সাময়িক প্রসঙ্গ
ধৈর্যই সফলতার চাবি-কাঠি
অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ রঈসুদ্দীন
মহানাবী (সাঃ)-এর অমীয় বাণী :
عَنْ خَبَّابِ بْنِ الْأَرَتِّ قَالَ شَكَوْنَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَهُوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِيْ ظِلِّ الْكَعْبَةِ قُلْنَا لَهُ أَلَا تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلَا تَدْعُوْ اللهَ لَنَا قَالَ كَانَ الرَّجُلُ فِيْمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِيْ الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوْضَعُ عَلٰى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ وَمَا يَصُدُّهُ ذٰلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذٰلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الْأَمْرَ حَتّٰى يَسِيْرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ لَا يَخَافُ إِلَّا اللهَ أَوْ الذِّئْبَ عَلٰى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ.
সরল অনুবাদ : খাববাব ইবনু আরত্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নাবী (সাঃ)-এর খিদমতে অভিযোগ করলাম। তখন তিনি তাঁর চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা‘বার ছায়ায় বিশ্রাম করছিলেন। আমরা তাঁকে বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করবেন না? তিনি বললেন, তোমাদের আগের লোকদের অবস্থা ছিল এই, তাদের জন্য মাটিতে গর্ত খুঁড়া হত এবং ঐ গর্তে তাকে পুঁতে রেখে করাত দিয়ে তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করা হত। এটা তাদেরকে দ্বীন হতে টলাতে পারত না। লোহার চিরুনী দিয়ে শরীরের হাড় গোশ্ত ও শিরা-উপশিরা সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে দিত। এটা তাদেরকে দ্বীন থেকে সরাতে পারেনি। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তা‘আলা এ দ্বীনকে অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন। তখন একজন উষ্ট্রারোহী সান‘আ হতে হাযারামাউত পর্যন্ত সফর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় করবে না। অথবা তার মেষপালের জন্য নেকড়ে বাঘের ভয়ও করবে না। কিন্তু তোমরা বড্ড তাড়াহুড়া করছ।[১]
রাবী পরিচিতি : নাম খাব্বাব, পিতা আরাত। তিনি ছিলেন বানু তামীমের সন্তান। অন্য এক গোত্রের আক্রমণে তাঁর গোত্রটি পরাজিত হয়। আক্রমণকারীরা সকল পুরুষদেরকে হত্যা করে এবং নারী ও ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে দাসে পরিণত করে। খাব্বাব (রাযিঃ) ছিলেন ছোটদের একজন। হাত বদল হয়ে তিনি পৌঁছেন মক্কার বাজারে। বানু খুজায়া’র উম্মু আনমার নামের এক মহিলা তাঁকে ক্রয় করে। উম্মু আনমার তাঁকে কর্মকারের কাজে নিয়োজিত করে। তিনি কয়লার মধ্যে লোহা গলিয়ে ঢাল, তলোয়ার ও বর্শা তৈরির কাজ করতেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও কর্মঠ তরুণ। মুহাম্মাদ (সাঃ) নামক এক ব্যক্তি নতুন দ্বীন প্রচার করছেন জানতে পেরে যুবক খাব্বাব (রাযিঃ) মুহাম্মাদুর রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গেলেন, তাঁর মুখে আল কুরআনের বাণী শুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। খাব্বাব (রাযিঃ) প্রথম পাঁচ ছয়জনের পরেই ইসলাম গ্রহণ করেন।
খাব্বাব (রাযিঃ) তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন না। নিঃসংকোচে অন্যদের কাছে দ্বীনের কথা বলা শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই খবর পৌঁছলো উম্মু আন্মারের কাছে। উম্মু আনমার তার ভাই সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে খাব্বাব (রাযিঃ)-এর কাছে এসে বলে, ‘তুমি নাকি ধর্মত্যাগী হয়ে বানু হাশিমের এক যুবকের অনুসারী হয়েছ?’ তিনি বললেন, ‘আমি ধর্মত্যাগী হইনি। তবে লা-শারিক মহান আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি, মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সাক্ষ্য দিয়েছি মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সিবা’ ও তার সাথীরা নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। অনবরত কিল-ঘুষি মারতে থাকে, পা দিয়ে পিষতে থাকে।
একদিন খাব্বাব (রাযিঃ) আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর সান্নিধ্য থেকে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে আসেন। সেখানে ছিল একদল লোক। তারা যখন জানতে পেল খাব্বাব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট থেকে এসেছেন, তারা তাঁকে মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে দেখেন তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত এবং পোশাক রক্তে-রঞ্জিত।
মক্কার মুশরিক নেতাদের নির্দেশে সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও তার সাথীরা খাব্বাব (রাযিঃ)-কে লোহার পোশাক পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দিতে থাকে। প্রচণ্ড গরমে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন, পিপাসায় ছটফট করতেন। এই অবস্থায় তাঁকে বলা হত, ‘মুহাম্মাদ সম্পর্কে এখন তোমার বক্তব্য কী?’ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলতেন, ‘তিনি মহান আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নেয়ার জন্য তিনি আমাদের নিকট এসেছেন।’ আবারো শুরু হত মারপিট। ইসলাম গহণ করার অপরাধে তার মনিব উম্মু আনমারের ভাইয়েরা তাকে অকথ্য নির্যাতন করত। তারা হাপরে কতকগুলো পাথর টুকরো গরম করে সেইগুলো বিছিয়ে এবং উত্তপ্ত আগুন তৈরি করে তার ওপর তাঁকে শুইয়ে দিত এবং একজন বলবান ব্যক্তি তাঁর বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকত। এই উত্তপ্ত পাথর ও জলন্ত কয়লার আগুনে তাঁর পিঠের গোশত খসে পড়ত, শরীরের রক্ত মাংসগুলো গলে গলে কয়লা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। কয়লার আগুনে ঝলসে গিয়ে তার শরীরে এমন গর্ত হয়েছিল যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই গর্তগুলো পূরণ হয়নি। সেজন্য তিনি সব সময় গায়ের ওপর চাদর জড়িয়ে রাখতেন। মাঝে-মধ্যে উম্মু আনমার দোকানে এসে হাপরে লোহার পাত গরম করে তাঁর মাথায় ঠেসে ধরত, যন্ত্রণায় তিনি ছট্ফট্ করতেন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এত নির্যাতনের পরেও তিনি ইসলাম ত্যাগ করে কুফ্রে ফিরে যেতে রাজি হননি।
‘উমার (রাযিঃ)-এর খিলাফতের সময় তিনি খাব্বাব (রাযিঃ)-এর উপর নির্যাতনের বিস্তারিত জানতে চাইলে খাব্বাব (রাযিঃ) বলেন, ‘আমার কোমরের প্রতি লক্ষ্য করুন।’ ‘উমার (রাযিঃ) তাঁর কোমর দেখে বলেন, ‘হায় একি অবস্থা!’ তখন খাব্বাব (রাযিঃ) বলেন, ‘আমাকে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে ধরে রাখা হত, ফলে আমার চর্বি এবং রক্ত প্রবাহিত হয়ে আগুন নিভে যেত। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে খাব্বাব অফড়নব ঝুংঃবসং-এর মৃত্যু হয় এবং সাহাবাদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই কুফায় কবরস্থ হন। তাঁর মৃত্যুর পর ‘আলী (রাযিঃ) তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা খাব্বাবের উপর রহমত করুন। তিনি নিজের ইচ্ছায় মুসলমান হয়েছিলেন, হিজরত করেছিলেন, সকল জিহাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ : মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের মাধ্যমে যখন মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে শুরু করল, তখন কাফিরদের পক্ষ থেকে রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীদের উপর যুল্ম-নির্যাতনের মাত্রাও চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে থাকল। রাসূল (সাঃ)-কে শি’বে আবি তালিবে বন্দি জীবন-যাপন করতে হলো, সুমাইয়াহ্, খুবাইব, আম্মারসহ বেশকিছু সাহাবীকে শহীদ করা হলো। বেলাল, খাব্বাবের মতো সাহাবীদের প্রতি যুল্ম-নির্যাতনের মাত্রা চরম সীমায় পৌঁছে গেল এ সময় একদিন  খাব্বাব ইবনু আরাত (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট গেলেন, রাসূল (সাঃ) তখন ক্বাবার ছায়ায় বসেছিলেন। খাব্বাব (সাঃ) বললেন-
أَلَا تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلَا تَدْعُوْ اللهَ لَنَا يَا رَسُوْلَ الله.
“হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্য চাইবেন না, আমাদের জন্য দু‘আ করবেন না?”
খাব্বাব (রাযিঃ)-এর প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন।
যুগ যুগ ধরে যারা ইসলামের দা‘ওয়াত ও তাবলীগে অংশ নিয়েছিল তাদের উপর যে যুল্ম-নির্যাতন হয়েছে আলোচ্য হাদীসে রাসূল (সাঃ) সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। আদম  থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত নাবী-রাসূল এবং তাঁদের উত্তরসূরী এই পৃথিবীতে দ্বীনে হক্বের দা‘ওয়াত দিয়েছেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের বিরুদ্ধেই শত্রুতা করেছে। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَكَذٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ.
“আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নাবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু বানিয়েছি।”[২]
এ আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে যারা ইসলামের দা‘ওয়াত ও তাবলীগের কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা হবে, যুল্ম-নির্যাতন হবে, নির্যাতনের মাত্রার সীমা ছাড়িয়ে গেলেও দ্বীনে হক্বের উপর তারা টিকে থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুল্ম-নির্যাতনের অতীত ইতিহাস তুলে ধরে খাব্বাব (রাযিঃ)-কে সে কথাই বলেছেন-
كَانَ الرَّجُلُ فِيْمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِيْ الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوْضَعُ عَلٰى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ وَمَا يَصُدُّهُ ذٰلِكَ عَنْ دِيْنِهِ وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذٰلِكَ عَنْ دِيْنِهِ.
“তোমাদের আগে যারা এই পৃথিবীতে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিতে এসেছিল তাদেরকে ইসলাম বিরোধী শাক্তি ধরত, তাদের জন্য যমীনে গর্ত খনন করা হত, সে গর্তে তাদেরকে গেড়ে দিত, এরপর করাত আনা হত, সে করাত তার মাথার উপরে রাখা হত, এরপর করাত চালিয়ে জীবিত মানুষটাকে চিরে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হত। এরপরেও তাদেরকে একচুলও মহান আল্লাহর দ্বীন থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলা হত, এর পরেও তাদেরকে দ্বীন থেকে সারানো সম্ভব হয়নি।”
ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ করার কারণে পৃথিবীতে অনেক নাবী-রাসূলগণকে শহীদ করা হয়েছে, জেলখানায় বন্দি করা হয়েছে, অমানুসিক নির্যাতন করা হয়েছে। যারা তাঁদের উপর ঈমান এনেছিল তারাও রেহায় পায়নি, তাদের কাউকেও অনুরূপ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে, এর পরেও তাদেরকে হক্বের রাস্তা থেকে দূরে সরানো সম্ভব হয়নি। যুগযুগ ধরে নাবী-রাসূলগণের প্রতি যুল্ম-নির্যাতনের বর্ণনায় আল-কুরআন ঘোষণা করেন-
﴿أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوْا حَتّٰى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ﴾
“নাকি তোমরা ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মতো কিছু আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথী মু’মিনগণ বলেছিল, ‘কখন আল্লাহর সাহায্য (আসবে)’? জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।”[৩]
আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে পরীক্ষা করার মাধ্যমে জেনে নেন ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। আল-কুরআনের অন্য আয়াতে আরো ঘোষণা হয়েছে-
﴿أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوْا أَنْ يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ ۝ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ﴾
“মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্যবাদী এবং তিনি এটাও জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।”[৪]
ষঢ়যন্ত্রকারীরা সব সময় ষঢ়যন্ত্র করে ক্ষতি সাধন করবে, কিন্তু তারা বিজয়ী হতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনের আলোকে জ্বালিয়ে রাখবেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿يُرِيْدُوْنَ لِيُطْفِئُوْا نُوْرَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُوْرِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُوْنَ﴾
“তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।”[৫]
আল-কুরআন থেকে জানা যায়, বড় বড় ইসলাম বিরোধী শক্তি ইসলামকে পৃথিবী থেকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছে, কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। যেমন-
ইব্রা-হীম  ('আঃ) নমরুদকে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিলেন, নমরুদ সহ্য করতে পারল না, রাগান্বিত হয়ে ইব্রা-হীম (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য অগ্নিকুণ্ড তৈরী করে সে আগুনে তাঁকে ফেলে দিলো, আল্লাহ তা‘আলা সে আগুনকে ইব্রা-হীম ('আঃ)-এর জন্য শান্তিদায়ক ঠাণ্ড করে দিলেন। যেমন- আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
﴿قَالُوْا حَرِّقُوْهُ وَانْصُرُوْا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِيْنَ قُلْنَا يَا نَارُ كُوْنِيْ بَرْدًا وَسَلَامًا عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ﴾
“তারা বলল, ‘তাকে আগুনে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেব-দেবীদেরকে সাহায্য করো, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, ‘হে আগুন! ইব্রা-হীমের জন্য তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।”[৬]
মূসা ('আঃ) ফিরআউনকে তাওহীদের দা‘ওয়াত দিলেন। ফিরআউন বলল, হে মূসা! এতবড় তোমার কলিজায় সাহস আমার ভুখণ্ডে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে বাদ দিয়ে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছ? আমি তোমাকে জেলখানায় বন্দি করব। যেমন- আল-কুরআনের বাণী-
﴿قَالَ لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَهًا غَيْرِيْ لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُوْنِيْنَ﴾
“ফিরআউন বলল, ‘যদি তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে ইলাহরূপে গ্রহণ করো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে কয়েদীদের অন্তর্ভুক্ত করব।”[৭]
তারপর মূসা ('আঃ) বললেন-
﴿وَقَالَ مُوْسٰى رَبَّنَا إِنَّكَ آتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلَأَهُ زِيْنَةً وَأَمْوَالًا فِيْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّوْا عَنْ سَبِيْلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلٰى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوْا حَتّٰى يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيْمَ﴾
“আর মূসা বলল, ‘হে আমাদের রব! আপনি ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গকে দুনিয়াবী জীবনে সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদ দান করেছেন। হে আমাদের রব! যাতে তারা আপনার পথ থেকে গোমরাহ করতে পারে। হে আমাদের রব, তাদের ধন-সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দিন, তাদের অন্তরসমূহকে কঠোর করে দিন। ফলে তারা ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব দেখে।”[৮]
মহান আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধচারণ করার কারণে এই ফিরআউনকে আল্লাহ তা‘আলা চরম শিক্ষা দিলেন। মিসরের লোহিত সাগরের মাঝে তাকে ও তার পারিষদবর্গকে সলিল সমাধি করলেন। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿وَجَاوَزْنَا بِبَنِيْ إِسْرَائِيْلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُوْدُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتّٰى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِيْ آمَنَتْ بِهِ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ﴾
“আর আমি বানী ইসরা-ঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে তাদের পিছু নিলো। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি যে, সে সত্তা ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, যার প্রতি বানী ইসরা-ঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত’।”[৯]
এখানেই শেষ নয়, পৃথিবীবাসীর জন্য নিদর্শন ও শিক্ষণীয় হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা ফিরআউনের লাশকে সংরক্ষণ করে রেখে দিলেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِيْنَ فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُوْنَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيْرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُوْنَ﴾
“এখন অথচ ইতোপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছ, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল।”[১০]
যুগে যুগে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র করেছে, ইসলামী দা‘ওয়াত ও তাবলীগে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের উপর যুল্ম-নির্যাতন করেছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। কালের সাক্ষী হিসেবে আজো তা পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
﴿وَمَكَرُوْا مَكْرًا وَمَكَرْنَا مَكْرًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُوْنَ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِيْنَ فَتِلْكَ بُيُوتُهُمْ خَاوِيَةً بِمَا ظَلَمُوْا إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَعْلَمُوْنَ وَأَنْجَيْنَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
“আর তারা এক চক্রান্ত করল এবং আমিও কৌশল অবলম্বন করলাম। অথচ তারা উপলদ্ধিও করতে পারল না। অতএব দেখো, তাদের চক্রান্তের পরিণাম কিরূপ হয়েছে। আমি তাদের ও তাদের ক্বওমকে একত্রে ধ্বংস করে দিয়েছি। সুতরাং ঐগুলো তাদের বাড়ীঘর, যা তাদের যুল্মের কারণে বিরান হয়ে আছে। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে সে ক্বওমের জন্য যারা জ্ঞান রাখে। আর আমি মু’মিনদের মুক্তি দিলাম এবং তারা ছিল তাক্বওয়া অবলম্বনকারী।”[১১]
অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন :
عِظَمُ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلَاءِ، وَإِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ، فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السُّخْطُ.
বিপদ-আপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হবে তার প্রতিদানও তত মূল্যবান হবে। আর আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তখন অধিক যাচাই-বাচাই ও সংশোধনের জন্য তাদেরকে বিপদ-আপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। অতঃপর যারা মহান আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি মনে মেনে নেয় এবং ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর সন্তুষ্ট হন। আর যারা এ বিপদ ও পরীক্ষায় মহান আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয় মহান আল্লাহও তাদের উপর অসন্তুষ্ট হন।[১২]
এই বিপদ-আপদ, যুল্ম-নির্যাতনের মাঝেও যারা ধৈর্য অবলম্বন করবে, দ্বীনে হক্বের উপর টিকে থাকবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম প্রতিদান দিবেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَتُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِيْ جَنَّاتِ عَدْنٍ ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ وَأُخْرَى تُحِبُّوْنَهَا نَصْرٌ مِنَ اللهِ وَفَتْحٌ قَرِيْبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ﴾
“তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত এবং চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহে উত্তম আবাসগুলোতেও (প্রবেশ করাবেন)। এটাই মহাসাফল্য এবং আরো একটি (অর্জন) যা তোমরা খুব পছন্দ করো। (অর্থাৎ-) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। আর মু’মিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।”[১৩]
উক্ত হাদীসের শেষাংশে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাব্বাব (রাযিঃ)-কে সেই সুসংবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, খাব্বাব যুল্ম-নির্যাতনে ধৈর্য অবলম্বন করে দৃঢ়তার সাথে ইসলামের পথে টিকে থাকো তাহলে খুব তাড়াতাড়ি তোমরা মহান আল্লাহর সাহায্যে বিজয় অর্জন করবে। অতঃপর মহানাবী (সাঃ) বলেন :
وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الْأَمْرَ حَتّٰى يَسِيْرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ لَا يَخَافُ إِلَّا اللهَ أَوْ الذِّئْبَ عَلٰى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ.
“আমি মহান আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, এমন এক সময় আসবে যখন সানা থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত মানুষ চলবে, এ মানুষগুলোর মনের মধ্যে মহান আল্লাহর ভয় ছাড়া আর কোনো ভয় থাকবে না। আর মেষ পালের জন্য বাঘের ভয় ছাড়া কোন ভয় থাকবে না; বরং তোমরা বড্ড তাড়াহুড়ো করছ।”
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ-
১. দ্বীনে হক্বের পথে থাকলে বিপদ-আপদ আসতেই পারে যেমনটি নাবী-রাসূলগণের বেলায় হয়েছে।
২. এমতাবস্থায় মহান আল্লাহর পথে দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকতে হবে।
৩. সর্বদা মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে।
৪. যুল্ম ও নির্যাতনে সর্বদা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।
৫. বিদপাপদে সব সময় ধৈর্য ধারণ করে সফলতার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নিকট নিবেদিত হয়ে দু‘আ করতে হবে। যেমনটি মহানাবী (সাঃ)-সহ নাবীগণ করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা যেনো আমাদের প্রতি রহম করেন -আমীন।

[১] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৩৬১২, আধুনিক প্রকাশনী, হাঃ ৩৩৪৪, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাঃ ৩৩৫১।
[২] সূরা আল ফুরক্বা-ন : ৩১।
[৩] সূরা আল বাক্বারাহ্ : ২১৪।
[৪] সূরা আল ‘আনকাবূত : ২-৩।
[৫] সূরা আস্ স-ফ্ : ৮।
[৬] সূরা আল ‘আম্বিয়া- : ৬৮-৬৯।
[৭] সূরা আশ্ শু‘আরা : ২৯।
[৮] সূরা ইউনূস : ৮৮।
[৯] সূরা ইউনূস : ৯০।
[১০] সূরা ইউনুস : ৯১-৯২।
[১১] সূরা আন্ নাম্ল : ৫০-৫৩।
[১২] সুনান আত্ তিরমিযী, ইবনু মাজাহ্)
[১৩] সূরা আস্ স-ফ্ : ১১-১৩।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত