সাময়িক প্রসঙ্গ
পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম স্থাপনা
আবূ সা‘আদ আব্দুল মোমেন বিন আব্দুস্ সামাদ


আল্লাহ তা‘আলার বাণী

﴿اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ بِبَکَّۃَ مُبٰرَکًا وَّهُدًی لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ۝ فِیۡهِ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ مَّقَامُ اِبۡرٰهِیۡمَ ۬ۚ وَمَنۡ دَخَلَهٗ کَانَ اٰمِنًاؕ وَلِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَمَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ﴾

সরল বঙ্গানুবাদঃ “নিশ্চয় মানুষের জন্য নির্মিত প্রথম ঘর (কা’বা) যা বাক্কায় (মক্কার পূর্ব নাম বাক্কা) অবস্থিত। এটা বরকতময় ও বিশ্ববাসীর জন্য পথ প্রদর্শক। এতে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ (রয়েছে) মাকামে ইব্রাহীম। যে ব্যক্তি এই ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। যারা সামর্থ্য রাখে আল্লাহর জন্য এই ঘরে এসে হজ্জব্রত পালন করা তাদের উপর আবশ্যিক। আর যে কুফ্রী করে নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বজাহানের মুখাপেক্ষী নন।”[১]

শাব্দিক বিশ্লেষণ
اِنَّ শব্দটি حروف مشبه بالفعل (অর্থাৎ- ক্রিয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অব্যয়) অর্থ- নিশ্চয়। اَوَّلَ অর্থ- প্রথম। بَیۡتٍ অর্থ- ঘর। وُّضِعَ শব্দটি واحد مذكر فعل ماضى مجهول অর্থ- নির্মাণ করা হয়েছে। لِلنَّاسِ-এর মধ্যে ل অক্ষরটি حرف جر আর الناس শব্দটি مجرور অর্থ- মানুষের জন্য। لَلَّذِیۡ অর্থ যা بِبَکَّۃَ অর্থ্- বাক্কায়। مُبٰرَکًا অর্থ- বরকতময়। وّ অর্থ- এবং هُدًی অর্থ- পথ প্রদর্শন। ل অক্ষরটি حرف جر আর الۡعٰلَمِیۡنَ শব্দটি مجرور অর্থ বিশ্ববাসীর জন্য। فِیۡهِ অর্থ- এর মধ্যে রয়েছে। اٰیٰتٌۢ অর্থ- নিদর্শণসমূহ। بَیِّنٰتٌ অর্থ- সুস্পষ্ট। مَّقَامُ اِبۡرٰهِیۡمَ অর্থ- ইব্রাহীম ('আ.)-এর পদচিহ্নযুক্ত পাথরখ- (এই পাথরখ-টিকেই মাকামে ইব্রাহীম বলা হয়)। وَ অর্থ- এবং مَنۡ অর্থ- যে। আর دَخَلَهٗ-এর মাঝে دَخَل শব্দটি فعل এবং ه অক্ষরটি فاعل অর্থ- তাতে প্রবেশ করবে। اٰمِنًا অর্থ- নিরাপদ। وَ অর্থ- এবং لِلّٰهِ শব্দের ل অক্ষরটি حرف جر আর الله শব্দটি مجرور অর্থ- আল্লাহর জন্য। عَلَی শব্দটি حرف جر আর النَّاسِ শব্দটি مجرور অর্থ- মানুষের উপর। حِجُّ শব্দটি مضاف আর الۡبَیۡتِ শব্দটি مضاف إليه অর্থ- এই ঘরে এসে হজ্জব্রত পালন করা। مَنِ اسۡتَطَاعَ অর্থ- যার সামর্থ্য আছে। اِلَیۡهِ অর্থ- এর দিকে। سَبِیۡلًا অর্থ্-পথ। وَ অর্থ- এবং مَنۡ অর্থ- যে। আর کَفَر শব্দটি فعل অর্থ- সে কুফরী করল। فَاِنَّ اللّٰهَ অর্থ- আর নিশ্চয় আল্লাহ। غَنِیٌّ এটি আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। অর্থ- ধনী। عَنِ শব্দটি حرف جر আর الۡعٰلَمِیۡنَ  শব্দটি مجرور অর্থ- বিশ্ববাসী থেকে।

দরসঃ আলোচ্য আয়াতে কারীমার প্রথম আয়াতটিতে ইয়াহুদীদের একটি অভিযোগের উত্তর দেওয়া হয়েছে। অভিযোগটি সে সময়ের, রাসূল (সা.) যখন মহান আল্লাহর নির্দেশে ক্বিবলা পরিবর্তন করে বাইতুল মুক্কাদ্দাসের দিক হতে কা’বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ইয়াহুদীরা তখন বলতে লাগলো- বাইতুল মুক্কাদ্দাসই তো প্রথম ‘ইবাদতখানা। মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার অনুসারীরা কেন ক্বিবলা পরিবর্তন করল? তাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন। তাদের এই বক্তব্য মিথ্যা। সত্যি হলো- ধরার বুকে মানুষের ‘ইবাদতের জন্য প্রথম নির্মিত ঘর হচ্ছে কা‘বা। হাদীসে আছে- আবূ যার (রাযি.) রাসূল (সা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করেন যে, জগতের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? উত্তরে তিনি বললেন- মসজিদুল হারাম। আবারো প্রশ্ন করা হলো- এরপর কোনটি? উত্তর বললেন- মসজিদে বায়তুল-মুকাদ্দাস। আবার জিজ্ঞাসা করলেন : এই দু’টি মসজিদ নির্মাণের মাঝখানে কতদিনের ব্যবধান ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, চল্লিশ বছর।[২]

সুতরাং বুঝা গেলো ইয়াহুদীদের বর্তমান ক্বিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস-এরও চল্লিশ বছর পূর্বে মুসলিমদের বর্তমান ক্বিবলা কা’বা নির্মিত হয়েছে। কা’বা ঘরটি মক্কায় অবস্থিত। মক্কারই একটি নাম- بكة (বাক্কা)। با বর্ণের জবরের সাথে। بكة (বাক্কা) শব্দটির অর্থ- ভেঙ্গে দেওয়া, গুড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু বাক্কা তাকে ধ্বংসকারী বড় বড় জালেমদের গর্দান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় তাই তাকে বাক্কা বলা হয়। একটি বর্ণনায় এসেছে- আসমান-জমিন সৃষ্টিকালে পানির পৃষ্ঠের উপর সাদা ফেনার ন্যায় যে বস্তুটি প্রকাশিত হয়েছিল সেটিই কা’বা অতঃপর জমিনকে তার নীচ থেকে বিস্তৃত করা হয়েছে।[৩]

প্রাচীনকাল থেকেই এই কা’বার প্রতি মানুষের সম্মানপ্রদর্শন অব্যাহত রয়েছে। আলোচ্য আয়াতে কাবা গৃহের শ্রেষ্ঠত্বের কয়েকটি বিশেষ দিক বর্ণিত হয়েছে। প্রথমত মানবজাতির জন্য নির্মিত প্রথম ‘ইবাদতখানা এটিই। দ্বিতীয়তঃ এই গৃহ বরকতময়। তৃতীয়তঃ এটি বিশ্বের সকল মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। চতুর্থত এতে রয়েছে সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শন। রয়েছে মাকামে ইব্রাহীম। রয়েছে হাজরে আসওয়াদ। রয়েছে যম্যম্ কূপ। এই ঘর বিশ্ববাসীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। যে এই ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে।
যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে তার জন্য এই ঘরে গিয়ে হজ্জব্রত পালন করা আবশ্যিক। হজ্জ ইসলামের মৌলিক পঞ্চস্তম্ভের একটি। এটি শর্তসাপেক্ষে ফরয। আর এই ফরয ‘ইবাদতটি ফরয হিসেবে জীবনে একবারই করতে হবে।

ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। একদা আকরা’ ইবনু হাবেস নবী করীম (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! হজ্জ কি প্রত্যেক বছর ফরয নাকি জীবনে একবার ফরয? তিনি বললেন- না, এটি বরং জীবনে একবারই ফরয। যে বেশি করবে তা তার জন্য নফল হবে।[৪]

কারো উপর হজ্জ ফরয হওয়ার জন্য শর্ত হলো- কাবা গৃহ পর্যন্ত পৌঁছার খরচ, সেখান থেকে বাড়ি ফেরার খরচ এবং এ পর্যন্ত পরিবারের লোকদের ভরণপোষণের খরচসহ কারো যদি শারীরিক সামর্থ্য থাকে তাহলে তার উপর হজ্জব্রত পালন করা ফরয। মহিলাদের জন্য মাহরাম সাথে থাকা শর্ত। চাই সে ব্যক্তি নিজ খরচে ভ্রমণ করুক বা মহিলার খরচে।

হজ্জের বহু ফায়দা রয়েছে। অন্যতম ফায়দা হলো- হজ্জের একমাত্র প্রতিদান-জান্নাত। হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ (ঃ) أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ (ﷺ) قَالَ : الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا، وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّةُ.

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এক ‘উমরাহ্ অপর ‘উমরাহ্ পর্যন্ত সময়ের (সগীরা গুনাহের) কাফ্ফারাস্বরূপ। আর জান্নাতই হলো কবুল হজ্জের একমাত্র প্রতিদান’।[৫]

হজ্জে আরো একটি ফযীলত হচ্ছে- হজ্জ জীবনের পূর্ববর্তীগুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়। হাদীসে এসেছে-

عَنِ ابْنِ شَمَاسَةَ الْمَهْرِىِّ، قَالَ حَضَرْنَا عَمْرَوْ بْنَ الْعَاصِ، وَهُوَ فِيْ سِيَاقَةِ الْمَوْتِ، فَبَكَىْ طَوِيْلًا وَحَوَّلَ وَجْهَهُ إِلَى الْجِدَار، وَقَالَ : فَلَمَّا جَعَلَ اللهُ الْإِِسْلَامَ فِيْ قَلْبِيْ أَتَيْتُ النَّبِيَّ (ﷺ)، فَقُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ابْسُطْ يَمِيْنَكَ لْأُبَايِعَكَ، فَبَسَطَ يَدَهُ، فَقَبَضْتُ يَدِيْ، فَقَالَ : مَا لَكَ يَا عَمْرُوْ؟ قَالَ : أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ، قَالَ : تَشْتَرِطُ مَاذَا؟ قَالَ : أَنْ يُغْفَرَ لِيْ، قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ يَا عَمْرُوْ أَنَّ الْإِسْلَامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ، وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهَدَّمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا، وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ.

ইবনু শামাসা আল-মাহরী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা ‘আম্র ইবনুল ‘আস (রাযি.)-এর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদলেন এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসূল (সা.)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, যাতে আমি বায়‘আত করতে পারি। রাসূল (সা.) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। তখন রাসূল (সা.) বললেন, কি ব্যাপার হে আমর? আমি বললাম, আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন, কি শর্ত করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার (পিছনের সব) গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি বললেন, হে ‘আমর! তুমি কি জানো না, ‘ইসলাম’ তার পূর্বেকার সকল পাপ বিদূরিত করে দেয় এবং ‘হিজরত’ তার পূর্বেকার সকল কিছুকে বিনাশ করে দেয়। একইভাবে ‘হজ্জ’ তার পূর্বের সবকিছুকে (পাপ) বিনষ্ট করে দেয়।[৬]

সর্বোপরি হাজীগণ হচ্ছেন মহান আল্লাহর মেহমান। হাদীসে এসেছে-

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (ﷺ) : وَفْدُ اللهِ ثَلَاثَةٌ : الْغَازِيْ، وَالْحَاجُّ، وَالْمُعْتَمِرُ.

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর মেহমান হলো তিনটি দল- মহান আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকারী, হজ্জকারী ও ‘উমরাহ্কারী’।[৭]

যে ব্যক্তি তার উপর ফরযকৃত এই হজ্জকে অস্বীকার করে, তার এ কথা জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ববাসীর প্রতি মুখাপেক্ষী নন। অর্থাৎ- সকল মানব-দানব ও ফেরেশ্তাকুল এবং তাদের ‘ইবাদতের তিনি অমুখাপেক্ষী। মোটকথা, ধরার বুকে প্রথম ‘ইবাদতখানা হিসেবে নির্মিত কা‘বা যা মুসলিম জাতির ক্বিবলা। সারা পৃথিবী থেকে জাতি-গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে হজ্জমৌসুমে লক্ষ লক্ষ মুসলিম ছুটে আসে এই ঘর তাওয়াফ করতে। এ ঘরে এসে মানুষ অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করে। হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করে নিজের গুনাহ-খাতা সাফ করে। মাক্কামে ইব্রাহীমকে সালাতের মুসল্লা বানিয়ে সালাত আদায় করে, যম্যমের পানি পান করে মানুষ তাদের দেহে-মনের তৃষ্ণা মিটায়।


[১] সূরা আ-লি ‘ইমরান : ৯৬-৯৭।
[২] সহীহুল বুখারী- হাদীস নং- ৩৩৬৬; সহীহ মুসলিম- হা. ৫২০।
[৩] তাফসীরে জালালাইন।
[৪] সুনান আবূ দাঊদ- হা. ১৭২১।
[৫] সহীহুল বুখারী- হা. ১৭৭৩।
[৬] সহীহ মুসলিম- হা. ১২১।
[৭] সুনান আন্ নাসায়ী- হা. ২৬২৫।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45 সূর্যাস্ত : 5:11:51

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত