সতীদাহ প্রথা কী? স্বামীর শব বা মৃত দেহের সঙ্গে বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রাচীন হিন্দুদের ধর্মীয় প্রথাই হলো- সতীদাহ। সংস্কৃত ‘সতী‘ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে এমন সতীসাধ্বী রমণীকে বুঝায় যিনি তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত সততা প্রদর্শন করেন এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিও থাকেন সত্যনিষ্ঠ। সতীদাহ প্রথা মূলত দুই ধরনের : সহমরণ ও অনুমরণ। স্বামীর চিতায় অগ্নিদগ্ধ হওয়া ও মৃত্যুবরণ করার অর্থ সহমরণ। আবার কখনও কখনও পৃথকভাবে বিধবা স্ত্রীকে সতী করা হত- হয়তো দূরত্বের জন্য বা শারীরিক কোনও অসুস্থতার জন্য বা গর্ভবতী থাকার জন্য স্বামীর ব্যবহৃত কোনো বস্ত্র বা দ্রব্য নিয়ে আলাদা চিতায় অনুমরণের মাধ্যমে বিধবা স্ত্রীকে অগ্নিদগ্ধ করা হতো। কখনও কখনও উপপত্তদেরও এই জঘন্য প্রথার শামিল হতে হতো। এই প্রথা সব বর্ণ, বয়স, ধনী-দরিদ্র উভয় পরিবারেই প্রচলিত ছিল।[১]
সতীদাহের বীভৎসতা : এই প্রথা কীরকম নির্মম ও বীভৎস ছিল এবার তার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। সদ্যবিধবা নারী নববধূর মতো সাজে, তার শ্রেষ্ঠ পোশাক পরে, সিঁদুর, কাজল, ফুলমালা, চন্দন, আলতায় সুসজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে সে চিতায় ওঠে। তার স্বামীর পা দু’টি বুকে আঁকড়ে ধরে কিংবা মৃতদেহকে দুই বাহুতে আলিঙ্গন করে। এইভাবে যতক্ষণ না আগুন জ্বলে সে বিভ্রান্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে। যদি শেষ মুহূর্তে বিচলিত হয় এবং নীতিগত, দৃশ্যগতভাবে ছন্দপতন ঘটে তাই আগে থেকেই আফিং বা সিদ্ধি জাতীয় উত্তেজক কিছু খাইয়ে বিধবা নারীকে আচ্ছন্ন করে রাখা হতো অনেকসময় হাত-পা বেঁধে জোর করে স্বামীর চিতায় তুলে দেওয়া হতো। কাঁচা কাঠ জ্বালানো হত যাতে ধোঁয়া বেশি হয়। যখন আগুনের লেলিহান শিখা অসহনীয় হয়ে ওঠে, সিদ্ধির নেশা কেটে যায়, তখন যদি সেই বিধবা বিচলিত হয়ে পড়ে এবং পালানোর চেষ্টা করে তখন কাঠ বা বাঁশ দিয়ে বারে বারে তাকে আগুনের মধ্যে ঠেলে ঠেলে দেওয়া হতো। তার ক্রন্দন যাতে কেউ না শুনতে পারে তাই হই-হুল্লোড় করে শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসর, ঢোল বাজানো হতো।[২]
হিন্দু সমাজে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল। এক স্বামীর ১০, ১৫ বা ২০ জন স্ত্রী থাকতো। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর তাদের সকলকে নির্মমভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো।
হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থে সতীদাহ : হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সতীদাহ বা সহমরণের বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। যেমন- মহাভারত, রামায়ণ, স্মৃতিশাস্ত্র ইত্যাদি।
হিন্দুদের স্মৃতিশাস্ত্রে একাধিক স্থানে সতীদাহের কথা এসেছে। সহমরণে স্বামীসহ স্ত্রীকে ৩৩ কোটি বছর স্বর্গে যাওয়ার লোভ দেখানো হয়েছে।
সতীদাহের কথা আরও এসেছে- আর্য ধর্মশাস্ত্র পরাশর সংহিতায়, দক্ষ সংহিতায়, ব্যাস সংহিতায়, অত্রি সংহিতায়। বেদের ক্ষেত্রে ঋগ্বেদে সতীদাহের অনুমোদন কিংবা সুস্পষ্ট নিষিদ্ধতা দেখা যায় না। তবে ঋগ্বেদকে ব্যবহার করা হয়েছে ব্রাহ্মণ্য বাদীদের দ্বারা, সতী প্রথাকে জাস্টিফাই করার জন্য।[৩]
অথর্ব বেদে সতীদাহের আভাস রয়েছে, (অথর্ব বেদ- ১৮/৩/১-৩) পুরাণে সতীদাহ-ষ্ণুপুরাণ অনুসারে কৃষ্ণের ৮ স্ত্রী তার সাথে আগুনে প্রবেশ করে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের ৪র্থ স্কন্দে সতীদাহের প্রমাণ মেলে। পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডেও সহমরণ দেখা যায়। এছাড়াও দেবী ভাগবত পুরাণেও সতীদাহের, অপ্সরার কথা এসেছে।
বিধবারা স্বেচ্ছায় আগুনে ঝাঁপ দিতো নাকি জোর করা হতো? সাধারণত নারীদের জোরপূর্বক দাহ করা হতো আর কিছু নারী স্বেচ্ছায় তা বরণ করে নিত। নারীরা যাতে চিতা থেকে পালাতে না পারে সেজন্য ভারি বাঁশ দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। আর কিছু নারী স্বেচ্ছায় আগুনে ঝাঁপ দিতো। সেটা ছিল তাদের ধর্মীয় কারণে, স্বামীর সাথে স্বর্গে বাস করতে পারবে এমন বিশ্বাস থেকে-যেমনটা হিন্দু শাস্ত্রে লেখা রয়েছে।
সতীদাহ প্রথা সর্বপ্রথম কে বন্ধ করেন?
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কাছে সর্বাধিক পরিচিত যে, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করেন রাজা রামমোহন রায় (জন্ম : ২ মে ১৭৭২, মৃত্যু : ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩, বয়স ৬১) অথচ সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা বন্ধ করার সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন ভারতের শাসন মসনদে আরহণকারী মুসলিম শাসকগণ এবং তা পর্যায়ক্রমে হ্রাস ঘটাতে ঘটাতে সর্বশেষ বাদশাহ আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয়ভাবে তা বন্ধ করেন। কিন্তু কৌশলে এক তরফা অপপ্রচার এবং মুসলিমদের অবদান বিস্মৃত করা হয়।
হ্যাঁ, রাজা রামমোহন রায় যদিও কোনো অঞ্চলের শাসক ছিলেন না (দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন) কিন্তু বাঙ্গালী হিসেবে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদে তার ক্ষুরধার লিখনি, সমাজ সচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে বিশাল প্রচেষ্টা ও অসামান্য অবদান রয়েছে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ ভারতে ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক [lord william bentinck] আইন করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করলেন।
উল্লেখ্য যে, রামমোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন।[৪]
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে সতীদাহ : ইতিহাসের সুদীর্ঘ কাল ভারত বর্ষর মুসলিমগণ শাসন করেছেন। তারা হলেন, মুসলিম ঘুরি সালতানাত (মুহাম্মদ ঘুরি), মামলুক সালতানাত (কুতুবউদ্দিন আইবেক), খিলজি সালতানাত (আলাউদ্দিন খিলজি), লোদী সালতানাত, মোঘল বাদশাহি, বাংলা অঞ্চলের ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী।
প্রায় হাজার বছরের মুসলিম শাসনামলে সতীদাহের গতিপথ কীরকম ছিল -তা জানাতে আমরা একাধিক ঐতিহাসিকের বর্ণনা উল্লেখ করছি।
ক. ইবনু বতুতার বর্ণনা (১৩২৫-১৩৫৪) : বিখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনু বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, সুলতানি শাসনামলে সুলতানরা গভর্নর নিয়োগ দিতেন, যাতে জোরপূর্বক সতীদাহ না হয়। নারীর ইচ্ছা এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সতীদাহ সম্ভব ছিল না সে সময়।
খ. দে থেভেনতের বর্ণনা (১৬৬৩-১৬৬৭) : De Thevenot একজন ইয়োরোপীয় ভ্রমণকারী ছিলেন। তার এবং ড. ক্যারেরির ভ্রমণকাহিনী উঠে এসেছে Indian Travels of Thevenot and Careri বইতে। আমরা সেখান থেকেই দেখাচ্ছি। তিনি বিধবা পোড়ানোর বিভিন্ন বর্ণনার পর সারাংশ হিসেবে যা লিখেছেন, তা হলো- “মহিলারা খুশি যে মুসলিমরা (মুহাম্মদিয়/মাহোমেটানস্) ইন্ডিয়ার শাসক হয়েছে, তাদের ব্রাহ্মণদের অত্যাচার থেকে উদ্ধার করার জন্য যাইহোক, গ্রেট মুঘল এবং অন্যান্য মুসলিম রাজকুমারগণ, তাদের গভর্নরদের এই প্রথা দমন করার জন্য তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করার আদেশ দিয়েছিলেন, যতটা তাদের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে...।
তার সময় মুঘল শাসকগণ ব্যবস্থা করেছিলেন যে, সতীদাহের জন্য তাদের থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর এই অনুমতি নেওয়ার জটিলতার কারণেই অনেক নারী জীবন্ত আগুন থেকে রক্ষা পেতো, সাথে সাথে গোত্রের সম্মানহানি থেকেও। তিনি আরও বলেছেন, “যখন থেকে মুসলিমরা ইন্ডিয়ার শাসক হলো, তারা এই অমানুবিকতাকে মেনে নেয়নি, যেটা ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থে করতো...।
গ. উইলিয়াম ফৌস্টারের সংকলিত বর্ণনা (১৫৮৩-১৬২৯) : ফৌস্টার তার ‘Early Travels in India’-তে এডওয়ার্ড টেরির (১৬১৬-১৬১৯) বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, “সম্রাট জাহাঙ্গীর হিন্দু বিধবাদের আর্থিক সাহায্য করতেন যাতে মৃত স্বামীর চিতায় শুয়ে আত্মহত্যা না করে।”
আকবরনামায় আবূ ফজলের বর্ণনা : “সম্রাট আকবরকে নিয়ে বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আকবরনামা’-তে আবূ ফজল বর্ণনা করেছেন, সব শহর ও জেলায় সম্রাট আকবর লোক নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাতে জোর করে নারীদের না পোড়ানো হয়।
ঘ. ভিনসেন্ট স্মিথের কোটেশন : ভিনসেন্ট স্মিথ তার ‘Akbar The Great Mughal’ বইতে আকবর নামায় বর্ণিত ঘটনা কোট করেছেন। সম্রাট আকবর নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহমরণ প্রথা রদ করে দিয়েছিলেন। তার অনুমতি ছাড়া সতীদাহ অসম্ভব ছিল।
ঙ. ট্রাভের্নিয়ারের বর্ণনা : ট্রাভের্নিয়ার উল্লেখ করেছেন, মুসলিম গভর্নররা সহজে সতীদাহের অনুমতি দিতো না।
সতীদাহ প্রথা রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পূর্ণ বিলোপ করেন কে?
সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণভাবে প্রথম বিলোপ করেন সম্রাট আওরঙ্গজেব (মৃত্যু : ৩ মার্চ ১৭০৭)।
উইলিয়াম মুরক্রফট এবং জর্জ ট্রেবেকের বর্ণনা : সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেন, জোর করে হোক, আর স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা হোক।[৫]
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানকালের অনেক হিন্দু পণ্ডিতও সতীদাহের সমর্থক। যেমন- শঙ্করাচার্য, স্বামী বিবেকানন্দও প্রমুখ।
আল-হামদুলিল্লাহ- সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন এবং দুনিয়ার আগুন থকে রক্ষা করেছে। আর তার প্রতি ঈমান আনায়নের পর তার নির্দেশিত পথে পরিচালিত হলে তিনি আমাদেরকে পরকালের জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় তিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়।
[১] সূত্র : ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য-পরিমার্জত।
[২] সূত্র : ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য-পরিমার্জিত।
[৩] ঋগ্বেদ- ১০/১৮/৭।
[৪] উইকিপিডিয়া।
[৫] Travels in the Himalayan Provinces of Hindustan and the Panjab: In …, Volume 2 By William Moorcroft, George Trebeck, page 131।
আপনার মন্তব্য1