সাময়িক প্রসঙ্গ
সালাতুয্ যাওয়াল কি সুন্নাহ সম্মত?
আরাফাত ডেস্ক

এ কথা অনস্বীকার্য যে, সালাতুয যাওয়াল তথা সূর্য ঢলার সালাত নামে কোন সালাতের অস্তিত্ব আছে এ বিষয়টি অধিকাংশ মানুষের কাছে অপরিচিত। অথচ রাসূল সা. সূর্য ঠিক মাথা বরাবর থেকে পশ্চিম দিগন্তে একটু ঢলে গেলে নিয়মিতভাবে চার রাকআত সালাত আদায় করতেন। এ সময় আসমানের দরজাগুলো খোলা হয় এবং বান্দাদের ‘আমলগুলো উপরে উত্তোলন করা হয়।
হাদীসের কিতাবগুলোতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে আর মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিম্নে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হলো-
১ম হাদীস :
عَنْ أَبِيْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِيْ (رَضِيَ اللهُ عَنهُ) : أُنَّ النَّبِيَ ﷺ كاَنَ يُدْمِنُ أَرْبَعُ رَكْعَاتٍ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ فَقُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّكَ تُدْمِنُ هَذِهِ الأْرْبَعَ رَكَعَاتٍ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ؟ فَقَالَ إِنَّ أَبْوَابِ السَّمَاءِ تُفْتَحُ عِنْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ فَلَا تُرَتِّجُ حَتّٰى يُصَلِّى الظُّهْرَ فَأُحِبُّ أَنْ يَّصْعَدَ لِيْ فِيْ تِلْكَ السَّاعَةِ خَيْرٌ قُلْتُ : أَفِيْ كُلِّهِنَّ قِرَاءَةٌ؟ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ : هَلْ فِيْهِنَّ تَسْلِيْمٌ فَاصِلٌ؟ قَالَ لَا.
আবূ আইয়্যূব আনসারী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) প্রতিনিয়ত সূর্য ঢলার সময় চার রাকআত নামায পড়তেন। একদা আমি বললাম : ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি সূর্য ঢলার সময় এই চার রাকআত প্রতিনিয়তই পড়ছেন?’ তিনি বললেন : “সূর্য ঢলার সময় আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং যোহরের নামায না পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। অতএব আমি পছন্দ করি যে, এই সময় আমার নেক ‘আমল (আকাশে মহান আল্লাহর নিকট) উত্তোলন করা হোক।” আমি বললাম : ‘এ সালাতের প্রত্যেক রাকআতেই কি কিরাআত আছে?’ তিনি বললেন : “হ্যাঁ।” আমি বললাম : ‘তার মাঝে কি পৃথককারী সালাম আছে?’ তিনি বললেন : “না।”[১]
২য় হাদীস :
عَن عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ كَانَ يُصَلِّيْ أَرْبَعًا بَعْدَ أَنْ تَزُوْلَ الشَّمْسُ قَبْلَ الظُّهْرِ وَقَالَ إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيْهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ فَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِيْ فِيْهَا عَمَلٌ صَالِحٌ. (رواه التِّرمِذِيُّ وَقَالَ حَدِيْثٌ حَسَنٌ)
‘আব্দুল্লাহ ইবনুস্ সায়েব রাযি. হতে বর্ণিত, সূর্য (পশ্চিম দিগন্তে) ঢলে যাবার পর, যোহরের র্ফযের পূর্বে নবী (সা.) চার রাকআত সালাত পড়তেন। আর বলতেন, “এটা এমন সময়, যখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তাই আমার পছন্দ যে, সে সময়েই আমার সৎকর্ম ঊর্ধ্বে উঠুক।”[২]
৩য় হাদীস :
عَن أَبِى أَيُّوبَ عَن النَّبِىِّ ﷺ قَالَ أَرْبَعٌ قَبْلَ الظُّهْرِ لَيْسَ فِيْهِنَّ تَسْلِيْمٌ تُفْتَحُ لَهُنَّ أَبْوَابُ السَّمَاءِ.
আবূ আইয়্যূব রাযি. হতে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, “যোহরের পূর্বে চার রাকআত-যার মাঝে কোনো সালাম নেই-তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।”[৩]
৪র্থ হাদীস :
أنهُ كان يُصلِّي أربعَ ركعاتٍ بعدَ الزوالِ لا يُسلِّمُ إلا في آخرِهنَّ.
নবী সা. সূর্য ঢলার পর চার রাকআত পড়তেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চার রাকআত শেষ করার পূর্বে সালাম ফেরাতেন না।"[৪]
উপরোক্ত হাদীসসমূহ থেকে স্পষ্ট যে, এ চার রাকআত সালাতে দু’রাকআত পড়ে সালাম ফেরানো যাবে না; বরং চার রাকআত শেষ করে সালাম ফিরাতে হবে।
৫ম হাদীস : রাসূল সা. বলেন,
أربعُ ركعاتٍ قبلَ الظهرِ يعْدِلْنَ بصلاةِ السَّحَرِ.
“যোহরের পূর্বে চার রাকআত সালাত ভোররাতের সালাত (তাহাজ্জুদ) সমতুল্য।”[৫]
এই চার রাকআত কোন সালাত?
এখন এই চার রাকআত কোন সালাত? এগুলো কি যোহরের পূর্বের চার রাকআত সুন্নতে রাতেবা (নিয়মিত সুন্নাত) না কি তা স্বতন্ত্র সালাত? এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমগণের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কতিপয় আলেম বলেন, এই চার রাকআত মূলতঃ যোহরের চার রাকআত সুন্নত সালাত আর কতিপয় বিদ্বানের মতে, এটি যোহরের পূর্বের চার রাকআত সুন্নত নয়; বরং এটি স্বতন্ত্র সালাত। নিম্নে এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের কয়েকটি অভিমত তুলে ধরা হলো- ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ্. বলেন :
قَدْ يُقَالُ : إِنَّ هَذِهِ الْأَرْبَعَ لَمْ تَكُنْ سُنَّةَ الظُّهْرِ، بَلْ هِيَ صَلَاةٌ مُسْتَقِلَّةٌ كَانَ يُصَلِّيْهَا بَعْدَ الزَّوَالِ.
“এটাও বলা যেতে পারে যে, এই চার রাকআত যোহরের সুন্নত নয়; বরং তা আলাদা সালাত। যা তিনি যাওয়াল তথা সূর্য আকাশের মধ্যভাগ থেকে পশ্চিম দিগন্তে ঢলে যাওয়ার পর আদায় করতেন।”[৬] এছাড়াও তিনি এটিকে স্বতন্ত্র ‘আমল বলার পেছনে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সকল প্রকার সুন্নত সালাত দু’রাকআত দু’রাকআত করে পড়া উত্তম। যেমন- নবী সা. বলেন :
্রصَلَاةُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ مَثْنَى مَثْنَىগ্ধ.
“দিন ও রাতের নামায দুই দুই রাকআত।”[৭]
অর্থাৎ- রাত ও দিনের সকল সালাত (ফরয ও বিতর ছাড়া) দু’রাকআত করে পড়াই উত্তম। অথচ এখানে চার রাকআত পড়ার হাদীসগুলোতে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, এই চার রাকআত পড়ার সময় কেবল শেষে একবারই সালাম ফেরাতে হবে। মাঝখানে দু’রাকআত পড়ে সালাম ফেরানো যাবে না। তাতে বুঝা যায়, এটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ‘আমল। তার কারণ হলো, এটি দিনের মধ্যভাগ ও সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলার সময়।[৮] এরপর তিনি আরও বলেন :
هذه الأربع صلاة مستقلة كان يصليها بعد الزوال، وورد مستقل سببه انتصاف النهار وزوال الشمس، وسر هذا ـ وَاللهُ أَعْلَمُ- أَنَّ انْتِصَافَ النَّهَارِ مُقَابِلٌ لِانْتِصَافِ اللَّيْلِ، وَأَبْوَابُ السَّمَاءِ تُفَتَّحُ بَعْدَ زَوَالِ الشَّمْسِ، وَيَحْصُلُ النُّزُولُ الْإِلَهِيُّ بَعْدَ انْتِصَافِ اللَّيْلِ، فَهُمَا وَقْتَا قُرْبٍ وَرَحْمَةٍ، هَذَا تُفْتَحُ فِيْهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَهَذَا يَنْزِلُ فِيْهِ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا. انتهى
“এই চার রাকআত স্বতন্ত্র সালাত যা তিনি সূর্য ঢলার পর পড়তেন। আর এই স্বতন্ত্র ‘আমলটি করার পেছনে কারণ হলো, এটি দিনের ঠিক মধ্যভাগ ও সূর্য ঢলার সময়। এর রহস্য হলো- আল্লাহ ভালো জানেন- এটি দিনের মধ্যভাগ যার অবস্থান রাতের ঠিক মধ্যভাগের বিপরীতে। দিনের মধ্যভাগে সূর্য ঢলার পর আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় আর রাতের মধ্যভাগের পর মহান আল্লাহর অবতরণ ঘটে। সুতরাং এ দু’টি আল্লাহর নৈকট্য ও রহমতের সময়। দিনের মধ্যভাগে আসমানের দরজাগুলো উন্মুক্ত হয় আর রাতের মধ্যভাগে মহান রব দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন।”[৯] আল্লামা মুবারকপূরী তার বিখ্যাত ‘আল মিরআতুল মাফাতিহ শারহু মিশকাতিল মাসাবীহ’ গ্রন্থে বলেন :
هذه سنة الزوال، وهي غير سنة الظهر.
“এটি যাওয়াল বা সূর্য ঢলার সুন্নত। এটি যোহরের সুন্নত থেকে ভিন্ন।”[১০] মুনাবী বলেন : “যোহরের পূর্ব চার রাকআত সালাত-যার মাঝে কোনো সালাম নেই। এ সময় আসমানের দ্বারসমূহ খোলা হয়। এই চার রাকআতকে বলা হয় যাওয়ালের সুন্নত। এটি যোহরের সুন্নত নয়। যেমনটি গাযযালী রহ্. তাঁর এহিয়া উলূমিদ্দীন গ্রন্থে স্পষ্টভাবেই বলেছেন।”[১১] অবশ্য একদল আলেম বলেন যে, এই চার রাকআত যোহরের পূর্বের চার রাকআত; আলাদা কোনও সালাত নয়। যেমনটি মুনাবী রহ্. পূর্বোক্ত সায়েব ইবনু ইয়াযিদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ মতের পক্ষে বায়যাবী *’র অভিমত উল্লেখ করেছেন।
যাহোক, পূর্বোক্ত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা ও বিজ্ঞ আলেমের মতামত ও ব্যাখ্যার আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, এই চার রাকআত স্বতন্ত্র সালাত (যাওয়ালের সালাত) যা নবী সা. নিয়মিত পড়তেন। কারণ, তিনি চাইতেন, এ সময় যেহেতু আসমানের দরজা খোলা হয় সেহেতু এ সময় আল্লাহর নিকট তাঁর নেক ‘আমল উত্থাপিত হোক। অর্থাৎ- আল্লাহর নিকট এই ‘আমলটি দ্রুত কবুলের আশা করা যায়।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকেও এই ‘আমলটি করার তাওফীক্ব দান করুন -আমীন, আল্লাহু আ’লাম।


[১] শাইখ আলবানী রচিত মুখতাসারুশ্ শামাইলিল মুহাম্মাদিয়াহ, হা. ২৪৯, তিনি এটিকে সহিহ বলেছেন।
[২] আত্ তিরমিযী- হা. ৪৭৮, হাসান; সহীহুত্ তারগীব- হা. ৫৮৭।
[৩] সুনান আবূ দাঊদ- হা. ১২৭০; সুনান ইবনু মাজাহ্- হা. ১১৫৭; ইবনু খুযাইমাহ্- হা. ১২১৪, সহীহুল জামে’- হা. ৮৮৫।
[৪] সিলসিলা সহীহাহ্- ৭/১১৯৭, শাইখ আলবানী বলেন, এর সনদ সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী جيد (ভালো)। এছাড়াও তিনি তাখরীজু মিশকাতিল মাসাবিহ গ্রন্থে এটিকে সহীহ বলেছেন। হা. ১২২৬।
[৫] সহীহুল জামে‘- হা. ৮৮২।
[৬] যাদুল মা‘আদ- ১/২৯৮, ২৯৯।
[৭] আবূ দাঊদ- ই. ফা. বাং, অধ্যায় : ২. সালাত, হা. ১২৯৫; আত্ তিরমিযী; আন্ নাসায়ী; সুনান ইবনু মাজাহ্ প্রমুখ সনদ সহীহ।
[৮] যাদুল মা‘আদ থেকে ভাবার্থ।
[৯] যাদুল মা‘আদ- মাকতাবাতুশ্ শামেলা, ১/৩০০।
[১০] মিরআতুল মাফাতীহ।
[১১] ফায়যুল ক্বাদির।


আপনার মন্তব্য1

ঢাকায় সূর্যোদয় : 5:43:02 সূর্যাস্ত : 6:09:54

সাপ্তাহিক আরাফাতকে অনুসরণ করুন

@সাপ্তাহিক আরাফাত