ভিত্তিহীন প্রচলিত কথা
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া ছিল?
আরাফাত ডেস্ক
আমাদের মাঝে একটি কথা প্রচলিত যে “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল না।” অবশ্য এ কথার পিছনে একটি জাল হাদীস বিদ্যমান। তা হলো-
لم يكن يري له ظل في شمس ولا قمر.
যাকওয়ান থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, সূর্য ও চাঁদের আলোতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া দেখা যেত না।[১]
এ বর্ণনাটি জাল ও ভিত্তিহীন। কেননা, প্রথমত এ হাদীসের সূত্রে রয়েছে ‘আব্দুর রহমান ইবনু ক্বাইস যাফরানী, যার সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের কঠোর মন্তব্য রয়েছে। বিজ্ঞ রিজালশাস্ত্রবিদ আব্দুর রহমান বিন মাহদী এবং ইমাম আবূ আবূ যরআ (রাহিমাহুল্লা-হ) তাকে মিথ্যুক বলেছেন। আবূ ‘আলী সালেহ ইবনু (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, তথা ‘আব্দুর রহমান বিন কাইস যাফরানী হাদীস জাল করতো।
এছাড়াও তার সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লা-হ) ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লা-হ) প্রমুখ প্রখ্যাত ইমামদের কঠোর উক্তি রয়েছে।[২]
অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى مَا خَلَقَ اللهُ مِنْ شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِيْنِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِلّٰهِ وَهُمْ دَاخِرُوْنَ﴾
“তারা কি আল্লাহর সৃজিত বস্তু দেখে না, যার ছায়া আল্লাহর প্রতি বিনীতভাবে সাজদাবনত থেকে ডান ও বাম দিকে ঝুঁকে পড়ে।”[৩] আল কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে-
﴿وَلِلّٰهِ يَسْجُدُ مَنْ فِيْ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ﴾
“আল্লাহকে সাজদাহ্ করে যা কিছু নভোমণ্ডলে এবং ভূমণ্ডলে আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের প্রতিচ্ছায়াও সকাল-সন্ধ্যায়।”[৪]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল কি-না এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য স্বয়ং নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিংবা তাঁর নিকটতম সাহাবায়ে কিরামদের নিকটেই ছিল। এখন আমরা এ বিষয়ে জানব নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর সাহাবীগণের নিকট থেকে।
‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক সফরে ছিলেন। সাথে ছিলেন সাফিয়্যাহ ও যায়নব। সাফিয়্যাহ নিজের উট হারিয়ে ফেলেন। যায়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা)-এর কাছে ছিল অতিরিক্ত উট। তাই নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যায়নবকে বলেন, সাফিয়্যার উট নিখোঁজ হয়ে গেছে। যদি তুমি তাকে তোমার একটি উট দিয়ে সাহায্য করতে তো ভাল হত। উত্তরে যয়নব বলেন, হুঁম! আমি ঐ ইহুদীর মেয়েকে উট দেব? (অর্থাৎ- তিনি দিতে অস্বীকার করেন এবং সাফিয়্যাহকে ইহুদীর সন্তান বলে কটূক্তি করেন, কারণ তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইহুদী ছিলেন)। এ কটূক্তির কারণে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যায়নবের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেন। যিলহাজ্জ এবং মুহাররম দুই কিংবা তিন মাস ধরে তার সাথে সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকেন। যায়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বলেন, আমি নিরাশ হয়ে পড়ি। এমনকি শয়নের খাটও সরিয়ে ফেলি। এমনি এক সময় দিনের শেষার্ধে, নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়ার মধ্যে পাই। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন।[৫]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
যয়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আগমন থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন। (এমতাবস্থায়) রবীউল আওয়ালে তার নিকট যান। ঘরে প্রবেশের প্রক্কালে যয়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) তাঁর ছায়া দেখতে পান এবং বলেন, এতো কোন পুরুষ মানুষের ছায়া বলে মনে হয়, (অথচ) তিনি তো আমার কাছে আসেন না। তাহলে এ ব্যক্তি কে? ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রবেশ করেন।[৬]
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، قَالَ : بَيْنَمَا النَّبِيُّ ﷺ يُصَلِّي ذَاتَ لَيْلَةٍ صَلَاةً إِذْ مَدَّ يَدَهُ ، ثُمَّ أَخَّرَهَا ، فَقُلْنَا : يَا رَسُوْلَ اللهِ رَأَيْنَاكَ صَنَعْتَ فِيْ هَذِهِ الصَّلَاةِ شَيْئًا لَمْ تَكُنْ تَصْنَعُهُ فِيْمَا قَبْلَهُ، قَالَ : أَجَلْ إِنَّهُ عُرِضَتْ عَلَيَّ الْجَنَّةَ فَرَأَيْتُ فِيهَا دَالَيَةً قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ فَأَرَدْتُ أَنْ أَتَنَاوَلَ مِنْهَا شَيْئًا، فَأُوحِيَ إِلَيَّ أَنِ اسْتَأْخِرْ فَاسْتَأْخَرْتُ، وَعُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ فِيْمَا بَيْنِيْ وَبَيْنَكُمْ حَتّٰى رَأَيْتُ ظِلِّيْ وَظِلَّكُمْ فِيْهَا.
সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, কোনো এক রাতে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালাতে ইমামতি করছিলেন। (এমতাবস্থায়) তিনি সহসা সামনের দিকে হাত বাড়ান এরপর তা আবার পেছনের দিকে টেনে নেন। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম), এ সালাতে আপনাকে এমন কাজ করতে দেখেছি যা ইতিপূর্ব কখনো করেননি? তিনি (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হ্যাঁ! আমার কাছে জান্নাত উপস্থিত করা হয়েছিল। তাতে বিশাল বৃক্ষরাজি দেখতে পেলাম যেগুলোর ছড়া ঝুঁকানো ছিল। তা থেকে কিছু নিতে চাইলে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হলো, আপনি পেছনে সরে দাঁড়ান। আমি সরে দাঁড়ালাম। তারপর আমার নিকট জাহান্নাম উপস্থিত করা হলো, যার আলোতে আমি আমার এবং তোমাদের ছায়া পর্যন্ত দেখেছি।[৭]
উল্লেখ্য যে, সহীহ ইবনু খুজাইমাহ্ কিতাবের সংকলক ইমামুল আয়িম্মাহ আবূ বক্বর মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক ইবনু খুজাইমাহ্ আস-সালামী আন্ নিসাপুরী আশ্ শাফে‘য়ী (রাহিমাহুল্লা-হ) (২২৩-৩১১ হিজরী)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জাহান্নামের প্রতিচ্ছবি যখন তাঁর সম্মুখে পেশ করা হয়েছিল তখন জাহান্নামের আগুনের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল; ফলে তখন নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীদের ছায়া পেছন দিকেই সরে গিয়েছিল। আর এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালাতরত অবস্থায় সম্মুখ থেকে পেছনের ছায়া কীভাবে দেখেছিলেন?
তিনি অত্যন্ত সাবলিলভাবে এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালাতরত অবস্থায় সম্মুখ থেকে পেছনে দেখারও ক্ষমতা রাখেন, যা ছিল তাঁর অন্যতম মু’যিজাহ্। এর পক্ষে সুস্পষ্ট দলীল-
্রإِنِّيْ أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ، وَأَسْمَعُ مَا لَا تَسْمَعُوْنَগ্ধ.
নিশ্চয় আমি যা দেখি তোমরা তা দেখো না। আমি যা শুনতে পাই তোমরা তা শুনতে পাও না।[৮]
وَاللهِ إِنِّيْ لَأَرَى مِنْ خَلْفِيْ كَمَا أَرَى مِنْ بَيْنِ يَدَيَّগ্ধ.
আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় আমি পেছনেও তেমনই দেখতে পাই, যেমনভাবে আশে পাশে দেখতে পাই।[৯]
আরো বর্ণিত হয়েছে-
وﻳﺌﺴﺖ ﻣﻨﻪ ﻓﻠﻤﺎ ﻛﺎن ﺷﻬﺮ رﺑﻴﻊ ﺍﻷوﻝ دﺧﻞ ﻋﻠﻴﻬﺎ فرأت ﻇﻠﻪ ﻓﻘﺎﻟﺖ ﺇن ﻫﺬﺍ ﻟﻈﻞ رﺟﻞ وﻣﺎ ﻳﺪﺧﻞ ﻋﻠﻲ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﷺ ﻓﻤﻦ ﻫﺬا ﻓﺪﺧﻞ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﷺ.
শাইখ ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কোনো ছায়া ছিল না বলে যে সব কথা বলা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা এবং বানোয়াট।[১০]
উল্লেখ্য যে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল না” এ বিশ্বাস কেবল ঐ সকল ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ্ পোষণকারীদের- যারা বলেন, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নূরের তৈরি, আর নূর বা আলোর কোনো ছায়া হয় না।
প্রকৃত সত্য হলো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বমহান সৃষ্টি। কিন্তু তিনিও পিতৃ ঔরশে ও মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করা জৈবিক চাহিদাসম্পন্ন রক্ত-মাংশের মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا﴾
“আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ...।”[১১]
এছাড়া সত্যিই যদি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া না থাকতো, তবে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও আশ্চর্যজনক বিষয় হিসেবে গণ্য হত আর অনেক সাহাবীই এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণনা করতেন। অথচ এ সম্পর্কিত কোনো হাদীস নেই; বরং তাঁর ছায়া আছে মর্মে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অতএব যৌক্তিক বিচারে এ কথা ধোপে টিকে না যে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল না।” আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ্-বিশ্বাস পরিহার সঠিক উপলব্ধিবোধ দান করুন -আমীন। [গ্রন্থনা : এম. জি. রহমান]
لم يكن يري له ظل في شمس ولا قمر.
যাকওয়ান থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, সূর্য ও চাঁদের আলোতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া দেখা যেত না।[১]
এ বর্ণনাটি জাল ও ভিত্তিহীন। কেননা, প্রথমত এ হাদীসের সূত্রে রয়েছে ‘আব্দুর রহমান ইবনু ক্বাইস যাফরানী, যার সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের কঠোর মন্তব্য রয়েছে। বিজ্ঞ রিজালশাস্ত্রবিদ আব্দুর রহমান বিন মাহদী এবং ইমাম আবূ আবূ যরআ (রাহিমাহুল্লা-হ) তাকে মিথ্যুক বলেছেন। আবূ ‘আলী সালেহ ইবনু (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, তথা ‘আব্দুর রহমান বিন কাইস যাফরানী হাদীস জাল করতো।
এছাড়াও তার সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লা-হ) ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লা-হ) প্রমুখ প্রখ্যাত ইমামদের কঠোর উক্তি রয়েছে।[২]
অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى مَا خَلَقَ اللهُ مِنْ شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِيْنِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِلّٰهِ وَهُمْ دَاخِرُوْنَ﴾
“তারা কি আল্লাহর সৃজিত বস্তু দেখে না, যার ছায়া আল্লাহর প্রতি বিনীতভাবে সাজদাবনত থেকে ডান ও বাম দিকে ঝুঁকে পড়ে।”[৩] আল কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে-
﴿وَلِلّٰهِ يَسْجُدُ مَنْ فِيْ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ﴾
“আল্লাহকে সাজদাহ্ করে যা কিছু নভোমণ্ডলে এবং ভূমণ্ডলে আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের প্রতিচ্ছায়াও সকাল-সন্ধ্যায়।”[৪]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল কি-না এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য স্বয়ং নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিংবা তাঁর নিকটতম সাহাবায়ে কিরামদের নিকটেই ছিল। এখন আমরা এ বিষয়ে জানব নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর সাহাবীগণের নিকট থেকে।
‘আয়িশাহ্ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক সফরে ছিলেন। সাথে ছিলেন সাফিয়্যাহ ও যায়নব। সাফিয়্যাহ নিজের উট হারিয়ে ফেলেন। যায়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা)-এর কাছে ছিল অতিরিক্ত উট। তাই নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যায়নবকে বলেন, সাফিয়্যার উট নিখোঁজ হয়ে গেছে। যদি তুমি তাকে তোমার একটি উট দিয়ে সাহায্য করতে তো ভাল হত। উত্তরে যয়নব বলেন, হুঁম! আমি ঐ ইহুদীর মেয়েকে উট দেব? (অর্থাৎ- তিনি দিতে অস্বীকার করেন এবং সাফিয়্যাহকে ইহুদীর সন্তান বলে কটূক্তি করেন, কারণ তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইহুদী ছিলেন)। এ কটূক্তির কারণে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যায়নবের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেন। যিলহাজ্জ এবং মুহাররম দুই কিংবা তিন মাস ধরে তার সাথে সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকেন। যায়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) বলেন, আমি নিরাশ হয়ে পড়ি। এমনকি শয়নের খাটও সরিয়ে ফেলি। এমনি এক সময় দিনের শেষার্ধে, নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়ার মধ্যে পাই। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন।[৫]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
যয়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আগমন থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন। (এমতাবস্থায়) রবীউল আওয়ালে তার নিকট যান। ঘরে প্রবেশের প্রক্কালে যয়নব (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হা) তাঁর ছায়া দেখতে পান এবং বলেন, এতো কোন পুরুষ মানুষের ছায়া বলে মনে হয়, (অথচ) তিনি তো আমার কাছে আসেন না। তাহলে এ ব্যক্তি কে? ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রবেশ করেন।[৬]
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، قَالَ : بَيْنَمَا النَّبِيُّ ﷺ يُصَلِّي ذَاتَ لَيْلَةٍ صَلَاةً إِذْ مَدَّ يَدَهُ ، ثُمَّ أَخَّرَهَا ، فَقُلْنَا : يَا رَسُوْلَ اللهِ رَأَيْنَاكَ صَنَعْتَ فِيْ هَذِهِ الصَّلَاةِ شَيْئًا لَمْ تَكُنْ تَصْنَعُهُ فِيْمَا قَبْلَهُ، قَالَ : أَجَلْ إِنَّهُ عُرِضَتْ عَلَيَّ الْجَنَّةَ فَرَأَيْتُ فِيهَا دَالَيَةً قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ فَأَرَدْتُ أَنْ أَتَنَاوَلَ مِنْهَا شَيْئًا، فَأُوحِيَ إِلَيَّ أَنِ اسْتَأْخِرْ فَاسْتَأْخَرْتُ، وَعُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ فِيْمَا بَيْنِيْ وَبَيْنَكُمْ حَتّٰى رَأَيْتُ ظِلِّيْ وَظِلَّكُمْ فِيْهَا.
সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, কোনো এক রাতে রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালাতে ইমামতি করছিলেন। (এমতাবস্থায়) তিনি সহসা সামনের দিকে হাত বাড়ান এরপর তা আবার পেছনের দিকে টেনে নেন। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম), এ সালাতে আপনাকে এমন কাজ করতে দেখেছি যা ইতিপূর্ব কখনো করেননি? তিনি (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হ্যাঁ! আমার কাছে জান্নাত উপস্থিত করা হয়েছিল। তাতে বিশাল বৃক্ষরাজি দেখতে পেলাম যেগুলোর ছড়া ঝুঁকানো ছিল। তা থেকে কিছু নিতে চাইলে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হলো, আপনি পেছনে সরে দাঁড়ান। আমি সরে দাঁড়ালাম। তারপর আমার নিকট জাহান্নাম উপস্থিত করা হলো, যার আলোতে আমি আমার এবং তোমাদের ছায়া পর্যন্ত দেখেছি।[৭]
উল্লেখ্য যে, সহীহ ইবনু খুজাইমাহ্ কিতাবের সংকলক ইমামুল আয়িম্মাহ আবূ বক্বর মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক ইবনু খুজাইমাহ্ আস-সালামী আন্ নিসাপুরী আশ্ শাফে‘য়ী (রাহিমাহুল্লা-হ) (২২৩-৩১১ হিজরী)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জাহান্নামের প্রতিচ্ছবি যখন তাঁর সম্মুখে পেশ করা হয়েছিল তখন জাহান্নামের আগুনের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল; ফলে তখন নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীদের ছায়া পেছন দিকেই সরে গিয়েছিল। আর এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালাতরত অবস্থায় সম্মুখ থেকে পেছনের ছায়া কীভাবে দেখেছিলেন?
তিনি অত্যন্ত সাবলিলভাবে এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালাতরত অবস্থায় সম্মুখ থেকে পেছনে দেখারও ক্ষমতা রাখেন, যা ছিল তাঁর অন্যতম মু’যিজাহ্। এর পক্ষে সুস্পষ্ট দলীল-
্রإِنِّيْ أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ، وَأَسْمَعُ مَا لَا تَسْمَعُوْنَগ্ধ.
নিশ্চয় আমি যা দেখি তোমরা তা দেখো না। আমি যা শুনতে পাই তোমরা তা শুনতে পাও না।[৮]
وَاللهِ إِنِّيْ لَأَرَى مِنْ خَلْفِيْ كَمَا أَرَى مِنْ بَيْنِ يَدَيَّগ্ধ.
আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় আমি পেছনেও তেমনই দেখতে পাই, যেমনভাবে আশে পাশে দেখতে পাই।[৯]
আরো বর্ণিত হয়েছে-
وﻳﺌﺴﺖ ﻣﻨﻪ ﻓﻠﻤﺎ ﻛﺎن ﺷﻬﺮ رﺑﻴﻊ ﺍﻷوﻝ دﺧﻞ ﻋﻠﻴﻬﺎ فرأت ﻇﻠﻪ ﻓﻘﺎﻟﺖ ﺇن ﻫﺬﺍ ﻟﻈﻞ رﺟﻞ وﻣﺎ ﻳﺪﺧﻞ ﻋﻠﻲ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﷺ ﻓﻤﻦ ﻫﺬا ﻓﺪﺧﻞ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﷺ.
শাইখ ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কোনো ছায়া ছিল না বলে যে সব কথা বলা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা এবং বানোয়াট।[১০]
উল্লেখ্য যে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল না” এ বিশ্বাস কেবল ঐ সকল ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ্ পোষণকারীদের- যারা বলেন, নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নূরের তৈরি, আর নূর বা আলোর কোনো ছায়া হয় না।
প্রকৃত সত্য হলো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বমহান সৃষ্টি। কিন্তু তিনিও পিতৃ ঔরশে ও মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করা জৈবিক চাহিদাসম্পন্ন রক্ত-মাংশের মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا﴾
“আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ...।”[১১]
এছাড়া সত্যিই যদি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া না থাকতো, তবে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও আশ্চর্যজনক বিষয় হিসেবে গণ্য হত আর অনেক সাহাবীই এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণনা করতেন। অথচ এ সম্পর্কিত কোনো হাদীস নেই; বরং তাঁর ছায়া আছে মর্মে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অতএব যৌক্তিক বিচারে এ কথা ধোপে টিকে না যে, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছায়া ছিল না।” আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ্-বিশ্বাস পরিহার সঠিক উপলব্ধিবোধ দান করুন -আমীন। [গ্রন্থনা : এম. জি. রহমান]
[১] খাসায়েলুল কুবরা- ১/১২২।
[২] তারীখে বাগদাদ- ১০/২৫১-২৫২; মিযানুল ই‘তিদাল- ২/৫৮৩; তাহযীবুত তাহযীব- ৬/২৫৮।
[৩] সূরা আন্ নাহ্ল- ১৬/৪৮।
[৪] সূরা আর রা’দ- ১৩ : ১৫।
[৫] আহমদ- ৬/১৬৪-১৮২; আত্ ত্বাবাকাত আল কুবরা, ৮/১০০।
[৬] মুসনাদে আহমাদ- হাঃ ২৬৮৬৬।
[৭] হাকীম- ৫/৬৪৮, মাঃশাঃ, ৮৪০৮; ইবনু খুজাইমাহ্- ২/৫০।
[৮] সুনান ইবনু মাজাহ্- হাঃ ৪১৯০।
[৯] মিশকা-তুল মাসা-বীহ- হাঃ ৮১১/২২।
[১০] আল কাউলুল মুফীদ- ১/৬৮।
[১১] সূরা কাহ্ফ- ১৮/১১০; সূরা হা-মীম, আস্ সাজদাহ্ : ৪১/৬।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য1