সাময়িক প্রসঙ্গ
খারেজীদের দল ত্যাগের ঘটনা
গিয়াসুদ্দীন বিন আব্দুল মালেক
উবায়দুল্লাহ ইবনু ইয়ায ইবনু ‘আম্র আল-ক্বারী বলেছেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনু শাদ্দাদ ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর নিহত হওয়ার কয়েক দিন পর ইরাক থেকে ফিরে ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা)-এর কাছে আসলেন। আমরা তখন ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা)-এর নিকটে বসেছিলাম। ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) তাকে বললেন, হে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু শাদ্দাদ! আমি যা তোমাকে জিজ্ঞেস করব তুমি কি তার জবাবে আমাকে সত্য বলবে? ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) কর্তৃক নিহত লোকদের ঘটনা আমাকে বর্ণনা করো। সে বলল, আমার কী হয়েছে যে, আপনার কাছে সত্য বলব না? ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বলেন, তাদের কাহিনী আমাকে বলো। তিনি বললেন, ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) যখন মু‘আবিয়ার সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন এবং দু’জন শালিসে তাদের সিদ্ধান্ত দিলেন, তখন আট হাজার কুরআনের পাঠক (হাফেয) তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল। তারা ‘হারূরা’ নামক স্থানে কূফার দিক থেকে এসে সমবেত হলো এবং তারা এই বলে (‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-কে ভৎর্সনা করল, যে জামাটি আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে পরিয়েছিলেন, (অর্থাৎ- খিলাফত) তা আপনি খুলে ফেলেছেন এবং যে নামে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে নামকরণ করেছিলেন তা আপনি খুইয়ে ফেলেছেন। তারপর আপনি এতদূর গিয়েছেন যে, মহান আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে অন্যদের শালিস মেনেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারো শাসন নয় (অর্থাৎ- আপনাকে শাসক মানি না)। ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) যখন তাদের এই ভর্ৎসনা ও তাদের পক্ষ থেকে তাকে ত্যাগ করার খবর শুনলেন, তখন জনৈক ঘোষণাকারীকে দিয়ে এই ঘোষণা জারী করালেন যে, আমীরুল মু’মিনীনের কাছে কুরআন বহনকারী ছাড়া আর কেউ যেনো না আসে।
(এ ঘোষণার ফলে) যখন ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর বাড়ি হাফিযদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেল, তখন একটি বড় আকারের কুরআন মাজীদ তাঁর কাছে নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। সেই কুরআন মাজীদটি তাঁর সামনে রাখা হলো। তিনি তার উপর হাত রেখে বললেন, ওহে কুরআন মাজীদ! মানুষকে জানাও। লোকেরা তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! তার কাছে আপনি কি জানতে চাইছেন? সে তো একটা কাগজের ওপর কিছু কালি ছাড়া কিছু নয়। আর আমরা বলছি, আমাদের পক্ষ থেকে যা বর্ণনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে। সুতরাং আপনি কি চান?
‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বললেন, তোমাদের এসব সাথী, যারা বিদ্রোহ করেছে, তাদের ও আমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর কিতাব ফায়সালাকারী হিসাবে বিদ্যমান। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে একজন পুরুষ ও স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন,
﴿وَاِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَیْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَمًا مِّنْ اَہْلِه وَحَكَمًا مِّنْ اَہْلِهَا ۚ اِنْ یُّرِیْدَاۤ  اِصْلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰهُ بَیْنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِیْمًا خَبِیْرًا﴾
“তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন ও তার (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।”[১]
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মাতের রক্ত ও সম্মান একজন স্বামী ও স্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশী মর্যাদা সম্পন্ন। তারা আমার উপর রাগান্বিত এজন্য যে, আমি মু‘আবিয়ার সাথে সন্ধি করেছি। অথচ আবূ ত্বালিবের ছেলে ‘আলী চুক্তি লিখেছিল। আর সুহাইল ইবনু ‘আম্র এসেছিল এবং আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। সে সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিজ গোত্র কুরাইশের সাথে হুদায়বিদায়ার সন্ধি করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লিখলেন, ‘বিস্মিল্লা-হির রহ্মা-নির রহীম’। সুহাইল বলল, ‘বিস্মিল্লা-হির রহ্মা-নির রহীম’ লিখবেন না। তিনি বললেন, তাহলে কিভাবে লিখব? সে বলল, লিখুন, ‘বিস্মিকা আল্লাহুম্মা’। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, লেখো ‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ’। সুহাইল (বাধা দিয়ে) বলল, আমরা যদি আপনাকে মহান আল্লাহর রাসূল মানতাম, তাহলে তো আপনার বিরোধিতা করতাম না। তাই রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লিখলেন, ‘এটা সেই সন্ধি, যা ‘আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মাদ কুরাইশের সাথে স্থাপন করেছেন’। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বলেন,
﴿لَقَدْ كَانَ لَکُمْ  فِیْ رَسُوْلِ اللّٰهِ  اُسْوَۃٌ حَسَنَۃٌ  لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوْا اللّٰهَ وَ الْیَوْمَ  الْاٰخِرَ  وَ ذَكَرَ  اللّٰهَ  كَثِیْرًا﴾
“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও ক্বিয়ামাতের দিনকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করে, তাদের জন্য অবশ্যই উত্তম আদর্শ রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মধ্যে।”[২]
অতঃপর ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) তাদের নিকট ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-কে পাঠালেন। আমিও তার সাথে রওনা হলাম। যখন তাদের বাহিনীর মাঝে পৌঁছলাম, তখন ইবনু কাওয়া জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে লাগল। সে বলল, হে কুরআন বহনকারীগণ! এ হচ্ছে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস। তাঁকে যারা চেনে না, আমি তাদের সামনে মহান আল্লাহর কিতাব থেকে তাঁর পরিচয় তুলে ধরছি। এই ব্যক্তি তাদেরই একজন, যাদের সম্পর্কে কুরআনে নাযিল হয়েছে-
﴿قَوْمٌ خَصِمُوْنَ﴾
“তারা একটি ঝগড়াটে জাতি।”[৩]
সুতরাং তাকে তার বন্ধুর কাছে (‘আলীর কাছে) ফেরত পাঠাও এবং তার সাথে মহান আল্লাহর কিতাব দ্বারা বাজি ধরো না।
তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্য থেকে অন্যান্য ভাষণদাতা উঠে বলল, আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তার সাথে মহান আল্লাহর কিতাব দ্বারা বাজি ধরব। সে যদি সত্য ও সঠিক বক্তব্য নিয়ে আসে এবং আমরা তা বুঝতে পারি তাহলে আমরা অবশ্যই তা মেনে চলব। আর যদি অসত্য নিয়ে আসে, তাহলে আমরা তাকে অবশ্যই তার বাতিল যুক্তিকে পরাজিত করব। তারপর তারা ‘আব্দুল্লাহর সাথে তিনদিন মহান আল্লাহর কিতাবের বাজি ধরে রইল। এরপর তাদের (মু‘আবিয়ার পক্ষের) মধ্য থেকে চার হাজার ব্যক্তি (তাদের বাজি প্রত্যাহার করল এবং প্রত্যেকে) তাওবাহ্ করল। ইবনুল কাওয়াও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাদের সবাইকে কূফায় ‘আলীর নিকট উপস্থিত করলেন।
‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) অবশিষ্ট লোকদের নিকট এই মর্মে বার্তা পাঠালেন যে, ইতিমধ্যে আমাদের ও জনগণের মধ্যে যা হয়েছে, তা তো তোমরা দেখতেই পেয়েছ। সুতরাং তোমরা যেখানে চাও, স্থির হও, যতক্ষণ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মাত আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমবেত না হয়। তোমরা কোনো অবৈধ রক্তপাত করো না। ডাকাতি, রাহাজানি করো না। যিম্মীদের ওপর যুল্ম করো না। যদি এসব করো, তাহলে আমরাও একইভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাসঘাতকদেরকে পছন্দ করেন না। ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) তাকে বললেন, হে ইবনু শাদ্দাদ! ‘আলী কি তাদেরকে হত্যা করেছিলেন? ইবনু শাদ্দাদ বললেন, আল্লাহর কসম! তাদের কাছে ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) কোনো বাহিনী ততক্ষণ পাঠাননি, যতক্ষণ না তারা ডাকাতি ও লুটপাট চালিয়েছে, রক্তপাত করেছে এবং যিম্মীদের (অমুসলিমদের) ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।
‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বললেন, সত্যি? সে বলল, আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। এটাই ঘটেছিল। ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বললেন, তাহলে ইরাকীদের সম্পর্কে আমি যে শুনলাম, তারা বলাবলি করে, ‘উন্নত বক্ষা নারীদের মালিক, উন্নত বক্ষা নারীদের মালিক’- এটা কি? ইবনু শাদ্দাদ বললেন, (যে ব্যক্তি এ রকম রটনা করে) তাকে আমি দেখেছি এবং ‘আলীকে সাথে নিয়ে নিহতদের মধ্যে তার জানাযা পড়েছি। তিনি লোকজনকে ডাকলেন এবং বললেন, তোমরা কি একে চেনো? বহুলোক এসে বলল, ওকে অমুক গোত্রের মাসজিদে সালাত আদায় করতে দেখেছি, অমুক মাসজিদে সালাত আদায় করতে দেখেছি। কিন্তু এটুকু ছাড়া কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউ দিতে পারল না।
‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বললেন, ‘আলী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) যখন তার জানাযা পড়লেন, তখন ইরাকবাসী যে ধারণা পোষণ করে, তার সম্পর্কে তিনি কি বললেন? ইবনু শাদ্দাদ বললেন, তাকে বলতে শুনলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বললেন, তাকে কি অন্য কিছু বলতে শুনেছ? ইবনু শাদ্দাদ বললেন, আল্লাহর কসম! না। ‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ‘আলী’র ওপর রহমত করুন। কারণ তিনি যে কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার দেখলেই বলতেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। অথচ ইরাকবাসী তাঁর ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে ও অতিরঞ্জিত কথা বলে।[৪]

[১] সূরা আন্ নিসা ৪ : ৩৫।
[২] সূরা আল আহ্যা-ব ৩৩ : ২১।
[৩] সূরা আয্ যুখরূফ ৪৩ : ৫৮।
[৪] মুসনাদে আহমাদ- হাঃ ৬৫৬।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত