আমরা আজ প্রকৃত মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতার চেয়ে জাগতিক ঐশ্বর্য কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের লড়াইয়ে ব্যস্ত। আমাদের কাছে মনুষ্যত্ব তুচ্ছ। মানবাধিকারের কথা যতই আমরা বলি, সেটা কেবল বলা, লেখা, প্লা-কার্ড, ফেস্টুন বা স্টিকার স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকে। কখনো বা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা ও কবিতা আবৃতি কিংবা প্রবন্ধ পাঠের গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকে। মানবতার কোনো চর্চা প্রায়োগিক জগতে পরিলক্ষিত হয় না। মনে হয় যেন জগতের চাকচিক্যের মিছিলে মানবতাবোধ হারিয়ে গেছে। নির্জন নিভৃতে শুধু অশ্রম্ন ঝরাচ্ছে মাত্র। মানবতা ও নৈতিকতার স্লোগান যেন প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে অবশ্যই মানবতার মহান সম্রাট বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে; তা না হলে কোনোভাবেই মানুষের মাঝে প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হবে না। প্রিয় নবী (সা.) পরিবারের মধ্যে প্রকৃত মানবতাবোধের চর্চা করে উম্মতকে নির্দেশনা দিয়েছেন এ মর্মে যে, “তামাদের মাঝে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবারের মাঝে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারে উত্তম।”
সন্তানদের প্রতি ইনসাফের নির্দেশনা দিয়ে প্রকৃত মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি বলেন, “তোমরা মহান আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তানের মাঝে সমতা বিধান করো।” সামাজিকভাবে সর্বত্র মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে বলেন: “ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! তোমাদের কেউ ততক্ষণ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।” ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দিয়ে তিনি আরো বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর উপরে ইহসান ফর্য করেছেন। যখন তোমরা কোনো প্রাণী জবাই করবে, তাতে ইহসান করো। আর যখন লড়াই করবে, সেখানে ইহসান করবে। তোমাদের কেউ যখন কোনো প্রাণী জবাই করতে যায়, সে যেন তার ছুরি ধারালো করে নেয়।”
প্রিয় নবী (সা.) বিনা কারণে গাছপালা কাটতে নিষেধ করেছেন। প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, আল্লাহর কসম সে ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম সে ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম সে ঈমানদার নয়। সাহাবা (রা.)-গণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কে সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, যার অনিষ্ট হতে প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।” অপর বর্ণনায় এসেছে, তিনি (সা.) বলেন: তোমাদের কেউ যখন রান্নাবান্না করে, তখন সে যেন একটু জুল বেশি দেয় যাতে সে তার প্রতিবেশীকে কিছু দিতে পারে।” এমনকি যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রতিবেশীকে দেয় না, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিচার দিবস অস্বীকারকারীরূপে আখ্যায়িত করেছেন।
এসব নির্দেশনা যদি আমরা কাজে-কর্মে বাস্তবায়ন করতাম, তাহলে আমাদের জন্য ইনসাফ নীতি-নৈতিকতা ও মানবতাবোধ শিখতে অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হতো না। আজ যারা মানবতার ফেরি করে, তারাই সামান্য স্বার্থের জন্য মানবতার কন্ঠরোধ করে। তাদের হাতেই মানুষ ও মনুষ্যত্ব নিষ্পেষিত হয়। পৃথিবীতে সর্বত্র যে হাহাকার, নৈরাজ্য, বিপর্যয় ও পেশীশক্তির বলয় দেখছি, তা তথাকথিত ওই মানবতাবাদীদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে।
সুতরাং শুধু কথায় মানবতার জাগরণ নয়; বরং তখনই ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে সাম্য মৈত্রী এবং ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা মহান আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করব এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষ মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে সুন্দর সুখী সমৃদ্ধ পরিবার সমাজ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করব। যদি আমরা এভাবে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে এবং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়-ইনসাফের সঠিক চর্চা করি এবং প্রতিটি কাজের পূর্বে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করি, আমি যা করছি তা-কি কুরআন-হাদীস সম্মত হচ্ছে, আমার কাজ ও আমার জবান কাউকে তো কষ্ট দিচ্ছে না, আমিতো প্রতিবেশীর হক্ব নষ্ট করছি না-এভাবে একজন মানুষ আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে সত্যিকারের ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে পারে। আর তখনই আমাদের সমাজ সুখ ও সমৃদ্ধির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে এবং আমরা মানুষ হিসাবে শ্রেষ্ঠ জাতির খেতাব পেয়ে ইহ ও পরকালে ধন্য হবো। নতুবা প্রতারণা প্রবঞ্চনা অধিকার বিনষ্ট করা ও যাকে সম্মান দেওয়ার তা না করার কারণে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হব আর মনুষ্যত্ব ও মানবতা নিভৃতে অশ্রম্ন ঝরাবে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সুবুদ্ধির উদয় দান করুন, সত্যিকারের মানুষ হওয়ার তাওফীক্ব দিন -আমিন।
আপনার মন্তব্য1