাচার ও নিষিদ্ধ কর্মসমূহ ঘৃণাঘরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে; অতঃপর আল্লাহ প্রদত্ত এবং নাবী (সা.) কর্তৃক জারিকৃত যাবতীয় বিধি-বিধান প্রতিপালনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে। এর মধ্যেই রয়েছে মুমিন ব্যক্তির মহাসাফল্য। [চলবে...]

 টীকা :

[১] সূরা আত্ তাহরীম ৬৬ : ৮।
[২] সহীহ মুসলিম- হা. ২৫৫৩; আত্ তিরমিযী- হা. ২৩৮৯।
[৩] জামি‘ আত্ তিরমিযী- হা. ২৫১৮; আন্ নাসায়ী- হা. ৫৭১১।
[৪] সহীহুল বুখারী- হা. ৬৩০৮।
[৫] সহীহুল বুখারী- হা. ৬৪৯২।
[৬] মুসনাদ আহমাদ- (মা. শা.) হা. ৩৮১৮, বায়হাক্বী- হা. ৬৮৮১; আস্ সিলসিলাতুস সহীহাহ্- হা. ২৪৭১।
[৭] সূরা আল ‘আনকাবুত ২৯ : ৪০।
[৮] সুনান আত্ তিরমিযী- হা. ২২১২ (আলবানী-সহীহ)।
[৯] সূরা র্আ রূম ৩০ : ৪১।
[১০] সূরা আন্ নূর ২৪ : ৩১।

আপনার মন্তব্য

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত