সাময়িক প্রসঙ্গ
ইমাম মাহদীর আগমন: কিছু ভ্রান্ত অপপ্রচার
আরাফাত ডেস্ক
শুনা যাচ্ছে, ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের পূর্বে রমাযাান মাসে কয়েকটি নিদর্শন প্রকাশিত হবে। তার মধ্যে রমাযান মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুক্রবার রাতে আকাশে বিকট শব্দে আওয়াজ হওয়া অন্যতম নিদর্শন। হাদীসটি হলো- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “ক্বিয়ামতের আগে কোনও এক রামাযান মাসে আকাশে বিকট শব্দ হবে। এতে অনেক মানুষ বোবা, বধির ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।” উল্লেখ্য যে, হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল, বানোয়াট এবং সর্বৈব বাতিলযোগ্য।
কিন্তু দুঃখজনক যে, বর্তমানে কিছু তথাকথিত বক্তা বা ‘আলেম ইমাম মাহদী সম্পর্কে বহু জাল-য‘ঈফ ভিত্তিহীন এবং অতিরঞ্জনমূলক বক্তব্য দিয়ে মানুষের মাঝে নানা বিভ্রান্তি ও ভয়ভীতি সঞ্চার করে চলেছে। এ সব শুনে অনেক মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এভাবেই কথিত বক্তাগণ নিজেদের প্রচার-প্রসার ঘটিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
উল্লেখ্য যে, ক্বিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদী আসবেন এবং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিশ্ব শাসন করবেন। পৃথিবব্যাপী শান্তি ও সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়বে। এর সম্পর্কে বহু হাদীস সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো আমাদের জন্য যথেষ্ট। তবে অতি উৎসাহি হয়ে, ইমাম মাহ্দী সম্পর্কে বানোয়াট ও জাল-য‘ঈফ হাদীস বর্ণনা, তার আগমনের সম্ভাব্য সময় বা সন-তারিখ নির্ধারণ, তাকে স্বপ্নে দর্শন, ইতোমধ্যে তিনি এসে গেছেন, ইতোমধ্যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, অমুক দেশে এক ব্যক্তির মাঝে এত পারসেন্ট আলামত মিলে গেছে ইত্যাদি সব গালগল্প ও মিথ্যাকথন মাহফিলে-মাহফিলে বলে বেড়িয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এসব ফিত্না হতে হিফাজত করুন -আমীন।
উল্লেখ্য যে ইমাম মাহ্দীর আগমনের আলামত সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদীসটি সহীহ নয়। বিজ্ঞ হাদীস বিশারদগণের দৃষ্টিতে এটি ‘অত্যন্ত দুর্বল’ বাতিল ও বানোয়াট হিসেবে চিহ্নিত।
নিম্নে উপরোক্ত মূল হাদীসটির আরবি টেক্সট, তরজমা, উৎস অতঃপর এ সম্পর্কে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতামত ও বক্তব্য তুলে ধরা হলো। হাদীসটি নিম্নরূপ :
ফিরোজ দায়লামি বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন :
يَكُوْنُ فِيْ رَمَضَانَ صَوْتٌ، قَالُوْا : فِيْ أَوَّلِهِ أَوْ فِيْ وَسَطِهِ أَوْ فِيْ آخِرِهِ؟ قَالَ : لَا؛ بَلْ فِيْ النِّصْفِ مِنْ رَمَضَانَ، إِذَا كَانَ لَيْلَةُ النِّصْفِ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ؛ يَكُوْنُ صَوْتٌ مِنَ السَّمَاءِ يُصْعَقُ لَهُ سَبْعُوْنَ أَلْفًا، وَيُخْرَسُ سَبْعُوْنَ أَلْفًا، وَيُعْمَى سَبْعُوْنَ أَلْفًا، وَيُصِمُّ سَبْعُوْنَ أَلْفًا. قَالُوْا : فَمَنِ السَّالِمُ مِنْ أُمَّتِكَ؟ قَالَ : مَنْ لَزِمَ بَيْتَهُ، وَتَعَوَّذَ بِالسُّجُوْدِ، وَجَهَرَ بِالتَّكْبِيْرِ لِلّٰهِ. ثُمَّ يَتْبَعُهُ صَوْتٌ آخَرُ. وَالصَّوْتُ الْأَوَّلُ صَوْتُ جِبْرِيْلَ، وَالثَّانِيْ صَوْتُ الشَّيْطَانِ. فَالصَّوْتُ فِيْ رَمَضَانَ، وَالمَعْمَعَةُ فِيْ شَوَّالٍ، وَتُمَيَّزُ الْقَبَائِلُ فِيْ ذِيْ الْقَعْدَةِ، وَيُغَارُ عَلٰى الْحُجَّاجِ فِيْ ذِيْ الْحِجَّةِ، وَفِيْ الْمُحْرِمِ، وَمَا الْمُحْرَّمُ؟ أَوَّلُهُ بَلْاءٌ عَلٰى أُمَّتِيْ، وَآخِرُهُ فَرَحٌ لْأُمَّتِيْ، الرَّاحِلَةُ فِيْ ذٰلِكَ الزَّمَانِ بِقَتَبِهَا يَنْجُوْ عَلَيْهَا الْمُؤْمِنُ لَهُ مِنْ دَسْكَرَةٍ تَغُلُّ مِائَةَ أَلْفٍ. أخرجه الطبراني في "المعجم الكبير" (১৮/৩৩২/৮৫৩(
“কোন এক রমাযানে আওয়াজ আসবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রামাযানের শুরুতে? নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে? নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “না; বরং রামাযানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রামাযানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় সত্তর হাজার মানুষ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে আর সত্তর হাজার বধির হয়ে যাবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনার উম্মাতের মধ্যে কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে? নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সাজদায় লুটিয়ে আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চ শব্দে আল্লাহু আকবর বলবে। পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিবরা-ঈল-এর এবং দ্বিতীয়টি হবে শয়ত্বানের। (ঘটনার পরম্পরা এরূপ) : শব্দ আসবে রামাযানে। ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হবে শাওয়ালে। আরবের গোত্রগুলো বিদ্রোহ করবে জুলক্বা’দা মাসে। হাজী লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটবে যিলহাজ্জ মাসে। আর মুর্হরমের শুরুটা আমার উম্মাতের জন্য বিপদ, শেষটা মুক্তি। সেদিন মুসলিমগণ যে বাহনে চড়ে মুক্তি লাভ করবে, সেটি তার কাছে এক লাখ মূল্যের বিনোদন সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ঘরের চেয়েও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে।”[১]
এ হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মতামত :
◉ শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, হাদীসটি موضوع বা বানোয়াট।
◉ ইমাম ইবনুল জাওযী তার ‘আল মাউযুআত’ বা বানোয়াট হাদীস সংকলন গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন (৩/১৯১)।
তিনি বলেন : هذا حديث لا يصح এ হাদীসটি সহীহ নয়। কারণ এর সনদে আব্দুল ওয়াহাব নামক একজন বর্ণনাকারী আছে, তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ কঠোর আপত্তি করেছেন। যেমন-
◉ উকাইলী বলেন, عبد الوهاب ليس بشيء “‘আব্দুল ওয়াহাব কিছুই নয়।” (এ বাক্যটি দ্বারা বর্ণনাকারীর প্রতি কঠোর সমালোচনা বুঝায়।)
◉ ইবনু হিব্বান বলেন, كان يسرق الحديث؛ لا يحل الاحتجاج به “সে হাদীস চুরি করত। তার বর্ণিত হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করা বৈধ নয়।”
◉ দারাকুত্বনী বলেন, منكر الحديث মুনকারুল হাদীস। এছাড়াও সনদে আরও সমস্যা আছে।[২]
◉ ইমাম যাহাবী বলেন, باطل এ হাদীসটি বাতিল।[৩]
◉ হাইসামী বলেন, এই হাদীসের বর্ণনাসূত্রে ‘আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনুয যাহহাক নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যে মুহাদ্দিসীনদের দৃষ্টিতে মাতরূক বা পরিত্যাজ্য।[৪]
◉ ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন :
فِيْ أَحَادِيْثَ لَا تَصِحُّ فِيْ التَّوَارِيْخِ المستقبلية.
“অগ্রিম তারিখ নির্ধারণ করে বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বেশ কিছু হাদীস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো সহীহ নয়।”
সে সব হাদীসের মধ্যে একটি হলো :
يكون صوت في رمضان إذا كانت ليلة النصف منه ليلة جمعة، يصعق له سبعون ألفا، ويصم سبعون ألفا.
“অর্ধ রামাযানের জুমু‘আর রাতে একটি আওয়াজ হবে। এতে সত্তর হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে... সত্তর হাজার মানুষ বোবা হয়ে যাবে...।”[৫]
পরিশেষে বলব, আমাদের কর্তব্য, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং মিথ্যা, বানোয়াট বা বিশুদ্ধসূত্রে প্রমাণিত নয়, এমন হাদীস থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা। কেননা বানোয়াট, জাল-য‘ঈফ হাদীস দ্বারা ইসলামের লাভ হয় না; বরং ক্ষতি হয়। পরিণতিতে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, যে ব্যক্তি জেনে-শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নামে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করে তার পরিণত হবে জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং হক্বের পথে অবিচল রাখুন -আমীন।

[১] আল মু’জামুল ক্বাবীল লিত ত্বাবারানী।
[২] শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লা-হ)-এর সিলসিলা য‘ঈফার ৬০৭৮ ও ৬০৭৯ নং হাদীস পর্যালোচনা থেকে সংক্ষেপিত।
[৩] তারতীবুল মাউযুআত- ২৭৮।
[৪] মাজমাউয যাওয়ায়েদ- ৭/৩১৩।
[৫] আল মানারুল মুনীফ- ৯৬ পৃঃ।

আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত