সাময়িক প্রসঙ্গ
নবী নূহ্ (আ.)-এর নৌকা ও উপহাসকারীদের পরিণাম
আবূ সা‘আদ আব্দুল মোমেন বিন আব্দুস্ সামাদ

আল্লাহ তা‘আলার বাণী

وَاصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا وَلَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِیْ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ ۝ وَیَصۡنَعُ الۡفُلۡکَ ۟ وَکُلَّمَا مَرَّ عَلَیۡهِ مَلَاٌ مِّنۡ قَوۡمِهٖ سَخِرُوۡا مِنۡهُ ؕ قَالَ اِنۡ تَسۡخَرُوۡا مِنَّا فَاِنَّا نَسۡخَرُ مِنۡکُمۡ کَمَا تَسۡخَرُوۡنَ ۝ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ۙ مَنۡ یَّاۡتِیۡهِ عَذَابٌ یُّخۡزِیۡهِ وَ یَحِلُّ عَلَیۡهِ عَذَابٌ مُّقِیۡمٌ

সরল বাংলায় আনুবাদ

“আর তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার নির্দেশ অনুসরণ করে নৌকা তৈরি করো, আর যারা বাড়াবাড়ি করছে তাদের ব্যাপারে আমার কাছে তুমি কোনো আবেদন করো না, তাদেরকে অবশ্যই পানিতে নিমজ্জিত করা হবে। অতএব সে নৌকা তৈরি করতে লাগল, যখনই তার জাতির কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার পাশ দিয়ে যেত তখন তারা তাকে নিয়ে উপহাস করত। সে বলল, তোমরা যেমন আমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করছ একদিন আমরাও তোমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করব। সুতরাং শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে যে, কোনো ব্যক্তির উপর এমন শাস্তি আসবে, যে তাকে লাঞ্ছিত করে দিবে এবং তার উপর আপতিত হবে চিরস্থায়ী শাস্তি।” 

শাব্দিক অনুবাদ

وَ অর্থ-এবং/আর, اصۡنَعِ শব্দটি, واحد مذكر امر حاضر معرف অর্থ-আপনি তৈরি করুন, الۡفُلۡکَ অর্থ-ফ্ল্যাক/নৌকা, بِاَعۡیُنِنَا অর্থ-আমার চোখের সামনে, وَ অর্থ-এবং, وَحۡیِنَا অর্থ-আমার ওহীর অনুসরণ করে, لَا تُخَاطِبۡنِیۡ শব্দটি, واحد مذكر نهى حاضر معرف অর্থ-আপনি আমার কাছে কোনো আবেদন করবেন না, فِی অর্থ-মধ্যে/ব্যাপারে, الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا অর্থ-যারা যুলুম করেছে, اِنَّهُمۡ অর্থ-নিশ্চয় তারা, مُّغۡرَقُوۡنَ অর্থ-তারা ডুবে গেছে, کُلَّمَا অর্থ-যখনই, مَرَّ عَلَیۡهِ অর্থ-সে তার পাশ দিয়ে যেত, مَلَاٌ مِّنۡ قَوۡمِهٖ অর্থ-তার গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি, سَخِرُوۡا مِنۡهُ অর্থ-তারা তাকে উপহাস করত, قَالَ অর্থ-সে বলল, اِنۡ শব্দটি حرف شرط অর্থ-যদি, تَسۡخَرُوۡا অর্থ-তারা মজা করে, مِنَّا অর্থ-আমাদের নিয়ে, فَاِنَّا نَسۡخَرُ অর্থ-তার প্রতিদানে আমরাও উপহাস করব, مِنۡکُمۡ অর্থ-তোমাদের ব্যাপারে, کَمَا অর্থ-যেমনিভাবে, تَسۡخَرُوۡنَ অর্থ-তোমরা আমাকে নিয়ে উপহাস করো, فَسَوۡفَ অর্থ-অতঃপর অচিরেই, تَعۡلَمُوۡنَ অর্থ-তোমরা জানবে, مَنۡ یَّاۡتِیۡهِ অর্থ-যে ব্যক্তির উপর আসবে, عَذَابٌ অর্থ-শাস্তি, یُّخۡزِیۡهِ অর্থ-সে তাকে অপমান করবে,  وَ অর্থ-এবং/আর, یَحِلُّ عَلَیۡهِ অর্থ-এটা তার জন্য হালাল/বৈধ, عَذَابٌ مُّقِیۡمٌ অর্থ-চিরস্থায়ী শাস্তি।

বিষয়বস্তু ও অবতরণের প্রেক্ষাপট

সূরা হূদে বর্ণিত উপর্যুক্ত তিনটি আয়াতে প্লাবন পূর্ববর্তী সময়ে প্রস্তুতিস্বরূপ নবী নূহ্ (আ.)-এর নৌকা নির্মাণের নাতিদীর্ঘ ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আল-কুরআনুল কারীমের বাকরীতি অনুযায়ী কেবল প্রয়োজনীয় কথাগুলোই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাদীসে এসেছে- আবূ বকর (রা.) নবী (আ.)-কে বললেন : আমি দেখছি আপনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন এর কারণ কি? জবাবে নবী (আ.) বললেন : সূরা হূদ ও তারই মতো বিষয়বস্তু সম্বলিত সূরাগুলো আমাকে বুড়ো করে দিয়েছে।

এ হাদীসে থেকে বুঝা যায়, এ সূরাগুলোতে যে বিষয়বস্তুসমূহ আলোচিত হয়েছে তা অত্যন্ত ভীতিপ্রদ। জাতিকে সতর্ক করার জন্য ক্বওমে নূহ্, ক্বওমে লূত, ‘আদ, সামুদ, মাদায়েনবাসী ও ফিরআউন সম্প্রদায়ের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। এ ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট করে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো হলোÑ আল্লাহ যখন কোনো বিষয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা করতে উদ্যত হন তখন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ পদ্ধতিতেই মীমাংসা করেন। সে সময়ে কাউকে সামান্যতমও ছাড় দেওয়া হয় না। তখন দেখা হয় না কে কার আত্মীয় কে কার পুত্র কিংবা কে কার পত্নী। এহেন অবস্থায় বংশ ও রক্ত সম্বন্ধের প্রতি সামান্যতম পক্ষপাতিত্বও ইসলামের প্রাণসত্তার সম্পর্ক বিরোধী।

এ সূরার আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে এ কথা উপলব্ধি করা যায় যে, এ সূরাটি সূরা ইউনূসের সমসময়ে নাযিল হয়েছে। এমনকি তার অব্যবহিত পরেই যদি অবতীর্ণ হয়ে থাকে তবে তাও বিচিত্র নয়। কারণ মূল বক্তব্য একই।

আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীর

وَاصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا

“আর তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার নির্দেশ অনুসরণ করে নৌকা তৈরি করো।”

بِاَعۡیُنِنَا (আমার চোখের সামনে) আয়াতের এ অংশে আল্লাহ তা‘আলার সিফাত “চক্ষু”র প্রমাণ রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ্ও তাই। 

সুতরাং কোনো উদাহরণ বা সদৃশ বর্ণনা না করে এর উপর ঈমান আনা সকল মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। وَ وَحۡیِنَا (ও আমার নির্দেশ অনুসরণ করে)-এর অর্থ হলো- তুমি যে নৌকাটি তৈরি করবে তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ইত্যাদি আমার নির্দেশ অনুসরণ করে, যেভাবে আমি বলব ঠিক সেভাবেই তৈরি করো। এ কথা ধারণা করা মোটেও অমূলক নয় যে, সেই নৌকাটি তৈরি করতে নবী নূহ্ (আ.)-এর বহুদিন সময় লেগেছিল। কাব আল-আহবারের এক বর্ণনাতে পাওয়া যায় নবী নূহ্ (আ.) ত্রিশ বছর সময় ধরে নৌকাটি নির্মাণ করেন।  কিন্তু কাব-এর অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় নৌকাটি তৈরিতে চল্লিশ বছর সময় লেগেছিল।  মুজাহিদের বর্ণনামতে তিন বছরে নৌকার নির্মাণকর্ম সমাপ্ত হয়। ইবনু ‘আব্বাস (রা.) হতে একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, দুই বছরে তিনি নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন।  এ মতটিই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। নৌকাটি অবশ্যই বিরাট আয়তনের ছিল। যাতে মানুষ ও পশু-পাখি পৃথকভাবে থাকতে পারে। কোনো কোনো তাফসীরবিদ উক্ত স্থানে নৌকাটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ, তলা এবং তাতে কি ধরনের কাঠ ও অন্যান্য আসবাবপত্র লাগানো হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। যেমন-কেউ বলেছেন, নৌকাটি গফর কাঠ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। যাতে তিনটি ডেক এবং অন্তঃস্থ প্রকোষ্ঠ ছিল। আর বাইরে পিচ দেওয়া ছিল। এটি ৪৫০ ফুট লম্বা, ৭৫ ফুট চওড়া এবং ৪৫ ফুট উচু। এর প্রবেশপথ ছিল একদিকে। ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক তাওরাতের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, নৌকাটি সেগুন কাঠ দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। ওর দৈর্ঘ্য ছিল আশি হাত এবং প্রস্ত ছিল পঞ্চাশ হাত। ভিতর ও বাইরে আলকাতরা মাখানো হয়েছিল। নৌকাটি যাতে পানি ফেড়ে চলতে পারে তাতে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। কারো কারো মতে নৌকাটি দেবদারু কাঠ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।  ক্বাতাদাহ্ (রা.)’র উক্তি নৌকাটির দৈর্ঘ্য ছিল তিনশ’ হাত। ইবনু ‘আব্বাস (রা.) বলেন যে, এর দৈর্ঘ্য ছিল বারোশ’ হাত এবং প্রস্ত ছিল ছয়শ’ হাত। এমন একটি উক্তিও আছে যে, নৌকাটির দৈর্ঘ্য ছিল দু’হাজার হাত এবং প্রস্ত ছিল একশ’ হাত।  এ বর্ণনাগুলো নির্ভরযোগ্য প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় মূলত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে নেওয়া হয়েছে। এর সঠিক জ্ঞান মহান আল্লাহর নিকটই আছে। আয়াতের এ অংশ থেকে অনেক মুফাস্সিরই আবার এটা বুঝেছেন যে, নূহ্ (আ.)-ই সর্বপ্রথম নৌকা তৈরি করেছিলেন । এর পূর্বে নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণাদি ও নির্মাণ কৌশল মানবজাতীর জ্ঞানের অগোচরেই ছিল। এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা ইরশাদ করেছেনÑ “আর তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার নির্দেশ অনুসরণ করে নৌকা তৈরি করো।” নৌকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ ও নির্মাণ কৌশল জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা নবী নূহ্ (আ.)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। এভাবে ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। অতঃপর যুগে যুগে তার উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। আধুনিক বিশ্ব সভ্যতা যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে।

وَلَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ

“আর যারা বাড়াবাড়ি করছে তাদের ব্যাপারে আমার কাছে তুমি কোনো আবেদন করো না, তাদেরকে অবশ্যই পানিতে নিমজ্জিত করা হবে।”

অর্থাৎ-নবী নূহ্ (আ.)-এর জাতি ছিল বড়ই অবাধ্য। কুফ্রীতে তারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। তাই নবী নূহ্ (আ.) আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাদের জন্য বদ দু‘আ করে বলেছিলেন- “হে আমার প্রতিপালক! যমীনের কাফিরদের মধ্য থেকে কোনো গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিবেন না, আপনি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা আপনার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুষ্কৃতিকারী ও কাফির।” 

নবী নূহ্ (আ.)-এর এই বদ দু‘আ আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কবূল করলেন। উক্ত আয়াতাংশে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা তাদের শোচনীয় পরিণতির কথা উল্লেখ করে বললেনÑতাদেরকে অবশ্যই পানিতে ডুবিয়ে মারা হবে। সুতরাং আপনি তাদের কারো জন্য ক্ষমা চাইবেন না। তাদের কাউকে ক্ষমা করতে বলবেন না। তারা তাদের অর্জিত কুফ্রীর কারণেই পানিতে ডুবে মরবে। 

এ থেকে বুঝা যায়, ক্বওমের যারা মু’মিন ছিল না তাদের সকলের জন্যই এই নির্মম পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাদের জন্য অবকাশ বা অব্যাহতি চাওয়ার কোনো সুযোগও আর নেই। কারণ এখন তাদের ধ্বংসের সময় এসে গেছে। অথবা তাদের ধ্বংসের জন্য তাড়াতাড়ি করো না, নির্ধারিত সময়েই তারা ডুবে শেষ হয়ে যাবে। 

অনেকে মনে করেন, পরিবার ও যারা ঈমান এনেছেন তাদের ব্যতীত নবী নূহ্ (আ.)-এর পুরো জাতি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। নবী নূহ্ (আ.)-এর পরিবারের ঈমানদারদেরকে আল্লাহ তা‘আলা পরবর্তী মানব বংশ বিস্তারের জন্য মনোনীত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- “নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে, নূহ্কে ও ইব্রাহীমের বংশধর এবং ‘ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করেছেন। এরা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” 

অনেকে যালেম বলতে নূহ্ (আ.)-এর পুত্র এবং তার স্ত্রীকে বুঝেছেন, কারণ তারা মু’মিন ছিল না। নূহ্ (আ.)-এর পরিবার পরিজনের মধ্য থেকে তার ছেলে ‘ইয়াম’, যার ডাকনাম ছিল কেন‘আন এবং কেন‘আনের মা ইলা‘ এ দু‘জন পৃথক থাকে এবং তারা দু‘জনও পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। 

কেউ কেউ মনে করেন পবিত্র কুরআনুল কারীমে যেহেতু নূহ্পু-ত্রের নিমজ্জিত হওয়ার বর্ণনা থাকলেও নবী নূহ্ (আ.)-এর স্ত্রীর নিমজ্জিত হওয়ার উল্লেখ নেই। কেননা, তার পূর্বেই সে মারা গিয়েছিল। 

তবে সে যে কাফির ছিল এটি সুস্পষ্ট। কারণ কুরআনুল কারীমে তার কুফ্রীর কথা ও জাহান্নামে প্রবেশের কথা সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে।

وَیَصۡنَعُ الۡفُلۡکَ ۟ وَکُلَّمَا مَرَّ عَلَیۡهِ مَلَاٌ مِّنۡ قَوۡمِهٖ سَخِرُوۡا مِنۡهُ

“অতএব সে নৌকা তৈরি করতে লাগল, যখনই তার জাতির কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার পাশ দিয়ে যেত তখন তারা তাকে নিয়ে উপহাস করত।”

অর্থাৎ-এ আয়াতে নৌকা তৈরিকালীন সময়ে নূহ্ (আ.)-এর ক্বওমের উদাসীনতা গাফিলতি ও দুঃসাহস এবং এর শোচনীয় পরিণতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবী নূহ্ (আ.) যখন নৌকা নির্মাণকার্যে ব্যস্ত ছিলেন তখন তার পাশ দিয়ে পথ অতিক্রমকালে ক্বওমের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে জিজ্ঞেস করত আপনি কি করছেন? তিনি উত্তর দিতেন অনতিবিলম্বে এক মহাপ্লাবন হবে তাই নৌকা তৈরি করছি। তখন তারা ঠাট্টা করে বলত, হে নূহ্! আপনি তো আগে নিজেকে নবী বলতেন, এখন কি তাহলে কাঠমিস্ত্রি হয়ে গেলেন। আর হঁ্যা, আপনি ডাঙ্গাতে এই নৌকা কীভাবে চালাবেন? এভাবে তারা নানারকম উপহাস করত।  নদীবিহীন মরু এলাকায় বিনা কারণে নৌকা তৈরি করাকে ক্বওমের বিশিষ্টজনেরা পণ্ডশ্রম ও নিছক পাগলামি বলে মনে করত। তারা তাকে মিথ্যাবাদি মনে করত। তিনি তাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখিয়েছিলেন তা তারা মোটেই বিশ্বাস করেনি। তাই তারা চলতে, ফিরতে, উঠতে, বসতে এরূপ ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। কেউ কেউ বলতÑ আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষগণের কালে এরকম কিছু ঘটেছে একথা কখনো শুনিনি। এতো এমন লোক যাকে উন্মত্ততা পেয়ে বসেছে; সুতরাং তোমরা তার সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা করো।

قَالَ اِنۡ تَسۡخَرُوۡا مِنَّا فَاِنَّا نَسۡخَرُ مِنۡکُمۡ کَمَا تَسۡخَرُوۡنَ

“সে বলল, তোমরা যেমন আমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করছ একদিন আমরাও তোমাদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করব।”

অর্থাৎ-ক্বওমের বিশিষ্টজনদের এমন নির্লজ্জ মিথ্যাচার, ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাসের প্রেক্ষিতে নবী নূহ্ (আ.) বললেন- যদিও আজ তোমরা আমাদেরকে নিয়ে উপহাস করছ কিন্তু মনে রেখ! সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন মহান আল্লাহর শাস্তি তোমাদের পাকড়াও করবে, তখন আমরাও কিন্তু তোমাদের নিয়ে উপহাস করব। অর্থাৎ-তোমরাও তখন কিন্তু উপহাসের পাত্র হবে। কাউকে উপহাস করলে কেমন লাগে তখন তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে।

فَسَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ۙ مَنۡ یَّاۡتِیۡهِ عَذَابٌ یُّخۡزِیۡهِ وَ یَحِلُّ عَلَیۡهِ عَذَابٌ مُّقِیۡمٌ

“সুতরাং শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে যে, কোন ব্যক্তির উপর এমন শাস্তি আসবে, যে তাকে লাঞ্ছিত করে দিবে এবং তার উপর আপতিত হবে চিরস্থায়ী শাস্তি।”

অর্থাৎ-দীর্ঘ দিন ধরে নবী নূহ্ (আ.)-এর নৌকা তৈরি শেষ হওয়ার পরেই মহান আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা নেমে আসবে। মহান আল্লাহর সে চূড়ান্ত ফয়সালা ছিল “তুফান” (অর্থাৎ-মহাপ্লাবন) আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বলেন, “অতঃপর তাদেরকে ‘তুফান’ (অর্থাৎ-মহাপ্লাবন) গ্রাস করেছিল। আর তারা ছিল অত্যাচারী।”  সহজ-সরল ও প্রকাশ্য অর্থ অনুযায়ী ইরাকের মুসেল নগরীতে অবস্থিত নূহ্ (আ.)-এর পারিবারিক চুলা থেকে পানি উথলে বের হওয়ার আলামতের মাধ্যমেই নূহ্ (আ.)-এর আমলের এই তুফানের সূচনা হয়। অর্থাৎ-এটি ছিল “তুফান” (মহাপ্লাবন) এর প্রাথমিক আলামত। “তুফান” অর্থ-যেকোনো বস্তুর অত্যাধিক্য। এই প্লাবনকে “তুফান” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে পানির আধিক্যের কারণে, যা সে সময়ে সব কিছুকে ডুবিয়ে দিয়েছিল। ভূ-তলে উত্থিত পানি ছাড়াও তার সাথে যুক্ত হয়েছিল অবিরাম ধারে আকাশবন্যা। যেমন-আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তখন আমি প্রবল বারিপাতের মাধ্যমে আকাশের দুয়ারসমূহ খুলে দিলাম এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম নদীসমূহকে। অতঃপর উভয় পানি মিলিত হলো একটি পূর্ব নির্ধারিত (অর্থাৎ-ডুবিয়ে মারার) কাজে।” অতঃপর এই মহাপ্লাবন এক বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে। এই সময়ে এই পানির কোনো কোনো ঢেউ পাহাড়ের চূড়া হতেও উঁচু হয়ে উঠে। যে কারণে নূহ্—পুত্র ‘ইয়াম’ অন্য নাম কেন‘আন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পায়নি। এই “তুফান”এর আলামত প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে নবী নূহ্ (আ.)-কে নির্দেশ দেওয়া হলো তার পরিবারসহ ঈমানদার নর-নারীকে নৌকায় তুলে নিতে। যাদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। এর সঠিক সংখ্যা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করা হয়নি। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ জন পুরুষ ও চল্লিশজন নারী মোট আশিজন। এই আশিজন পরবর্তীতে যে স্থানে বসতি স্থাপন করেন সে স্থান ‘সামানূন’ (আশি) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আর বাকী সবাই দুনিয়ায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অপমানজনক শাস্তি পেয়ে এই প্লাবনে ধ্বংস হয়েছে। আর তাদের উপর রয়েছে পরকালে জাহান্নামের চিরস্থায়ী শাস্তি! যা কখনো দূর হবার নয়।

শিক্ষা

এ আয়াতত্রয় থেকে নিম্নের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।

এক. পৃথিবীর প্রত্যেক কারিগরি জ্ঞানই ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। পরবর্তীতে যা মানব কল্যাণে দিক-বিদিক ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঐশী জ্ঞানের উপরেই আধুনিক বিশ্বসভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

দুই. অপরাধীরা যখন অপরাধের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে যায়। তখন তাদের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। আর মহান স্রষ্ঠার পক্ষ থেকে শাস্তির ফয়সালা হয়ে গেলে তা থেকে বাঁচানোর জন্য নবীগণকেও দু‘আ-সুপারিশ করার সুযোগ দেওয়া হয় না।

তিন. যারা ঐশী কোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাদেরকেও আল্লাহ তা‘আলা ছাড় দেন না। কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করেন। এ শাস্তি দুনিয়াতেও তাদেরকে পাকড়াও করে। আর পরকালে চিরস্থায়ী শাস্তি তো তাদের জন্য অপেক্ষা করছেই। 


প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, জা’মেআ দারুল ক্বোরআন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

[১] সূরা হূদ : ৩৭-৩৯।

[২] মাজমু ফাতাওয়া-৫/৯০।

[৩] তাফসীরুল মাযহারী-সানাউল্লাহ পানীপতি, খণ্ড-৫, পৃ. ৮৫।

[৪] রূহুল মাআনী-আল-আলুসী, খণ্ড-১২, পৃ. ৫০।

[৫] আত-তাফসীরুল মাযহারী-খণ্ড-৫, পৃ. ৮৪।

[৬] আল-বিদায়া-প্রথম খণ্ড, ১১০ পৃ.।

[৭] তাফসীর ইবনু কাসীর-দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৬।

[৮] আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর।

[৯] সূরা নূহ্ : ২৬-২৭।

[১০] তাফসীরে তাবারী।

[১১] তাফসীরে ফাতহুল কাদীর।

[১২] সূরা আ-লি ‘ইমরান : ৩৩-৩৪।

[১৩] সংক্ষিপ্ত তাফসীরে ‘উসমানী-পৃ. ৪৭২।

[১৪] তাফসীর ইবনু কাসীর।

[১৫] তাফসীরে ফাতহুল কাদীর।

[১৬] সূরা আল ‘আনকাবূত : ১৪।

[১৭] তাফসীরে কুরতুবী।

[১৮] সূরা আল ক্বামার : ১১।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত