সাময়িক প্রসঙ্গ
বন্ধু বা সহপাঠি কেমন হওয়া উচিৎ
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন

وَعَنْ أَبِىْ مُوْسٰى، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ : ্রإِنَّمَا مَثَلُ جَلِيْسِ الصَّالِحِ وَجَلِيْسِ السُّوءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ، فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الْكِيْرِ إِمَّا أَنْ يَحْرِقَ ثِيَابَكَ، وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيْحًا مُنْتِنَةًগ্ধ.
হাদীসের সরল অনুবাদ : “আবূ মূসা আল-আশআরী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই সৎ সহপাঠী ও খারাপ সহপাঠীর দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধি বহনকারী ও হাপরে ফুঁ দানকারীর মতো। সুগন্ধি বহনকারী তোমাকে (সুগন্ধ) উপহার দিবে। অথবা তার কাছ থেকে কিছু কিনে নেবে কিংবা তার কাছ থেকে পবিত্র সুগন্ধ পাবে। পক্ষান্তরে হাপরে ফুঁদানকারী- সে হয়তো তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা তার কাছ থেকে দূর্গন্ধ পাবে।”১
বর্ণনাকারী পরিচিতি : আবূ মূসা আল-আশআরী (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু) একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। তাঁর নাম ‘আব্দুর রহমান ইবনু ক্বায়েস। তিনি আশআরী গোত্রের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন। প্রথমে একাকী ইসলাম গ্রহণ করে নিজ গোত্রে ফিরে যান। অতঃপর খায়বার বিজয়ের পর (ষষ্ঠ হিঃ) গোত্রের ৫০ জন ব্যক্তিসহ মাদীনায় এসে সাহাবীদের কাতারে শামিল হন। নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে ইয়ামানের কোনো কোনো অঞ্চলে দায়ীত্বশীল হিসেবে প্রেরণ করেন। এ ধারাবাহিকতায় ‘উমার (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) আযহার ও স্পেনে এবং ‘উসমান (রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্ হু) কুফা নগরীতে গভর্ণর করে তাকে প্রেরণ করেন। খ্যাতিমান এ সাহাবী ৬৩ বৎসর বয়সে ৪২ হিঃ ইন্তেকাল করেন।২
 হাদীসের বিষয়বস্তু : সাথী বা সহপাঠীর প্রভাব স্বভাবপ্রসূত। ভাল সাথীর সু-প্রভাব অপরকে ভাল পথে আহ্বান জানায়। আর খারাপ সঙ্গীর কু-প্রভাব অপরিণাম দর্শিতার দিকে ডেকে নেয়।
 বিশেষ বিশেষ পরিভাষা :
 جَلِيْسِ الصَّالِحِ (জালীসুস স্বালেহ) : অর্থ : সৎ সঙ্গী। এখানে সৎ সঙ্গী বলতে এমন বন্ধু উদ্দেশ্য, যে সম্মানিত ও মর্যাদাবান চরিত্রের অধিকারী। এক কথায় মু’মিন-মুত্তাকী বান্দাহ।
وَجَلِيْسِ السُّوءِ (জালীসুস সু’ই) : খারাপ সঙ্গী। এখানে এমন খারাপ বন্ধু উদ্দেশ্য যার চারিত্রিক বিপর্যয় ঘটে অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছে। এক কথায় ফাসেক ফাজের ও নিশাগ্রস্ত ব্যক্তি, যার নিকট থেকে কোন কল্যাণ আশা করা যায় না।
  حَامِلِ الْمِسْكِ(হা-মিলুল মিস্ক) : অর্থ : সুগন্ধ বহনকারী। এখানে সু-গন্ধি বা আতর বিক্রেতা উদ্দেশ্য।
نَافِخِ الْكِيرِ (না-ফিখুল ক্বীর) : অর্থ লোহার হাপর দ্বারা ফুঁ দানকারী। এখানে কামার উদ্দেশ্য। যে হাপরের সাহায্যে লোহার আগুনে ফুঁ দিয়ে প্রজ্জ্বলিত করে থাকে।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : আল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনন্য বৈশিষ্ট হলো চমৎকার উদাহরণ পেশ করা। এখানে মহানাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সঙ্গী বা সাথী নির্বাচনে কোন গুণ ও বৈশিষ্ট বিচারে নিয়ে আসা উচিৎ, সে বিষয়ে সহজবোধ্য একটি উদাহরণ পেশ করে উম্মাতকে বুঝিয়েছেন। আদর্শ মুসলিম ব্যক্তিকে সাথী বানালে সৎ স্বভাবের প্রভাব পড়বে। কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা থাকবে না। যেমন- একজন আতর বিক্রেতার সাথে চললে নূন্যতম সু-ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
পক্ষান্তরে চরিত্রহীন অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তির সাথে চললে কখনো তার কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করা যায় না। উপরন্তু অসৎ লোকের সঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীবন বিপন্ন হওয়ার সমূহসম্ভাবনা থাকে। সে জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অসৎ সঙ্গকে কামারের হাপর দ্বারা লোহায় ফুঁক দেয়ার সাথে তুলনা করেছেন। কামারের কাছে বসলে পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় কিংবা ছুটে আসা ফুলকি নিজের কাপড় জ্বালিয়ে দেয়। অর্থাৎ- খারাপ লোকের কাছে কিছুই আশা করা যাবে না; বরং আসলটুকু হারিয়ে সর্বসান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
০১. সামাজিক দর্পনে : আমরা এ হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তব প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবো যে, বন্ধু বা সহপাঠির প্রভাবে পুরো সমাজ ব্যবস্থা সংক্রামিত হয়েছে। মাদকাসক্তদের সাথে চলে যুব সমাজ মাদক ও নেশাজাত দ্রব্য পান ও ভক্ষণ করছে। বাদ্য-বাদকদের সাথে মিশে গান-বাজনায় লিপ্ত হচ্ছে। আড্ডাবাজদের সাথে চলে বেহুদা সময় নষ্ট করছে এবং পরিবারের উপর এ ধরনের সন্তান বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার মোবাইল আসক্তি যাদের পেয়েছে, তারাতো রীতিমত যেন অন্যজগতের মানুষ রূপে বেড়ে উঠছে এবং ভারসাম্যহীন জীবন-যাপন করছে। অপর দিকে প্রেমাসক্তি যুব সমাজকে উম্মাদ করে তোলছে। ফলে পরকীয়া প্রেমের মতো ন্যাক্কারজনক পাপ পারিবারিক বন্ধনকে তছনছ করে ফেলছে। এ সব অবক্ষয় কি অসৎ সহপাঠির কু-প্রভাব নয়?
০২. ‘আক্বীদাহ্গত বিচ্যুতি : ‘আক্বীদাহ্ ও ঈমান একজন মানুষের নৈতিকভিত্তি। এ মূলভিতও নড়বড়ে হয়ে পড়ছে বন্ধুদের কু-প্রভাবে। দেখা যায়- যুবকরা সহপাঠির সাথে চলতে গিয়ে নিজ ‘আক্বীদাহ্-ঈমানের স্বাতন্ত্রতা ভুলতে বসেছে। মুসলিম দাবী করেও অমুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে নিজের অজান্তে কুফুরী করে বসছে। মূর্তিপুজা, ফুল বা অর্গ ভক্তি, মঙ্গল যাত্রা, রথ যাত্রা, সন্যাসী মেলা, শিখা অনির্বাণ নামে অগ্নি পুজা ও ভালোবাসা দিবসের নামে খৃষ্টবাদের দীক্ষা  নেওয়া ইত্যাদি কুফুরী কর্ম-কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে ঈমান হারা হচ্ছে।
০৩. সৎ ও ন্যায়পরায়ণ সঙ্গ : ‘আলেম ও শিক্ষাবিদদের ছোঁয়ায় জ্ঞানার্জনের প্রতি উদ্ভুদ্ধ হতে দেখা যায়। মাতা-পিতা সালাত আদায়কারী ও কুরআন তিলাওয়াতে অভ্যস্থ থাকলে সন্তানও সালাত আদায়কারী দীনদার হচ্ছে। ফলে তারা যথাসাধ্য পাপমুক্ত পবিত্র জীবন-যাপন করছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা মর্যাদাবান অনুসরণীয় আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। এ সব কি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ সহপাঠির সু-প্রভাব নয়?
সহপাঠির প্রভাবের ফলাফল :
ক) যারা খারাপ ও অসৎ সঙ্গী দ্বারা যারা প্রভাবিত হচ্ছে, তারা নৈতিক ও সামাজিকভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। উপরন্তু কারো কারো বেলায় ঈমান হীনতার সংস্কৃতিও দেখা দিচ্ছে। এ দের পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
্রمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْগ্ধ.
“যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে, সে তাদের একজন বলে গন্য হবে।”৩
অপর বর্ণনায় রয়েছে-
্রالرَّجُلُ عَلٰى دِيْنِ خَلِيْلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُগ্ধ.
“ব্যক্তি তার সহপাঠির দীন দ্বারা প্রভাবিত হয়। কাজেই তোমাদের দেখে নিতে হবে, সে কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছে।”৪
খ) ভালো ও ন্যায়পরায়ণ সহপাঠির দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তি সৎ পথ পায় এবং নি‘আমত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জান্নাত বাসী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُوْلَئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيْقًا ۝ ذٰلِكَ الْفَضْلُ مِنَ اللهِ وَكَفَى بِاللهِ عَلِيْمًا﴾
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তার রাসূলের আনুগত্য করবে, সেসব লোকেরা নাবী, সিদ্দিক্ব, শহীদ ও সৎকর্মশীল নি‘আমত প্রাপ্তদের সাথী হবে, এরাই সর্বোত্তম সঙ্গী। এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ এবং আল্লাহর জ্ঞানই যথেষ্ট।”৫
দারসের শিক্ষাসমূহ-
১.    রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিজ্ঞোচিত বক্তব্য তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের বলিষ্ঠ প্রমাণ।
২.    মানুষ তার সঙ্গী বা সাথী দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৩.    সঙ্গী বা সাথী নির্বাচনে সতর্ক হওয়া বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।
৪.    সন্তানেরা কোন্ আদর্শের লোকদের সাথে উঠাবসা করে তা পর্যবেক্ষণ করা উচিৎ।
৫.    যথাযথ উপমা বক্তব্যের যৌক্তিকতার ও উপস্থাপনা শৈলীর বহিঃপ্রকাশ।
উপসংহার : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি সুন্দর ও বোধগম্য উদাহরণ দিয়ে সহপাঠির প্রভাব সম্পর্কে সু-স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। তার পরও আমরা বেখায়াল আছি। অভিভাবক নিজ দায়িত্ব হতে অনেক দূরে। ফলে ছেলে-মেয়েরা খারাস সহপাঠি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অকর্মন্য ও জাতির উপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অশুভ গ্রাস থেকে বাঁচতে ও সমাজকে বাঁচাতে হলে সর্বস্তরের অভিভাবকদেরকে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের তাওফীক্ব দিন -আমীন। ###


১. বুখারী ও মুসলিম, গৃহীত ফাতহুল মুন‘ঈম- ১০/১২৭, ৫৪৫০৬, আবূ ই‘য়ালা- ৭৩০৭।
২. কিতাবুস্ সুন্নাহ- পৃঃ ২২৪, ইমাম আয্-যাহাবী “সিয়ারু আলাম আননুবালা- পৃঃ ৩৮১।
৩. ইরওয়া- হা/১২৬৯ ও সুনান আবূ দাঊদ- হা/৪০৩১ (সহীহ)।
৪. সহীহুল জামি‘আ- হা/৩৫৪৫, সুনান আত্ তিরমিযী- হা/২৪৯৭ (সহীহ)।
৫. আল-কুরআন : সূরা আন্ নিসা/৬৯ ও ৭০।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত