সাময়িক প্রসঙ্গ
বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদ : কারণ ও প্রতিকার
সাইফুল্লাহ্ ত্রিশালী

বিবাহ শব্দটি সুন্দর, আকর্ষণীয়, লোভনীয়, কারও মুখে শুনলে রোমাঞ্চ জাগে। কে বিয়ে করছে, কার বিয়ে ? কেমন জানি অদৃশ্য একরকম ভালো লাগা কাজ করে অবিবাহিতদের মনে। আবার বিবাহিতদের মনে অন্য রকম অনুভূতি। বিয়ে নিয়ে ইয়ে’র যেন শেষ নেই। মজাটাও এখন আর আগের মতো নেই। একটা সময় শুনতাম, বিয়ে যে কত্ত মজা খালি খাওন আর খাওন। এখন বিয়ে হয় শর্টকাটে। হঠাৎ কারও ব্যাপকভাবে। বিয়ে হয় মোবাইল ফোনে, মহাকাশে, সমুদ্রের নিচে। যে ভাবেই হোক সুখের পরশটা স্থায়ী হয়না। শুরুটা হয় জমকালো। শেষটা হয় ভীষণ কালো। অল্পতেই ভেঙ্গে যায় পবিত্র সম্পর্ক। যে বিবাহ বন্ধন জীবনটাকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আগমন করে, সে বন্ধন কেন যেন হতাশ হয়ে প্রস্থান করে। কালবৈশাখীর মতো সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে যায়। কিন্তু কেন? 

বিবাহ বিচ্ছেদ কেন বাড়ছে

লোকে বলে সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে। তাহলে কি দুঃখের হয় পুরুষের গুণে ? একেবারেই না। সুখ-দুঃখের সাথী স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। সমস্যাটা হলো, শয়তান যার উপর বিজয়ী হয় সে নিজেকে সাধু মনে করে। প্রতিপক্ষকে দোষী মনে করে। স্বামী স্ত্রীকে, কখনো স্ত্রী স্বামীকে দোষী মনে করে। ব্যস, বিচ্ছেদ শুরু।

বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিবাহ বিচ্ছেদের কিছু যথোপযুক্ত কারণ রয়েছে। যেমন-

পরকীয়া সম্পর্ক (এটিকে সবাই প্রধান সমস্যা মনে করে)

পরকীয়া (ইংরেজি : Adultery বা Extramarital affair Extramarital sex) হলো বিবাহিত কোনো ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহোত্তর বা বিবাহ বহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক। Cambridge Dictionary-তে বলা আছে, sex between a married man or women and someone he or she is not married to. পরকীয়া ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। এটি বর্তমানে মহামারির মতো ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে রূপ নিয়েেছে। পরকীয়া মানবতা বিরোধী একটি কাজ। বিকৃত মানসিকতার কাজ। সুস্থ মস্তিস্কের কোন নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হতে পারে না।

নিষিদ্ধ কাজ জেনেও মানুষ কেন পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে?

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। কারো মধ্যে যদি ডিআরডিফোর জিনের উপস্থিতি বেশি হয়, তাদেরও পরকীয়ার মতো বাড়তি সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা থাকতে পারে। সাইকোলজিস্ট ইশরাত জাহান বিথী বলেন, পরকীয়ার পেছনে জড়ানোর একটি বড় কারণ হলো শূন্যতা। তবে সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিদদের মতে আরও কিছু কারণ সু¯পষ্ট। যেমন— স্বামী—স্ত্রীর চাহিদা পূূরণ না হওয়া* দু’জনের মধ্যে একজনের যৌন সমস্যা* দীর্ঘদিন সন্তান না হওয়া* অতিরিক্ত আর্থিক সমস্যা থাকলে* স্বামী বিদেশ গেলে বা দীর্ঘদিন কাছে না থাকলে* স্বামী বা স্ত্রীর কেউ নেশাগ্রস্ত হলে* মানুষের কান কথা শুনে একে অপরের প্রতি সন্দিহান হলে* অতিরিক্ত টাকা বা বিলাসিতার লোভ থাকলে ইত্যাদি কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়াতে পারে। ইসলাম এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর সতর্কবাণী ও শাস্তি ঘোষণা করেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেন,

وَلَا تَقْرَبُوْا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيْلًا

“তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।” ৫৫

পরকীয়ার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الزَّانِيَةُ وَالزَّانِيْ فَاجْلِدُوْا

“ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে একশ ঘা করে বেত্রাঘাত করো।” ৫৬

পরকীয়ার ফাঁদে আটকা পড়ে আত্মহনন করছেন অসংখ্য নারী পুরুষ। বলি হচ্ছেন নিরপরাধ স্বামী, স্ত্রী অথবা সন্তান। পরকীয়ার পথে বাধা হওয়ায় নিজ সন্তানকেও নির্মমভাবে হত্যা করছে মমতাময়ী মা। তাইতো একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোন নারীর পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। মহান আল্লাহর বাণী হলো,

“হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য কোনো স্ত্রীলোকদের মতো নও, যদি তোমরা ধর্মভীরুতা অবলম্বন কর তবে কথাবার্তায় তোমরা কোমল হয়ো না, পাছে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়, আর তোমরা বলো উত্তম কথাবার্তা।”

শুধু নারীদেরই নয়; বরং সূরা আন্ নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে ৩১ নং আয়াতে মহিলাদেরকে তাদের দৃষ্টি সংযত ও গোপন শোভা অনাবৃত করতেও নিষেধ করেছেন।

সাহ্ল ইবনু সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল () বলেন, যে ব্যক্তি মুখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের জামিনদার হবে আমি তার বেহেশতের জামিনদার হবো। ৫৭

ইসলাম দেবরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার লাগামকেও টেনে ধরেছে। ‘উক্ববাহ্ ইবনু ‘আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ () বলেনÑসাবধান, তোমরা নির্জনে নারীদের কাছে যেও না। এক আনসার সাহাবি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? নবীজী () বললেন, ‘ দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য।’ ৫৮

কীভাবে বুঝবেন আপনার সঙ্গী পরকীয়ায় জড়িত

এ ব্যাপারে সুধী মহল থেকে কিছু ধারণা এ রকম এসেছে যে,

ক. সঙ্গী যদি আপনার সাথে যৌন সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন তাহলে আপনি এটি পরকীয়ার নিশ্চিত লক্ষণ হিসেবে ধরতে পারেন।

খ. আপনার সঙ্গীর কথায় রাগের সূর অর্থাৎ—-অকারণে রেগে যাওয়া (অবশ্য মেয়েদের হরমোন ও থাইরয়েডের সমস্যা দীর্ঘদিন থাকলে মেজাজ খিটখিটে হয়)।

গ. সঙ্গী যদি অতিরিক্ত ফোন বা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েন।

ঘ. কাছের মানুষটি যদি হঠাৎ করে আপনার ও পরিবরের সাথে কম সময় ব্যয় করেন।

ঙ. আপনার প্রতিদিনের রুটিন খঁুটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন। চ. হঠাৎ যদি স্ত্রী নিজের সৌন্দর্য্য সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে উঠেন ইত্যাদি। এগুলো মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত ধারণা মাত্র। তবে এরকম ধারণা সঠিক নাও হতে পারে।

পরকীয়া সমস্যা থেকে ফিরে এসে অনুতপ্ত হয়ে কী করবেন

জিরো থেকে হিরো হতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু হিরো থেকে জিরো হলে, পরেরবার হিরো হওয়া সত্যিই কঠিন। তাই তালপট্টি নষ্ট হলেও তালের গাছটা ধরে থাকা জরুরি। চলুন, এ পর্যায়ে সুধীজনের আরও কিছু পরামর্শ দেখিÑ

আপনি ধরা পড়ে গেছেন। এমন অবস্থায় নিজেকে অপরাধী মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার চেয়ে বড় যে বিষয়টি আপনাকে ভাবাচ্ছে, তা হলো সঙ্গীর অভিমান। আপনার প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ।

প্রথমত-সে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। নিজেকে সামলান।

দ্বিতীয়ত-কখনো কান্নাকাটি করবেন না। আপনার চোখের জলকে সে মনে করতে পারে কুমিরের কান্না।

তৃতীয়ত-নিজের মন খারাপের কথা সাধারণ মহলে বলবেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন কিছু পোষ্ট করবেন না। এসব দেখে সঙ্গী আরও ক্ষেপে যেতে পারে।

চতুর্থত-মনটাকে একদম শান্ত করুন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। দরকার হলে পরিবারের ঘনিষ্ঠ কারোর সঙ্গে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

পঞ্চমত-যে ব্যক্তির সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণে আপনার বিচ্ছেদ সেই ব্যক্তির সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবেন না। তাঁকেও খোলাখুলি বলে দিন আপনি কী চাইছেন।

ষষ্ঠত-দুঃখ, কষ্ট সামলাতে অন্য কোনো পুরুষ/নারীর সঙ্গে সাময়িক সম্পর্কে জড়াবেন না। কেননা তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

সপ্তমত-সঙ্গী যদি সিদ্ধান্ত নেন তিনি আপনাকে আরও একটা সুযোগ দিয়ে দেখবেন, তবে সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করুন। যে ভুল আপনি করেছেন সেটা নিজ মুখে স্বীকার করুন। দুঃখ প্রকাশ করুন। অঙ্গীকার করুন ভবিষ্যতে এমন ভুল আর করবেন না। দেখবেন সুন্দর একটা সমাধান আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

বিবাহ বিচ্ছেদের ২য় কারণ ‘নারী নির্যাতন’

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর-অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। -কাজী নজরুল ইসলাম

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি অবাক হতেন। নারী নেতৃত্বের এই দেশে পুরুষ খচিত সমাজে নারীরা আজও কত অবহেলিত। তা দেখে বেগম রোকেয়া কী করতেন সেটা আমাদের জানা নেই। ভাগ্যিস তারা বেঁচে নেই। ফেনীর নুশরাত হত্যাকান্ড, কুমিল্লার তনু’র নিথর মৃতদেহ কিংবা দিনাজপুরের আলেয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশ। এ যুগের খাদিজারা নানা ভাবে আজ নির্যাতিত। বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, মানবাধিকারের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, ক্ষমতার অপব্যাবহার করে চার দেয়ালে কারাবন্দী করে রাখা কী নারী নির্যাতন নয়? এদের মতো হাজারো তরুণীর আর্তনাদ আজ দেশের সর্বত্রই। সমাজে কিছু মানুষের ঘুম ভাঙে কাক ডাকা শব্দে। কারও ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের আযানের সূরে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধরা সবাই জেগে উঠে সুন্দর দিনের প্রতাশায়। কিন্তু খবরের কাগজ, টেলিভিশনের পর্দা, নেট দুনিয়ার ব্যস্ত সাইটগুলো কী বার্তা দেয়। খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এগুলো কী নিত্যনৈমিত্তিক খবর নয়? যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, আত্মহত্যার সংবাদগুলো যখন দিনের শুরুতেই চোখে পড়ে সে দিনের শুভ পরিণতি কী আর আশা করা যায়?

বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের সমস্যাটি নতুন নয়। ভালোবাসার মানুষটির সাথে দীর্ঘদিনের সংসারের বন্ধন কেউ নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু অত্যাচারে জর্জরিত মেয়েটির পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন বিচ্ছেদের বিদ্রোহ অন্তরে জেগে উঠে। সে বাঁচতে চায়। হয়তো সন্তানের জন্যে, হয়তো সুন্দর একটি আগামীর জন্য। অত্যাচার যদি মানসিক কিংবা সাংসারিক অতি কাজের চাপের হতো—তবে অনেক নারী হয়তো তা মেনে নিত। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ‘নিমগাছ’ গল্পের নিপুণা লক্ষী বউয়ের মতো সংসারের রশিটা ধরে থাকতো। কিন্তু দিনের পর দিন শারীরিক নির্যাতন, জাহেলিয়াতের মতো বর্বরতা- সেটা কতদিন মেনে নেওয়া যায়?

পুরুষরা নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ কেন করে?

(ক) বিয়ের পর নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ ধরা হয়েছে যৌতুকের চাহিদা : আমরা জানি, বিয়ের সময় স্ত্রীর পরিবারকে শর্ত দিয়ে কিছু চাহিদা প্রকাশ কিংবা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির থেকে উৎকোচ গ্রহণ করাকেই যৌতুক বলে। এটি একটি নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ। দেশের আইন ও ইসলামে এটাকে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে আইন দিয়ে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর ২০১৭ সালে তা দুই দফায় হালনাগাদ করে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ নামে নতুন আইন পাস করা হয়। সেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদন্ডের শাস্তি রয়েছে। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, যৌতুক দাবি, প্রদান ও গ্রহণ করার দন্ড হচ্ছে অনধিক পাঁচ বছর। কিন্তু অনূন্যত এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ (সংশোধিত)-এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি যৌতুকের কারণে কোনো মৃত্যু ঘটানো হয়, তাহলে তার জন্য সাজা হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে, তার জন্যে শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। একই ধারায় বলা হয়েছে, যৌতুকের জন্যে মারাত্মক জখম হলে দোষী ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড অথবা অনধিক ১২ বছর সাজা পাবে। সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন হেল্পলাইন ১০৯ চালু করেছে। নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ও বাল্যবিবাহ বন্ধে এ পর্যন্ত ১২৯৫৬৩৯টি ফোন কল গ্রহণ করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের তাৎক্ষণিক সহায়তায় জয় মোবাইল এ্যাপস চালু করা হয়েছে। ২০১১ সালে গাজীপুরে ১০০ আসন বিশিষ্ট মহিলা, শিশু ও কিশোরীর হিফাযতীদের নিরাপদ আবাসন প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ও সিলেট বিভাগের প্রতিটিতে ১০০ আসন বিশিষ্ট নারী সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এগুলো নারীর আইনগত সহায়তা। কাজেই নারী নির্যাতন হতে সাবধান। এ ফাঁদে পা দিলে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই ভেস্তে যাবে। মনে রাখা জরুরি-জোরপূর্বক অন্যায্য দাবি আদায় করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর শাস্তিও নির্ধারিত আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَنْ يَفْعَلْ ذٰلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيْهِ نَارًا وَكَانَ ذٰلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيْرًا

“আর যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে আগুনে দহন করা হবে। আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।” ৫৯

ইসলামী জীবনধারার রীতি অনুযায়ী বরকে উপহার দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। এটা মানুষের তৈরি সামাজিক রীতি নামের প্রচলিত কুসংস্কার। নারীকে লালনপালনের দায়িত্ব দু’জন ব্যক্তির উপর দেয়া হয়েছে। বিয়ের আগে পিতা এবং বিয়ের পর থেকে স্বামী তার দেখাশোনা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে। যা আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল বাক্বারাহ্’র ২৩৩ ও সূরা আন্ নিসার ৩৪ নং আয়াতে স্পষ্ট করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ

“বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত পিতার উপর কন্যার ভরণপোষণের দায়ীত্ব।”

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الرِّجَالُ قَوَّامُوْنَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلٰى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوْا مِنْ أَمْوَالِهِمْ

“পুরুষগণ হলো স্ত্রীদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনকারী। কেননা, আল্লাহ তাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন আর এ জন্যেই তারা তাদের ধন-সম্পদ থেকে স্ত্রী লোকদের জন্য খরচ করে।”

যাই হোক, কোনো স্বামী একান্তই যদি তার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে চায় অথবা কোন স্ত্রী যদি সেচ্ছায় তার স্বামীকে ত্যাগ করতে চায় তাহলে তা যেন শরয়ী মোতাবেক হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। সূরা আন্ নিসা : ৩৫ এবং সূরা আল বাক্বারাহ্ : ২২৯ নং আয়াতে এর বিবরণ লক্ষ্য করা যায়।

খ. বিয়ের পর নারী নির্যাতনের ২য় কারণ মনে করা হয় স্বামীর মাদকাসক্ত হওয়া : মাদকাসক্ত ব্যক্তি সাধারণ মানুষের মতো নয়। মাদক হলো নেশা। যার কাছে সমাজ—সংসার, পরিবার এমনকি নিজের জীবনও তুচ্ছ মনে হয়ে যায়। পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান কারোরই যেন মূল্য নেই তার কাছে। এমন ব্যক্তির কাছে নারীরা তো নির্যাতিত হবেই। বর্তমানে মাদকের সহজলভ্যতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ই মাদকাসক্ত হওয়ার মূল কারণ। দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করা দরকার। চোরাকারবারির পথ চিরতরে বন্ধ করা দরকার। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে যুব সমাজকে এ বিষয়ে সচেতন করা খুবই জরুরি। মাদক বা মাদকাশক্তির সাজা যথাযথ কার্যকর করা উচিত। মাদক নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৮-এই আইনের ৯ ধারায় বিভিন্ন মাদক বহন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে ১-১৫ বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আর ইসলামে তো বহু আগেই এটিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে মাদক সেবনকে শয়তানের কর্ম বলে তিরস্কারও করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা সূরা আল বাক্বারাহ্ : ১০২, ২১৯, সূরা আন্ নিসা : ৪৩, সূরা আল মায়িদাহ্ : ৯০-৯১ নং আয়াতগুলো লক্ষ্য করতে পারি। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রা.) হতে বর্ণিত যে, রাসূল () বলেছেন : যে ব্যক্তি দুনিয়ায় মদ পান করেছে অতঃপর তা থেকে তাওবাহ্ করেনি, সে আখিরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। ৬০

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ () বলেন, যে সকল পানীয় নেশা সৃষ্টি করে, তা হারাম। ৬১

এ ব্যাপারে আমরা আরও জানার জন্য সহীহুল বুখারী’র কিতাবুল আশরিবাহ দেখতে পারি।

গ. বিয়ের পর নারী নির্যাতনের সর্বশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে স্ত্রীর সাথে স্বামীর বিভিন্ন বিষয়ে বনিবনা না হওয়া। যেমন-পছন্দের বাইরে গিয়ে হয়তো বাবা-মা’র কথায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করা, শশুর বাড়ির লোকজন (শ্বশুর-শাশুরীর) সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়া, প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা প্রকাশ করা ইত্যাদি।

বিবাহ বিচ্ছেদের ৩য় কারণ ‘পুরুষ নির্যাতন’

যুগ যুগ ধরে পৃথিবীকে শাসন করে আসছে পুরুষ জাতি। আল্লাহ তা‘আলা পুরুষকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। এজন্যেই দেখা যায়, মহিলাদের দায়ীত্বশীলতা মুসলিম সমাজে খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। সমাজের স্বাধীনচেতা লোকেরা মনে করেন, পুরুষের জীবনটা মশার কয়েলের মতো। যে নিজে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কিন্তু আপনজনদের সুরক্ষিত রাখে। বাসে একজন নারী দাঁড়িয়ে থাকলে Ñবেশিরভাগ পুরুষই সেই নারীকে জায়গা করে দেন। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় একজন পুরুষই বলে ওঠেনÑ তার পেছনের নারীটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। দোকানের বেশিরভাগ পুরুষ সেলসম্যান আরেকজন পুরুষকে শান্তস্বরে বলেন, ‘ভাই, এই মহিলাটিকে আগে বিদায় করে দিই। আপনি একটু বসুন’। স্কুলের যেসব শিক্ষক ছেলেদের গরু—ছাগলের মতো পেটান, সেসব শিক্ষকও মেয়েদের বেলায় সহানুভূতিশীল হন। কোনো পুরুষকে তার জীবনের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার মানুষের কথা বলতে বললেÑ সেই পুরুষটি একজন নারীরই নাম বলবেন। কিন্তু কট্টর নারীবাদ পুরুষের এই ব্যাপারগুলোকে শ্রদ্ধা করে না বরং অস্বীকার করে। তারা ভাবে Ñপুরুষ মানেই ধর্ষক, নির্যাতনকারী, দেহপ্রেমী ইত্যাদি। তারা মনে করে, পুরুষ রাস্তাঘাটে বেরই হয় নারীদের ধর্ষণ করতে। (সোশ্যাল মিডিয়ায় এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন একজন নির্যাতিত পুরুষ)। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশ্ত। এই কথার সঠিক ভিত্তি না থাকলেও “স্বামীর কথার অবাধ্য হলে, স্ত্রী অভিশাপ প্রাপ্ত হবে” এ কথা তো সত্য। সহীহ হাদীসের বর্ণনায় বলা হয়েছেÑ আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) বলেন : আল্লাহর রাসূল () বলেছেন- কোনো লোক যদি নিজ স্ত্রীকে নিজ বিছানায় আসতে ডাকে আর সে কোনো ওজর ছাড়া তা অস্বীকার করে এবং সে ব্যক্তি স্ত্রীর ওপর দুঃখ নিয়ে রাত্রি যাপন করে, তাহলে ফেরেশ্তারা এমন স্ত্রীর ওপর সকাল পর্যন্ত লানত দিতে থাকে। 

পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি আমাদের দেশে চরম আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে সবার জন্য প্লাটফর্ম আছে। নারীদের জন্য, শিশুদের জন্য, তৃতীয় লিঙ্গের জন্য। এমনকি পশু অধিকার রক্ষার জন্য। কিন্তু পুরুষের জন্য কোন প্লাটফর্ম নেই। বাংলাদেশে পুরুষ এখন এতটাই অসহায় যে, তার নামে একটি মামলা দিলে, একটা অভিযোগ করলে সেটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো ব্যপার নেই এখানে। জীবনে অনেক দেরি করে আমরা উপলব্ধি করি যে, নিজের ভালো থাকার দায়িত্বটা আসলে আমাদের নিজেকেই নিতে হয়। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাশ হতে হয়। দ্য বেঙ্গলী টাইমস ডেস্ক সূত্রে একটি গবেষণা পত্রে যা জানা গেছে, স্ত্রী’র হাতে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। পারিবারিক নির্যাতনের ৪০ শতাংশই হয় পুরুষের ওপর। পুরুষ অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘প্যারিটি’ নামের প্রচারণা গ্রুপের দাবি, সারা বিশ্বেই পুরুষ নির্যাতন বাড়ছে। শুধু দেশেই নয় ব্রিটেনে প্রতি পাঁচটি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনার দু’টির শিকার পুরুষ। অর্থাৎ-৪০ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে পুরুষের উপর। পুরুষ তার স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও পুলিশ প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা পাত্তা দেন না। পাত্তা দিবেন কিভাবে? বাইরে পুলিশ হলেও নিজ গৃহে তিনি তো বিড়াল। কারণ, তিনিও তো .........। একটি রসকথা শুনছিলাম এ রকম-

সে দিন বউয়ের সাথে ঝগড়ার এক পর্যায়ে বউ আমাকে ঝাড়–দিয়ে ঢিল দিলো! এমন লজ্জার বিষয় না পারি সইতে না পারি কইতে... অবশেষে আব্বার কাছে গেলাম বিচার দিতে। গিয়ে দেখি আব্বায় এই বয়সে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর আম্মা বলছে, “ফের যদি আমার কথার অবাধ্য হইছো বাসা থেকে বের করে দিব। আব্বা বললো এইবার শেষ, আর জীবনে তোমার মুখের উপর কথা বলবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।” এসব দেখে আব্বাকে আর কিছু বলা হলো না। গেলাম শ্বশুর আব্বার কাছে। গিয়ে দেখি তিনি ঘর ঝাড়– দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “শ্বশুর আব্বা আপনার এই হাল কেন? বললো, আর বইলো না বাবা। তোমার শাশুড়ি আম্মা সিরিয়াল দেখতেছিল, ভুল করে চ্যানেল চেঞ্জ করছি। তাই আজ বাড়ির সব কাজ আমার করা লাগবো।” শ্বশুরের কথা শুইনা যা বুঝলাম হের মেয়ে হের মায়ের মতো হইছে! গেলাম থানায় পুরুষ নির্যাতন মামলা করতে। গিয়ে দেখি, ওসি সাহেব পোড়া হাতে মলম দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, স্যার পুড়লো ক্যামনে? আর বইলেন না, ভুল করে আপনার ভাবির চায়ে চিনির বদলে লবণ দিছিলাম। তাই আপনার ভাবী খুন্তীর ছঁ্যাকা দিছে! ওসির কথা শুনে নিজেই দমে গেলাম! যেখানে ওসি নিজেই নির্যাতিত, সেখানে কী আর বিচার পাব। বেসরকারি একটি সংস্থার জরিপে জানা যায়, দেশে করোনাকালীন সময়ে পুরুষ নির্যাতনের সংখ্যা শতকরা ৪৫ ভাগ সে তুলনায় নারী নির্যাতনের সংখ্যা ৪০ ভাগ। পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি চেপে যাওয়া আর নারী নির্যাতনের সংখ্যা প্রকাশ পাওয়ায় নারী নির্যাতন ব্যাপক মনে হয়। বাংলাদেশের কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এক্ষেত্রে উদাসীন ও দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করছে। তবে ভয়াবহ খবর হচ্ছে বর্তমানে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশে পুরুষ নির্যাতনের মাত্রা ৮০% ছাড়িয়েছে।

যে সব কারণে পুুরুষেরা চুপ করে নারীর নির্যাতন সহ্য করে

১. সংসার ভেঙে যাবার ভয়ে

২. সন্তানের মা হারাবার ভয়ে। অনেক সময় সন্তান হারাবার ভয়ে।

৩. সমাজ কর্তৃক তালাক দেওয়াটাকে অপরাধ হিসেবে পুরুষের উপর বর্তানো।

৪. দেনমোহরের টাকার পরিমাণ না থাকার কারণে সাংসারিক দায়িত্ববোধ থেকে নিজেকেই দোষী মনে করা।

৫. আশঙ্কা করা সে ঠিক হয়ে যাবে।

৬. তালাক দিলে সন্তানের চোখে খারাপ হয়ে যাবার ভয়ে এবং সন্তানের ভালোবাসা হারাবার ভয়ে।

৭. নারী নির্যাতন মিথ্যা মামলার ভয়ে।

৮. সংবাদ মাধ্যমে নারীবাদী পুরুষ বিদ্বেষী কমিটিগুলোর মিডিয়াতে গিয়ে প্রমাণ ছাড়াই মিথ্যা অপবাদের ভয়ে।

৯. গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে নারীর বিভিন্ন অন্যায় সহ্য করতে বলা এবং মস্তিষ্ক/মগজ ধোলাই করে রাখা।

১০. যৌন সম্পর্ক হবে না বলে ভয় পাওয়া।

১১. আমি পুরুষ এই ধরনের ভুল ধারণা পোষণ করা। নিজের উপরে নিজেই অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া।

১২. লজ্জাবোধ আমি ছেলে মানুষ, একটা মেয়ে আমাকে নির্যাতন করল মানুষ শুনলে কি বলবে। আমার বন্ধু-বান্ধব শুনলে কি বলবে।

১৩. পারিবারিক সমস্যা, আমি পুরুষ এটা আমার পারিবারিক সমস্যা এই ভেবে অনেকেই চুপ করে থাকে। এটা ঠিক নয়।

১৪. পূর্বের মধুর সময়ের কথা চিন্তা করে মাফ করে দেওয়া।

১৫.অতিরিক্ত ভালোবাসার টানে দিশেহারা থাকা। সব নারী কী ভালোবাসা বুঝে? বুঝে না।

তো নারী কিসে আটকায়? আসলে নারী কোনো কিছুতেই আটকায় না। যে চলে যাওয়ার সে কোনো না কোনো অযুহাত দিয়ে চলে যায়; আর যে থেকে যাওয়ার সে সব পরিস্থিতিকে সামলে থেকে যায়...। বিদ্রোহী পুরুষেরা বলেÑ “নারী নাহি হতে চায় একা কারও... ওরা যতো পূজো পায় ততো চায় আরো... ওরা লোভী, লোভী ওদের মন, একজনে তৃপ্ত নহে যাচে বহুজন”। দেশের বিভিন্ন এলাকা এমনও আছে প্রতিরাতে স্ত্রীর হাতে মারধর খেতে হয় স্বামী নামের অসহায় পুরুষটিকে। বেচারা স্বামী লোক লজ্জা আর সমাজপতিদের ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। লিঙ্গ কর্তন সহ শত শত ঘটনা ঘটছে সারা দেশে। নির্যাতনের স্টিম রোলার সইতে না পেরে অনেক পুরুষ বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিকার কবে হবে?

সর্বশেষ পুরুষদের আইনি অধিকার ও পুরুষের মানবাধিকার রক্ষায় এইড ফর মেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রথিতযশা সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম নাদিম লিখিত ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

১. অপহরণ : বিবাহের উদ্দেশ্যে বা প্রেমখাট কারণে ছেলে-মেয়ে উভয়ে পালিয়ে গেলে শুধুমাত্র ছেলে ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা হয়। এই কৃতকর্মের জন্য শুধুমাত্র ছেলের শাস্তি বিধান হওয়াটা অযৌক্তিক বিধায় তা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি (বিবাহের উদ্দেশ্যে বা প্রেমঘটিত কারণে কোনো ছেলে মেয়ে স্বেচ্ছায় পালিয়ে গেলে উক্ত ঘটনাকে অপহরণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করা)।

২. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এ সংযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে শিশু ও নারীর পাশাপাশি পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৩. বিয়ের প্রতিশ্রম্নতিতে প্রাপ্ত বয়স্ক নর—নারীর সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যাবে না এবং এই ক্ষেত্রে যদি শাস্তি হয় তাহলে নারী—পুরুষ উভয়ের জন্য শাস্তির বিধান থাকতে হবে।

৪. নারী ধর্ষণ ও শিশু ধর্ষণ আলাদা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে পুরুষ ধর্ষণের সংজ্ঞা তৈরি করে লিঙ্গনিরপেক্ষ ধর্ষণ আইন তৈরি করতে হবে।

৫. পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা, সভ্য সমাজ ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত আইন এবং পুরুষদের মানবাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশীয় আইনে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সৃষ্ট তথাকথিত বৈবাহিক ধর্ষণের ধারণার অনুপ্রবেশ না ঘটানো।

৬. মিথ্যা ধর্ষণ মামলা প্রমাণিত হলে, মামলাকারীর বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান থাকতে হবে (ধর্ষকের সমমান শাস্তির বিধান থাকতে হবে)।

৭. যৌতুক সংক্রান্ত মামলায় সমন বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুর পূর্বে তদন্ত প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা।

৮. পুরুষের লিঙ্গ কর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে পুরুষকে পুরুষত্বহীন করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে হবে।

৯. বহু বিবাহ প্রতারণারোধে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি ডিজিটাল করা।

১০. পুরুষের মানবাধিকার রক্ষা ও পুরুষ নির্যাতন রোধে আইন চাই।

১১. কাবিন বাণিজ্যরোধে সাধ্যের অতিরিক্ত কাবিন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, বিধান থাকতে হবে।

১২. ব্যভিচারের ৪৯৭ ধারাকে সংশোধন করে পরকীয়ায় আসক্ত নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান শাস্তির বিধান থাকতে হবে।

১৩. পুরুষ বিষয়ক মন্ত্রনালয় থাকতে হবে।

পুরুষ নির্যাতনে করণীয়

দেশের সচেতন নাগরিক মনে করে পুরুষ নির্যাতন রোধে কিছু বিষয় বাস্তবায়ন খুব জরুরি। * নারী নির্যাতন আইনে সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্তাও রয়েছে। কিন্তু পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো নীতিমালা নেই। নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে পুরুষেরও। সুতরাং পুরুষ নির্যাতনের জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। * পারিবারিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। বাবা মাকে তার ছেলের মন মানসিকতা বুঝতে হবে। তাদের বুঝতে হবে তার ছেলে কোনো অর্থ উপার্জনের যন্ত্র নয়। সে মানুষ, তার সিদ্ধান্ত তাকে নিতে দিন। * সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারী নির্যাতন হলে যেমনভাবে তা একটি অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রেও তা হতে হবে। যাতে করে নির্যাতিত হয়ে কেউ চুপচাপ মেনে না নিয়ে এ ব্যাপারে সবার সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধান করতে পারেন পুরুষেরা।

এবার আসুন, এক পলকে দেখে নেই দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের কিছু ভয়ঙ্কর চিত্র

দেশে মানুষের মাঝে শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার অভাব যেমন বাড়ছে তেমনি বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে লাগামহীন। একশ্রেণির বিবেকহীন মানুষের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ এখন একটি ফ্যাশন বলে মনে হচ্ছে। জনশুমারির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিবাহ বিচ্ছেদে দেশে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী বিভাগে। সেখানে এর হার দশমিক ৬১ শতাংশ। অবিবাহিত রয়েছে বেশি সিলেটে। সেখানে এই হার ৩৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় সমগ্র দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যান্য বিভাগে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বরিশালে ০.২৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ০.৩০ শতাংশ, ঢাকায় ০.৪০ শতাংশ, খুলনায় ০.৫৫ শতাংশ, ময়মনসিংহে ০.৪০ শতাংশ, রংপুরে ০.৩৮ এবং সিলেটে ০.৪৩ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ঢাকা বিভাগে বসবাস করেন। দৈনিক প্রথম আলোসহ দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী গত বছর রাজধানীতে তালাক হয়েছে প্রতিদিন ৩৭টি করে। অর্থাৎ— প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে তালাক হয়েছে এবং চলতি বছর আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিচ্ছেদের পর সমঝোতা হয়েছে খুবই কম Ñ৫ শতাংশের নিচে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্টার কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিবাহবিচ্ছেদের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

পরিশেষে আমরা বলতে চাই, বিচ্ছেদ কখনোই ভালো নয়। সমঝোতার ভিত্তিতে যদি সম্ভব হয় সংসারের বন্ধনটা ধরে রাখা উচিত। জীবনের শেষ দিনটিও যেন ভালোবাসায় ভরপুর থাকে। শেষ বিদায়েও যেন মেলে পরিবারের সবার ভালোবাসা। অনাবিল সুখ শান্তিতে ভরে উঠুক সবার জীবন -আমীন।

তথ্যসূত্র : জাতীয় দৈনিকসমূহ, বাংলা ভিশন, এনটিভি, বিবিসি, দৈনিক কলকাতা এক্সপ্রেস, দৈনিক আনন্দবাজার ইত্যাদি।

(লক্ষণীয় : লেখার কলেবর বড় হওয়ার আশঙ্কায় শর্ট ভার্সন উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। অনাকাক্সিক্ষ তথ্য বিভ্রাট হলে, ক্ষমাপ্রার্থী)


*প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, টাঙ্গাইল রেসিডেন্সিয়াল কলেজ, সাভার, ঢাকা।

৫৫.  সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২।

৫৬.সূরা আন্ নূর : ০২।

৫৭.  সহীহুল বুখারী— হা. ৭৬৫৮।

৫৮.সহীহ মুসলিম— হা. ২৪৪৫।

৫৯.সূরা আন্ নিসা : ৩০।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত