রাসূলুল্লাহ (ﷺ)—এর অমীয় বাণী
عَنْ جَرِيرٍ عَنِ النَّبِيِّ (ﷺ) : مِنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ.
সরল বাংলা অনুবাদ
জারীর (রা.) নবী (ﷺ) হতে বর্ণনা
তিনি (রা.) বলেছেন, যাকে নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়, যেন তাকে পুণ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বর্ণনাকারীর পরিচয়
নাম : জারীর। উপনাম : আবূ আমের। পিতার নাম : ‘আব্দুল্লাহ। তিনি ইয়েমেনের বাজালী গোত্রের নেতা, তাই তাঁকে বাজালী বলা হয়। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর ইউসুফ বলে পরিচিত। তার বংশধারা : জারীর ইবনু ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জাবির ইবনুল মালেক ইবনু নসর ইবনে সালাবা ইবনুল জাশান ইবনু আওফ ইবনে খুযাইমাহ্ ইবনুল হারব ইবনে ‘আলী আল বাজালী। তাঁর ইসলাম গ্রহণের সময় নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যথা-
ক. আল্লামা আইনী (র.) বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের চল্লিশ দিন পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। জারীর নিজের মুখে এ ধরনের বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন-
اسْلَمْتُ قَبْلَ مَوْتِ النّبي (ﷺ) بِاَرْبَعِيْنَ يَوْمًا.
অর্থাৎ-আমি রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের চল্লিশ দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছি।
খ. আল্লামা আইনী (ﷺ)-এর দ্বিতীয় মত হলোÑ তিনি দশম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
গ. ওয়াকেদী (রা.) বলেন, রাসূল ( ﷺ)-এর ইন্তেকালের সাত মাস পূর্বে রমাযান মাসে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
জারীর ইসলাম গ্রহণ করার জন্য এলে তার সম্মানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চাদর বিছিয়ে দেন। তাঁর চমৎকার রূপ সৌন্দর্যের জন্য ‘উমার (রা.) তাঁকে উম্মতে মুহাম্মাদীর ইউসুফ বলে আখ্যায়িত করেন।
মক্কা বিজয়ের পর ইয়েমেনের মুশরিকদের বিখ্যাত মন্দির “যুল হুলায়ফা” ভেঙে ফেলার জন্য জারীরকে পাঠানো হলে তিনি ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে এ মন্দিরটি জ্বালিয়ে দেন। ‘উমার (রা)’র খিলাফত কালে ইয়ারমুক অভিযানে তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও পালন করেন। ‘উসমান ( )’র আমলে তিনি হামদানের গভর্নর নিযুক্ত হন। উষ্ট্রের যুদ্ধের পর ‘আলী (রা.)-এর বাইয়াত সংবলিত পত্র জারীরের মাধ্যমে সিরিয়ায় মু‘আবিয়াহ্ (রা.)’র নিকট প্রেরণ করা হয়। মু‘আবিয়াহ্ বাইয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে এতে ‘আলী (রা.)—এর অনুসারীগণ জারীরকে অযথা সন্দেহ করে বসে। তিনি বেদনাহত অন্তরে কিরকিসিয়ায় চলে যান। জারীর ( ) সর্বমোট ১০০টি হাদীস বর্ণনা করেন। এর মধ্যে ৮টি মুত্তাফাক ‘আলাইহি এবং ১টি ইমাম বুখারী ও ৭টি ইমাম মুসলিম (র.) এককভাবে বর্ণনা করেন। তিনি ৫১ হিজরি মতান্তরে ৫৪ হিজরিতে কিরকিসিয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা
বিনয় ও নম্রতা মানুষের চরিত্রে এমন এক অলংকার যা মহান আল্লাহর নিকট প্রিয়। মানুষের মাঝে অনন্য মর্যাদা প্রদান করে এ বিনয়। এটা উত্তম চরিত্রের ভূষণ। যার মূর্ত প্রতীক হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর সম্মানিত সাহাবীগণ। বিনয় ও নম্রতা দ্বারাই তারা মানুষকে আপন করে নেয়। নম্র ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা যেমন ভালোবাসেন মানুষও তাকে পছন্দ করেন। যে মহান আল্লাহর উদ্দেশে নম্র হয় আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। বিনয় ও ন¤্রতার বিপরীত শব্দ হলো কঠোরতা, অহঙ্কার ইত্যাদি। ইবনু ‘আত্বা (রা.) বলেন,
هو قبول الحق ممن كان العز في التواضع، فمن طلبه في الكبر فهو كطلب الماء من النار.
‘যে কোনো ব্যক্তি থেকে সত্যকে গ্রহণ করা। সম্মান হলো নম্রতায়। যে ব্যক্তি অহঙ্কারে তা তালাশ করবে, তা হবে আগুন থেকে পানি তালাশতুল্য।’
সুফিয়ান সাওরী (র.) তাঁর শিষ্যদের বলেন,
(أتدرون ما الرفق) قالوا : قل يا أبا محمد! قال : أن تضع الأمور في مواضعها : الشدة في موضعها، واللين في موضعه، والسيف في موضعه، والسوط في موضعه.
‘তোমরা কি জানো নম্রতা কি ? তারা বলল, আপনি বলুন, হে আবূ মুহাম্মাদ! তিনি বললেন, প্রত্যেক বিষয়কে যথাস্থানে রাখা। কঠোরতাকে সস্থানে, নম্রতাকে তার স্থানে, তরবারীকে যথাস্থানে, চাবুককে তার স্থানে রাখা।’ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (রা) বলেছেন,
رَأْسُ التَّوَاضُعِ أَنْ تَضَعَ نَفْسَكَ عِنْدَ مَنْ هُوَ دُوْنَكَ فِيْ نِعْمَةِ الدُّنْيَا، حَتَّى تُعْلِمَهُ أَنْ لَيْسَ لَكَ بِدُنْيَاكَ عَلَيْهِ فَضْلٌ، وَأَنْ تَرْفَعَ نَفْسَكَ عَمَّنْ هُوَ فَوْقَكَ فِيْ نِعْمَةِ الدُّنْيَا، حَتّٰى تُعْلِمَهُ أَنَّهُ لَيْسَ لَهُ بِدُنْيَاهُ عَلَيْكَ فَضْلٌ.
‘বিনয় ও ন¤্রতার মূল হলো, তুমি তোমার দুনিয়ার নিয়ামতের ক্ষেত্রে নিজেকে তোমার নীচের স্তরের লোকদের সাথে রাখো, যাতে তুমি তাকে বুঝাতে পার যে, তোমার দুনিয়া নিয়ে তুমি তার চেয়ে মর্যাদাবান নও। আর নিজেকে উঁচু করে দেখাবে তোমার চেয়ে দুনিয়াবী নিয়ামত নিয়ে উঁচু ব্যক্তির নিকট, যাতে তুমি তাকে বুঝাতে পার যে, দুনিয়া নিয়ে সে তোমার ওপর মর্যাদাবান নয়।’
মানুষের সাথে অহঙ্কারবশত কথা না বলে বিনয়ের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা উচিত : আল্লাহ বলেন,
﴿وَ لَا تُجَادِلُوْۤا اَهْلَ الْكِتٰبِ اِلَّا بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ اِلَّا الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا مِنْهُمْ وَ قُوْلُوْۤا اٰمَنَّا بِالَّذِیْۤ اُنْزِلَ اِلَیْنَا وَ اُنْزِلَ اِلَیْکُمْ وَ اِلٰـهُنَا وَ اِلٰـهُکُمْ وَاحِدٌ وَّ نَحْنُ لَہٗ مُسْلِمُوْنَ﴾
“তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী এবং বলো, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।”
দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি করা ন¤্রতার লক্ষণ হতে পারেন না : আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ
﴿لَاۤ اِکْرَاهَ فِی الدِّیْنِ ۟ۙ قَدْ تَّبَیَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَیِّ ۚ فَمَنْ یَّکْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَ یُؤْمِنْۢ بِاللّٰهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَۃِ الْوُثْقٰی لَا انْفِصَامَ لَهَا ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ﴾
দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। বিভ্রান্তি হতে সুপথ প্রকাশিত হয়ে গেছে। সুতরাং যে তাগূতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত রশি ধারণ করল যা কখনো ছিঁড়বে না। আল্লাহ তা‘আলা শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।”
শরিয়তে ন¤্রতা ও বিনয়ের মাপকাঠি হলো, ইল্ম অন্বেষণকারী শিক্ষার্থীর অজ্ঞ ও মূর্খ ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে ন¤্রতা ও ভদ্রতা অবলম্বন করা। যে বিষয়ে শ্রোতাকে সংক্ষেপে বোঝানো সম্ভব নয়, সে বিষয় ত্যাগ করা এবং অজানা বিষয় নিয়ে আলোচনা না করা। যে বিষয় শ্রোতা কিংবা প্রশ্নকারী জ্ঞাত নয়, সে বিষয়ে ন¤্রতা ও ভদ্রতার সঙ্গে বুঝানো কর্তব্য। কঠোরতা কিংবা অহঙ্কার প্রদর্শন করা যাবে না।
মানুষের সাথে ন¤্রভাবেই চলতে হবে; বরং কাউকে গালি না দেয়া উচিত : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَ لَا تَسُبُّوا الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ فَیَسُبُّوا اللّٰهَ عَدْوًۢا بِغَیْرِ عِلْمٍ ؕ كَذٰلِكَ زَیَّنَّا لِکُلِّ اُمَّۃٍ عَمَلَهُمْ ۪ ثُمَّ اِلٰی رَبِّهِمْ مَّرْجِعُهُمْ فَیُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ﴾
“আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে; এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি; অতঃপর তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” তিনি আরো বলেন,
﴿قُلْ یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ تَعَالَوْا اِلٰی كَلِمَۃٍ سَوَآءٍۢ بَیْنَنَا وَ بَیْنَکُمْ اَلَّا نَعْبُدَ اِلَّا اللّٰهَ وَ لَا نُشْرِكَ بِہٖ شَیْئًا وَّ لَا یَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ ؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوا اشْهَدُوْا بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ﴾
“বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা আসো এমন একটি কালেমার দিকে যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে সমান তা হলো, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ‘ইবাদত করব না এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করব না এবং আল্লাহ ব্যতীত আমাদের কেউ অপর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবে না। এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম।”
সহনশীল ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর রহমত। জাবির ইবনু ‘আব্দুল্লাহ ( ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ( ) বলেন,
رَحِمَ اللهُ رَجُلًا سَمْحًا اِذَا بَاعَ وَاِذَا اشْتَرَى وَاِذَا اقْتَضَى.
“আল্লাহ এক সহনশীল ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, যে ক্রয়—বিক্রয় ও নিজের অধিকার আদায়ের সময় ন¤্রতা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে।”
মানুষের সাথে সহনশীলতার নীতি অবলম্বন করে চলা : হাদীসে এসেছে,
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ () اَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّ لِىْ قَرَابَةً اَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُوْنِىْ وَاُحْسِنُ اِلَيْهِمْ وَيُسِيْئُوْنَ اِلَىَّ وَاَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُوْنَ عَلَىَّ فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَاَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللهِ ظَهِيْرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَىٰ ذٰلِكَ.
আবূ হুরাইরাহ্ ( ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : এক ব্যক্তি (এসে) বলল : হে আল্লাহর রাসূল ( )! আমার কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। যাদের সাথে আমি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চলি, আর তারা (আত্মীয়তা) ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি, আর তারা আমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে। আমি তাদের সাথে সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করে চলি, কিন্তু তারা আমার সাথে মূর্খের মতো আচরণ করে। (তাহলে আমি এখন কী করব?) রাসূলে করীম ( ) বললেন : যদি তুমি এরূপই হয়ে থাকো যেরূপ তুমি বললে, তবে যেনো তুমি তাদের চোখে—মুখে গরম বালি ছুড়ে মারছ। (অর্থাৎ— তোমার সহিষ্ণুতা তাদের জন্য চোখে—মুখে গরম বালি ছুড়ে মারার মতোই) যতক্ষণ তুমি এ নীতির ওপর অবিচল থাকবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এক সাহায্যকারী (ফেরেশ্তা) তাদের মুকাবিলায় তোমাকে সাহায্য করে যেতে থাকবে।
জাহান্নামের আগুন ন¤্র স্বভাববিশিষ্ট লোকদের জন্য হারাম : ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ ( ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ( ) বলেছেনÑ
اَلَا اُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَىَ النَّارِ اَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ عَىٰ كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ سَهْلٍ.
আমি কি তোমাদের অবহিত করব না কোন লোক জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম অথবা (বলেছেন) কার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম? (তাহলে শুনো) জাহান্নামের আগুন এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য হারাম যে লোকদের কাছে বা তাদের সাথে মিলেমিশে থাকে। যে কোমলমতি, নরম মেজাজ ও ন¤্র স্বভাববিশিষ্ট।
মহান আল্লাহর রাসূল ( )—এর বিনয় ও ন¤্রতার কথা কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন। আপনি যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার কাছ থেকে সরে পড়তো।
অহঙ্কার ত্যাগ করে বিনয় ও ন¤্রতাকে আপন করে নেওয়া সর্বাত্মক জরুরি। প্রতিটি আচরণে ও উচ্চারণে বিনয় মু’মিনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মহানবী ( )—এর জীবনাচার ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তিনি অত্যন্ত ন¤্র, বিনয়ী ও নিরহংকার ছিলেন। দম্ভ, অহঙ্কার ও আত্মগরিমার লেশমাত্র তার মাঝে ছিল না। বিনয় ও ন¤্রতা অবলম্বন করার কারণে নবাগন্তুকের জন্য তাকে চেনা কষ্টকর হতো।
عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ، وَأَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَا : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ (ﷺ) يَجْلِسُ بَيْنَ ظَهْرَيْ أَصْحَابِهِ، فَيَجِيْءُ الْغَرِيْبُ فَلَا يَدْرِيْ أَيُّهُمْ هُوَ حَتّٰى يَسْأَلَ، فَطَلَبْنَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ (ﷺ) أَنْ نَجْعَلَ لَهُ مَجْلِسًا يَعْرِفُهُ الْغَرِيبُ إِذَا أَتَاهُ، قَالَ : فَبَنَيْنَا لَهُ دُكَّانًا مِنْ طِيْنٍ، فَجَلَسَ عَلَيْهِ، وَكُنَّا نَجْلِسُ بِجَنْبَتَيْهِ، وَذَكَرَ نَحْوَ هَذَا الْخَبَرِ، فَأَقْبَلَ رَجُلٌ فَذَكَرَ هَيْئَتَهُ، حَتّٰى سَلَّمَ مِنْ طَرَفِ السِّمَاطِ، فَقَالَ : السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا مُحَمَّدُ قَالَ : فَرَدَّ عَلَيْهِ النَّبِيُّ (ﷺ).
আবূ যার ( ) ও আবূ হুরাইরাহ্ ( ) সূত্রে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ ( ) এসে সাধারণত সাহাবীদের মধ্যেই বসতেন। ফলে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি আসলে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত বলতে পারতেন না যে, কোন ব্যক্তিটি নবী ( )। অতএব আমরা রাসূলুল্লাহ ( )—এর নিকট আবেদন করলাম যে, আমরা তাঁর জন্য একটা বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট করব যেন আগন্তুকরা দেখেই তাঁকে চিনতে পারে।
বর্ণনাকারী বলেন, সুতরাং আমরা তাঁর জন্য মাটি দিয়ে একটি বসার স্থান বানালাম এবং তিনি তার ওপর বসলেন আর আমরা তাঁর নিকটে বসলাম। অতঃপর বর্ণনাকারী অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে উপস্থিত হলো। বর্ণনাকারী তার দৈহিক গঠনেরও বর্ণনা দিলেন। সে উপস্থিত জনতার এক প্রান্ত থেকে সালাম দিলো। সে বললো, হে মুহাম্মাদ! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। বর্ণনাকারী বলেন, নবী ( ) তাঁর সালামের জবাব দিলেন।
أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ، قَالَ قَامَ أَعْرَابِيٌّ فَبَالَ فِيْ الْمَسْجِدِ فَتَنَاوَلَهُ النَّاسُ، فَقَالَ لَهُمُ النَّبِيُّ (ﷺ) "دَعُوْهُ وَهَرِيْقُوْا عَلٰى بَوْلِهِ سَجْلًا مِنْ مَاءٍ، أَوْ ذَنُوْبًا مِنْ مَاءٍ، فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِيْنَ، وَلَمْ تُبْعَثُوْا مُعَسِّرِيْنَ".
আবূ হুরাইরাহ্ ( ) বলেন, একবার একজন বেদুঈন দাঁড়িয়ে মসজিদে পেশাব করল। তখন লোকেরা তাকে বাধা দিতে গেলে নবী ( ) তাদের বলেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং ওর পেশাবের ওপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদের কোমল ও সুন্দর আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, রূঢ় আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়নি।
কারো সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করলেই সম্মান বেড়ে যায় না। অন্যকে সম্মান করলে, ন¤্র আচরণ করলে মর্যাদা কমে যায় না; বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় কেউ মানুষের সঙ্গে ন¤্র আচরণ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আবূ হুরাইরাহ্ ( ) থেকে বর্ণিত, রাসূল ( ) বলেছেন, ‘সাদাক্বাহ্ করাতে সম্পদের হ্রাস হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তা‘আলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর কেউ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা সমুন্নত করে দেন।’
এর বিপরীতে অহঙ্কার, রূঢ় স্বভাব মানুষের ব্যক্তিত্ব খাটো করে দেয়, মানুষকে ইহকালে অন্যদের চোখে নিন্দিত করে তোলে, আর পরকালে তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেয়।
عَنْ حَارِثَةَ بْنَ وَهْبٍ الْخُزَاعِيَّ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ (ﷺ) يَقُوْلُ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيْفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ.
হারিস ইবনু ওয়াহাব খুজা‘ঈ ( ) বলেন, আমি নবী ( )—কে বলতে শুনেছি, আমি কি তোমাদের জান্নাতি লোকদের পরিচয় বলব না? তারা দুর্বল ও অসহায়; কিন্তু তাঁরা যদি কোনো ব্যাপারে আল্লাহর নামে কসম করে বসেন, তাহলে তা পূরণ করে দেন। আমি কি তোমাদের জাহান্নামি লোকদের পরিচয় বলব না? তারা রূঢ় স্বভাব, অধিক মোটা ও অহঙ্কারী তারাই জাহান্নামি।
উপসংহার
বিনয় ও ন¤্রতা শুধু একটি নৈতিক গুণ নয় এটি একজন মু’মিনের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ তা‘আলা বিনয়ী বান্দাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। অহঙ্কারীকে অপমানিত করেন। আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ ( )—এর জীবন থেকে এই গুণ শিখে নিজেদের জীবনকে বিনয়ী এবং ন¤্রতার আদর্শে গড়ে তোলা।
মুসলিম— হা. ২৫৯২; মিশকা-তুল মাসা-বীহ-হা. ৫০৬৯।
মাদারিজুস সালেকীন-হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযিইয়া, (বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৪১৬/১৯৯৬), ২/৩১৪ পৃ.।
ফায়যুল কাদীর-৪/৭৩ পৃ.।
আত্ তওয়াযু ওয়াল খামূল— আবূ বক্র ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনে আবিদ দুনিয়া, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪০৯/১৯৮৯), পৃ. ১৬৫।
সূরা আল-‘আনকাবূত : ৪৬।
সূরা আল-বাক্বারাহ্ : ২৫৬।
সূরা আল-আন‘আম : ১০৮।
সূরা আ-লি ‘ইমরান : ৬৪।
সহীহুল বুখারী-৩/২০৭৬।
সহীহ মুসলিম-৪/২৫৫৮।
জামে‘ আত্ তিরমিযী-হা. ৩৬৪।
সূরা আ-লি ‘ইমরান : ১৫৯।
সুনান আবূ দাঊদ-হা. ৪৬৯৮।
সহীহুল বুখারী-হা. ২২০।
সহীহ মুসলিম-হা. ৬৪৮৬।
সহীহুল বুখারী-হা. ৪৯১৮।
আপনার মন্তব্য1