সমাজচিন্তা
ইসলামে পতিতার জানাযা
অধ্যাপক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া রেলস্টেশন মাসজিদের ইমাম হলেন মাওলানা গোলাম মোস্তফা। তিনি দীর্ঘদিনের সমাজে প্রচলিত প্রথা ভেঙ্গে দৌলতদিয়া ফেরীঘাঁট এলাকায় অবস্থিত পতিতাপল্লীর একজন যৌনকর্মীর নামাযে জানাযা পড়িয়েছেন গত ২রা ফেব্রুয়ারী। এর আগে যৌনপল্লির মৃতদের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত অথবা রাতের আধারে কবর দিয়ে দেওয়া হত।
জানাযায় ইমামতি করার কারণে ইমামকে ঐ এলাকায় চরম সমালোচনার সম্মুখিন হতে হয়েছে। এমনকি তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো কোনো যৌনকর্মীর নামাযে জানাযা পড়াবেন না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘এইখানে তো সমালোচনা হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার সমালোচনা করছে। এতোদিন জানাযা হয়নি, আমি কেন্ হঠাৎ করে জানাযা পড়ালাম?’ আসলে ইসলামী শরী‘আয় একজন যৌনকর্মী বা পতিতার জানাযা দেওয়া যাবে কি-না এ প্রসঙ্গটি আজ তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে।
সালাতে জানাযা হচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে এ সলাত আদায়ের পর অনেক মানুষ আবারও মুনাজাত বা দু‘আ করতে ইমাম বা ‘আলেম-উলামাদের চাপ দিয়ে থাকেন। (সালাতের চারটি অর্থ রয়েছে- দু‘আ, তাসবীহ, রাহমত ও ইস্তেগফার) অনেক ‘আলেম জানাযা শেষে আবার দু‘আও করেন; অবিদ্যার কারণে, মানুষের অনুরোধে অথবা এই ভেবে যে দু‘আ করাতো; খারাপতো কিছু না। কিন্তু ইসলামে ‘ইবাদত হতে হয় আল কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী। সুন্নাহর বিপরীতে হলেই এটা ‘বিদ‘আত’ হয়ে যায়। যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ‘আমি যা করিনি; (ধর্মের ভেতরে) তা পরিত্যাজ্য।’
ইসলামী শরী‘আতের নীতি অনুযায়ী, মানুষ যতই পাপিষ্ট হোক তার জন্য দু‘আ চাইতে হবে। বিশেষ করে মরে গেলেতো অবশ্যই দু‘আ করতে হবে। হাদীসে এসেছে- ‘দু‘আ হলো ‘ইবাদতের মগজ।’ তাই একজন মৃত মানুষ মুসলিম হলে অবশ্যই তার জন্য জানাযার সলাত পড়তে হবে; পড়া উচিৎ। পতিতালয়ে যারা দেহ ব্যবসা করে থাকেন, তারা কাজটি চরম অন্যায় করছেন, হারাম এবং ঘৃণিত বা নিষিদ্ধ কাজ করছেন; এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবূ মাস‘ঊদ আনসারী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ‘কুকুরের মূল্য, পতিতার উপার্জন ও গণকের পারিতোষিক নিষিদ্ধ।’[১] অন্য হাদীসে এসেছে- নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লা‘নাত বা অভিসম্পাত করেছেন উল্কি অঙ্কণকারিণী, উল্কি গ্রহণকারিণী, সূদ গ্রহীতা ও সুদ দাতাকে। তিনি কুকুরের মূল্য ও পতিতার উপার্জন ভোগ করতে নিষেধ করেছেন।[২]
অতএব পতিতাবৃত্তি খুবই ঘৃণিত কাজ; এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাদের অধিকাংশের এ পথে আসার পেছনে একটি কারণ ও বাস্তবতা থাকে। যেই বাস্তবতা তাকে কখনো সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, কখনো তারা চক্ষু লজ্জায় পরিচিতদের থেকে দূরে সরে যায়। অধিকাংশ পতিতা সর্বহারা হয়ে পরিশেষে কোনো একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় খুঁজে নেয়। জন্মসূত্রে কেউ পতিতা হয়ে জন্মায় না। এই স্বপ্ন নিয়েও কোনো বালিকা বেড়ে ওঠে না; যে সে ভবিষ্যতে পতিতা বৃত্তিতে জড়াবে। সমাজ ও বাস্তবতার নির্মমতা তাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে নিক্ষেপ করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- তারা কি একা এ অপরাধটি করছে? না, পুরুষরাও এ অপরাধের সমান অংশীদার? যারা সেখানে গমন করে থাকে।
গমনকারী পুরুষদের এ কাজটিও অত্যন্ত ঘৃণিত; তারাও হারাম করছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আামাদের বুঝতে হবে, হারাম কাজে লিপ্ত হলেই মানুষ কিন্তু ‘কাফির’ হয়ে যায় না। যদিও আজকাল কিছু ‘আলেম-উলামা কথায় কথায় ভিন্ন মতাবলম্বী বা প্রতিপক্ষকে ‘কাফির’ ফাতাওয়া দেওয়াকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্যায়ভাবে কাউকে ‘কাফির’ বললে সে প্রকৃতপক্ষে কাফিরের পর্যায় না হয়ে থাকলে নিজের দিকে ফিরে আসে। অর্থাৎ- নিজেই কাফির হয়ে যায়। যারা পতিতালয়ে দেহ ব্যবসা করে উপার্জন করে থাকে বা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে; তাদের বড় একটা অংশ কিন্তু বাধ্য হয়েই ওখানে যান।
বিভিন্ন প্রতারণা বা কারো চক্রান্তের শিকার হয়ে এ নিষিদ্ধ জগতে নিজেদের জড়িয়ে নেন আজীবনের জন্য। অতএব পতিতারা তাদের এ ঘৃণ্য কাজের দরুণ ‘কাফির’ হয়ে যায় না। কাজ যেটা করছে নিঃসন্দেহে অন্যায় করছে। এমনকি যারা স্বেচ্ছায়ও যায়, তারাও কাবিরা বা বড় গুনাহের কাজ করছে। দয়াময় মহান আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান যদি থেকে থাকে, মুসলিম যদি হয়ে থাকে তারা; অপরাধ করছেন তারপরও ইসলাম থেকে তারা কিন্তু খারিজ হয়ে যাননি।
তাছাড়া পতিতারা নিজেদেরকে অপরাধী মনে করে থাকে। তারা অনেকেই তাদের এ নীচু ও হীন-কদর্য কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেদের অপরাধী ভাবে; অনুতপ্ত ও ভেতরে ভেতরে লজ্জিত হয়ে দিনাতিপাত করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেকেই আযানের শব্দ শুনলে মাথায় কাপড় দেয়, ‘আলেম-উলামা দেখলে রাস্তার একপাশে সরে যায় (যদিও এর কোনো শরয়ী ভিত্তি নেই)। তাই শরী‘আতের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী তাদের মৃতে্যুর পর তাদের নামাযে জানাযা পড়তে হবে; পড়াতেও হবে। শুধু তাই নয়, নামাযে জানাযা পড়ানো ও নামাযে অংশগ্রহণ করা ‘র্ফযে কিফায়া’ হিসেবে শরী‘আতে ঘোষিত হয়েছে। তবে, এ ধরনের ব্যভিচারের মতো পাপ কাজে যারা লিপ্ত বা যারা আত্মহত্যা করে মারা যায়, তাদের জানাযার ব্যাপারে ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত্য অভিমত হলো, জানাযায় মান্যবর কোনো ‘আলেম উপস্থিত থাকতে পারবে না। সাধারণ শ্রেণির লোকজনই এ ধরনের ব্যক্তির জানাযা ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করবে। উলামায়ে কিরাম এই অভিমতটা এজন্য দিয়েছেন যে, এখান থেকে এ ধরনের পাপের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য লোকেরা যেনো শিক্ষা গ্রহণ করে এবং পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে।
যারা পতিতাদের নামাযে জানাযা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা ঐ সমস্ত লোকদের ব্যপারে কি বলেন- যারা ব্যভিচারকে ব্যক্তি স্বাধীনতা মনে করেন, বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে অপরাধ মনে করেন না। তাদের জানাযা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। কারণ অপরাধবোধ নিয়ে অপরাধ করলে বেঈমান হয়ে যায় না; কিন্তু অপরাধকে অপরাধ মনে না করলে বেইমান হয়ে যায়।
দৌলতদিয়ার মতো এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। গ্রামে যারা নামায পড়েন না, তাদের নামাযে জানাযায় ইমামতি কে করবে এই নিয়েও চলে অনেক বাদানুবাদ। মৃত ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার কাছে স্থানীয় ইমাম হয়তোবা কখনো দ্বীনের দা‘ওয়াত নিয়ে যাননি; কিংবা লোকটিও নিজের উদ্যোগে সলাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিয়মিত সলাত আদায় করেননি কিন্তু নিয়মিত নামায পড়েনি এই অপরাধে তার নামাযে জানাযা পড়ানো নিয়ে ছোঁ বেলায় ইমামদের গড়িমসি করতে আমরা দেখেছি। পাশাপাশি ঐ সমাজেরই সুদখোর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, আতঙ্কবাদী লোকটির ব্যাপারে সকলে থেকেছে নির্বাক। যারা যাকাত ও হাজ্জ র্ফয হওয়ার পরও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো অথবা উত্তরাধিকার সম্পত্তি কেবলমাত্র ছেলেদের নামে লেখে দিয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে বা বোনদের ঠিকমতো উত্তরাধিকার সম্পত্তি দেয়নি কিংবা লোকটি ছিলো ব্যক্তি জীবনে চরম দুর্নীতিবাজ।
সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায় এ সকল লোকদের মৃত্যুর পর এ দৃশ্য অনেকটা দেখা যায় না। এসব ইমামরা অনেকেই আবার মাহফিল করে থাকে। সেখানে সামান্য টাকার লোভে প্রধান অতিথি বানায় কতিপয় এসব ধর্মমোড়ল বিত্তশালী মদখোর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজদেরকে। কারণ তারা পয়সাওয়ালা। তাদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান এক রকম, আর গরীব-অসহায়দের জন্য কি ধর্মীয় বিধান ভিন্ন রকম? অসহায় গরীব লোকদের জন্য যতসব অনিয়মের বাস্তবায়ন চলছে! অথচ সমাজের অনেক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে রয়েছে ঐ প্রভাবশালী মহল। অনেক সময় মহান আল্লাহকে অস্বীকারকারী বড় ধনাঢ্য ব্যক্তিটির নামাযে জানাযা পড়িয়ে ‘আলেমরা গর্ব করে বলেন অমুকের জানাযা আমি পড়িয়েছি। তাৎক্ষনিক সুবিধা পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এবং পরবর্তীতে ভিন্ন আঙ্গিকে অন্য সুবিধা নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে পরিকল্পনার জাল বুনেন। কিভাবে মাদ্রাসার জন্য চাঁদা নেওয়া যায় তারও একটি ছক আঁকেন।
আসলে অজ্ঞতা সর্বক্ষেত্রেই আপদ বয়ে আনে কিন্তু ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবিদ্যা ও অজ্ঞতা বা সঠিক জ্ঞানের অভাব সবচেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর হয়। যা শুধু নি¤œ সুবিধাবাদী ধর্মব্যবসায়ীদেরই সুযোগ তৈরী করে না; বরং সঠিক ইসলামী চিন্তা-চেতনার দ্বারকেও রুদ্ধ করে তোলে। মুক্ত চেতনায় কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী চলার পথে শক্তিশালী দেয়াল নির্মাণ করে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে অনেক সময় সঠিক ‘আক্বীদাহ্ বিশ্বাসকে বেঠিক; পক্ষান্তরে বেঠিক ও ভ্রান্ত পথটাকে সঠিক মনে হয় জনসাধারণের কাছে।
এভাবে অবিদ্যা ও অজ্ঞতা ধর্মকে সঠিক অবস্থান থেকে জানা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে এবং মানুষের কাছে এর বিধানাবলী প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। সকল মুসলমানের জন্য জানাযা আদায় করা র্ফযে কিফায়া। কিছু মানুষ আদায় করে দিলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। আর যদি কেউ আদায় না করে তবে সকলকেই মহান আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে; জবাবদিহিতার জন্য। এটা ইসলামের একটা বিধান।
নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, হাজ্জ ও অন্যান্য বিধান প্রত্যেকটি পৃথক এক একটি বিধান। তেমনিভাবে অবৈধ যৌনাচার শরী‘আতে নিষিদ্ধ। এর থেকে বেঁচে থেকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে দৈহিক মিলন ও স্ত্রী সম্ভোগ ইসলামী শরী‘আতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কুরআন এর প্রত্যেকটি নির্দেশনাই সকল মুসলমানের জন্য ফরয। হাদীসের বিশুদ্ধগ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, প্রত্যেক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক্ব রয়েছে।
সালামের উত্তর দেয়া, কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া, মুসলমানের জানাযা আদায় করা, কেউ নিমন্ত্রণ করলে সাড়া দেয়া এবং কেউ হাঁচি দিলে তার উত্তর দেয়া। অন্য হাদীসে স্পষ্ট আছে- ‘যে ব্যক্তি কালিমাহ বলবে এবং এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এ কথা শুনে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, যদি সে ব্যভিচার করে, তবুও কি সে জান্নাতে যাবে? বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবাদের বললেন, হ্যাঁ যদি সে যিনা বা ব্যভিচারও করে, তবুও সে জান্নাতে প্রবেশ করবে (যদি এ বিশ্বাসের ওপর মৃত্যুবরণ করে)।
তাছাড়া মানুষের কৃতকর্মের ফলাফল নির্ধারণ করার ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে; কোনো মানুষের কাছে নয়। বিচারকের চেয়ারটি আল্লাহ তা‘আলার জন্যই বরাদ্ধ। তাই অপরাধীকে তার পাপের শাস্তি তাকে পেতে হবে। আর সেই শাস্তি দিবেন আল্লাহ তা‘আলা।
আমরা বিচারক নই। জঙ্গি বিভ্রান্ত যুবকদের মতো রাষ্ট্রীয় আইনকে ব্যক্তি নিজের হাতে তুলে ইসলামী চেতনা দেখালে তো আর হবে না। তাই পতিতাদেরকে দূরে ঠেলে না দিয়ে দ্বীনের পথে ডাকি, তাদের পাপীষ্ট হওয়ায় যেহেতু সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ অসন্তুষ্ট ও ইমামতি করার কারণে ইমামের প্রতিও রুষ্ট; তার অর্থ দাঁড়ায় আমরা চাই ঐ নিষিদ্ধপল্লীর মানুষজন স্বর্গে থাকুক পরকালে, নিষিদ্ধ কাজ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাই না? কেনইবা তারা এ অবৈধ ও চরম ঘৃণিত পেশাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম বানিয়েছে? তাই পুরুষরা যেনো সেখানে আর না যায়। এ সাধু লোকজন ওখানে গমন না করলে যৌনপল্লিও থাকবে না। নামাযে জানাযা নিয়ে দ্বিধাও তৈরী হবে না। ঠিক কি-না বলেন?
যারা নিয়মিত অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন বয়সী ঐ নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হতে ওখানে গমন করে, তাদের নামাযে জানাযা কি পড়ানো হয় না? আমার প্রশ্ন। তাহলে উপস্থিত থাকেন বা কারা পড়ান তাদের জানাযার নামাজ? নাকি মানুষ তাদের এমন ঘৃণিত ও জঘন্য কর্মকাণ্ড জানে না বলে তারা সাধু! তাদের মৃত্যুর পর নিষ্পাপ শিশুদের মতো তাদের পরিণত করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ইমামসহ সকলে দু‘আ করেন।
এটা কি এ জন্য যে, পুরুষদের নিষিদ্ধপল্লীতে গমনের খবর কেউ জানে না বলে? আবার যে নারীরা ঐ ঘৃনিত পেশা গ্রহণ করেছেন, এর পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতারণা, দারিদ্র্যতা, যৌতুক, ট্রেফেকিং ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের নেশা কাজ করে। অবলা নারী বাধ্য হয়ে এ পেশা নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়। এ ঘৃন্য কদর্য অবস্থার মোড়ক থেকে বের হতে শত প্রচেষ্টার পরও সে আর বের হতে পারে না। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ এবং সমাজের রীতিনীতি এর জন্য দায়ী। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে আজ, ব্যাংক হয়ে পড়েছে লুটেরাদের কারণে দেওলিয়া, শেয়ার মার্কেটের টাকা কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে অভিজাত শ্রেণীর করায়ত্বে। ধর্মীয় ‘আলেম-উলামাগণ নিজেরা নিজেদের মাঝে অনৈক্যের দেয়াল তৈরী করছে প্রতিনিয়ত। শরী‘আতের র্ফয-ওয়াজিব কোনো বিষয় কোনো অনৈক্য নেই; নেই কোনো মতভেদ।
কেবলমাত্র সুন্নাত, মুবাহ, মুস্তাহাব, মানদুব ও ইস্তেহসান নিয়ে হাজারও ভাগে বিভক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের উলামাগণ। এ অসহায় অবলা নারীদের জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বা ধর্মীয় ব্যক্তিদের কোনো দায় কি নেই?! বিত্তবানরা তাদের রিহেভিলিয়েট করতে পারেন। উলামারা তাদের কাউন্সিলিং করতে পারেন; সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আনতে ভূমিকা পালন করতে পারেন। এরা আমাদের সমাজেরই অংশ। কেবল ঘৃনা করে আমি মনে করি তাদের উপর আমরা অবিচার করে থাকি। তাদের এ পরিস্থিতির জন্য পুরুষরা বিশেষ করে সমাজ কোনো অংশেই কম দায়ী নয়। আসুন! তদের জন্য সাধ্য মতো কিছু করি। দূর্নীতি করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছে তারা অন্ততঃ এ যৌনপল্লিতে এ অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য বাস্তবমুখি কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে। তাহলে অন্ততঃ পরকালে সৃষ্টিকর্তার সামনে জবাবদিহী করা সহজ হবে। ধন্যবাদ সেই পুলিশ প্রশাসনকে যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এ নামাযে জানাযার মতো মহৎ কাজটি করেছেন। জগতে সকল মানুষ নিরাপদে ও সুস্থভাবে জীবন-যাপন করুক -আমীন।
জানাযায় ইমামতি করার কারণে ইমামকে ঐ এলাকায় চরম সমালোচনার সম্মুখিন হতে হয়েছে। এমনকি তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো কোনো যৌনকর্মীর নামাযে জানাযা পড়াবেন না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘এইখানে তো সমালোচনা হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার সমালোচনা করছে। এতোদিন জানাযা হয়নি, আমি কেন্ হঠাৎ করে জানাযা পড়ালাম?’ আসলে ইসলামী শরী‘আয় একজন যৌনকর্মী বা পতিতার জানাযা দেওয়া যাবে কি-না এ প্রসঙ্গটি আজ তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে।
সালাতে জানাযা হচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে এ সলাত আদায়ের পর অনেক মানুষ আবারও মুনাজাত বা দু‘আ করতে ইমাম বা ‘আলেম-উলামাদের চাপ দিয়ে থাকেন। (সালাতের চারটি অর্থ রয়েছে- দু‘আ, তাসবীহ, রাহমত ও ইস্তেগফার) অনেক ‘আলেম জানাযা শেষে আবার দু‘আও করেন; অবিদ্যার কারণে, মানুষের অনুরোধে অথবা এই ভেবে যে দু‘আ করাতো; খারাপতো কিছু না। কিন্তু ইসলামে ‘ইবাদত হতে হয় আল কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী। সুন্নাহর বিপরীতে হলেই এটা ‘বিদ‘আত’ হয়ে যায়। যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ‘আমি যা করিনি; (ধর্মের ভেতরে) তা পরিত্যাজ্য।’
ইসলামী শরী‘আতের নীতি অনুযায়ী, মানুষ যতই পাপিষ্ট হোক তার জন্য দু‘আ চাইতে হবে। বিশেষ করে মরে গেলেতো অবশ্যই দু‘আ করতে হবে। হাদীসে এসেছে- ‘দু‘আ হলো ‘ইবাদতের মগজ।’ তাই একজন মৃত মানুষ মুসলিম হলে অবশ্যই তার জন্য জানাযার সলাত পড়তে হবে; পড়া উচিৎ। পতিতালয়ে যারা দেহ ব্যবসা করে থাকেন, তারা কাজটি চরম অন্যায় করছেন, হারাম এবং ঘৃণিত বা নিষিদ্ধ কাজ করছেন; এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবূ মাস‘ঊদ আনসারী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- ‘কুকুরের মূল্য, পতিতার উপার্জন ও গণকের পারিতোষিক নিষিদ্ধ।’[১] অন্য হাদীসে এসেছে- নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লা‘নাত বা অভিসম্পাত করেছেন উল্কি অঙ্কণকারিণী, উল্কি গ্রহণকারিণী, সূদ গ্রহীতা ও সুদ দাতাকে। তিনি কুকুরের মূল্য ও পতিতার উপার্জন ভোগ করতে নিষেধ করেছেন।[২]
অতএব পতিতাবৃত্তি খুবই ঘৃণিত কাজ; এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাদের অধিকাংশের এ পথে আসার পেছনে একটি কারণ ও বাস্তবতা থাকে। যেই বাস্তবতা তাকে কখনো সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, কখনো তারা চক্ষু লজ্জায় পরিচিতদের থেকে দূরে সরে যায়। অধিকাংশ পতিতা সর্বহারা হয়ে পরিশেষে কোনো একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় খুঁজে নেয়। জন্মসূত্রে কেউ পতিতা হয়ে জন্মায় না। এই স্বপ্ন নিয়েও কোনো বালিকা বেড়ে ওঠে না; যে সে ভবিষ্যতে পতিতা বৃত্তিতে জড়াবে। সমাজ ও বাস্তবতার নির্মমতা তাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে নিক্ষেপ করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- তারা কি একা এ অপরাধটি করছে? না, পুরুষরাও এ অপরাধের সমান অংশীদার? যারা সেখানে গমন করে থাকে।
গমনকারী পুরুষদের এ কাজটিও অত্যন্ত ঘৃণিত; তারাও হারাম করছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আামাদের বুঝতে হবে, হারাম কাজে লিপ্ত হলেই মানুষ কিন্তু ‘কাফির’ হয়ে যায় না। যদিও আজকাল কিছু ‘আলেম-উলামা কথায় কথায় ভিন্ন মতাবলম্বী বা প্রতিপক্ষকে ‘কাফির’ ফাতাওয়া দেওয়াকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্যায়ভাবে কাউকে ‘কাফির’ বললে সে প্রকৃতপক্ষে কাফিরের পর্যায় না হয়ে থাকলে নিজের দিকে ফিরে আসে। অর্থাৎ- নিজেই কাফির হয়ে যায়। যারা পতিতালয়ে দেহ ব্যবসা করে উপার্জন করে থাকে বা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে; তাদের বড় একটা অংশ কিন্তু বাধ্য হয়েই ওখানে যান।
বিভিন্ন প্রতারণা বা কারো চক্রান্তের শিকার হয়ে এ নিষিদ্ধ জগতে নিজেদের জড়িয়ে নেন আজীবনের জন্য। অতএব পতিতারা তাদের এ ঘৃণ্য কাজের দরুণ ‘কাফির’ হয়ে যায় না। কাজ যেটা করছে নিঃসন্দেহে অন্যায় করছে। এমনকি যারা স্বেচ্ছায়ও যায়, তারাও কাবিরা বা বড় গুনাহের কাজ করছে। দয়াময় মহান আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান যদি থেকে থাকে, মুসলিম যদি হয়ে থাকে তারা; অপরাধ করছেন তারপরও ইসলাম থেকে তারা কিন্তু খারিজ হয়ে যাননি।
তাছাড়া পতিতারা নিজেদেরকে অপরাধী মনে করে থাকে। তারা অনেকেই তাদের এ নীচু ও হীন-কদর্য কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেদের অপরাধী ভাবে; অনুতপ্ত ও ভেতরে ভেতরে লজ্জিত হয়ে দিনাতিপাত করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেকেই আযানের শব্দ শুনলে মাথায় কাপড় দেয়, ‘আলেম-উলামা দেখলে রাস্তার একপাশে সরে যায় (যদিও এর কোনো শরয়ী ভিত্তি নেই)। তাই শরী‘আতের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী তাদের মৃতে্যুর পর তাদের নামাযে জানাযা পড়তে হবে; পড়াতেও হবে। শুধু তাই নয়, নামাযে জানাযা পড়ানো ও নামাযে অংশগ্রহণ করা ‘র্ফযে কিফায়া’ হিসেবে শরী‘আতে ঘোষিত হয়েছে। তবে, এ ধরনের ব্যভিচারের মতো পাপ কাজে যারা লিপ্ত বা যারা আত্মহত্যা করে মারা যায়, তাদের জানাযার ব্যাপারে ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত্য অভিমত হলো, জানাযায় মান্যবর কোনো ‘আলেম উপস্থিত থাকতে পারবে না। সাধারণ শ্রেণির লোকজনই এ ধরনের ব্যক্তির জানাযা ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করবে। উলামায়ে কিরাম এই অভিমতটা এজন্য দিয়েছেন যে, এখান থেকে এ ধরনের পাপের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য লোকেরা যেনো শিক্ষা গ্রহণ করে এবং পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে।
যারা পতিতাদের নামাযে জানাযা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা ঐ সমস্ত লোকদের ব্যপারে কি বলেন- যারা ব্যভিচারকে ব্যক্তি স্বাধীনতা মনে করেন, বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে অপরাধ মনে করেন না। তাদের জানাযা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। কারণ অপরাধবোধ নিয়ে অপরাধ করলে বেঈমান হয়ে যায় না; কিন্তু অপরাধকে অপরাধ মনে না করলে বেইমান হয়ে যায়।
দৌলতদিয়ার মতো এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। গ্রামে যারা নামায পড়েন না, তাদের নামাযে জানাযায় ইমামতি কে করবে এই নিয়েও চলে অনেক বাদানুবাদ। মৃত ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার কাছে স্থানীয় ইমাম হয়তোবা কখনো দ্বীনের দা‘ওয়াত নিয়ে যাননি; কিংবা লোকটিও নিজের উদ্যোগে সলাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিয়মিত সলাত আদায় করেননি কিন্তু নিয়মিত নামায পড়েনি এই অপরাধে তার নামাযে জানাযা পড়ানো নিয়ে ছোঁ বেলায় ইমামদের গড়িমসি করতে আমরা দেখেছি। পাশাপাশি ঐ সমাজেরই সুদখোর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, আতঙ্কবাদী লোকটির ব্যাপারে সকলে থেকেছে নির্বাক। যারা যাকাত ও হাজ্জ র্ফয হওয়ার পরও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো অথবা উত্তরাধিকার সম্পত্তি কেবলমাত্র ছেলেদের নামে লেখে দিয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে বা বোনদের ঠিকমতো উত্তরাধিকার সম্পত্তি দেয়নি কিংবা লোকটি ছিলো ব্যক্তি জীবনে চরম দুর্নীতিবাজ।
সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায় এ সকল লোকদের মৃত্যুর পর এ দৃশ্য অনেকটা দেখা যায় না। এসব ইমামরা অনেকেই আবার মাহফিল করে থাকে। সেখানে সামান্য টাকার লোভে প্রধান অতিথি বানায় কতিপয় এসব ধর্মমোড়ল বিত্তশালী মদখোর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজদেরকে। কারণ তারা পয়সাওয়ালা। তাদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান এক রকম, আর গরীব-অসহায়দের জন্য কি ধর্মীয় বিধান ভিন্ন রকম? অসহায় গরীব লোকদের জন্য যতসব অনিয়মের বাস্তবায়ন চলছে! অথচ সমাজের অনেক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে রয়েছে ঐ প্রভাবশালী মহল। অনেক সময় মহান আল্লাহকে অস্বীকারকারী বড় ধনাঢ্য ব্যক্তিটির নামাযে জানাযা পড়িয়ে ‘আলেমরা গর্ব করে বলেন অমুকের জানাযা আমি পড়িয়েছি। তাৎক্ষনিক সুবিধা পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এবং পরবর্তীতে ভিন্ন আঙ্গিকে অন্য সুবিধা নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে পরিকল্পনার জাল বুনেন। কিভাবে মাদ্রাসার জন্য চাঁদা নেওয়া যায় তারও একটি ছক আঁকেন।
আসলে অজ্ঞতা সর্বক্ষেত্রেই আপদ বয়ে আনে কিন্তু ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবিদ্যা ও অজ্ঞতা বা সঠিক জ্ঞানের অভাব সবচেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর হয়। যা শুধু নি¤œ সুবিধাবাদী ধর্মব্যবসায়ীদেরই সুযোগ তৈরী করে না; বরং সঠিক ইসলামী চিন্তা-চেতনার দ্বারকেও রুদ্ধ করে তোলে। মুক্ত চেতনায় কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী চলার পথে শক্তিশালী দেয়াল নির্মাণ করে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে অনেক সময় সঠিক ‘আক্বীদাহ্ বিশ্বাসকে বেঠিক; পক্ষান্তরে বেঠিক ও ভ্রান্ত পথটাকে সঠিক মনে হয় জনসাধারণের কাছে।
এভাবে অবিদ্যা ও অজ্ঞতা ধর্মকে সঠিক অবস্থান থেকে জানা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে এবং মানুষের কাছে এর বিধানাবলী প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। সকল মুসলমানের জন্য জানাযা আদায় করা র্ফযে কিফায়া। কিছু মানুষ আদায় করে দিলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। আর যদি কেউ আদায় না করে তবে সকলকেই মহান আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে; জবাবদিহিতার জন্য। এটা ইসলামের একটা বিধান।
নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, হাজ্জ ও অন্যান্য বিধান প্রত্যেকটি পৃথক এক একটি বিধান। তেমনিভাবে অবৈধ যৌনাচার শরী‘আতে নিষিদ্ধ। এর থেকে বেঁচে থেকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে দৈহিক মিলন ও স্ত্রী সম্ভোগ ইসলামী শরী‘আতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কুরআন এর প্রত্যেকটি নির্দেশনাই সকল মুসলমানের জন্য ফরয। হাদীসের বিশুদ্ধগ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, প্রত্যেক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক্ব রয়েছে।
সালামের উত্তর দেয়া, কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া, মুসলমানের জানাযা আদায় করা, কেউ নিমন্ত্রণ করলে সাড়া দেয়া এবং কেউ হাঁচি দিলে তার উত্তর দেয়া। অন্য হাদীসে স্পষ্ট আছে- ‘যে ব্যক্তি কালিমাহ বলবে এবং এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এ কথা শুনে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, যদি সে ব্যভিচার করে, তবুও কি সে জান্নাতে যাবে? বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবাদের বললেন, হ্যাঁ যদি সে যিনা বা ব্যভিচারও করে, তবুও সে জান্নাতে প্রবেশ করবে (যদি এ বিশ্বাসের ওপর মৃত্যুবরণ করে)।
তাছাড়া মানুষের কৃতকর্মের ফলাফল নির্ধারণ করার ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে; কোনো মানুষের কাছে নয়। বিচারকের চেয়ারটি আল্লাহ তা‘আলার জন্যই বরাদ্ধ। তাই অপরাধীকে তার পাপের শাস্তি তাকে পেতে হবে। আর সেই শাস্তি দিবেন আল্লাহ তা‘আলা।
আমরা বিচারক নই। জঙ্গি বিভ্রান্ত যুবকদের মতো রাষ্ট্রীয় আইনকে ব্যক্তি নিজের হাতে তুলে ইসলামী চেতনা দেখালে তো আর হবে না। তাই পতিতাদেরকে দূরে ঠেলে না দিয়ে দ্বীনের পথে ডাকি, তাদের পাপীষ্ট হওয়ায় যেহেতু সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ অসন্তুষ্ট ও ইমামতি করার কারণে ইমামের প্রতিও রুষ্ট; তার অর্থ দাঁড়ায় আমরা চাই ঐ নিষিদ্ধপল্লীর মানুষজন স্বর্গে থাকুক পরকালে, নিষিদ্ধ কাজ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাই না? কেনইবা তারা এ অবৈধ ও চরম ঘৃণিত পেশাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম বানিয়েছে? তাই পুরুষরা যেনো সেখানে আর না যায়। এ সাধু লোকজন ওখানে গমন না করলে যৌনপল্লিও থাকবে না। নামাযে জানাযা নিয়ে দ্বিধাও তৈরী হবে না। ঠিক কি-না বলেন?
যারা নিয়মিত অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন বয়সী ঐ নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হতে ওখানে গমন করে, তাদের নামাযে জানাযা কি পড়ানো হয় না? আমার প্রশ্ন। তাহলে উপস্থিত থাকেন বা কারা পড়ান তাদের জানাযার নামাজ? নাকি মানুষ তাদের এমন ঘৃণিত ও জঘন্য কর্মকাণ্ড জানে না বলে তারা সাধু! তাদের মৃত্যুর পর নিষ্পাপ শিশুদের মতো তাদের পরিণত করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ইমামসহ সকলে দু‘আ করেন।
এটা কি এ জন্য যে, পুরুষদের নিষিদ্ধপল্লীতে গমনের খবর কেউ জানে না বলে? আবার যে নারীরা ঐ ঘৃনিত পেশা গ্রহণ করেছেন, এর পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতারণা, দারিদ্র্যতা, যৌতুক, ট্রেফেকিং ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের নেশা কাজ করে। অবলা নারী বাধ্য হয়ে এ পেশা নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়। এ ঘৃন্য কদর্য অবস্থার মোড়ক থেকে বের হতে শত প্রচেষ্টার পরও সে আর বের হতে পারে না। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ এবং সমাজের রীতিনীতি এর জন্য দায়ী। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে আজ, ব্যাংক হয়ে পড়েছে লুটেরাদের কারণে দেওলিয়া, শেয়ার মার্কেটের টাকা কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে অভিজাত শ্রেণীর করায়ত্বে। ধর্মীয় ‘আলেম-উলামাগণ নিজেরা নিজেদের মাঝে অনৈক্যের দেয়াল তৈরী করছে প্রতিনিয়ত। শরী‘আতের র্ফয-ওয়াজিব কোনো বিষয় কোনো অনৈক্য নেই; নেই কোনো মতভেদ।
কেবলমাত্র সুন্নাত, মুবাহ, মুস্তাহাব, মানদুব ও ইস্তেহসান নিয়ে হাজারও ভাগে বিভক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের উলামাগণ। এ অসহায় অবলা নারীদের জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বা ধর্মীয় ব্যক্তিদের কোনো দায় কি নেই?! বিত্তবানরা তাদের রিহেভিলিয়েট করতে পারেন। উলামারা তাদের কাউন্সিলিং করতে পারেন; সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আনতে ভূমিকা পালন করতে পারেন। এরা আমাদের সমাজেরই অংশ। কেবল ঘৃনা করে আমি মনে করি তাদের উপর আমরা অবিচার করে থাকি। তাদের এ পরিস্থিতির জন্য পুরুষরা বিশেষ করে সমাজ কোনো অংশেই কম দায়ী নয়। আসুন! তদের জন্য সাধ্য মতো কিছু করি। দূর্নীতি করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছে তারা অন্ততঃ এ যৌনপল্লিতে এ অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য বাস্তবমুখি কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে। তাহলে অন্ততঃ পরকালে সৃষ্টিকর্তার সামনে জবাবদিহী করা সহজ হবে। ধন্যবাদ সেই পুলিশ প্রশাসনকে যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এ নামাযে জানাযার মতো মহৎ কাজটি করেছেন। জগতে সকল মানুষ নিরাপদে ও সুস্থভাবে জীবন-যাপন করুক -আমীন।
[১] সহীহুল বুখারী- হাঃ ২২৮২।
[২] সহীহুল বুখারী- হাঃ ৫৩৪৭।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:31:55
সূর্যাস্ত : 5:13:27
আপনার মন্তব্য1