সমাজচিন্তা
আত্মগঠন
মুহাম্মদ আব্দুল হাই
আমাদের বোধশক্তি যখন সচেতন হবে, চিন্তার পরিধি বেড়ে যাবে তখন সময়কে বুঝা সহজ হবে। এটা আমাদের মন, মস্তিষ্কে সচেতনভাবে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমাদের জীবনে সময়ের গুরুত্ব কতটুকু আর সেভাবে আমরা কাজ করতে পারছি কিনা, তা বুঝার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের কাছে জীবন যতটা গুরুত্ববহ, সময়কে মূল্যায়ন করে অর্থবহ কাজ করার মধ্যে তার প্রতিফলন স্পষ্ট হবে। কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অসংখ্য দিক নির্দেশনা বর্ণিত আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার চেষ্টা করবো -ইন্শা-আল্লাহ।
Quran on time & lifeকুরআনে উল্লেখিত সময় ও জীবন
মানুষের জীবনের এই ক্ষুদ্র পরিসরকে যদি যর্থাথভাবে মূল্যায়ণ করা যায়, তবে সভ্যতার অভূতপূর্ব বিকাশ অনিবার্য। বর্তমান সময়ে তা আরো বেশি অর্থবহ। আজ বিজ্ঞান সময়ের ন্যানো সেকেন্ডের হিসাবে চলে। দ্রুতগামী ট্রেন, বিমানের সাহায্যে ধারণাতীত কম সময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যায়। সামান্য একটা ক্ষুদ্র ‘এটম বোমের’ দ্বারা মূহুর্তেই কোনো নগরী, শহর ধ্বংস করা হচ্ছে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে একটা দেশ মৃত্যুপুরুতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে সময়ের হিসাব খুব দ্রুত হচ্ছে। আর এই সময় মানুষের জীবনের নানামুখি চাহিদাও বাড়ছে প্রতিক্ষণেই। তাই আমাদের জীবনে সময় কতটা মূল্যবান এ থেকেই অনুমেয়।
আমরা যদি সময়কে মূল্যায়ণ না করি, তবে সমূহ ক্ষতির মধ্যে পড়বো। যার শুরু হবে শৈশব কাল থেকে। এরপর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে। ছাত্র জীবনে অবহেলা জীবনের অন্য ধাপগুলোতে পরবে। ফলাফল হবে খারাপ। এরপর তার জন্য ভালো কর্মের অভাব, ফলে সংসারে টানাপোড়েন, শেষ পরিণতি অশান্তি নিত্য সঙ্গি, এভাবে চক্রাকারে জীবনের এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে। এক সমস্যা থেকে নতুন সমস্যার তৈরী। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু তা উদাহরণ হিসাবে রাখতে চাই না।
তাই এই সময়কে মূল্যায়ণ করার অর্থ হলো কল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে জীবনকে স্বার্থক করে তোলা। তবে যদি আমরা আমাদের জীবনের অর্থ বুঝি তখন তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে।
আর এই অর্থ বোঝাটা হলো আমার জীবনের এই মহামূল্যবান সময়কে; কি কি কাজে ব্যবহার করলাম তার হিসাব রাখা। যদি তা না রাখি তবে আমিও ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হবো। আমি মানুষ হিসাবে জন্ম লাভ করলাম, পরিবারে বড় হলাম, তারপর নিজের পরিবার হলো, এক সময় বৃদ্ধ হলাম, মারা গেলাম, জীবনের পরিসমাপ্তি হলো। এটাই কি আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য? নাকি আরো কোনো মহৎ চিন্তার, মহৎ কর্মের, মহৎ সৃজনশীলতার জন্য আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? যা পৃথিবীকে আরো বেশি সুন্দর করার নিয়ামক। আর এর বিপরিত যদি হয় তবে তো তা অনান্য সৃষ্টি, গরু, ছাগল, গাধা, ঘোড়া হাতি তাদের জীবনের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। কারণ খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন নয়। জীবনের প্রকৃত অর্থ হবে স্রষ্টা কর্তৃক হুকুমগুলো যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা। যেহেতু স্রষ্টা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তাই তার ‘ইবাদতের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করা। আর এই ‘ইবাদত জীবনের প্রতিটি মূহুর্তেই আদায় করা সম্ভব যদি সেখানে আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশনার অনুসরণ থাকে।
এই নির্দেশনা মানুষের ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সকল কাজের মধ্যে সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়। শুধু আমরা সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো। ঘুম থেকে উঠার দু‘আ, যেকোনো কাজের শুরুতে বিস্মিল্লা-হ বলে শুরু করা, প্রয়োজনীয় স্থানে দু‘আ-ইস্তিগফার পাঠ, সামাজিক মুয়ামেলাতের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকা, সময়ের কাজগুলো সময় মতোই সম্পন্ন করা; এটাই সময়ের যথার্থ মূল্যায়ণ। যদিও বিষয়গুলো খুব সাধারণ ও সহজ বলে মনে হয়। কিন্তু নিয়মিত ও সঠিক সময়ে সঠিক স্থলে নিয়মানুযায়ী পালন করা কিন্তু খুব একটা সহজ নয়। তবে যারা অনুশীলন অব্যাহত রাখে এ ক্ষেত্রে তারাই সফলকাম।
আর এটাও মনে রাখতে হবে যে, এ হুকুম আমার মহান রবের পক্ষ থেকেও নির্ধারিত। এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও আমরা নির্ধারিত সময়ে আদায় করি। সে হিসাবে বলা যায় একজন মুসলিম মুয়াজ্জিন সময় সম্পর্কে যতেষ্ট সচেতন ব্যক্তি। কারণ সে নামাযের জন্য আহ্বান নির্ধারিত সময়েই সম্পন্ন করে।
এজন্য মৃত্যু নামক এক অনিবার্য বাস্তবতার মুখোমুখি হবার আগেই আমাদেরকে সর্তক হতে হবে। জীবনকে কী কী কাজে ব্যবহার করেছি, কতটা অর্থবহ করেছি তাই এখানে বিচার করতে হবে। কেননা মৃত্যু একবার গ্রাস করলে বাড়তি কোনো সময় পাওয়া যাবে না। যেহেতু মুসলিম মাত্রই বিশ্বাস করে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জীবনের পরিসমাপ্তি নয়; বরং দুনিয়ার জীবনে আমি কতটা অন্যায় করেছিলাম, ভালো করেছিলাম তার প্রতিফল না পেয়েই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি হবে, এটা একটা অবান্তর চিন্তা। আর এটা কুরআনে স্পষ্ট করা হয়েছে-
﴿يَا لَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ مَا أَغْنَى عَنِّيْ مَالِيَهْ هَلَكَ عَنِّيْ سُلْطَانِيَهْ﴾
“হায়, আমার মৃত্যুই যদি শেষ হত। আমার ধন-সম্পদ কোনো উপকারে আসলো না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেলো।”[১]
আর সময়কে জানার, উপলব্ধি করার সবচেয়ে বড় নির্দেশনা এসেছে সূরা আল ‘আস্র-এ। সেখানে যুগের/চলমান সময়ের কসম করে বলা হয়েছে, যদি না মানুষ সময়কে মূল্যায়ণ করে, তবে সে ক্ষতির মধ্যে পড়বে। কোনো কোনো মানুষ ক্ষতির মধ্যে; কেনো মানুষ ক্ষতির মধ্যে এটাও বলা হয়েছে সেখানে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
﴿وَالْعَصْرِ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ إِلَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ﴾
“কালের/সময়ের শপথ। মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎ ‘আমল করে পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়, ধৈর্যধারণে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে।”[২]
এ ক্ষতির বিষয়টি একালে সে ভাবে প্রকাশ না পেলেও ক্বিয়ামত দিবসে অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ তার জীবনের চলার পথে কীভাবে অর্থ ব্যয় করেছে, কিভাবে অর্থ উপার্জন করেছে, কার প্রতি কতটা যুল্ম করেছে, অন্যায় অবিচারের মাধ্যমে কি কি দুনিয়াবি ফায়দা লুটেছে, সে সম্পর্কে অবশ্যই তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। সে যদি এই উত্তরগুলো সঠিকভাবে না দিতে পারে, দুনিয়াতে এগুলোর সঠিক হিসাব না রাখে তবে সে ধরা খাবে। এজন্য আমাদের কে সময় থাকতেই ভালো হতে হবে।
পাশাপাশি অন্যকেও হক্বের পথে থাকার সৎ উপদেশ এবং যেকোনো বিপদাপদে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে।
কারণ ক্বিয়ামত দিবসের অনিঃশেষ সময় যখন তারা নিজেরাই দেখতে পাবে, তখন বুঝতে পারবে তারা কিভাবে সময়ের অবমূল্যায়ণ করেছে। আর তখন তাদের আর কিছুই করার থাকবে না। তাই, অন্তত ভালো কাজ যতটুকুই পারিনা কেনো, খারাপ কাজগুলো থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ দুনিয়ার মানুষের জীবনে জয়-পরাজয়, লাভ লোকসান এবং সত্যিকার অর্থে সফলকাম হবার দিক-নির্দেশনা এই সময়ের মূল্যায়ণের উপরই দেয়া হয়েছে।[৩]
এটা একই সাথে মানুষের জীবনের মূল্যায়ণও বটে। ঈমানের সাথে সঠিক কাজ করে জীবনকে অর্থবহ করাই হলো আসল উদ্দেশ্য। যার মধ্যে থাকবে সৎ কর্মের অনুপ্রেরণা, সত্য তথা কল্যাণকর পথে চলার, সেই পথে চলতে গিয়ে বাধা বিঘœ এলে অসীম ধৈর্যধারণের। আর এটা অবশ্যই মৃত্যু আসার আগেই সম্পন্ন করতে হবে। যেহেতু আমরা জানি, মৃত্যু এলে কৈফিয়ত দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই সময়কে এখনই মূল্যায়ণ করতে হবে। সংক্ষিপ্ত সময়ের এই জীবনকে অনন্ত কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। [চলবে...]
টীকা :
[১] সূরা আল হা-ক্বক্বাহ্ ৬৯ : ২৭-২৯।[২] সূরা আল ‘আস্র ১০৩ : ১-৩।
[৩] আম্মাপারার তরজমা ও ভাষ্য- আল্লামা আবু মুহাম্মদ আলীমুদ্দীন নদীয়াভী (রহ.), সূরা আল ‘আস্র-এর তাফসীর, পৃ. ২৫৩।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য1