মানুষ মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা সমৃদ্ধ। তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে আধুনিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। পাতালপুরীর অজানা কাহিনিকে পেছনে ফেলে নিত্য-নতুন আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠছে। জল-স্থল ও মহাশূন্যে বিচরণ এখন নেহায়েত মামুলি ব্যাপার। অকুতোভয় সেনানীর মতো জগৎপানে মানুষ অগ্রসরমান। জাগতিক উন্নয়নের নেশায় মানুষ বিভোর। আত্ম-প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মহারা। নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচার নেই। সে দিক থেকে মানুষ বড্ড ঊদাসীন। বস্তুবাদী ও জগৎপূজারি মানুষ এমনই হবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়; কিন্তু যখন দেখি এ ব্যাধিতে আলেম-ওলামা, দাঈ‘ ইলাল্লাহ ও কথিত ইসলাম দরদিগণ আক্রান্ত, তখন মনোজগতে বেদনার সিন্ধু তরঙ্গায়িত হয়। ভারাক্রান্ত হৃদয় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। মানুষ অনুকরণীয় মনে করে হৃদয়-মন দিয়ে যাদেরকে ভালোবাসে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, তাদের অন্তর যদি ঘুণেধরা ও বিবেক অন্ধ হয়, তাহলে জাতি যাবে কোথায়(?)। অজানা মানুষ আলেম-ওলামার কাছে জানবে। কোনো বিষয়ে শরঈ সমাধান তাদের কাছেই চাইবে। সৎ ও নিষ্ঠাবান আল্লাহওয়ালা মানুষ মনে করে তাদেরকে অনুস্মরণীয়-অনুকরণীয় মনে করবে। পরিতাপ এই যে, আয়না দেখায়া তো বুরা মান গিয়া।
এক মুসলিম অপর মুসলিমের আয়নাসদৃশ। সৎ পরামর্শ ও পারস্পরিক ইসলাহ্ মু’মিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাহ বা সংশোধন মহান আল্লাহর কাছে ভীষণ পছন্দনীয়। দু’জন মু’মিনের মাঝে বিবাদ মীমাংসাকারী ব্যক্তি মহাপুরস্কারে ভূষিত হবে। কিন্তু এ পুরস্কার প্রাপ্তির পথ বেশ কন্টকাকীর্ণ। মীমাংসা করতে গেলেই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। যাদের কাছে আপনার প্রত্যাশা যে, সহজেই সত্য মেনে নেবেন এবং সঠিক ফায়সালায় সন্তুষ্ট হবেন, তারাই সবচেয়ে বেশি বেঁকে বসবে। উল্টো আপনাকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করবে। বাহ্যিক লেবাস, আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে তারাই দুধে ধোয়া সাদাসিধে সাধু-সজ্জন। কিন্তু অন্যায়কে অন্যায় বলে মানতে নারাজ। কিন্ত কেন(?) স্বার্থে আঘাত পড়বে? আত্ম-প্রতিষ্ঠার জোয়ারে ভাটা পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে? কিংবা ভবিষ্যৎ অভিলাষ ও স্বপ্ন পূরণে অন্তরায় সৃষ্টি হবে? তাকি আর মেনে নেওয়া যায়? বিপত্তি তো এখানে।
আমানতদারিতা ও নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের পথে হাঁটলে সাময়িকভাবে দুনিয়াতে লাভবান হওয়া যাবে ঠিকই কিন্তু পরপারে পাকড়াও থেকে কোনোভাবেই রক্ষা পাওয়া যাবে না। বিচারতো মরণের পর। সেতো আরেক জগৎ। যা হবার অদৃশ্য জগতেই হবে। সাজা না জাযা হলো মানুষতো তা দেখবে না। তাতে অসুবিধা কি? দুনিয়ায় তো আমি সফল। কর্তৃত্বপরায়ণতায় আমিতো সফল। কিন্তু জাগতিক এ সফলতা যে ক্ষণস্থায়ী তা কি কখনো ভেবে দেখেছি?
মানুষ আছে মনুষ্যত্ব নেই। নীতি আছে প্রয়োগ নেই। নৈতিকতার খোলস আছে কিন্তু অন্তঃসারশূন্য। কথায় পটু কাজে আমড়া কাঠের ঢেঁকি। অন্যকে উপদেশ খয়রাত করতে জানি, কিন্তু নিজ আমলের ঘটি ফাঁকা। লাভ কি তাতে? আয়না এক নিঃস্বার্থ দর্পণ। আপনার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যেমন আয়নায় দেখা যায়, তেমনি ভীষন্নতার ছাপ থাকলেও তা ভেসে ওঠে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কি একবার জিজ্ঞেস করেছি- আমি যা করছি তা কতটা ইনসাফপূর্ণ? বিবেকের আয়না কি আমার স্বচ্ছ? না কি সেখানেও মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে? তাহলে তো আমি আত্মঘাতি দুরারোগ্য মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা- এ প্রবাদ কি আমার জন্যই যথার্থ?
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষের দেহে একটুকরা মাংস আছে যা ঠিক থাকলে পুরো দেহই সঠিক থাকে। আর যদি তাতে বিভ্রাট দেখা দেয়, তাহলে সর্বাঙ্গে সর্বনাশ হয়ে যায়। সেটিই হলো মানুষের অন্তরাত্মা। আর এখানেই প্রকৃত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। তাক্বওয়া না থাকলে ‘ইল্ম, ‘আমল কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা কেবল মুত্তাক্বী বান্দার কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করে থাকেন। আল-কুরআন ঐ শ্রেণির মানুষকে সত্য পথের সন্ধান দেবে। আর তাদের জন্যই নয়নাভিরাম জান্নাত। আসুন! আত্ম সমালোচনা করি। নীতি ও নৈতিকতাকে শাণিত করি। সত্যকে সত্য বলি। ন্যায়কে সমর্থন ও অন্যায়-অবিচারকে প্রত্যাখ্যান করতে শিখি। তবে-ই সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যাবতীয় মিথ্যা ও অন্যায় বিদূরিত হবে। দুনিয়ায় হবো আদর্শ মানুষ এবং আখিরাতে পরম সাফল্য লাভ করে হবো ধন্য। মহান আল্লাহই হিদায়েতের মালিক।
[সাপ্তাহিক আরাফাতঃ বর্ষ : ৬৪, সংখ্যা : ৩৩-৩৪]
আপনার মন্তব্য1