সাময়িক প্রসঙ্গ
মুনাফিক্বের চরিত্র ও তাদের পরিণতি
অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ রঈসুদ্দীন

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّقُوْلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ وَبِالْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِیْنَۘ۝ یُخٰدِعُوْنَ اللّٰهَ وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا١ۚ وَمَا یَخْدَعُوْنَ اِلَّاۤ اَنْفُسَهُمْ وَمَا یَشْعُرُوْنَ ؕ۝ فِیْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ١ۙ فَزَادَهُمُ اللّٰهُ مَـرَضًـا١ۚ وَلَـهُـمْ عَـذَابٌ اَلِـیْمٌۢ١ۙ۬ بِمَا كَانُوْا یَكْذِبُوْنَ﴾
আয়াতের সরল অর্থানুবাদ
“মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা মু’মিন নয়। তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের ধোঁকা দেয়, আসলে তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। কিন্তু এটা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের অন্তরে আছে ব্যাধি, তারপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। কারণ তারা মিথ্যাবাদী।”[১]
আয়াতসমূহের সংক্ষিপ্ত তাফসীর
মুনাফিক্বের পরিচয়
অত্র সূরার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনদের বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর দু’টি আয়াতে কাফিরদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখন কপটচারী মুনাফিক্বদের বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে যারা বাহ্যত ঈমানদাররূপে প্রকাশ পায়, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ও গোপনে তারা কাফির। সাধারণত তাদের চতুরতা গোপন থেকে যায় বলে তাদের আলোচনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে হয়েছে এবং তাদের অনেক নিদর্শনও বর্ণনা করা হয়েছে। তাদেরই সম্বন্ধে সূরাহ্ বারা’আত অবতীর্ণ হয়েছে এবং সূরাহ্ আন্ নূর ও আল মুনা-ফিকূন ইত্যাদিতে তাদের সম্বন্ধেই আলোচনা রয়েছে যাতে তাদের থেকে পূর্ণভাবে রক্ষা পাওয়া যায় এবং মুসলিমগণ তাদের জঘন্য ও নিন্দনীয় স্বভাব থেকে দূরে সরে থাকতে পারে। তাই আল্লাহ তা‘আলা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন :
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّقُوْلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ... بِمَا كَانُوْا یَكْذِبُوْنَ﴾
‘নিফাক’ শব্দের অর্থ
‘নিফাক’-এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ভালো গুণাবলী প্রকাশ করা ও মন্দ গুণাবলী গোপন করা। ‘নিফাক’ দু’ প্রকার : (১) বিশ্বাস জনিত ও (২) কাজ জনিত। প্রথম প্রকারের মুনাফিক্ব তো চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং দ্বিতীয় প্রকারের মুনাফিক্ব জঘন্যতম পাপী।
ইবনু জুরাইজ (রাযিঃ) বলেন যে, মুনাফিক্বের কথা তার কাজের উল্টো, তার গোপনীয়তা তার প্রকাশ্যের বিপরীত। তার আগমন তার প্রস্থানের উল্টো এবং উপস্থিতি অনুপস্থিতির বিপরীত হয়ে থাকে।[২]
﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّقُوْلُ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ...﴾
আয়াতের বিশ্লেষণ
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক অফড়নব ঝুংঃবসং ইবনু ‘আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এই কপটচারীদের আউস ও খাযরাজ গোত্রভুক্ত ছিলো এবং কতিপয় ইয়াহূদীও তাদের দলে ছিলো। এই আয়াতে আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের কপটতার বর্ণনা রয়েছে।[৩]
আবুল ‘আলিয়া (রাযিঃ) হাসান বাসরী (রাযিঃ), ক্বাতাদাহ্ (রাযিঃ) এবং সুদ্দী (রাযিঃ) এটাই বর্ণনা করেছেন। বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ তা‘আলা এখানে কপটাচারীদের অনেকগুলো বদ অভ্যাসের বর্ণনা দিয়েছেন, যাতে মুসলিমগণ তাদের বাহ্যিক অবস্থা দেখে প্রতারিত না হয় এবং তাদেরকে মুসলিম মনে করে অসতর্ক না থাকে, নচেৎ একটা বিরাট হাঙ্গামা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, অসৎকে সৎ মনে করার পরিণাম খুবই খারাপ ও ভয়াবহ। যেমন- এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, তারা মুখে তো অবশ্যই স্বীকার করছে, কিন্তু অন্তরে ঈমান নেই। এভাবেই সূরাহ্ আল মুনা-ফিক্বূনেও বলা হয়েছে-
﴿اِذَا جَآءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ قَالُوْا نَشْهَدُ اِنَّكَ لَرَسُوْلُ اللّٰهِ١ۘ وَاللّٰهُ یَعْلَمُ اِنَّكَ لَرَسُوْلُه﴾
“মুনাফিক্বরা যখন তোমার নিকট আসে তখন তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। আর আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল।”[৪]
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক্বদের কথা তাদের বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো না বলেই তাদের জোরালো সাক্ষ্য দান স্বত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে স্পষ্টভাবে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করলেন। যেমন- আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেন :
﴿وَاللّٰهُ یَشْهَدُ اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ لَكٰذِبُوْنَ﴾
“আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিক্বরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।”[৫]
মুনাফিক্বরা মু’মিন নয়
এ মর্মে আল্লাহ বলেন : ﴿وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِیْنَ﴾ “তারা ঈমানদার নয়।”[৬]
তারা ঈমানকে প্রকাশ করে ও কুফ্রীকে গোপন রেখে নিজেদের বোকামীর দ্বারা আল্লাহকে ধোঁকা দিচ্ছে এবং মনে করছে যে, এটা তাদেরকে আল্লাহর কাছে উপকার ও সুযোগ সুবিধা দিবে এবং কতোগুলো মু’মিন তাদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হবে। কুরআন মাজীদের অন্য স্থানে আছে-
﴿یَوْمَ یَبْعَثُهُمُ اللّٰهُ جَمِیْعًا فَیَحْلِفُوْنَ لَه كَمَا یَحْلِفُوْنَ لَكُمْ وَیَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ عَلٰى شَیْءٍ اَلَاۤ اِنَّهُمْ هُمُ الْكٰذِبُوْنَ﴾
“যেদিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে, তখন তারা আল্লাহর নিকট সেরূপ শপথ করবে যেরূপ শপথ তোমাদের নিকট করে এবং তারা মনে করে যে, এতে তারা উপকৃত হবে। সাবধান! তারাই তো মিথ্যাবাদী।”[৭]
এখানেও তাদের ভুল বিশ্বাসের পক্ষে তিনি বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের কাজের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে অবহিতই নয়। এ ধোঁকা তো তারা নিজেদেরকেই দিচ্ছে। যেমন- আল কুরআনের অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছে-
﴿اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللّٰهَ وَ هُوَ خَادِعُهُم﴾
“নিশ্চয়ই মুনাফিক্বরা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করে আর তিনি তাদেরকে ঐ প্রতারণার শাস্তি দেন।”[৮]
অর্থাৎ- ফলাফল দান করেন।
এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, মুনাফিক্বরা মহান আল্লাহকে এবং মু’মিনদেরকে কিভাবে ধোঁকা দিবে তারা তো মনের বিপক্ষে যা কিছু প্রকাশ করে থাকে তা তো শুধু তাদের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে করে থাকে।
এর জবাব হলো- যে ব্যক্তি কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এ রকম কথা বলে, আরবী ভাষায় তাকে مخادع বলে। মুনাফিক্বরাও হত্যা, বন্দী হওয়া এবং ইহলৌকিক শাস্তি হতে নিরাপত্তা লাভের উদ্দেশ্যে এই চালাকি করতো এবং মনের বিপরীত কথা বাইরে প্রকাশ করতো, এজন্য তাদেরকে প্রতারক বলা হয়েছে। তাদের এ কাজ দুনিয়ার লোককে কিছু ধোঁকা দিলেও প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছে।
ইবনু জুরাইজ (রাযিঃ)-এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেন যে, ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহু’ কালিমা মুখে প্রকাশ করে তারা জীবনের নিরাপত্তা কামনা করে। এই কালিমাটি তাদের অন্তরে স্থান পায় না।[৯]
ক্বাতাদাহ্ (রাযিঃ) বলেন যে, মুনাফিক্বদের অবস্থা এই- তাদের মুখ পৃথক, অন্তর পৃথক, কাজ পৃথক, বিশ্বাস পৃথক, সকাল পৃথক, সন্ধ্যা পৃথক, তারা নৌকার মতো, যা বাতাসে কখনো এদিকে ঘুরে কখনো ওদিকে ঘুরে।[১০]
‘ব্যাধি’ শব্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
ব্যাধির অর্থ এখানে সংশয় ও সন্দেহ।[১১] ইবনু ‘আব্বাস (রাযিঃ), ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিঃ) এবং অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী (রাযিঃ) থেকে এটাই বর্ণিত আছে। মুজাহিদ (রাযিঃ), ইকরিমাহ (রাযিঃ), হাসান বাসরী (রাযিঃ), আবুল ‘আলিয়া (রাযিঃ), রাবী‘ ইবনু আনাস (রাযিঃ) এবং ক্বাতাদাহ্ (রাযিঃ)-এরও এটাই অভিমত।[১২] ইকরিমাহ (রাযিঃ) এবং তা‘উস (রাযিঃ)-এর তাফসীর করেছেন ‘রিয়া’ বা কৃত্রিমতা, আর ইবনু ‘আব্বাস (রাযিঃ) থেকে এর তাফসীর ‘নিফাক’ বা কপটতাও বর্ণিত হয়েছে। যায়দ ইবনু আসলাম (রাযিঃ) বলেন যে, এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মীয় রোগ বা ব্যাধি, শারীরিক রোগ নয়। ইসলাম সম্পর্কে তাদের সংশয় ও সন্দেহজনিত একটা বিশেষ রোগ ছিলো, আল্লাহ তাদের সেই রোগ বাড়িয়ে দিলেন।[১৩] যেমন- কুরআন মাজীদে আছে-
﴿فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فَزَادَتْهُمْ اِیْمَانًا وَّ هُمْ یَسْتَبْشِرُوْنَ وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا اِلٰى رِجْسِهِمْ﴾
“অবশ্যই যে সব লোক ঈমান এনেছে, এই সূরাহ্ তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে এবং তারাই আনন্দ লাভ করছে। আর যাদের অন্তরসমূহে রোগ হয়েছে, এই সূরাহ্ তাদের মধ্যে তাদের কলুষতার সাথে আরো কলুষতা বর্ধিত করেছে।”[১৪]
অর্থাৎ- তাদের পাপ গোমরাহী আরো বেড়ে যায় এবং এই প্রতিদান তাদের কাজের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই তাফসীরই উত্তম। এই ফরমানটি ঠিক এরই মতো-
﴿وَالَّذِیْنَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَّاٰتٰىهُمْ تَقْوٰىهُمْ﴾
“যারা সৎ পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তাদের সৎ পথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে মুত্তাকী হওয়ার শক্তি দান করেন।”[১৫]
মুনাফিক্বরা অবিশ্বাসী ও মিথ্যাবাদী
মুনাফিক্বদের মধ্যে এই বদ অভ্যাস ছিলো যে, তারা মিথ্যা কথাও বলতো এবং অবিশ্বাসও করতো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুনাফিক্বদেরকে চেনা সত্ত্বেও তাদেরকে হত্যা করেননি। এর কারণ এই যে, সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘উমার (রাযিঃ)-কে বলেন :
أُكْرِهُ أَنْ يَّتَحَدَّثَ الْعَرَبُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ.
‘মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সাথীগণকে হত্যা করে থাকেন, আরবদের মাঝে এ চর্চা হওয়াটা আমি আদৌ পছন্দ করি না।’[১৬]
ভাবার্থ এই যে, মুনাফিক্বদেরকে তাদের অন্তরের কুফ্রীর জন্য হত্যা করা হলে আশে পাশের মরুচারী বেদুঈনদের এটা জানা থাকবে না। তাদের দৃষ্টি তো শুধু বাহ্যিকের ওপরই থাকবে। সুতরাং যখন তাদের মধ্যে এ সংবাদ প্রচারিত হবে যে, রাসূল (সাঃ) নিজের সাথীদেরকে হত্যা করেছেন তখন তারা হয়তো ভয়ে ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, আমাদের ‘আলেমদেরও এটাই অভিমত। ঠিক এভাবেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুআল্লাফাতে কুলূব তথা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ধন-সম্পদ দান করতেন। যদিও তাদের খারাপ ‘আক্বীদাহ্ সম্পর্কে অবহিত থাকতেন। ইমাম মালিক (রাযিঃ)-ও মুনাফিক্বদের হত্যা না করার কারণ এটাই বর্ণনা করেছেন। যেমন- মুহাম্মাদ ইবনু জাহাম, কাযী ইসমা‘ঈল এবং আবহারী (রাযিঃ) নকল করেছেন। ইবনু মাজেশুনের কথায় একটি কারণ এটাও নকল করা হয়েছে। যাতে নাবী (সাঃ)-এর উম্মাত জানতে পারে যে, বিচারক নিজের অবগতির ওপর ফায়সালা করতে পারেন না। মুনাফিক্বদেরকে হত্যা না করার এটাও ছিলো অন্যতম কারণ।
পরকালে মু’মিন-মুনাফিক্বদের পৃথক পৃথক আবাসিস্থল
সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন :
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتّٰى يَقُوْلُوْا لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ فَمَنْ قَالَ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ فَقَدْ عَصَمَ مِنِّىْ مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلَّا بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلٰى اللهِ.
‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ তা‘আলার রাসূল। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ থেকে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করলো; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোনো কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার মহান আল্লাহর ওপর অর্পিত।’[১৭]
উদ্দেশ্য এই যে, এ কালিমা বলার সাথে সাথে তাদের ওপর ইসলামের প্রকাশ্য আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করা চালু হয়ে যাবে। অতএব, তাদের আন্তরিক বিশ্বাসও যদি এর অনুরূপ হয়, তাহলে এটা আখিরাতে তাদের মুক্তির কারণ হবে, নচেৎ এটা সেখানে কোনো উপকারে আসবে না। কিন্তু দুনিয়ার বুকে তাদের ওপর অন্যান্য মুসলমানের আইন চালু থাকবে। এসব লোকের নাম এখানে যদিও মুসলমানের নামের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু আখিরাতে ঠিক পুলসিরাতের ওপর মুসলমানদের মধ্য হতে তাদেরকে দূরে পৃথক করে দেয়া হবে। তখন তারা অন্ধকারে বিচলিত হয়ে উচ্চ শব্দে মুসলমানদের ডাক দিয়ে বলবে-
يُنَادُونَهُمْ أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ قَالُوا بَلَى وَلَكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ وَتَرَبَّصْتُمْ وَارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الْأَمَانِيُّ حَتّٰى جَاءَ أَمْرُ اللهِ.
‘তারা মু’মিনদের ডেকে বলবে- ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?’ তারা উত্তর দিবে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদে ফেলে দিয়েছো, তোমরা অপেক্ষা করেছিলে আমাদের ধ্বংসের জন্য। তোমরা সন্দেহে পতিত ছিলে, আর মিথ্যা আশা-আকাক্সক্ষা তোমাদের প্রতারিত করেছিলো। শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহর হুকুম এসে গেলো।’[১৮]
মোটকথা, আখিরাতেও মুনাফিক্বরা মুসলিমদের পিছনে থেকে তাদেরকে জড়িয়ে থাকতে সচেষ্ট হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরকে আলাদা করে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে। তাদের এবং তাদের আশা আকাঙ্খার মাঝে বাধার প্রাচীর সৃষ্টি হয়ে যাবে। আর তারা মুসলিমদের মাঝে সাজদায় পড়ে যাবে। কিন্তু তারা সাজদা করতে সক্ষম হবে না।
মুনাফিক্বরা প্রতারক ও কপটতাকারী
চৌদ্দজন প্রধান ও কুখ্যাত লোকের ‘নিফাক’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিশ্চিত রূপেই জানতেন। এসব কলুষিত লোক তারাই ছিলো যারা তাবূকের যুদ্ধে পরস্পরের সুপরিকল্পিত পরামর্শক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে প্রতারণা করবেই।
তারা তাঁকে হত্যা করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এঁটেছিলো যে, রাতের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে যখন তিনি অমুক খাদের নিকটবর্তী হবেন তখন তাঁর উষ্ট্রীকে তারা তাড়া করবে। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাদের মধ্যে পড়ে যাবেন। আল্লাহ স্বীয় নাবী (সাঃ)-কে ওয়াহীর মাধ্যমে এই জঘন্য কপটতার কথা জানিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হুযাইফাহ্ (রাযিঃ)-কে ডেকে এ ঘটনার সংবাদ দেন, এমন কি এক এক করে ঐ কপটদের নাম পর্যন্তও তিনি বলে দেন। তথাপিও তিনি উপরোক্ত কারণে তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ জারী করলেন না। এরা ছাড়া অন্যান্য মুনাফিক্বদের নাম তাঁর জানা ছিলো না। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
﴿وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِّنَ الْاَعْرَابِ مُنٰفِقُوْنَ وَمِنْ اَهْلِ الْمَدِیْنَةِۛ۫ مَرَدُوْا عَلٰى النِّفَاقِ۫    لَا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ﴾
“আর তোমাদের মরুবাসীদের মধ্য থেকে কতিপয় লোক এবং মাদীনাবাসীদের মধ্য হতেও কতিপয় লোক এমন মুনাফিক্ব রয়েছে, যারা নিফাকের চরমে পৌঁছে গেছে। তুমি তাদেরকে জানো না, আমিই তাদেরকে জানি।”[১৯]
অন্য এক জায়গায় তিনি বলেন :
﴿لَىِٕنْ لَّمْ یَنْتَهِ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ وَّالْمُرْجِفُوْنَ فِیْ الْمَدِیْنَةِ لَنُغْرِیَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا یُجَاوِرُوْنَكَ فِیْهَاۤ اِلَّا قَلِیْلًا مَّلْعُوْنِیْنَۛۚ اَیْنَمَا ثُقِفُوْۤا اُخِذُوْا وَقُتِّلُوْا تَقْتِیْلًا﴾
“মুনাফিক্বরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা নগরে গুজব রটনা করে, তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করবো; এরপর এই নগরীতে তোমার প্রতিবেশী রূপে তারা স্বল্প সময়ই থাকবে অভিশপ্ত হয়ে, তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।”[২০]
এই আয়াতগুলো থেকে জানা গেলো যে, ঐ মুনাফিক্বরা কে কে ছিলো, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা জানতেন না। তবে তাদের নিন্দনীয় স্বভাবের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছিলো তা যাদের মধ্যে পাওয়া যেতো, তাদের ওপর নিফাক প্রযোজ্য হতো। যেমন- এক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবেই বলেন :
﴿وَلَوْ نَشَآءُ لَاَرَیْنٰكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِیْمٰىهُمْ١ؕ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِیْ لَحْنِ الْقَوْلِ﴾
“আমি ইচ্ছা করলে তোমাকে তাদের পরিচয় দিতাম। ফলে তুমি তাদের লক্ষণ দেখে তাদেরকে চিনতে পারবে, তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদেরকে চিনতে পারতে।”[২১]
এ কপটচারী মুনাফিক্বদের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিলো ‘আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল। যায়দ ইবনু আরকাম (রাযিঃ) তার কপটতাপূর্ণ স্বভাব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে সাক্ষ্য দানও করেছিলেন, যা মুনাফিক্বদের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বিবৃত হয়েছে। এ সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই যখন সে মারা যায় তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জানাযার সালাত আদায় করেছেন। অন্যান্য মুসলিম সাহাবীগণের মতো তিনিও তার দাফন কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। এমন কি ‘উমার (রাযিঃ) যখন একটু জোর দিয়ে তার কপটতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তখন তিনি বলছেন :
إِنِّيْ أُكْرِهُ أَنْ يَّتَحَدَّثَ الْعَرَبُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ.
‘আরবের লোক সমালোচনা করবে যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সহচরদেরকে হত্যা করে থাকেন, তা আমি চাই না।’[২২] সহীহ হাদীসের বর্ণনায় আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
إِنِّيْ خُيِّرْتُ فَاخْتَرْتُ.
‘আমাকে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বা না করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। ‘কিন্তু আমি ক্ষমা প্রার্থনা করাকেই পছন্দ করেছি।’[২৩] অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, নাবী (সাঃ) বলেছেন :
لَوْ أَنِّيْ أَعْلَمُ لَوْ زِدْتُ عَلٰى السَّبْعِيْنَ يَغْفِرُ اللهُ لَهُ لَزِدْتُ.
‘আমি যদি জানতাম যে, সত্তরবারের অধিক ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে মার্জনা করা হবে তাহলে আমি অবশ্যই তার অধিকই করতাম।’[২৪]
দারস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
১. জীবনের সর্বাবস্থায় মুনাফিক্বী আদর্শ বর্জন করতে হবে।
২. পরকালে মুনাফিক্বদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের সকলকেই সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে।
৩. মুনাফিক্বরা ইসলামী সমাজের ক্ষতিকারক ও ইসলাম ধ্বংসকারী। সুতরাং নিফাকী আচরণ থেকে সর্বদা বিরত থাকতে হবে।
৪. আমাদের সকলেরই একান্ত উচিত- মুনাফিক্বী চরিত্র থেকে বেঁচে থাকা এবং সত্যিকার মু’মিন হয়ে জান্নাতে যাওয়ার উপযোগী ‘আমল করা।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র বিধ্বংসকারী মুনাফিক্বরা মহানবী (সাঃ)-কে যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছিলো ও হত্যা করার মতো জঘন্য পরিকল্পনা করেছিলো এবং ইসলামী সমাজকে সমূলে বিনাশ করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে তারা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তারা ধ্বংস হয়েছে এবং জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে গেছে। কাজেই আমাদের সকলেরই এহেন চরিত্র থেকে বিরত থেকে খালিস মু’মিন হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সহায় হোন -আমীন। #


[১] সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ৮-১০।
[২]. তাফসীর তাবারী- ১/২৭০।
[৩]. তাফসীর তাবারী- ১/২৬৯।
[৪]. ৬৩ নং সূরাহ্ আল মুনা-ফিক্বূন, আয়াত নং- ১।
[৫]. ৬৩ নং সূরাহ্ আল মুনা-ফিক্বূন, আয়াত নং- ১।
[৬]. ২ নং সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্, আয়াত নং- ৮।
[৭]. ৫৮ নং সূরাহ্ আল মুজা-দালাহ্, আয়াত নং- ১৮।
[৮]. ৪ নং সূরাহ্ আন্ নিসা, আয়াত নং- ১৪২।
[৯]. তাফসীর ইবনু আবী হাতিম- ১/৪৬।
[১০]. তাফসীর ইবনু আবী হাতিম- ১/৪৭।
[১১]. তাফসীর তাবারী- ১/২৮০।
[১২]. তাফসীর ইবনু আবী হাতিম- ১/৪৮।
[১৩]. তাফসীর তাবারী- ১/২৮০।
[১৪]. ৯ নং সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্, আয়াত নং- ১২৪-১২৫।
[১৫]. ৪৭ নং সূরাহ্ মুহাম্মাদ, আয়াত নং- ১৭।
[১৬]. সহীহুল বুখারী- হাঃ ২৪৯৬, সহীহ মুসলিম- হাঃ ৪/৬৩, ১৯৯৮, ১৯৯৯, তাফসীরে কুরত্ববী- ১/২১৬।
[১৭]. বুখারী- ২৫, ৩৮৫, ১৩৩৫, মুসলিম- ১৩৩, ১৩৪, ১৩৫, ১৩৬, হাঃ ২২; আঃ প্রঃ, হাঃ ২৪, বাং ইঃ ফাঃ, হাঃ ২৪।
[১৮]. ৫৭ নং সূরাহ্ আল হাদীদ, আয়াত নং- ১৪।
[১৯]. ৯ নং সূরাহ্ আত্ তাওবাহ, আয়াত নং- ১০১।
[২০]. ৩৩ নং সূরাহ্ আল আহ্যা-ব, আয়াত নং- ৬০-৬১।
[২১]. ৪৭ নং সূরাহ্ মুহাম্মাদ, আয়াত নং- ‌৩০।
[২২]. সহীহুল বুখারী- হাঃ ৪৯০৫, সহীহ মুসলিম- হাঃ ২৫৮৪।
[২৩]. সহীহুল বুখারী- হাঃ ১৩০০, ৪৩৯৪।
[২৪]. বুখারী- ১৩০০, ৪৩৯৪, ফাতহুল বারী- ৮/১৮৪, মুসলিম- ৪/২১৪১, তিরমিযী- ৫/৩০৯৭, নাসায়ী- ৪/১৯৬৫, আহমাদ- ১/১৬/৯৫।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত