﴿وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلَا تَفَرَّقُوْا وَاذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلٰى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ ۞ وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ۞ وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُوْلَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ﴾
সরল বঙ্গানুবাদ : “আল্লাহর রজ্জু তথা আল-কুরআন ও হাদীসকে সমবেতভাবে সুদৃঢ়রূপে ধারণা করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নি‘আমত স্মরণ করো। যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু। তিনি তোমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করলেন, ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নি-গহ্বরের প্রান্তে ছিলে, তারপর আল্লাহ তোমাদের তা থেকে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ নিজের নিদর্শনাবলী তোমাদের কাছে প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা। সঠিক পথ প্রাপ্ত হও। তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হোক, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর এরাই সফলকাম। তোমরা সেই লোকদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন পৌঁছার পরে বিভক্ত হয়েছে এবং মতভেদ করেছে। আর এ শ্রেণীর লোকদের জন্য আছে মহাশাস্তি।”[১]
প্রসঙ্গ কথা : উপর্যুক্ত আয়াত তিনটিতে মহান আল্লাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ প্রদান করেছেন।
প্রথমতঃ মহান আল্লাহর বাণী ও মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সহীহ সুন্নাহকে সম্মিলিতভাবে ধারণ করার কথা বলেছেন। সাথে সাথে মহান আল্লাহর নি‘আমতের কথাও ব্যক্ত করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে মানবম-লীকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, সে কথাও তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয়তঃ একটি দলের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছেন, যারা পরকালে সফলতা লাভ করবে।
তৃতীয়তঃ ইতোপূর্বে যারা দলে দলে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে গেছে তাদের মতো হতে আল্লাহ তা‘আলা কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কেননা এ জাতীয় লোকদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।
আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ :
মহান আল্লাহর বিধানকে আঁকড়ে ধরা অপরিহার্য :
﴿وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلَا تَفَرَّقُوْا﴾
“তোমরা এক সাথে মহান আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করো ও পরস্পর বিভক্ত হয়ো না।”
তাফসীর ইবনু কাসীরে বর্ণিত হয়েছে যে, بِحَبْلِ اللهِ শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে- মহান আল্লাহর ওয়া‘দা ও অঙ্গীকার। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
﴿ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُوْا إِلَّا بِحَبْلٍ مِنَ اللهِ وَحَبْلٍ مِنَ النَّاسِ﴾
“আল্লাহর ওয়া‘দা-অঙ্গীকার ও মানুষের আশ্রয় ছাড়া যেখানেই তারা অবস্থান করুক, সেখানেই তারা হয়েছে লাঞ্ছিত।”[২]
অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে- তোমরা মহান আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করো। ঐ রজ্জু হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম।[৩]
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা মতভেদ সৃষ্টি করো না এবং পৃথক পৃথক হয়ে যেয়ো না।”
সুতরাং দলে দলে বিভক্ত হওয়া এটা অন্যায় ও গর্হিত কাজ। যারা এমনটি করবে তাদের সাথে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কোন সম্পর্ক নেই। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
﴿إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِىْ شَيْءٍ﴾
“নিশ্চয়ই যারা স্বীয় ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই।”[৪]
এ প্রসঙ্গে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য। মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন :
"إِنَّ اللهَ يَرْضَى لَكُمْ ثَلَاثًا، وَيَكْرَهُ لَكُمْ ثَلَاثًا، فَيَرْضَى لَكُمْ : أَنْ تَعْبُدُوْهُ، وَلَا تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا، وَأَنْ تَعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلَا تَفَرَّقُوْا، وَأَنْ تَنَاصَحُوْا مَنْ وَّلَّاهُ اللهُ اَمْرَكُمْ وَيَكْرَهُ لَكُمْ : قِيْلَ وَقَالَ، وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ، وَإِضَاعَةِ الْمَالِ".
আল্লাহ তা‘আলা তিনটি কাজে সন্তুষ্ট হোন এবং তিনটি কাজে অসন্তুষ্ট হোন। যে তিনটি কাজে তিনি সন্তুষ্ট হোন তার একটি এই যে, তোমরা একমাত্র তারই ‘ইবাদত করবে এবং তার সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করবে না। দ্বিতীয় হচ্ছে এই যে, তোমরা একতাবদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করবে এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না। তৃতীয় হচ্ছে এই যে, তোমরা মুসলিম শাসকগণের সহায়তা করবে। আর যে তিনটি কাজ তার অসন্তুষ্টির কারণ তার একটি হচ্ছে বাজে ও অনর্থক কথা বলা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে অত্যাধিক প্রশ্ন করা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে সম্পদ ধ্বংস করা।[৫]
﴿وَاذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ...﴾
“অতঃপর আল্লাহ স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁর নি‘আমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।”
অজ্ঞতার যুগে ‘আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে খুবই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কঠিন শত্রুতা ছিল। প্রায়ই পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। তারপর গোত্রদ্বয় যখন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়, তখন মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে তারা পূর্বের সবকিছু ভুলে গিয়ে সব এক হয়ে যায়। হিংসা-বিদ্বেষ বিদায় নেয় এবং তারা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যায়। তারা সওয়াবের কাজে একে অপরের সহায়ক হয় এবং মহান আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তারা পরস্পর একতাবদ্ধ হয়ে যায়। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
﴿هُوَ الَّذِىْ أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْمُؤْمِنِيْنَ ۞ وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِىْ الْأَرْضِ جَمِيْعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ وَلَكِنَّ اللهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ﴾
“তিনি তো তাঁর সাহায্য ও মু’মিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের হৃদয়গুলোকে প্রীতির বন্ধনে জুড়ে দিয়েছেন। দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার সবটুকু খরচ করলেও তুমি তাদের অন্তরগুলোকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন জুড়ে দিয়েছেন।”[৬]
আল্লাহ করুণাময় ও দয়াশীল :
﴿وَكُنْتُمْ عَلٰى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ...﴾
“হে মু’মিনগণ! তোমরা একেবারে জাহান্নামের আগুনের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলে এবং তোমাদের কুফ্র ও র্শিকের কারণে তোমাদেরকে এর ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিত।”
যেমন- আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
﴿وَإِنْ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّيْنَ﴾
অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই ইতোপূর্বে তোমরা ছিলে পথহারা।”[৭]
কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ইসলাম গ্রহণের তাওফীক্ব প্রদান করে তোমাদেরকে ঐ আগুন থেকেও বাঁচিয়ে নিয়েছেন।
তাফসীর ইবনু কাসীরে রয়েছে যে, হুনাইনের যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ধর্মীয় মঙ্গলের কথা চিন্তা করে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টন করতে গিয়ে কোনো কোনো লোককে কিছু বেশি প্রদান করেন। তখন আনসারগণের কেউ কেউ গাণীমাতের মালামাল বন্টন করার ব্যাপারে খুশি হতে পারেননি, যদিও মহান আল্লাহর নিকট থেকে প্রিয়নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে যেভাবে বলা হয়েছিল সেভাবেই বন্টন করা হয়েছিল। তখন মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন :
্রيَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ، أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلَّالًا فَهَدَاكُمُ اللهُ بِىْ، وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِيْنَ فَأَلَّفَكُمُ اللهُ بِىْ، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللهُ بِىْগ্ধ كُلَّمَا قَالَ شَيْئًا قَالُوْا : اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمَنُّ.
হে আনসারগণ! আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট পায়নি? তারপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন। আর তোমরা দলে দলে বিভক্ত ছিলে? অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমারই তোমাদের দ্বারা অন্তরে প্রেম-প্রীতি স্থাপন করেন। তোমদেরকে কি দরিদ্র পাইনি? তারপর আল্লাহ তা‘আলা আমারই মাধ্যমে তোমাদেরকে সম্পদশালী করেন। প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলল : আমাদের ওপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়ইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুগ্রহ এর চেয়েও বেশি রয়েছে।[৮]
তাফসীরুল কুরআন বি ক্বালামির রহমান গ্রন্থে আল্লামা সানাউল্লাহ অমৃতসরী (রাহিমাহুল্লা-হ) উপর্যুক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন : “মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে রাসূল করে পাঠানোর মাধ্যমে তোমাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করলেন।”
যেমন- আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন :
﴿لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلٰى الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ﴾
“আল্লাহ ঈমানদারগণের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নাবী পাঠিয়েছেন।”[৯]
কাজেই আল্লাহ আমাদের জন্য নাবী প্রেরণ করে অনুগ্রহ করেছেন। কেননা তিনি করুণাময় ও দয়াশীল।
মহান আল্লাহর দ্বীনের দা‘ওয়াত ও প্রচার আবশ্যক :
﴿وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ...﴾
“আর তোমাদের মধ্যে এরূপ এক সম্প্রদায় হওয়া উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং সৎ কাজে আদেশ করে ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। আর তারাই সুফল প্রাপ্ত হবে।”[১০]
তাফসীরে ইবনু কাসীরে রয়েছে যে, ‘আল্লামাহ যাহ্হাক (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন- “এই দল বা সম্প্রদায়”-এর ভাবার্থ হচ্ছে বিশিষ্ট সাহাবী ও বিশিষ্ট হাদীসের বর্ণনাকারী অর্থাৎ- দ্বীনের মুজাহিদ এবং প্রখ্যাত ‘আলেমগণ। ইমাম আবূ জা‘ফার বাকির (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ আয়াতটি পাঠ করেন। তারপর বলেন- الْخَيْرِ শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে- আল-কুরআন ও হাদীসের অনুসরণ। এটা অবশ্যই স্বরণ রাখার বিষয় যে, প্রত্যেকের ওপরই স্বীয় ক্ষমতা অনুযায়ী সত্যের প্রচার করা অবশ্য কর্তব্য বা র্ফয। কিন্তু তথাপিও একটি বিশেষ দলের এ কাজে লিপ্ত থাকা একান্ত প্রয়োজন।[১১]
এ প্রসঙ্গে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দু’টি হাদীস প্রণিধান যোগ্য। রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন :
্রمَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِগ্ধ.
“তোমাদের মধ্যে যে কেউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, সে যেনো তাকে হাত দ্বারা বাধা দেয়, যদি এতে তার ক্ষমতা না থাকে তাহলে যেনো জিহ্বা অর্থাৎ- কথা দ্বারা বাধা প্রদান করে, যদি এটাও করতে না পারে তাহলে যেনো অন্তর দ্বারা তাকে ঘৃণা করে এবং এটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল ঈমান।”[১২]
অন্য একটি বর্ণনায় এর পরে এও রয়েছে যে, “এর পরে সরিষার বীজ পরিমাণও ঈমান নেই।”
অপর হাদীসে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আরো ইরশাদ করেন :
"وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ، لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ، وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ، أَوْ لَيُوْشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْ عِنْدِهِ، ثُمَّ لَتَدْعُنَّهُ فَلَا يَسْتَجِيْبُ لَكُمْ".
“যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে থাকো। নতুবা সত্বরই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর স্বীয় শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তারপর তোমরা প্রার্থনা করবে কিন্তু তা গৃহীত হবে না।”[১৩]
উপর্যুক্ত আয়াতের তাফসীরে আল্লামাহ সানাউল্লাহ অমৃতসরী (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : “এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কুরআন, হাদীস ও দ্বীন সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে বিজ্ঞ ‘আলেম হবে। যারা ইসলামের পথে মানুষদেরকে আহ্বান জানাবে। অর্থাৎ- সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বারণ করবে। আর পরকালে এরাই সফলকাম হবে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র ইরশাদ করেন :
﴿فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ﴾
“অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই সফলতা লাভ করেছে।”[১৪]
সুতরাং আমাদেরকে মহান আল্লাহর দ্বীনের দা‘ওয়াত ও প্রচার অবশ্যই করতে হবে।
বিভক্ত না হওয়া আল্লাহর নির্দেশ :
﴿وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا...﴾
“আর তাদের মতো হয়ো না যাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে ও পরস্পর মতভেদে লিপ্ত রয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।”[১৫]
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামাহ ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লা-হ) বলেন : তোমরা পূর্ববর্তী লোকদের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি করো না। ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা তোমরা পরিত্যাগ করো না।[১৬]
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে- আবূ ‘আমির ‘আব্দুল্লাহ ইবনু লুহাই (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) বলেন, আমরা মু‘আবিয়াহ্ ইবনু আবূ সুফ্ইয়ান (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু)-এর সাথে হাজ্জ পালন করি। তিনি মক্কায় উপস্থিত হন এবং যোহরের সালাত আদায় করেন। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে বলেন, রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন :
্রوَإِنَّ بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلٰى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِىْ عَلٰى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِىْ النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةًগ্ধ، قَالُوْا : وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ : ্রمَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْগ্ধ.
“বানী ইসরা-ঈল বাহাত্তর ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মাতেরা তিয়াত্তর ফিরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে হতে একটি ফিরকা জান্নাতে যাবে। তাঁরা আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল! ঐ দল (জান্নাতী) কোনটি? তিনি বলেন : ঐ দল তারা যারা আমার এবং আমার সাহাবীগণের আদর্শের ওপর কায়িম থাকবে।[১৭]
অপর হাদীসে মহানাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেন :
্রلَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِىْ ظَاهِرِيْنَ عَلٰى الْحَقِّ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ، حَتّٰى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَগ্ধ.
“ক্বিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মাতের একদল লোক সবসময় হক্বের ওপর কায়িম থাকবে। তাদের যতোই অপমান করা হোক না কেনো তাদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। মহান আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত তারা ঐ অবস্থায় থাকবে।”[১৮]
সুতরাং ইসলামে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকতে হবে। কেননা এতেই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ রয়েছে।
দারস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ-
১. আল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কেননা এর মধ্যেই কল্যাণ ও সফলতা রয়েছে।
২. দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের প্রতিরোধ করতে হবে।
৩. দলে দলে বিভক্ত হওয়া যাবে না। কেননা বিভক্তির পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
৪. সর্বদা মহান আল্লাহকে ভয় করতে হবে এবং কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। আর এ ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহারে বলা যায় যে, সঠিক ইসলামের দা‘ওয়াত ও তাবলীগের গুরু দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কেননা এর মধ্যেই দুনিয়াতে শান্তি ও পরকালে মুক্তি রয়েছে, আর ইসলামী শরী‘আতে দলে দলে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। যারা কুরআন-সুন্নাহ পরিত্যাগ করে দলে দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের জন্য পরকালে কঠোর শাস্তি রয়েছে।
আজ সারা বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের মহামারীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং বহু লোক মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমাদের আবেদন তিনি যেনো আমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দেন এবং করোনা ভাইরাস থেকে মুসলিম মিল্লাতকে হিফাযত করেন -আমীন।
[১] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১০৩-১০৫।
[২] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১১২।
[৩] তাফসীর ইবনু কাসীর- ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং- ৯৬।
[৪] সূরা আল আন‘আম ৬ : ১৫৯।
[৫] সহীহ মুসলিম- হাদীস নং- ৩/১৩৪০, মাকতাবাতুশ্ শামেলা- হাঃ ১০/১৭১৫।
[৬] সূরা আল আনফাল ৮ : ৬২-৬৩।
[৭] সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৯৮। তাফসীরুল কুরআন বি ক্বালামির রহমান (বঙ্গানুবাদ)- ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩২৩।
[৮] সহীহুল বুখারী- মাঃ শাঃ, হাঃ ৪৩৩০।
[৯] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৬৪, তাফসীরুল কুরআন বি ক্বালামির রহমান (বঙ্গানুবাদ)- ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩২৪।
[১০] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১০৪।
[১১] তাফসীর ইবনু কাসীর- ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৯।
[১২] সহীহ মুসলিম- হাঃ ১/৬৯, ৭০, মাঃ শঃ, হাঃ ৭৮/৪৯।
[১৩] আহমাদ- হাঃ ৫/৩৮, মাঃ শাঃ, হাঃ ২৩৩০১; আত্ তিরমিযী- হাঃ ৬/৩৯০, আত্ তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[১৪] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৮৫। তাফসীরুল কুরআন বি ক্বালামির রহমান (বঙ্গানুবাদ)- ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩২৩-৩২৪।
[১৫] সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১০৫।
[১৬] তাফসীর ইবনু কাসীর- ২য় খণ্ড, পৃঃ ১০০।
[১৭] জামি‘ আত্ তিরমিযী- হাঃ ২৬৪১, তাফসীর ইবনু কাসীর- ২য় খণ্ড, পৃঃ ১০০।
[১৮] সহীহ মুসলিম- হাঃ ১৭০/১৯২০।
আপনার মন্তব্য1