আধুনিক সভ্যতার বাহন সংবাদপত্র। আঠারো শতকে ইউরোপে আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাংবাদিকতার সূচনা হয়। বাংলা সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয় ১৮১৮ সালে ‘বাঙ্গাল গেজেট’, ‘দিকদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। অপরদিকে ইসলামী সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ১৯০৩ সালে ‘মাসিক মুহাম্মদী’ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালে মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, সুসাহিত্যিক, দার্শনিক ও প্রাজ্ঞ আলেম আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী (রহিমাহুল্লাহ্) সাপ্তাহিক আরাফাত পত্রিকার সূচনা করেন এবং এ সাপ্তাহিকীর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অবশ্য সাপ্তাহিক আরাফাত প্রকাশের আগে তিনি ১৯৪৯ সালে ‘মাসিক তর্জুমানুল হাদীস’ এবং তারও আগে ১৯২৪ সালে ‘সাপ্তাহিক সত্যাগ্রহী’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রকাশনা কার্যক্রম করেন। কিন্তু দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অন্য পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা মাঝপথে থেমে গেলেও মহান আল্লাহর অসীম কৃপায় আজও সাপ্তাহিক আরাফাত-এর প্রকাশনা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত আছে। হয়ত কখনো কখনো প্রতিকূল প্রেক্ষাপটে দেরিতে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। এ গৌরব কেবল এদেশের আহলে হাদীস পরিবারের সদস্যদের নয়; বরং এটি গোটা প্রকাশনা জগতের গৌরব, সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সম্মান।
১৯৬০ সালে আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী (রহিমাহুল্লাহ্) ইহধান ত্যাগ করেন। এরপর স্বাধীনতা পূর্ব অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম- কিন্তু সাপ্তাহিক আরাফাত পাহাড়সম প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে প্রভাকরের ন্যায় নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্যোতির্ময় করেছে বাংলার আকাশকে। আলোকিত হয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। নেপথ্যে যিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় আদর্শিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল বারী (রহিমাহুল্লাহ্)। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অন্যতম কিংবদন্তী আব্দুর রহমান বিএবিটি (রহিমাহুল্লাহ্)। এরপর বহু সময় অতিবাহিত হয়েছে। কাগুজে পত্রিকার পাশাপাশি রেডিও-টেলিভিশন মিডিয়াজগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। সময়ের পালাবদলে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট। মানুষ এখন কাগুজে পত্রিকা ছেড়ে অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে।
এই তো একবিংশ শতকের প্রথম দশকেও সংবাদপত্রের কি রমরমা ব্যাবসা। সূর্যোদয়ের আগে হকাররা ভিড় জমাতেন পত্রিকার এজেন্সি অফিসগুলোতে। তারপর নিজস্ব স্টাইলে প্রসেসিং করে সকাল ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা। প্রত্যেক হকারের পৃথক পৃথক লেন বা এরিয়া ছিল। একজনের অন্যজনের এরিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এ থেকেই বুঝা যায় যে, পত্রিকা হকারদের ব্যবসায় কতটা পেশাদারিত্ব ছিল।
এদিকে শহরের বাসিন্দাগণ বিশেষ করে পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতেন, কখন হকার তার পছন্দের সংবাদপত্রটি দরজার নীচ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে কড়া নেড়ে বলবে, ‘পেপার পেপার’। অফিসগামী বাসেও গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত অন্তত ৪/৫জন হকার উঠে পেপার পেপার বলে হাঁকতেন। এছাড়াও রাস্তার মোড়ে মোড়ে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার পসরা সাজিয়ে বসতেন হকাররা। এখন এসব দৃশ্য স্মৃতির পাতায় বন্দি। সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে দু-একজনের পত্রিকা পড়ার নেশা থাকলেও তা গণনা করার মতো নয়। দৈনিক সংবাদপত্র মাঝে মাঝে চোখে পড়লেও সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহে সাপ্তাহিক আরাফাত এখনো স্বমহিমায় ভাস্বর। নিরন্তর প্রকাশনার আজ ৬৫তম বছর পূর্ণ হলো- ফালিল্লাহিল হামদ।
আমরা সকলেই জানি, মূলত কাগুজে পত্রিকার সমাধি রচনা করেছে মুঠোফোন। প্রযুক্তি নির্ভর মানুষ এখন আর কাগুজে পত্রিকায় চোখ বোলাতে চায় না। নিউজ পোর্টালে ঢুকে পছন্দ মতো পত্রিকা পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুই বদলে যায়। তারাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে যারা সময়ের সাথে নিজেকে বদলাতে পারে। এ কথা অকপটে স্বীকার করছি- কিছু প্রতিকূলতার কারণে সাপ্তাহিক আরাফাত এখনো কাঙ্ক্ষিত অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠেনি। তবে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইন্শা-আল্লাহ। সকলের সার্বিক সহযোগিতা আমাদের পথচলাকে আরো মসৃণ করবে।
পঁয়ষট্টি বর্ষের বিদায়লগ্নে লেখক পাঠক শুভানুধ্যায়ী ও কলাকুশলীসহ সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাই এবং সূচনালগ্ন থেকে যাঁরা খিদমত আঞ্জাম দিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের প্রতি রহম করুন এবং জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন -আমীন।
আপনার মন্তব্য1