প্রবন্ধ
আত্মহত্যা ও তার ভয়াবহ শাস্তি
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা কবীরা গুনাহ। শিরকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহ। সকল ফিকহবিদ এবং চার মাযহাবেই আত্মহত্যা হারাম। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। ধনী-গরীব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতেই হবে।
◍ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
﴿كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُوْنَ﴾
“প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।”[১]
আর এ মৃত্যু দান করেন একমাত্র তিনিই। তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না।
◍ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيْتُ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُوْنَ﴾
“তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।”[২]
উপরোক্ত আয়াত দু’টি থেকে বুঝা যায় মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র মহান আল্লাহর। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, নিজের মৃত্যু ঘটান নিজের হাতে তবে তিনি অনধিকার চর্চাই করবেন। আল্লাহ তা‘আলা তা পছন্দ করেন না। কেউ অনধিকার চর্চা প্রত্যাশা করে না। ইসলামে তাই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। এ কাজ থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র আল কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।
◍ আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيْمٗا - وَمَنْ يَفۡعَلۡ ذٰلِكَ عُدۡوَٰنٗا وَظُلۡمٗا فَسَوۡفَ نُصۡلِيْهِ نَارٗاۚ وَكَانَ ذٰلِكَ عَلٰى ٱللهِ يَسِيْرًا﴾
“আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ যুল্ম করে, অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।”[৩]
◍ আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُلۡقُوْا بِأَيۡدِيْكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ﴾
“আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।”[৪]
◈ হাদীসে নাববী থেকে :
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ও তাই কাজটি থেকে নানাভাবে বারণ করেছেন। এ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছেন। যেমন-
◍ সাবিত ইবনু যিহাক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَىْءٍ فِىْ الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
“যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।”[৫]
◍ অপর এক হাদীসে রয়েছে, আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَهْوَ فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ، يَتَرَدَّى فِيْهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّىْ سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَسَمُّهُ فِىْ يَدِهِ، يَتَحَسَّاهُ فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيْدَةٍ ، فَحَدِيْدَتُهُ فِىْ يَدِهِ، يَجَأُ بِهَا فِىْ بَطْنِهِ فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا.
“যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।”[৬]
◍ আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ خَنَقَ نَفْسَهُ فِيْ الدُّنْيَا فَقَتَلَهَا خَنَقَ نَفْسَهُ فِيْ النَّارِ، وَمَنْ طَعَنَ نَفْسَهُ طَعَنَهَا فِيْ النَّارِ، وَمَنِ اقْتَحَمَ، فَقَتَلَ نَفْسَهُ اقْتَحَمَ فِيْ النَّارِ.
“যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোযখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোযখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে। আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, ক্বিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।”[৭]
◍ জুনদুব ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
كَانَ فِيْمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ فَجَزِعَ فَأَخَذَ سِكِّيْنًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتّٰى مَاتَ قَالَ اللهُ تَعَالَى بَادَرَنِيْ عَبْدِيْ بِنَفْسِهِ حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ.
‘তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’[৮]
❑ আত্মহত্যা তো দূরে থাক, মৃত্যু কামনাও বৈধ নয় : আত্মহত্যা তো দূরের কথা আমাদের পবিত্র এই শরী‘আত কোনো বিপদে পড়ে বা জীবন যন্ত্রনায় কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করতে পর্যন্ত বারণ করেছে। যেমন- আনাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
لَا يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْمَوْتَ لِضُرٍّ نَزَلَ بِهِ فَإِنْ كَانَ لَا بُدَّ مُتَمَنِّيًا فَلْيَقُلِ اَللّٰهُمَّ أَحْيِنِىْ مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِى وَتَوَفَّنِى إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِىْ.
‘তোমাদের কেউ যেনো কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেনো বলে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়।’[৯]
❑ আত্মহত্যাকারী কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী?
কেউ যখন নিজেকে হত্যা করে তখন সে নিজেকে মূলতঃ মহান আল্লাহর গজব ও ক্রোধের শিকারে পরিণত করে। সে মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কারণ তা কোনো শিরকী কাজ নয়। একমাত্র শিরকই এমন গুনাহ আল্লাহ তা‘আলা যা ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿إِنَّ ٱللهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ يَشَآءُۚ وَمَنْ يُشۡرِكۡ بِٱللهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلَۢا بَعِيْدًا﴾
“নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হলো।”[১০]
শিরক ছাড়া যা আছে তা মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আর আত্মহত্যা রক নয়। তেমনি যিনা, চুরি, মদ্য পান- সবকিছুই গুনাহ বটে। তবে তা শিরক নয়। এসবে লিপ্ত ব্যক্তি মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। কেউ যখন এসব গুনাহে লিপ্ত হয়ে মারা যাবে আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন- তার নেক কাজগুলোর বদৌলতে কিংবা ইসলামে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আর তিনি চাইলে তাকে তার অপরাধ অনুপাতে তাকে শাস্তি দেবেন। অতপর সে গুনাহ থেকে পবিত্র হবার পর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিশ্বাস মতে সে চির জাহান্নামী হবে না। কোনো গুনাহগারই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। খুনী, মদ্যপ কিংবা অন্য কোনো অপরাধীও নয়। কিন্তু ওপরে যেমন- বলা হলো, আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন, তার অপরাধ অনুযায়ী তাকে ‘আযাব দেবেন তারপর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। একমাত্র কাফিররাই শুধু জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে। মহান আল্লাহতে অবিশ্বাসী মুশরিক-কাফিররাই শুধু জাহান্নামে চিরকাল থাকবে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আনীত দীনকে যারা অস্বীকার করেছে।
তবে শুধু খারেজী ও মুতাজিলা সম্প্রদায় মনে করে আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। তাদের মতে গুনাহগার ব্যক্তিরাও চির জাহান্নামী। এ দু’টি দলই ভ্রান্ত ফিরকা। এটি তাদের ভ্রান্ত মত। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবীবৃন্দ এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর আদর্শ অনুসারীদের মত হলো, গুনাহগার ব্যক্তিরা চির জাহান্নামী হবে না। কারণ গুনাহগার মাত্রেই সে নিজেকে অপরাধী ভাবে; বরং শয়ত্বানের প্ররোচনায় বা প্রবৃত্তির তাড়নায় সে গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তাই সে অনন্তকাল জাহান্নামী হবে না; বরং আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে তার ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অন্যথায় তাকে তার সাজা ভোগ করার পর জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর এ ব্যাপারে হাদীসের কোনো অভাব নেই যে মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবে অতপর সাজা খেটে সেখান থেকে জান্নাতে দাখিল হবে। অবশ্য কেউ যদি নিজের গুনাহকে বৈধ মনে করে বা মহান আল্লাহর বিধানের সঙ্গে কুফ্রীবশতঃ গুনাহ করে বা আত্মহত্যা করে তবে সবার মতে সে জাহান্নামী। জাহান্নামই তার স্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হিফাযত করুন -আমীন।
◍ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
﴿كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُوْنَ﴾
“প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।”[১]
আর এ মৃত্যু দান করেন একমাত্র তিনিই। তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না।
◍ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيْتُ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُوْنَ﴾
“তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।”[২]
উপরোক্ত আয়াত দু’টি থেকে বুঝা যায় মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র মহান আল্লাহর। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, নিজের মৃত্যু ঘটান নিজের হাতে তবে তিনি অনধিকার চর্চাই করবেন। আল্লাহ তা‘আলা তা পছন্দ করেন না। কেউ অনধিকার চর্চা প্রত্যাশা করে না। ইসলামে তাই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। এ কাজ থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র আল কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।
◍ আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيْمٗا - وَمَنْ يَفۡعَلۡ ذٰلِكَ عُدۡوَٰنٗا وَظُلۡمٗا فَسَوۡفَ نُصۡلِيْهِ نَارٗاۚ وَكَانَ ذٰلِكَ عَلٰى ٱللهِ يَسِيْرًا﴾
“আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ যুল্ম করে, অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।”[৩]
◍ আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُلۡقُوْا بِأَيۡدِيْكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ﴾
“আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।”[৪]
◈ হাদীসে নাববী থেকে :
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ও তাই কাজটি থেকে নানাভাবে বারণ করেছেন। এ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছেন। যেমন-
◍ সাবিত ইবনু যিহাক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَىْءٍ فِىْ الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
“যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।”[৫]
◍ অপর এক হাদীসে রয়েছে, আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَهْوَ فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ، يَتَرَدَّى فِيْهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَحَسَّىْ سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَسَمُّهُ فِىْ يَدِهِ، يَتَحَسَّاهُ فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيْدَةٍ ، فَحَدِيْدَتُهُ فِىْ يَدِهِ، يَجَأُ بِهَا فِىْ بَطْنِهِ فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا.
“যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।”[৬]
◍ আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ خَنَقَ نَفْسَهُ فِيْ الدُّنْيَا فَقَتَلَهَا خَنَقَ نَفْسَهُ فِيْ النَّارِ، وَمَنْ طَعَنَ نَفْسَهُ طَعَنَهَا فِيْ النَّارِ، وَمَنِ اقْتَحَمَ، فَقَتَلَ نَفْسَهُ اقْتَحَمَ فِيْ النَّارِ.
“যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোযখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোযখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে। আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, ক্বিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।”[৭]
◍ জুনদুব ইবনু ‘আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
كَانَ فِيْمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ فَجَزِعَ فَأَخَذَ سِكِّيْنًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتّٰى مَاتَ قَالَ اللهُ تَعَالَى بَادَرَنِيْ عَبْدِيْ بِنَفْسِهِ حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ.
‘তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’[৮]
❑ আত্মহত্যা তো দূরে থাক, মৃত্যু কামনাও বৈধ নয় : আত্মহত্যা তো দূরের কথা আমাদের পবিত্র এই শরী‘আত কোনো বিপদে পড়ে বা জীবন যন্ত্রনায় কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করতে পর্যন্ত বারণ করেছে। যেমন- আনাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
لَا يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْمَوْتَ لِضُرٍّ نَزَلَ بِهِ فَإِنْ كَانَ لَا بُدَّ مُتَمَنِّيًا فَلْيَقُلِ اَللّٰهُمَّ أَحْيِنِىْ مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِى وَتَوَفَّنِى إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِىْ.
‘তোমাদের কেউ যেনো কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেনো বলে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়।’[৯]
❑ আত্মহত্যাকারী কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী?
কেউ যখন নিজেকে হত্যা করে তখন সে নিজেকে মূলতঃ মহান আল্লাহর গজব ও ক্রোধের শিকারে পরিণত করে। সে মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কারণ তা কোনো শিরকী কাজ নয়। একমাত্র শিরকই এমন গুনাহ আল্লাহ তা‘আলা যা ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿إِنَّ ٱللهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ يَشَآءُۚ وَمَنْ يُشۡرِكۡ بِٱللهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلَۢا بَعِيْدًا﴾
“নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হলো।”[১০]
শিরক ছাড়া যা আছে তা মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আর আত্মহত্যা রক নয়। তেমনি যিনা, চুরি, মদ্য পান- সবকিছুই গুনাহ বটে। তবে তা শিরক নয়। এসবে লিপ্ত ব্যক্তি মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। কেউ যখন এসব গুনাহে লিপ্ত হয়ে মারা যাবে আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন- তার নেক কাজগুলোর বদৌলতে কিংবা ইসলামে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আর তিনি চাইলে তাকে তার অপরাধ অনুপাতে তাকে শাস্তি দেবেন। অতপর সে গুনাহ থেকে পবিত্র হবার পর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিশ্বাস মতে সে চির জাহান্নামী হবে না। কোনো গুনাহগারই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। খুনী, মদ্যপ কিংবা অন্য কোনো অপরাধীও নয়। কিন্তু ওপরে যেমন- বলা হলো, আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন, তার অপরাধ অনুযায়ী তাকে ‘আযাব দেবেন তারপর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। একমাত্র কাফিররাই শুধু জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে। মহান আল্লাহতে অবিশ্বাসী মুশরিক-কাফিররাই শুধু জাহান্নামে চিরকাল থাকবে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আনীত দীনকে যারা অস্বীকার করেছে।
তবে শুধু খারেজী ও মুতাজিলা সম্প্রদায় মনে করে আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। তাদের মতে গুনাহগার ব্যক্তিরাও চির জাহান্নামী। এ দু’টি দলই ভ্রান্ত ফিরকা। এটি তাদের ভ্রান্ত মত। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবীবৃন্দ এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর আদর্শ অনুসারীদের মত হলো, গুনাহগার ব্যক্তিরা চির জাহান্নামী হবে না। কারণ গুনাহগার মাত্রেই সে নিজেকে অপরাধী ভাবে; বরং শয়ত্বানের প্ররোচনায় বা প্রবৃত্তির তাড়নায় সে গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তাই সে অনন্তকাল জাহান্নামী হবে না; বরং আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে তার ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অন্যথায় তাকে তার সাজা ভোগ করার পর জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর এ ব্যাপারে হাদীসের কোনো অভাব নেই যে মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবে অতপর সাজা খেটে সেখান থেকে জান্নাতে দাখিল হবে। অবশ্য কেউ যদি নিজের গুনাহকে বৈধ মনে করে বা মহান আল্লাহর বিধানের সঙ্গে কুফ্রীবশতঃ গুনাহ করে বা আত্মহত্যা করে তবে সবার মতে সে জাহান্নামী। জাহান্নামই তার স্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হিফাযত করুন -আমীন।
[১] সূরা আল ‘আনক্বাবূত, আয়াত : ৫৭।
[২] সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৬।
[৩] সূরা আন্ নিসা, আয়াত : ২৯-৩০।
[৪] সূরা আল বাক্বারাহ্, আয়াত : ১৯৫।
[৫] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৭০০; সহীহ মুসলিম- হাঃ ১১০।
[৬] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৪৪২; সহীহ মুসলিম- হাঃ ১০৯।
[৭] সহীহ ইবনু হিব্বান- হাঃ ৫৯৮৭; তাবরানী- হাঃ ৬২১।
[৮] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৩২৭৬; সহীহ মুসলিম- হাঃ ১১৩।
[৯] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৬৭১; সহীহ মুসলিম- হাঃ ৬৯৯০।
[১০] সূরা আন্ নিসা, আয়াত : ৪৮।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য