ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট। এ জেলাতেই অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘ষাটগম্বুজ মসজিদ’। বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে বাসস্টপেজ সংলগ্ন সুন্দরঘোনা গ্রামে আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ মসজিদটি। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে প্রতীয়মান হয়, সম্ববতঃ এটি খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন। ষাটগম্বুজ মসজিদের নিকটবর্তী দূরত্বে বেশ কয়েকটি প্রচীন ঐতিহ্যবাহী মসজিদ রয়েছে। এ জন্য বাগেরহাট জেলা ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত। পূর্ব-পশ্চিমে ২.৫ এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলো সিঙ্গাইর মসজিদ, বিবিবেগনী মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, রেজাখোদা মসজিদ, নয়গম্বুজ মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ প্রভৃতি।
সম্প্রতি মাননীয় জমঈয়ত সভাপতি অধ্যাপক শাইখ ড. আব্দুল্লাহ ফারুক বাগেরহাট জেলা জমঈয়তের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। অধিবেশন শেষে ঢাকা প্রত্যাবর্তনকালে তিনি ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদটি পরিদর্শন করেন। এ সময় আমি এবং কেন্দ্রীয় শুব্বানের দফরত সম্পাদক মুহাম্মদ হেদায়েতুল্লাহ তার সফরসঙ্গী ছিলাম। পরিদর্শনকালে মসজিদের পূর্বপ্রান্তের সাইনবোর্ড থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছি তা প্রদত্ত হলো-
মসজিদের নির্মাতা খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান, যিনি খান জাহান আলী নামে প্রসিদ্ধ। পনের শতকে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রাচীন আয়তকার মসজিদ। মসজিদ নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ হলো, পোড়ামাটির তৈরি টালি ইট, চুন-সুরকি, পাথর ও টেরাকোটা। মসজিদের বাহ্যিক পরিমাপ ৮৪.৮০ী৩২.৯৫ মিটার। দেয়ালের প্রশস্ততা ২.৭৪ মিটার। মসজিদের ভিতরে ৬০টি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলো জ্যামিতিক মাপে উত্তর-দক্ষিণে ৬ সারিতে বসানো হয়েছে এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলো পাথর কেটে মাপ মত তৈরি করা হয়েছে। সবগুলো স্তম্ভই পাথরের তৈরি। মাত্র ৫টি স্তম্ভের পাথর বাইরের দিকে ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।। গম্বুজ সংখ্যা ৭৭+৪=৮১টি; এর মধ্যে ৭০টি গোলাকার, ৭টি চারচালা এবং ৪টি কর্নার বুরুজ আকৃতির গম্বুজ। মেহরাব সংখ্যা ১০টি। খিলান দরজার সংখ্যা ১১+৭+৭= ২৫টি। কিবলার দেয়ালেও বিশেষ একটি দরজা রয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওয়েব সাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে ষাটগম্বুজ মসজিদটিতে ৮১ টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু। মসজিদ এলাকায় একটি জাদুঘর রয়েছে।
ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ বিশাল মসজিদের চতুর্দিকের প্রাচীর ৮ ফুট চওড়া, এর চার কোণে চারটি মিনার আছে। দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম রোশনাই কুঠির এবং এ মিনারে উপরে উঠার সিঁড়ি আছে। মসজিদটি ছোট ইট দিয়ে তৈরি, এর দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট, প্রস্থ ১০৮ ফুট, উচ্চতা ২২ ফুট। মসজিদের সম্মুখ দিকের মধ্যস্থলে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে। ইউনেস্কো এ মসজিদটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণ : অনেকেই মনে করেন যে, এই মসজিদে ৬০টি গম্বুজ রয়েছে, এজন্যই এর নামকরণ হয়েছে ষাটগম্বুজ মসজিদ। কিন্তু এই মসজিদে মোট ৮১টি গম্বুজ রয়েছে, তাই এ ধারণা প্রকৃত বাস্তবতার বিপরীত। তবে ছাদগম্বুজ মসজিদের নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সাত’ ও ফারসি শব্দ ‘ছাদ’-এর ওপর গম্বুজ থাকায় এটি ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে ‘ষাটগম্বুজ’ হয়েছে। আবার কারও মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে ১০টি করে মোট ষাটটি পাথরের স্তম্ভের ওপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে, এ জন্য এর নামকরণ হয়েছে ছাদগম্বুজ। কারও মতে, মসজিদটির ছাদ সমতল নয়, গম্বুজ আকৃতির। সেই থেকে মসজিদটি ‘ছাদগম্বুজ‘ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে ‘ছাদগম্বুজ’ কথ্যরূপে ‘ষাটগম্বুজ‘ নাম হয়েছে।
বন্ধ-খোলার সময়সূচি : গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর শুক্রবারে জুমুআর নামাযের জন্যে সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার সাধারণ ছুটি এবং সোমবার বেলা ২.০০টা থেকে বাগেরহাট জাদুঘর খোলা থাকে। এছাড়াও সরকারি কোন বিশেষ দিবসে বাগেরহাট জাদুঘর খোলা থাকে।
টিকিট প্রাপ্তিস্থান : বাগেরহাট জাদুঘরের গেটের ঠিক ডান পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। জনপ্রতি টিকিটের দাম ২০/- টাকা করে। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চার জন্যে টিকেট এর দরকার পড়ে না। যেকোনো বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে টিকিট মূল্য ২০০/- টাকা করে। [সরেজমিন প্রতিবেদন]
প্রচ্ছদ রচনা
আপনার মন্তব্য1