‘আলেমগণ কি নাবীদের পক্ষ থেকে কেবল দ্বীনী ইল্মের উত্তরাধিকারী?
আরাফাত ডেস্ক : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “‘আলেমগণ নাবীগণের উত্তরসূরি” -এ হাদীসদ্বারা বুঝা যায় যে, ‘আলেমগণ নাবী (‘আলাইহিস্ সালাম)-গণের ‘ইল্মের উত্তরসূরি। এখন প্রশ্ন হলো, ‘আলেমগণ কি কেবল দ্বীনী ‘ইল্মের উত্তরসূরি না-কি অন্যান্য ‘ইল্মও এর অন্তর্ভুক্ত।
এ বিষয়ে জানতে প্রথমে আমরা “‘আলেমগণ নাবীগণের উত্তরসূরি” -এ সংক্রান্ত পূর্ণ হাদীসটি দেখব। তারপর এ সংশ্লিষ্ট আরও কতিপয় আয়াত ও হাদীস তুলে ধরে মুহাদ্দিসগণের ব্যাখ্যার আলোকে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব -ইন্শা-আল্লাহ। পূর্ণ হাদীসটি নিম্নরূপ-
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন :
مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيْقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِيْ السَّمَوَاتِ، وَمَنْ فِيْ الْأَرْضِ، حَتّٰى الْحِيْتَانُ فِيْ جَوْفِ الْمَاءِ، وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلٰى الْعَابِدِ، كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلٰى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا، وَلَا دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوْا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ.
“যে (আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে) ‘ইল্ম তথা জ্ঞান অর্জনের জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে আল্লাহ্ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেন। ফেরেশ্তাগণ ‘ইল্ম অন্বেষণকারীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার পায়ের নিচে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। একজন ‘ইল্ম অন্বেষণকারীর জন্য আসমান জমিনে যা কিছু আছে সবাই ক্ষমা প্রার্থনা ও দু‘আ করে; এমনকি পানির মধ্যকার মাছও।
আর একজন ‘আলেমের মর্যাদা একজন সাধারণ আবেদ (‘ইবাদতকারী)-এর তুলনায় পূর্ণিমা রাতে সমস্ত নক্ষত্ররাজির তুলনায় চাঁদের মতো। ‘আলেমগণ নাবীদের উত্তরসূরি। নাবীগণ উত্তরাধিকারী সম্পদ হিসেবে দিনার-দিরহাম তথা অর্থ-সম্পদ রেখে যান না; বরং তারা উত্তরাধিকারী সম্পদ হিসেবে রেখে গেছেন ‘ইল্ম। যে সেটাকে গ্রহণ করল সে যেন পূর্ণ অংশকেই গ্রহণ করল।
ব্যাখ্যা : নাবীদের দায়িত্ব ছিল, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ওয়াহীর জ্ঞানকে মানুষের মাঝে প্রচার করা। ‘আলেমগণ সেই ওয়াহীর জ্ঞানেরই ধারক ও বাহক। এই দৃষ্টিতে তাদেরকে নাবীদের উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায়, ‘আলেমগণ নাবীদের রেখে যাওয়া দ্বীন বা শরী‘আতের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী; সাধারণ দুনিয়াবী জ্ঞানের নয়। তাদের দায়িত্ব নাবীদের সেই ‘ইল্মে শরী‘আতকে মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া। ‘আলেমদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ۗ﴾
“আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই (যারা দ্বীনী বিষয়ে জ্ঞানী) কেবল তাঁকে ভয় করে।”
মুফাসসিরগণ-এর ব্যাখ্যায় বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যতো বেশি জ্ঞানার্জন করবে সে ততো বেশি তাঁকে ভয় করবে। আর যে যতো বেশি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করতে পারবে, সে ততো বেশি তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করে ধন্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ذٰلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ﴾
“আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট। এটা (পূর্বোল্লিখিত পুরস্কার) তার জন্য যে তার রবকে ভয় করেছে।”
জ্ঞানের সাথে আল্লাহভীতির সম্পর্ক রয়েছে। নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন :
إِنَّ أَتْقَاكُمْ وَأَعْلَمَكُمْ بِاللهِ أَنَا.
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক তাক্বওয়াসম্পন্ন এবং আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী হলাম আমি।”
দীনের জ্ঞান সম্পর্কে নাবী (সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন :
مَنْ يُرِدْ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِيْ الدِّيْنِ.
“আল্লাহ তা‘আলা যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।”
উপরোক্ত আয়াত, হাদীস ও ‘আলেমদের বক্তব্যের আলোকে প্রতিয়মান হয় যে, নাবীগণ ওয়াহীর জ্ঞান বিতরণ করেছেন এবং তা উত্তরাধিকার সম্পদ হিসেবে রেখে গেছেন। আর যুগ পরম্পরায় সাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, মুজতাহিদ, ইমাম, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির এবং ফকিহগণ সকলেই ছিলেন সেই ‘ইল্মে ওয়াহী তথা শরী‘আতের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।
তবে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দুনিয়া পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেছেন। সে আলোকে তারা মেডিকেল, সাইন্স, টেকনোলোজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশুনা করে, আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিবৈচিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে, মানব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করে এবং দুনিয়াবি উপকারে সেগুলো কাজে লাগায়। এগুলো মানুষ সময়ের প্রয়োজনেই করে। ইসলাম মানুষকে এ সব দুনিয়াবি উপকারী বিষয়ে জ্ঞানার্জন, গবেষণা, সৃষ্টি জগতের রহস্য উন্মোচন, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারকে বাধা দেয় না বরং এসবের প্রতি উৎসাহিত করে, কিন্তু তা হতে হবে বিশ্বচরাচরের একচ্ছত্র সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি মহান আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে; তার বিরুদ্ধাচরণ করে নয়।
তাহলে মানুষ দুনিয়াতে যেমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের অধিকারী হবে তমনি আখিরাতেও পাবে অনন্ত চিরসুখের নীড় জান্নাত। আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক্ব দান করুন -আমীন। ###
0
আপনার মন্তব্য1